#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-১৫
“মামুন ভাই, আমার কারণে আপনাদের দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব নষ্ট হোক তা কিছুতেই চাইনা। কেন এমন করছেন বলুন তো?”
সুমনার কাতর কন্ঠ শোনা গেলো।
“আমি কি করলাম মোনা? যা করার তোমরাইতো করছো? আমরা বোকাসোকা ছেলেপিলে! আমাদের কি আর এসব করা সাজে বলো?”
মামুন হাসলো একটু।
“প্লিজ মামুন ভাই, কেন ভুল বুজছেন বলুন তো? আচ্ছা, মানলাম যে আমার দোষ আছে, আপনাকে নাচিয়েছি কিন্তু আদির দোষ কোথায়? ওর সাথে কেন কথা বলছেন না? বাজে ব্যবহার কেন করছেন?”
“ওর দোষ, ও তোমাকে ভালোবাসে। তোমরা দুজন যখন লাভ বার্ড হয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াও তখন আমার শরীর জ্বলে, বুকের ভেতর খা খা করে। তোমাদের দু’জনকে ধরে মারতে ইচ্ছে করে।”
“তো মারুন না! আমাকে যতগুলো ইচ্ছে চর লাগিয়ে দিন। কিন্তু তবুও আদির সাথে এমন করবেন না। ও আপনাকে বন্ধু হিসেবে খুব ভালোবাসে। আপনি ওর সাথে কথা বলছেন না ও কষ্ট পাচ্ছে।”
মামুন খানিকক্ষণ হেঁসে নিয়ে বললো-
“শোন এতো কষ্ট করতে হবে না। তুমি শুধু আদিকে ছেড়ে আমার কাছে চলে এসো দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। পারবে?”
সুমনা দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। মামুনকে খুব ভদ্র ছেলে ভেবেছিলো। এখন দেখছে ছেলেটা পুরোই উল্টো ক্যারেকটার। যতটা সহজ দেখা যায় ভেতরটা ততটাই কঠিন।
“সরি ভাইয়া, ভেবেছিলাম আপনি অন্যরকম। কিন্তু..”
“কি ভেবেছিলে? আমি বাংলা সিনেমার বাপ্পারাজের মতো? সবাইকে মিলিয়ে দিয়ে মারা যাবো টাইপ ক্যারেক্টার?”
সুমনা কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। আসলেও তো! এরকমই কিছু একটা ভেবেছিলো ও।
মামুন আবার কথা বলে-
“শোন জীবনটা বাংলা সিনেমা না আর আমিও বাপ্পারাজ না। তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল। তারমানে এই না যে, তোমাকে না পেলে আমি মারা যাবো…ব্লা ব্লা টাইপ ব্যাপার। হ্যা ব্যাপারটা ভুলতে, আবার তোমাদের সাথে সহজ হতে আমার একটু সময় লাগবে। তবে ব্যাপার না, কিছুদিন আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও দেখবে আপনাতেই ঠিক হয়ে গেছি। আমাকে নিয়ে তোমাদের এতো ব্যাস্ত না হলেও চলবে। ঠিক আছে?”
মামুন অনেক কষ্টে ঠোঁট টেনে হাসলো। মামুনের হাসিটা দেখেই কি না কে জানে, সুমনার নিজেকে খুব করে দোষী মনেহচ্ছিলো। ধুর, ছেলেটার সাথে এমন দুষ্টুমি না করলেও পারতাম। সুমনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই মনেহয় মামুন একটু নরম হলো। শান্ত গলায় বললো-
“আর যদি সময় দিতে না চায় তাহলে বাধ্য হয়ে ভার্সিটিতে আসা বন্ধ করতে হবে। কারন আমি রোবট না মানুষ। চাইলেই একদিনে সব ভুলে হাসাহাসি করবো তোমাদের সাথে, এটা পসিবল না। এখন বলো তুমি কি চাও? ভার্সিটি তে আসা বন্ধ করে দেবো?”
“না না তা করবেন কেন? ওকে, টেক ইয়োর টাইম। আমি আপনাকে ফোর্স করবো না আর। তবে আপনার ফিরে আসার অপেক্ষা করবো অধীর আগ্রহে।”
“থ্যাংস।”
মামুন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটা ধরলো। ছেলেটার চোখদুটো জ্বলে টইটম্বুর যা সুমনা দেখতে পেলো না। পেলে ওর কষ্টটা দ্বিগুন হতো, মেয়েটা অন্তর্দ্বন্দে ভুগতো হয়তো। থাক, এই ভালো! কিছু কিছু ব্যাপার আড়ালে থাকা ভালো।
*******
বছর পাঁচেক পর —
আজ আদি আর সুমনার বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে। ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হয়েছে আরো বছর খানের আগেই, আদি চাকরি পাওয়ার পর পরই।
সুমনার জেদ ছিলো যে, ও চাকরি পাওয়ার আগে বিয়ে করে সংসার শুরু করবে না। এখন সুমনাও কিছুদিন হলো পাশ করে বেড়িয়েছে, ভালো একটা কোম্পানিতে ওর ও জব হয়ে গেছে। তাই দু পরিবারের কেউ আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। আদি আর সুমনাও আর একে অপরের থেকে দূরে থাকতে চায় না। যথেষ্ট হয়েছে পড়ালেখা, ক্যারিয়ার গোছানো, এখন শুধু দুজনার দু’জনকে সময় দেওয়া। এই কয়েকটা বছর স্বপ্নের মতো কেটেছে ওদের। একসাথে পড়ালেখা, খুনসুটি, টম এন্ড জেরির মতো মারামারি, ঝগড়া, পেছনে লাগা। তবে দিনশেষে দু’জন জানতে ওরা একে অপরের আত্না। একজন আরেকজনকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। তাই সারাদিন যতই ঝগড়া করুন, রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই গুডনাইট লাভ জানাতে দুজনার কেউই ভুলতো না। আর আজ থেকে তো একসাথেই থাকবে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা। অবশ্য ওদের দু’জনের বাবা মায়েরা খুব চিন্তিত যে, ওরা দুজন ঠিকঠাক মতো থাকতে পারবে তো? যে ঝগড়া করে দু’জনে সারাদিন!
এই মুহুর্তে আদি চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে স্টেজে সুমনার পাশে। সুমনা আদিকে জিজ্ঞেস করলো-
“কি রে কি ভাবছিস এতো?”
“এই, মামুন কি আসবে? ব্যাটা তো আমার ফোন রিসিভ করে নাই।”
সুমনা ঠোঁট টিপে হাসলো।
“শোন, এতো ভাবিস না। আমার সাথে কথা হয়েছে মামুন ভাইয়ের। আসবে আজকে।”
“হায়রে আমার কপাল!”
আদি কপালে হাতের চাপড় দিলো।
“কি হলো?”
“আমার এখন সারাজীবন ধরে একটা সতীন পালতে হবে এটা ভেবেই কপাল চাপরাচ্ছি। কি কপাল নিয়ে এসেছিলাম, মাইরি!”
“ধুস, বদ ছেলে। এতো ভয় পাইয়ে দিস কেন? তোর বন্ধু যদি তোর সাথে কথা না বলে আমার সাথে কথা বলে তবে আমি কি করবো?”
“হ্যা, সেটাই বলছিলাম আর কি!”
হঠাৎ সুমনার নজর গেলো সামনে। মামুন হেঁটে আসছে স্টেজের দিকে। সাথে একটা মিষ্টি দেখতে মেয়ে। সুমনা আর আদি একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো। মামুন এগিয়ে এসে আদির সাথে কোলাকুলি করে হাত মেলালো-
“কন্গ্রাচুলেশনস বন্ধু। অবশেষে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে তুখোড় মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত বউ বানিয়েই ফেললি?”
“সে তো অনেক আগেই করে ফেলেছি। দোস্ত, তুই আসছিস আমি অনেক খুশি হয়েছি, অনেক।”
“তোর আর সুমনার বিয়ে, আর আমি আসবো না? ভাববি কি ভাবে? ওহ সরি, ভুলেই গেছি পরিচয় করিয়ে দিতে। মিট মাই উডবি ইশরাত নিম্মি। ইনশাআল্লাহ, আগামী মাসে দাওয়াত পাবি।”
আদি আর সুমনা দুজনাই কথাটা শুনে খুশি হলো। নিম্মি মেয়েটার সাথে কথা বলে ওরা দুজনাই মুগ্ধ হয়ে গেলো। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। সুমনার কাঁধ থেকে যেন হাজার মন ওজনের পাথরটা নেমে গেলো আজ নিম্মিকে দেখে। যাক বাবা, ছেলে স্থিতিশীল হয়েছে! তা না হলে মামুনকে দেখলে ওর নিজেকে গিল্টি মনে হতো। যাওয়ার আগে সুমনা ডাকলো মামুনকে-
“ভাইয়া, দেখলেন তো! আমার চাইতে ভালো কাউকে পেয়ে গেলেন? কতো লক্ষী একটা মেয়ে নিম্মি!”
“কেউ কারো জায়গা নিতে পারে না মোনা, আর কারে জন্য জীবনও থেমে থাকে না, তাই না! নিম্মি ওর মতো করে ভালো। তবে হ্যা, মেয়েটা বোঝে আমাকে। আশাকরি ওর সাথে বাকী জীবন খুব ভালো কাটবে আমার। ”
” অবশ্যই ভালো কাটবে ভাইয়া! আমি স্পেশাল দোয়া করবো আপনার জন্য।”
মামুন সুন্দর করে হাসলো সুমনার দিকে তাকিয়ে।
“তুমিও ভালো থেকো।”
মামুন চলে যেতেই আদি দৌড়ে এলো সুমনার কাছে-
“কি এতো কথা হচ্ছিল ফিসফিস করে শুনি?”
“তোকে বলবো কেন? ওসব আমাদের দু’জনার গোপন কথা।”
“বলবি না?”
আদি রাগে ফোঁস ফোঁস করে। তা দেখে সুমনা হেসে দিলো-
“এতো হিংসা কেন রে তোর? বিয়ে করেও ভয় যায়নি?”
আদি গভীর ভালোবাসা নিয়ে সুমনার দিকে তাকালো-
“যেখানে ভালোবাসা বেশি সেখানে ভয় বেশি রে, জেরি! বুঝিস না নাকি?”
সুমনা আদর করে আদির নাক টেনে দিয়ে বললো-
“খুব বুঝি! কিন্তু বিশ্বাস রাখাটাও জরুরি, তাই না?”
“ওটার কোনো কমনি নেই আর হবেও না কখনো। সু!”
আদির সু ডাকে সুমনা কেঁপে উঠলো একটু। এতো ভালোবাসা নিয়ে ডাকে ছেলেটা যে ডাক শুনলে গোটা শরীর যেন ঝাঁকুনি দিয়ে জেগে ওঠে। একটা মারামারি আর শত্রুতার সম্পর্কে কবে থেকে যে এতো ভালোবাসা জন্মালো কে জানে? সুমনা আদির ডাকে সারা দিয়ে তার বেশি গভীর ভালোবাসা নিয়ে জবাব দিলো –
“উমমম, বল।”
“ভালোবাসি তোকে অনেক অনেক বেশি।”
“আমিও তোর চেয়ে বেশি।”
সুমনা চোখ বুঁজে ভালোবাসার অনুভুতি অনুভব করছিলো তখনই জোরে সোরে চিমটি খেয়ে চোখ খুললো। দেখলো আদি দাঁত বের করে হাসছে আর ওকে ইশারা করলো চারপাশে তাকিয়ে দেখতে। সুমনা লজ্জা পেলো ভীষণ। এই ভরা বিয়ের মজলিসে সে প্রেমে মজেছিলো? আদির দিকে চোখ পাকিয়ে বিরবির করলো-
“আজ রাতে তোর খবর আছে। দেখে নিস?”
“খবর তো তোর আমি করবো, দেখি কি করে ঠেকাস?”
বলেই আদি চোখ টিপ দিলো সুমনার দিকে তাকিয়ে। সুমনা লজ্জায় মুখ ঘুড়িয়ে অন্যদিকে তাকালো। অন্য দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলো। সুমনা ছিলো আদির উল্টো ক্যারেকটার। অথচ আদির দুষ্টুমির জবাব দিতে যেয়ে ও নিজেও কখন যে আদির মতো দুষ্টু হয়ে গেছে টেরই পায়নি। অবশ্য তাতে তো কোনো ক্ষতি হয়নি কারোরই! বরং ভালোই হয়েছে। সুমনা আর আদি ভালোবেসে এক হয়েছে। দুজনার এক দুষ্টুমিষ্টি সংসার হতে যাচ্ছে যে সংসার আদি আর সুমনার মতো দুষ্টু বুদ্ধিতে ভরা বাচ্চাকাচ্চার কলকাকলীতে মুখরিত থাকবে। সুখী হোক আদি আর সুমনা, সুখী হোক ওদের সংসার জীবন।
সমাপ্ত।
©Farhana_Yesmin