ক্লাশরুমে টিচারের বকবক ভালো লাগছে না মিলিয়ার। সে মাঠে আদ্রিদের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিদ বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করছে। মিলিয়া আর আদ্রিদ এসএসসি পরীক্ষার্থী। তারা দুজনে খুব ভালো বন্ধুও। হঠাৎই আদ্রিদ বেহুঁ’শ হয়ে যায়। আদ্রিদকে তার বন্ধু জুনায়েদ ধরে। মিলিয়া আদ্রিদের এই অবস্থা দেখে তার বান্ধবি জুলি কে নিয়ে ক্লাশরুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। শিক্ষক প্রথমে অবাক হলেও পরে ঘটনাটা বুঝতে পেরে নিজেও ঘটনাস্থলে চলে যায়। আদ্রিদের মুখে পানি দিয়ে তার হুঁশ ফেরানো হয়। তার শিক্ষক তাকে ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নিতে বলে। স্কুল ছুটির পর মিলিয়া আর আদ্রিদ বাড়ি যাচ্ছিল। আদ্রিদ হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়াকে বলে –
-‘ আচ্ছা মিলিয়া এতো পড়াশোনা করে কি হবে?
মিলিয়া আদ্রিদের কথায় বিরক্ত হয়-
-” পড়াশোনা না করলে জীবনের কি মূল্য আছে? না কেউ তোমাকে দাম দিবে আর না তোমার নিজস্ব পরিচয় থাকবে। আর নাই বা তুমি প্রতিষ্ঠিত হতে পারবা।
আদ্রিদ চুপ করে মিলিয়ার কথা শুনে। তারপর হেসে দেয়।
-” মিলিয়া আমি পড়ালেখা করে কি করবো বল? আমি তো সবকিছুই ভূলে যাবো। আমি এখনি অনেকসময় ভূলে যাই। আমার মায়ের মতো আমারো এ্যালজাইমার রোগ হয়েছে। এই রোগের জন্য আমার মা আমাকেও ভূলে গিয়েছে। আর তারপর তো এই বই মনে রাখব আমি। আমিও আস্তে আস্তে এই পৃথিবীকেই ভূলে যাবো।
মিলিয়ার মন খারাপ হয় আদ্রিদের কথায়। বিষন্ন গলায় প্রশ্ন করে-
-” আচ্ছা এ্যালজাইমার কি রে?
-” শোন তাহলে- স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া হচ্ছে এ্যালজাইমারের প্রাথমিক লক্ষণ। এটা হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কের এক ধরনের অসুখ। এ্যালজাইমার ধীরে ধীরে মানুষের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনার শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়। এই এ্যালজাইমারে যখন মা আক্রান্ত হয়েছিল তাকে প্রায়ই সামান্য বিভ্রান্ত দেখতাম। তারপর মা অনেক কিছুই ভূলে যেতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তার চরিত্রে অনেক পরিবর্তন হতে থাকে এবং সে এখন আমাকেও ভূলে গেছে। এ্যালজাইমার রোগটা ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ) এর সবচাইতে প্রচলিত কারন। এই স্মৃতিভ্রংশের কারনে আমাদের ব্রেইনের নানা রকমের বিকৃতি হয়। আর সামাজিক মেলামেশার কারণে সমস্যা হয় পরে স্মৃতিশক্তি কমে যায়। আর শোন এই এ্যালজাইমার রোগের কিন্তু কোন বয়স হয়না। যানিস আম্মু আমাদের উপর খালি চি”ল্লাচি’ল্লি করতো। আম্মুর তো কোন সাল বা তারিখও মনে থাকতো না। ইভেন সে আমার জন্মদিন ও ভূলে যেতো। আম্মুর প্রচুর পরিমাণে মুড সুইং হতো। মাঝে মাঝে তো কথাই গুলিয়ে ফেলতো। তাই আর কি?
-” এটা তো অনেক সিরিয়াস অসুখ!
-” তাই তো বলি এতো সুন্দর পরিবেশে আমাদের লেখাপড়া করে কি লাভ? এখন উচিত খেলাধুলা করে সময় কাটানো।
-” দেখ আদ্রিদ আমাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বর্তমান নষ্ট করার মানেই নাই। আমাদের উচিত বর্তমানকে উপভোগ করা।
-” তোর সাথে কথা বলে পারা যায়না রে মিলি। যা তোর বাড়ি এসে গেছে।
-” আচ্ছা বায়।
-“হুম।
মিলিয়া তার বাড়ি চলে যায়। আদ্রিদ হাঁটতে থাকে নদীর পাড় ধরে। কাল কিছুদিন পরেই তাদের বিদায় অনুষ্ঠান! কথাটা শুনলেই কেমন জানি লাগে। সে আর মিলিয়াকে দেখতে পাবেনা! ভাবতে থাকে প্রথম দিনের কথা-
মিলিয়া এই স্কুলে ক্লাশ নাইনে ভর্তি হয়েছিলো। খুব সুন্দরী হওয়ায় সব ছেলেরা মিলিয়াকে তাদের পাশে বসাতে চাইছিলো। আর মজার ব্যাপার ছিল ঐ ক্লাসে প্রায় সব ছেলেই ফর্সা ছিলো! কিন্তু মিলিয়া ফর্সা ছেলেদেরকে পছন্দ করতো না। আর কোথাও জায়গা না পেয়ে বেচারি আদ্রিদের পাশেই বসেছিলো। আদ্রিদের সাথে আস্তে আস্তে বন্ধুত্বও হয়ে যায় মিলিয়ার সাথে। মিলিয়া আদ্রিদ, জুবায়ের, আর রিনি ছাড়া কারো সাথে তেমন একটা মিশেই না। মিলিয়া আদ্রিদকে শুধু বন্ধুই ভাবে। কিন্তু বোকা মিলিয়া কি জানে আদ্রিদ তাকে যেইদিন থেকে দেখেছে সেইদিন থেকেই তার জন্য মনে ভালোবাসার পাহাড় গড়তে শুরু করেছে। মিলিয়ার এক্টার হওয়ার অনেক শখ। আদ্রিদ সবসময় মিলিয়াকে সাপোর্ট করে।
।
হু হু করে বাতাশ এসে শীতল করে দিয়ে যায়। আদ্রিদের ধ্যান ভাঙে। ভাবতে থাকে বাস্তবতা নিয়ে। সে কেনো এ্যালজাইমার রোগে আক্রান্ত হলো? সেও তো পারতো ভালো কিছু করতে জীবনে। কিন্তু যেখানে প্রিয় মানুষদের মনে রাখাই দায় সেখানে কিভাবে একাডেমিক পড়াশোনা সম্ভব! আচ্ছা মিলিয়া কে কি সে ভুলে যাবে? এখনই তো প্রায় অনেক কিছুই মনে থাকেনা। একটা জিনিস কোথাও রাখলে পরবর্তীতে তা আর মনে করতে পারেনা। যখন তারা পরীক্ষার পর আলাদা হয়ে যাবে তখন তো মিলিয়ার সাথে দেখাই হবেনা। তাহলে কি করে মনে রাখবে তখন সে মিলিয়াকে? আদ্রিদ উঠে হাঁটা দেয়। আদ্রিদ খুব ভালো ড্রাম বাজাতে পারে। আসলে শিখেছে মিলিয়ার জন্য। মিলিয়ার পছন্দ অপছন্দ গুলোকে খুব মূল্যয়ন করে আদ্রিদ। আসলে সে চায় না মিলিয়াকে হারাতে। যদি আদ্রিদের ভালোবাসার কথা জেনে মিলিয়া বন্ধুত্ব নষ্ট করে দেয় তখন কি হবে? তাই আদ্রিদ কখনোই মিলিয়াকছ মনের কথা বুঝতে দেয়নাই।
।
কেটে গেছে কয়েকদিন আজ বিদায় অনুষ্ঠান। হাঁসি, মজা, আনন্দ, সুখ-দুঃখ, হৈ হুল্লোড় করে কাটিয়ে দিয়েছে সবাই স্কুল লাইফটা। আজ সময় জানান দিচ্ছে বিদায় নিতে হবে হবে। তাকে বিদায় দেয়া খুবই কঠিন যার সাথে কাটানো হয়েছে সুন্দর মূহূর্ত গুলো। সব শিক্ষার্থীর মুখেই আজ বিষাদ। কেউ কেউ স্মৃতি রেখে যাচ্ছে। কেউবা বেষ্টফ্রেন্ড। সবকিছুর শেষে মিলিয়া, জুবায়ের, রিনি আর আদ্রিদ একসাথে হয়। আদ্রিদ আগে বলে-
-” আমি কতটা ভাগ্যবান তাইনা মিলি? যে আমার কাউকে বিদায় দিতে কষ্ট হচ্ছে।
মিলিয়া হেসে বলে-
-” শুরু করতে হলে অতীতকে বিদায় দিতেই হয় রে। জুবায়ের, রিনি আর আদ্রিদ আমার জীবনের অভ্যাস হয়ে গেছিলি তোরা। কখনো ভূলিস না আমায়।
জুবায়ের তাকায়। তার চোখ জানান দিচ্ছে কষ্ট হচ্ছে তারো এই প্রিয় স্কুল বন্ধ আর স্মৃতিগুলোকে ছেড়ে যেতে-
-” শোন দোস্তরা কষ্টের বিদায় হয় সুখের আর কষ্ট ছাড়া হাসি খুশি বিদায়গুলো হয় দুঃখের। কেউ কাদবিনা খবরদার আমরা জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা রাখতে চলেছি তাই তো এই বিদায়। এটা বিদায় নয় নতুনকে বরন করার ধাপ। জীবনের লক্ষ্যে আমরা আরো একধাপ এগিয়ে গেলাম এবার।
-” হ্যা তুই ঠিক বলেছিস রে জুবায়ের। মিলিয়া আর আদ্রিদ তোদের ও খুব মিস করবো রে। আর শোন বিদায় শুধু কষ্টের নয় রে এই বিদায় ভালো কিছুই বয়ে আনবে।
আদ্রিদ বলে –
-” শোন আমরা বেষ্ট ফ্রেন্ড ছিলাম আর থাকবো সারাজীবন। তোদের থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি হয়তো তা কেউ দিতে পারবেনা। আর বিদায় কখনোই বলেনা এটা শেষ বিদায় তো অস্থায়ী জিনিস। আমরা আবার এক হবো কলেজ লাইফে। সবাই ভালো করে পড়বো। ভালো রেজাল্ট করে এক কলেজে এডমিশন নিব। আবার আগের মতো থাকবো।
-” হ্যা আদ্রিদ ঠিক বলেছে কিন্তু। তোরা দুজনে মন খারাপ করিস না। আর তোদের ভালোবাসা টা যেন আজীবন একরকম থাকে। আর হ্যা আসি রে আজ আদ্রিদ চল। রিনি জুবায়ের ভালো থাকিস। বিদায়ের মানে কখনোই ভূলে যাওয়া নয় বরং দ্বিতীয় বার মিলিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভূলে যাওয়াই বিদায়। মনে রাখিস আমাদের। আদ্রিদ আয়।
মিলিয়া হাঁটা দেয়। আদ্রিদ ও পিছে পিছে যেতে থাকে। জুবায়ের আর রিনি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওদের যাওয়ার পানে। খুব কষ্ট হচ্ছে চারজনের। একসাথে কাটানো মূহুর্তগুলো মনে পড়ছে সব। আহা কতো তারাতাড়ি সময় চলে গেলো। আর কি দেখা হবে?
-” মিলিয়া।
আদ্রিদের মুখে নিজের পুরো নাম শুনে অবাক হয় মিলিয়া। আদ্রিদ তাকৈ মিলি বলেই ডাকে।
-” হু বল।
-” দোস্ত শোন আমরা কিন্তু আবার এক হবো। আর তুই প্রেম টেম করবি না কিন্তু। আমরা একসাথে বিয়ে করবো।
-” মানে।
-” না না মানে তুই আর আমি একসাথে পছন্দ করবো আমাদের বউ আর জামাই।
কষ্টের মাঝেও মিলিয়া হেসে দেয় আদ্রিদের উদ্ভট কথায়। আদ্রিদ মুগ্ধ হয়ে দেখে।
-” শোন মিলিয়া আমাদের আবার দেখা হবে। ভূলিস না জানি। আমি হয়তো ভূলেই যাবো। শোন বিদায় মানে ভূলে যাওয়া নয় বরং বিদায় হলো অতীত মনে রেখে বেঁচে থাকার শুরু। তুই আমার বেষ্টি আমি তোকে কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিস। ভালো থেকো প্রিয় বন্ধু। বিদায় হলো সেই কষ্ট যা যার জন্য পাওয়া হয় তাকে কখনো বোঝানো যায় না।
আদ্রিদ চলে যেতে থাকে। মিলিয়া শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাসার গেটে। আর কি দেখা হবে?
#চলবে
#হৃদয়ে_রেখো
#সূচনা_পর্ব
#মেঘলা_আহমেদ