#অপূর্ণ_প্রেমগাঁথা
#The_Mysterious_Love
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১০
সকালবেলা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে বসে আছে মাধুর্য। খাটের পাশেই জানালা। জানালায় ফোঁটা ফোঁটা পানির আভাস বলে দিচ্ছে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। মেঘলা সকালে ঘুমটা একটু দেরিতেই ভাঙে। জানালার থাইয়ের লক খুলে জানালা টেনে খোলে মাধুর্য। সঙ্গে সঙ্গে এক শীতল হাওয়ার রেশ এসে মাধুর্যের সারা শরীর বয়ে যায়। ঠান্ডায় কুকিয়ে চাদর খামচে ধরে সে। গতকালই কত গরম ছিল আর আজ বৃষ্টির ঠান্ডা। মিষ্টি হাসি দিয়ে নিজের দুইহাতের বাহু কচলাতে থাকে মাধুর্য। সে কাল অনুভবকে অনুভব করেছে। আসলেই তাকে অনুভব করাটা অন্যরকম আনন্দের। কিছুক্ষণ পর নেমে পরে বিছানা থেকে। দরজা খুলে লিভিং রুমে প্রবেশ করে সে। বেশি সময় নেই তার হাতে। ক্লাস শুরু হবে। অনুভবকে দেখতে না পেয়ে আস্তেধীরে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় খোলা বান্দায়। সেখানে আরো বাতাস। খোলা বারান্দাতেই উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে অনুভব।
মাধুর্য কিছু বলার আগেই অনুভব মাধুর্যের উপস্থিতি টের পায়। বুঝতে পারে সেই ভয়ানক অনুভূতি তার হৃদয়কে আঁকড়ে ধরছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে অনুভব বলে…..
–“গুড মর্নিং মিস মাধুর্য!!”
বলে মাধুর্যের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। চোখজোড়া আটকে যায় মাধুর্যতে। মুখের জবান বন্ধ হয়ে যায়। ঠোঁটজোড়া অজান্তেই খুলে যায়। মাধুর্যের এলোমেলো চুল! একদিকে উঁচু আবার একদিকে নিচু হয়ে আছে। ফোলা ফোলা তার অস্বাভাবিক বড় চোখজোড়া। ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে হালকা কাঁপছে। ঠোঁটে আটকে গেছে দুই-তিনটে চুল আর পরনে অনুভবের গেঞ্জি। এই মেয়েটা যেখানে থাকে সেখানেই কি পাগল করে ছাড়ে সবাইকে? নাকি এটা শুধু অনুভবের সাথেই হচ্ছে? বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকে সে।
অনুভবের দৃষ্টি দেখে নিজের দিকে তাকায় মাধুর্য। সঙ্গে সঙ্গে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে সে। ফর্সা চকচকে গালে ফুটে ওঠে লাল আভা। চোখজোড়া লজ্জায় ছোট হয়ে যায়। কিছু বলার চেষ্টা করতেই না পেরে ঝড়ের গতিতে স্থান ত্যাগ করে সে। তার কীর্তিকলাপ দেখে না হেসে পারে না অনুভব। হালকা হেসে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় সে। আকাশের দিকে তাকাতেই শক্ত হয় ওর চোখমুখ। চোখ একবার খিঁচে বন্ধ করে পা দিয়ে রেলিংয়ে একনার আঘাত করে চোখ খোলে সে। চোয়াল শক্ত করে বলে ওঠে….
–“দিশেহারা হয়ে পড়ছি আমি। বার বার সেই অদ্ভুত অনুভূতি দোলা দিয়ে উঠছে আমার মনে। তাও ওই কয়েকদিনের চেনা মেয়ের জন্য। এর অর্থ কি? তাহলে কি আমি যা ভাবছি তাই? আমি বুঝব কি করে? চিনব কি করে?কেন আমাকে এতোবড় শাস্তি দেওয়া হলো? নিজের প্রেয়সীকে চিনতে বেগ পেতে হচ্ছে আমার। নো প্রবলেম। আমি চিনতে চিনতে যেন সে আগের মতো হারিয়ে না যায় তাই তো এই ব্যবস্থা করেছি আমি। নজরবন্দি করে রেখে দিয়েছি। আমার পারমিশন ছাড়া কেউ তাকে দেখতে পাবে না। ব্যাস….শুধু একবারের জন্য কোনো প্রমাণ পেয়ে যাই।”
শ্বাস-প্রশ্বাস বার বার ওঠানামা করছে মাধুর্যের। কান থেকে যেন ক্রমাগত ধোঁয়া বের হচ্ছে। লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছে। এই পোশাকে কি করে দাঁড়াল সে অনুভবের সামনে? একবারো খেয়াল হলো না সে কি পড়ে আছে? নিজের গালেই দুটো আলতো চাপড় মেরে চোখ বন্ধ করে বলে…..
–“মাধুর্য, তুই সত্যিই একটা মাথামোটা। পাগল তুই। এখন তো আর উনার সামনে যেতে পারবি না। বসে বসে কপাল চাপড়া।”
মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে গতকালকের লং জামা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় সে।দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবে মাথা নিচু করে শুকনো মুখে বাইরে বেরিয়ে আসে। বাইরে বেরিয়ে আসতেই টুংটাং শব্দে কিচেনের দিকে তাকায় সে। অনুভব এখন কিচেনে কিছু একটা করছে। এখন অন্তত অনুভবের সামনে দাঁড়ালে লজ্জায় মরেই যেতে হবে ভেবে বারান্দায় চলে যায় মাধুর্য।
বারান্দায় বেতের চেয়ার-টেবিল রাখা। টেবিলের ওপর বেতের ঝুড়ি। তাছাড়া ছোট ছোট ফুলের টবে বেশ কয়েকটা পাতাবাহার গাছ লাগানো রয়েছে। যা ঝুলানো রয়েছে ওপরে। নীল অপরাজিতা ফুলের গাছ লেপ্টে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওপর থেকে নিচের রেলিং পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। কি মনোরম জায়গাটি। মিষ্টি হেসে বাইরের দিকটা তাকাতেই হতচকিত চোখে তাকায় সে। বাইরের পরিবেশটা কি ভয়ানক! বাইরে জঙ্গলের আচ্ছাদনে পরিপূর্ণ। সেই জঙ্গল দিয়েই গিয়েছে একটা রাস্তা। সেই রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করানো। ভ্রু কুঁচকে তাকায় মাধুর্য। এই জায়গায়টা তার চেনা। আগেও এসেছিল সে। চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করতেই আরেক ধাপ চমকে ওঠে সে। আতঙ্কিত সুরে বলে….
–“এটা তো সেই জায়গা। কিছু দূরেই তো ওই রহস্যজনক কুয়ো আছে। আমি সেদিন এমনটা অনুভব করেছিলাম যে, আমি ওই কুয়োর ভেতরে পড়ে গিয়ে এক রহস্যময় জগতে প্রবেশ করেছিলাম।”
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বারান্দা ছেড়ে কিচেনে ঢুকে পড়ে সে। অনুভব তখন কোনো কিছু ছুরি দিয়ে কাটছে। মাধুর্যের এমন প্রবেশে চোখ তুলে তাকায় সে।
–“এখানে আমি থাকব না। আমি থাকতে পারব না। প্লিজ!”
মাধুর্যের অসহায় গলা এবং আতঙ্কিত চোখমুখ দেখে কপাল কুঁচকে যায় অনুভবের। কি কারণে ভয় পেল মেয়েটা? ছুরি ছেড়ে এগিয়ে আসে অনুভব। মাধুর্যের কাঁধে হাত দিয়ে একটু নিচু হয়ে বলে….
–“এনিথিং রং মাধুর্য? কেন থাকবে না এখানে? কি হয়েছে?”
মাধুর্যের চোখে বার বার ভেসে উঠছে ওর কুয়োতে পড়ে যাওয়া, সেই কফিনটা খুলে আলোকিত হয়ে ছোট ছোট সাপ কিলবিল করা, ওই রহস্যময় রাজমহল! হু হু শব্দ করে অনুভবের পিঠে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাধুর্য। অনবরত কাঁপতে থাকে সে।
হঠাৎ এই ঘটনায় কি প্রতিক্রিয়া করবে তা ভেবে পাচ্ছে না অনুভব। দুই ধাপ পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয় সে। মাধুর্য মনে হচ্ছে অনুভবের শার্ট ছিঁড়ে বুকের ভেতর ঢুকে যাবে! অনুভবের বুকের ভেতরটা ধুকধুক করছে। শীতল হয়ে যাচ্ছে তার প্রত্যেকটা অঙ্গে। নেশায় বুদ হয়ে বুঁজে আসছে তার চোখজোড়া। মাথার প্রত্যেকটা স্নায়ু বলছে মেয়েটা বড্ড চেনা, তার স্পর্শ চেনা, তাকে জড়িয়ে ধরতে কোনো বাঁধা নেই। অনুভবের গরম নিঃশ্বাস আঁচড়ে পড়ছে মাধুর্যের চোখে ও গালে। মেয়েটির চোখের পাতা নড়ছে। এই মূহুর্ত এখানেই থেমে যাক! সময়টা থেমে যাক। সারাজীবন থাকুক তাদের এই কাছে আসা। অনুভব হাতটা তুলে মাধুর্যকে স্পর্শ করতেই এক ঝটকায় সরে যায় মাধুর্য। নিজের মুখচোখ হাত দিয়ে একবার মুছে নিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেল সে। মিনমিনিয়ে বলে উঠল….
–“সরি।”
ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকায় অনুভব। সে প্রশ্ন করে….
–“ওকে, একটা কথা বলো। তুমি কি কোনোকিছু দেখে ভয় পেয়েছো?”
ভাবতে থাকে মাধুর্য। নিজেকে শান্তনা দেয় যে, সেদিন যা হয়েছিল সবই ওর ভ্রম। এখানে ভয় পাওয়ার মতো কিছুই নেই। সাহস নিয়ে অনুভবের দিকে তাকিয়ে মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয় সে। যার অর্থ, সে ভয় পায়নি। তৎক্ষনাৎ অনুভব বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল….
–“তুমি আমার কিছু লুকাচ্ছো। যাই হোক, তোমার এখানে থাকতে ভয় লাগলে আমি আমার একটা মেয়ে বন্ধুকে পাঠিয়ে দেব। ও তোমার সঙ্গে থাকবে। ঠিক আছে?”
–“হুমম।”
মাধুর্যের বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখে অনুভব। ও এখনো কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত যেটা ও অনুভবকে বলতে চাইছে না। তাকে এখন স্বাভাবিক করা প্রয়োজন।
তাই অনুভব গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে….
–“আচ্ছা সকালের ব্রেকফাস্টে কি খাও তুমি? তোমার তো ক্লাস আছে না? তাড়াতাড়ি ইউনিভার্সিটি যাবে তো তুমি।”
এবার স্বাভাবিক হয়ে তাকায় মাধুর্য। চোখমুখ থেকে মুছতে শুরু করে ভয়।
–“যেকোনো একটা হলেই হলো ব্রেকফাস্টে। আর আপনি কি খাবেন?”
–“রক্ত।”
অনুভবের উদ্ভট কথা শুনে আরেক দফা চমকে যায় মাধুর্য। অনুভব কি রক্তই বলল? নাকি তার কান রক্ত শুনল? কোনটা? অতিরিক্ত বিস্মিত হয়ে বলে উঠল….
–“হ্যাঁ???”
–“ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াসলি। আই ওয়াজ কিডিং।”
কথাটা বলে দাঁত বের করে হাসে অনুভব। মাধুর্যও অনুভবের হাসির প্রতিত্তোরে হাসি দিয়ে বলে ওঠে….
–“আপনি এসব করছেন কেন? আপনি রান্না করবেন?”
–“ইয়াহ। আমি আজকে রান্না করছি।”
–“আপনি রান্না পারেন?”
–“অভিয়েসলি! অনুভব সিনহা সব পারে। নাথিং ইজ ডিফিকাল্ট ফর হিম।”
–“রিয়েলি!” (সন্দেহি দৃষ্টিতে তাকিয়ে)
অনুভবও মাধুর্যের নকল করে তার মতো করেই তাকায়। মাধুর্যের হাতে পানির বোতল ধরে দিয়ে বলে….
–“ইয়েস। এখন পানি এই ময়দার ওপর ঢেলে আমার হেল্প করো।”
মাধুর্য মাথা দুলিয়ে পানি ঢালতে থাকে। অনুভব ময়দা মাখতে শুরু করে মনোযোগ দিয়ে। পানি ঢালতে ঢালতে হঠাৎ মাধুর্যের মনে একটা প্রশ্ন জাগে।
–“আচ্ছা, কাল রাতে আপনি কোনো প্রাণীর চিৎকারের আওয়াজ শুনেছিলেন?”
ময়দা মাখানো থামিয়ে দেয় অনুভব। কিছুক্ষণ ময়দার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবারও নিজের কাজে মন দেয়। আর বলে….
–“না তো। কেন?”
–“আমি শুনেছিলাম ঘুমের মাঝে। একটু উদ্ভুত ছিল হুংকার। যেন সে তৃষ্ণার্ত বা কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। শেয়াল বা কুকুর তো এমন চিৎকার করে না। তাই বলছিলাম।”
–“এটা তো জঙ্গল। অনেক ধরনের জঙ্গলি প্রাণীর বসবাস হয়। তারাই রাতে গর্জন করে।”
অনুভবের কথা বিশ্বাস হয় মাধুর্যের। তাই সে অনুভবের কথার সঙ্গে তাল মেলায়।
ব্রেকফাস্ট শেষ করে গাড়িতে করে প্রথমে ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অনুভব এবং মাধুর্য। সেখান থেকেই অফিসে যাবে অনুভব। আর মাধুর্যের অফিস টাইম দুপুর ২ টা থেকে। তাই সে ক্লাস শেষ করে যাবে।
ইউনিভার্সিটির গেটের কাছে এসে মাধুর্যকে নামিয়ে দেয় অনুভব। অনুভবও নামে গাড়ি থেকে কিছুক্ষণের জন্য। সামিহার আসার কথা আজকে বইপত্র নিয়ে। গেটের এক কোণে সামিহাকে দেখে হাসি ফুটে ওঠে মাধুর্যের। যেন কতবছর সামিহাকে দেখেনি সে। সামিহা এগিয়ে আসে ওদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরে তাকে মাধুর্য। সামিহা হেসে মাধুর্যের মাথা বুলিয়ে দিয়ে বলে….
–“নতুন জায়গাতে মানিয়ে নিতে পারছিস তো?”
–“মোটামুটি পেরেছি। কিন্তু তোমাদের ছাড়া আমার এক বিন্দুও ভালো লাগছে না সামিহা আপু।”
–“পাগলি, কয়েকদিন পর তো তোর বিয়ে হতোই। তখন তোর বরের সঙ্গে থাকতিস। আমাদের কি নিয়ে শ্বশুড়বাড়ি থাকতি?”
লজ্জামিশ্রিত হাসি দেয় মাধুর্য। ওর হাতে দুটো তুলে দেয় সামিহা।
–“এখানে তোর জামাকাপড় আর তোর বইখাতা এবং তোর দরকারি সব জিনিস আছে। তুই আর আমাদের বাড়ি আসিস না।”
–“একেবারে পর করে দিচ্ছো?”
ভারাক্রান্ত গলায় শুনে ব্যথিত হয় সামিহা। মাধুর্যের গালে হাত দিয়ে বলে ওঠে….
–“তোকে পর করে দেবার ক্ষমতা আমার আছে? আমার মায়ের জন্য তোকে আসতে বারণ করছি। আমি চাই না তুই আবার অপমানিত হ। তাই বলছি।”
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মাধুর্য। শেষমেশ তাকে তার প্রিয়জনদেরও ছাড়তে হলো।
গেটের ভেতর গার্ডেনের একটা সিটে বসে আড্ডায় মেতে ছিল অরুণের সাঙ্গপাঙ্গরা। সেই সঙ্গে অরুণও বসে ছিল সেই সিটের ধারে। সে করছে মাধুর্যের অপেক্ষা। আর পাঁচ মিনিটে ক্লাস শুরু হবে। কবিতাও এসে গেছে অথচ মাধুর্যের কোনো খবর না পেয়ে চিন্তিত সে। কবিতাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলেছে, কালকে মাধুর্যের সঙ্গে বেশ বাজে ঘটনা ঘটেছে। সেই নিয়ে আরো বিষন্ন সে।
এসব চিন্তায় যখন সে মগ্ন তখনই তার একজন বন্ধু তাকে আলতো ধাক্কা দিতেই বিরক্ত আর রাগ নিয়ে তাকায় অরুণ। তখনই তার বন্ধুটি বলে ওঠে….
–“তোর ভালোর জন্য ধাক্কা মারছি। গেটের ওইপাশে চেয়ে দেখ। তোর পেয়ারা মাধু থুক্কু ভাবি এসেছে। তাও সঙ্গে একটা পোলা আছে দেখি। এক রাতে বিয়ে টিয়ে করে ফেলেনি তো!”
চোখ লাল করে তাকায় অরুণ। সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে ফেটে পড়ে তার বন্ধুরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। ঘাড় ঘুড়িয়ে গেটের ওপাশে তাকায় সে। মাধুর্যকে দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে একটা মেয়ে আর ছেলে। ছেলেটাকে বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায় অরুণের। একচোখ ছোট আরেক চোখ বড় করে নজরটি হিংস্র প্রাণীর মতো তীক্ষ্ণ হয়ে আসে। উত্তেজনায় পাশে থাকা বন্ধুর হাত জোরে চেপে ধরে সে। কয়েক সেকেন্ড পর বন্ধুটির চাপা আর্তনাদে ধ্যান ভেঙে তাকায় অরুণ। দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে আসে।
অরুণের বন্ধুটির হাতে অরুণের নখ বসে গিয়ে গভীর ভাবে কেটে গিয়েছে। তা দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে অরুণ। হাত মুঠো করে ফেলে সে। থমথমে সুরে বলে….
–“শিট! আমি খেয়াল করিনি সরি।”
–“আরে ইয়ার, জেলাসি হলে এমন হয় মাঝেসাঝে। আমরা বুঝি তো। কিন্তু তোর এতো বড় বড় নখ কোথা থেকে এলো? আজকাল মেয়ে হওয়ার ট্রাই করছিস নাকি?
কথাটা বলে দুষ্টুমির হাসি দেয় তার বন্ধুরা। অরুণ মাথা গরম করে সেখান থেকে উঠে চলে আসে।
বইয়ের ব্যাগ নিয়ে গেট দিয়ে প্রবেশ করে মাধুর্য। পিছু ফিরে একবার তাকায় অদ্ভুত লোকটির দিকে। যেন সে যত দেখে তবুও দেখার শেষ নেই। মাধুর্যের জামাকাপড়ের ব্যাগ জোর করে নিজের সাথে নিয়ে গাড়িতে বসে অনুভব। গাড়ি স্টার্ট দেয় সে।
ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত হয়ে ক্যাম্পাসে আসে কবিতা ও মাধুর্য।
–“কবিতা, জেদ করিস না। আমাকে অফিস যেতে হবে। আজকে আমার ফার্স্ট দিন। আজ গল্প না করলেই নয়?”
ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মাথা তুলে তাকায় কবিতা। মাধুর্যের হাত ছেড়ে দিয়ে ভেংচি কেটে বলে….
–“ওকে যাহ! বেশি টাইম নেব না। শুধু বল এখন কোথায় আছিস তুই? আমার ক্রাশের কাছে নাকি?”
খানিকা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় মাধুর্য।
–“তোর ক্রাশ?”
–“হ্যাঁ আমার ক্রাশ। ওই নাম কি যেন! হ্যাঁ অনুভব সিনহা। আহা! যেমন তার লুক, তেমন তার স্টাইল। দিলমে তো ওয়ো জাগা কার লিয়া।”
মাধুর্য বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে। হাত ঝেড়ে বলে….
–“এ আর নতুন কি? প্রতিদিন তোর ক্রাশের সংখ্যা বাড়তে থাকে।”
মাধুর্যের হাত চিপকে ধরে কবিতা। খুশি খুশি মুখ করে বলে….
–“একদমই না। এটা একদম সিরিয়াস ক্রাশ। পারলে এখনই বিয়ে করে নিতাম।”
বাঁকা চোখে তাকায় মাধুর্য। তখনই কবিতা চিল্লিয়ে বলে ওঠে….
–“এই মাধু, দেখ দেখ।”
–“কি দেখব?”
–“আরে আমার ফোনে দেখ। একটা লাশের ছবি বেরিয়েছে। রক্তশূণ্য লাশ। তাও আবার আমরা যেই কুয়োর রাস্তা দিয়ে গেছিলাম তার আশেপাশের কোনো রাস্তায়।”
থম মেরে কিছুক্ষণ থেকে দ্রুত ফোনের দিকে তাকায় মাধুর্য। একটা ফ্যাকাশে লাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঢক গিলে মাধুর্য। নিচে লিখা আছে, এটা কোনো মানুষ নয়। প্রাণীর আক্রমনে মারা গিয়েছে। আর মৃত লোকটি চোর ছিল। সম্ভবত রাতে চুরি করতে গিয়েই কোনো অজ্ঞাত প্রাণীর হাতে মৃত্যু হয়েছে তার।
এটা দেখার পরেও কোনো ভয় কাজ করে না মাধুর্যের ভেতরে। দৃষ্টি সরাতেই অরুণের দিকে নজর যায় তার। অরুণ তার দিকেই আসছে। এতোক্ষণ যেন শান্তি ছিল তার আশেপাশে। এই ছেলেটা আসার পরেই মনের মধ্যে খচখচ শুরু হয় তার। তবে অরুণের মুখটা আজ হাসোজ্জল নয়। বেশ শুকনো। এসেই সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে…..
–“আজ তোমার সঙ্গে ওই ছেলেটি কে ছিল মাধুর্য? যে তোমাকে এখান পর্যন্ত এগিয়ে দিল?”
মাধুর্যের কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ে। সেখানে বিব্রতর ছাপ স্পষ্ট।
–“কেন বলুন তো? উনার ব্যাপারে জেনে আপনি কি করবেন?”
–“কথা ঘুরিয়ো না। আমি যা বলছি তার উত্তর দাও।”
অরুণের কন্ঠে রয়েছে অদ্ভুত একটা ভয়ানক সুর। সেই সঙ্গে রাগ। তবুও দমে না মাধুর্য।
–“আমি কথা ঘুরাতে যাব কেন? আমি আপনার সাথে বন্ধুত্ব করেছি তার মানে এই নয় যে আমার সব ব্যাপারে আপনি নাক গলাবেন। এই অধিকার তো আমি আপনাকে দিইনি।”
–“যাকে তাকে বিশ্বাস করো না। ক্ষতি তোমার হবে। যাকে তাকে নিজের কাছে টেনো না। তোমার সবটা শূন্য করে দিয়ে কখন চলে যাবে তা টেরও পাবে না।”
চলবে…..🍀🍀
বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।