নয়নতারা পর্ব ২০

0
494

#নয়নতারা
পর্ব ২০
Suvhan Årag (ছদ্মনাম)
Suvhan Arag’s Storys

“হে আল্লাহ,তুমি পরম করুণাময়,রহমানুর রহিম।আমি জীবনের এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছি।না পারছি অতীত ভুলতে না সামনে এগিয়ে যেতে।আমার চিন্তা নিজেকে নিয়ে নয়।আমার বাবা মাকে নিয়ে।অনেক কষ্ট করেছেন তারা আমার জন্য।তুমি আমার সহায় হও রহমানুর রহিম।সঠিক পথ দেখাও।সাহায্য কর আমাকে।রাব্বীর হাম হুমা কামা রাবাইয়ানী সগীরা।আমিন।”

দু হাতের তালু দিয়ে পুরো মুখমণ্ডলে ঘষে নিয়ে মোনাজাত শেষ করলো নাফিজ।জায়নামাজ উঠিয়ে নিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে জানালা খুলে দিল।

সকালের স্নিগ্ধ বাতাসে চোখ বুজে মন ভরে শ্বাস নিল নাফিজ।সচারচর তার সকালে ওঠা হয়না।নামাজ আদায় করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে সে।আজ যেন তার আর বিছানায় যেতে মন চাইছে না।

—-উহ,হিমশীতল।বড়ই হিমশীতল আবহাওয়া।যাই একটু ঘুরে আসি।ইউনিটে যাওয়ার এখনো দেড় ঘন্টা দেরী আছে।

কালো রঙের ট্রাউজার,গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে ফোনটা পকেটে নিয়ে নাফিজ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

—-কি রে এতো সকালে কোথায় যাচ্ছিস?

লতিফার কথায় দাড়িয়ে গেল নাফিজ।

—-মা তুমি উঠে পড়েছো?
—-হ্যাঁ।তুই বের হবি।রান্না করতে হবে না।
—-ওহ।
—-কোথায় যাচ্ছিস?
—-একটু হাঁটাহাটি করতে।এই জায়গা টা বেশ লেগেছে আমার।অনেক সুন্দর।অতোটা কোলাহল নেই।
—-আচ্ছা।তাড়াতাড়ি আসিস।
—-আচ্ছা।
—-তুই কি সাইকেল নিয়ে যাচ্ছিস নাকি?
—-হ্যাঁ মা।তাহলে দেরী হলে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারব।
—-আচ্ছা যা।ফি আমানিল্লাহ।

সাইকেলের চাবি নিয়ে গ্যারেজ থেকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নাফিজ।কিন্তু কোথায় যাবে সে?এটাই ভেবে পারছে না।

—-কোথায় যাব?এখানে তো অনেক জায়গা আছে।

নয়নতারা বাগানের কথা মনে পড়তেই নাফিজের মুখে হাসি ফুটলো।

—-হ্যাঁ সেখানেই যাব।ফুল গুলো যে আমাকে বড্ড টানছে কাল থেকে।কিন্তু কেন?

নাফিজ আর না ভেবে রওনা দিল।

;;;;;

“হাই সারি রিন্নামা দুকরুক সুয়ে রেন্নামা থাংসিরুরু জাজং নাম্মা নংমাওয়ান্না লেংয়ান্ন”
(অর্থ:আসো বন্ধুরা আজ সবাই খেলতে যাই,আজকে চাঁদ টা অনেক সুন্দর)

“এই এক খ্যাপ, এই দুই খ্যাপ,
এই তিন খ্যাপ,এই পাঁচ খ্যাপ,
উউরি বাববাহ,,,”

—-গাসু তোর পায়ে পড়ি বোইন চুপ কর।

গাসু লাফানো থামিয়ে তারার দিকে তাকালো।

—-আফা কি হইচ্চে?
—-এগুলো কি বলছো তুমি?আমার মাথার তার গুলো কি সব ছিড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছো?
—-ছ্যা ছ্যা,তারা আফা।কি বললেন আপ হে?আই গাসুয়া সিমসাং আপনের মাথার তার ছিড়ুম।ন কখনো।
—-এই দেখো আবার শুরু।তুমি যে কোন ভাষা থেকে কোন ভাষায় চলে যাও আমি কিছু বুঝিনা।আচ্ছা বাদ দেও।এতো লাফাচ্ছো কেন তুমি?
—-আরে আফা আমি তো পাইএইসজিকাল সাইজ করতেছি?
—-কিহ!সেটা আবার কি?
—-আরে আফা আপনে ও দেখি ইংলিশ ফিনিশ বোঝেন না।এর মানে ব্যায়াম।
—-ওহ আল্লাহ।ওটা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ।
—-ঐ হইলো।
—-আচ্ছা মা কি উঠেছে?
—-না আফা।ম্যাডাম তো নামাজ পইড়া ঘুমাইছে।
—-তাহলে আর কে ঠেকায় আমাদের?

গাসু আর তারা দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসি দিল।

;;;;;

—-ও বাবাই, বাবাই আমাকে একটু ভাত খেতে দেও না।খুব খিদে পেয়েছে বাবাই?

প্রতিদিনের মতো আজ ও সকালে উঠেই মিষ্টির শেষ কথা গুলো মনে পড়তেই বুকটা ছ্যাত করে উঠলো ফজলে শেখের।চোখের কোন দিয়ে আনমনেই পানি গড়িয়ে পড়লো।

—-আপনার চা।

তানিয়ার কথায় পেছনে ঘুরে তাকালো ফজলে শেখ।

—-তোর হাতের জিনিস খেতে আমার ঘেন্না লাগে।মরতে পারিস না তুই।

ফজলে শেখের কথা শুনে অন্যদিনের মতো আজও তানিয়ার বুক ফেটে কান্না আসছে।চোখের কোনে পানি টলটল করছে।

—-আপনি সব সময় এই এক কথা কেন বলেন?
—-কথা শুনতে যখন পারিস না দূর হতে পারিস না।এখনো কেনো আমার বাড়িতে পড়ে আছিস?
—-কোথায় যাব আমি?বাপের বাড়ি গেলে ভাই ভাই বউ দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়।বোনের বাড়ি গেলে এক অবস্থা।আরো বোনের বাচ্চা হবে।অপয়া অলক্ষী বলে ঝাটা লাথি দেয় সবাই।কোথায় যাব বলতে পারেন?
—-অপয়া বলবে না তো কি তোকে মাথায় তুলে নাচবে।তিন বার বাচ্চা জন্ম দিলি সব মরা বাচ্চা।পাঁচ বার তো জন্মানোর আগেই বাচ্চা খেয়ে নিয়েছিস।তোকে কে ঠাঁই দেবে?

আঁচলে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠলো তানিয়া।

—-আমার মিষ্টি কোথায় আল্লাহ জানে।কি অবস্থায় আছে?তোর জন্য আমার মেয়েটাকে আমিও দূর দূর করেছি।এখন দেখ।দেখ নিজের অবস্থা।আজ সন্তান থাকতেও নিঃসন্তান হয়ে রয়েছি আমি।মা মরার আগেও ঠিক ই বলেছিল ঐ বাচ্চা মেয়েটার চোখের পানির এক ফোঁটাও বৃথা যাবে না।আমার মিষ্টি মা কোথায় আছে?বেচে আছে নাকি,,,,কিছু জানিনা আমি।

পানজাবির হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছলেন ফজলে শেখ।

;;;;;

ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে তানহা।ইউনিফর্ম পড়া অবস্থায় আরো চোখে কালো সানগ্লাস পড়া।নাফিজের হ্যান্ডসাম লুকটা যেন আরো বেশি ফুটে উঠেছে।

এই নিয়ে কতোবার যে নাফিজের ফেসবুক আইডি তানহা ঘেঁটেছে তার হিসেব নেই।রোজ সকালে একবার করে ঘেঁটে দেখা, ঘুমানোর আগে একবার ,কাজের ফাঁকে কখনো বা নাফিজের কেবিনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একটু উঁকি দেওয়া তানহার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

—-তানহা আপু,তানহা আপু।

মানহার ডাক শুনে তাড়াতাড়ি ফোন লক করে পেছনে ঘুরলো তানহা।

—-কি হয়েছে?
—-মামীর নাকি আবার কোমড়ে ব্যথা করছে।তোমাকে রান্না করতে বললো।
—-আমার অফিস আছে।সারাদিন খাটা খাটুনি করে রাতে ও রান্না করতে হয়।এই একটা বেলাও কি কোমড়ে ব্যথার অজুহাত দিতে হবে ঐ মহিলার!
—-কি করবে বলো?আমাদের কি বা করার আছে?তাও তো এখন তুমি চাকরি করো আরো কতো বড় পদে তাই কম কষ্ট দেয়।আগে তো তোমাকে আমাকে কতো না খাইয়ে রেখেছে।
—-আমাদের ই মায়ের সম্পত্তি বেচে কিনে খাচ্ছে অথচ দেখ আমাদের সাথে কি ব্যবহার টাই না করে।
—-দেখা ছাড়া কি করার আছে বলো।চলো আমি তোমার হাতে হাতে এগিয়ে দেই।
—-তোর স্কুল আছে না?
—-আছে তো।
—-তুই যা।পড়তে বস।
—-না।তুমি অনেক কষ্ট কর সারাদিন।আমি একটু সাহায্য করি।
—-না।আমি পারব।তুই যা।এবার দেখি একটা কাজের লোক রাখব।

বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তানহা রান্না ঘরের দিকে গেল।

;;;;;

দুটো চোখ দেখে সাইকেল টাকে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিয়ে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লো নাফিজ।

জানালার নীল রঙের থাইগ্লাসের অপর প্রান্ত থেকে দুটো চোখ বার বার বাইরে উঁকি দিয়ে চারপাশ দেখছে।

গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নাফিজের দৃষ্টিও ঐ চোখের দিকে।

—-আফা,কি দেখলেন?কেউ আছেনি?
—-না গাসু কেউ নেই।
—-কইছিলাম না আপনি এতো টেনশন নিয়ে ন না।এতো সকালে কে আসবে?
—-চলো চলো তাড়াতাড়ি যাই।
—-চলেন আফা।

চোখ দুটো আড়াল হতেই নাফিজের মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল।ঐ চোখের চঞ্চল দৃষ্টিতে এতক্ষণ নাফিজ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।

তারা আর গাসু পা টিপে টিপে বের হচ্ছে।তারাও খুব সাবধানে ক্রাচ নিয়ে হাটছে।যেই দরজা খুলতে যাবে ঘটলো আরেক বিপত্তি।

—-তারা,গাসু দুটো তে এই ভোর বেলা কোথায় যাচ্ছো?

মাহমুদা বেগমের কথা শুনে জ্বিভ কামড়ে তারা পেছনে ঘুরলো।

—-আসলে মা ঐ একটু হাঁটতে যাচ্ছিলাম।এখন তো রাস্তায় কোনো লোক নেই।
—-সে ঠিকাছে।কিন্তু ঠান্ডা ঠান্ডা পড়ছে।তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।যাওয়া যাবে না।যাও দুজনে ঘরে যাও।
—-মা একটু যাই না।বেশিক্ষণ না দশ মিনিট।

তারার অনুরোধের চাহনি দেখে মাহমুদা বেগম আর না করতে পারলেন না।

—-আচ্ছা ঠিকাছে।দশ মিনিট ই কিন্তু।বেশিক্ষণ বাইরে থেকো না তোমার আবার গলা ব্যথা করবে।
—-আচ্ছা।গাসু চল চল।

দুজনের কান্ড দেখে মাহমুদা বেগম মুচকি হাসলেন।

নাফিজের মনটা কেন যে খারাপ হলো সে নিজেও বুঝতে পারছে না।হঠাৎ করেই সামনে তাকাতে নাফিজের মনটা এক অজানা আনন্দে ভরে উঠলো।ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

—-আফা মন খুইলা শ্বাস নেন।হামি দেখতাছি।কেউ আইবো না।আইলে ঝাটা পেটা করুম।
—-গাসু আজ তো মা দেখে ফেললো।
—-হ সেটাই।
—-আজ আর যাব না।আরেক দিন গিয়ে খেয়ে আসবো।

গাসু আর তারা দুজনেই আরেকবার রহস্যময়ী হাসি দিল।

লাল রঙের কুর্তি,সাদা রঙের প্লাজু, গলায় সাদা রঙের স্কার্ফ পেঁচিয়ে খোলা চুলে বাগানের মধ্যে ধীরে ধীরে হাটছে তারা।মাঝে মাঝে একটু নিচু হয়ে পরম আবেশের সাথে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার নয়নতারার গায়ে।

তারার উড়ন্ত কালো ঘন চুল,টোল পড়া হাসি সবকিছু যেন নাফিজের ভেতরে তোলপাড় করে দিচ্ছে।এক নজরে নাফিজ লুকিয়ে তাকিয়ে আছে তারার দিকে।

“নয়নতারা
তুমি কি বলতে পারো
সে কবে আসবে?
কখন আসবে সেই প্রহর।
আমি তার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছি।
অপেক্ষার দিন গুনে চলেছি
প্রতি মূহুর্তে,
সে কি আদৌ আসবে?”

চলবে————-

সবাই একটু লেখিকার জন্য দোয়া করবেন।আমার দাঁত গুলো যেন ভালো থাকে।নাইলে এই গাসুর কথা শিখতে গিয়ে এই বয়সে না বুড়ি হয়ে যাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here