#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-৬
ক্লাসে এসে চুপচাপ নিজের সিটে বসেছিলো সুমনা। এখন ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট এনালাইসিস ক্লাস হবে। সুমনার বেশ মজাই লাগে এই ক্লাসটা করতে। কারনটা অবশ্য স্যার! স্যার এতো সুন্দর মজা করে পড়া বুঝায় যে কঠিন জিনিসও সহজে বুঝে যায়। স্যারের নামটাও মজার, মোতাহার হোসেন। আজও যথারীতি নাম ডেকে স্যার লেকচার শুরু করবেন তখনই পেছনের দিকের সিটে তার নজর গেলো।
“আদি না? তুই এখানে কি করছিস?”
আদি কাচুমাচু মুখে উঠে দাঁড়ালো। স্যারের দিকে তাকিয়ে বললো-
“স্যার, আপনাকে মিস করছিলাম। আর তাছাড়া এই সাবজেক্টটা আমার ফেভারিট ছিলো, জানেন তো?”
“সে বুঝলাম! কিন্তু তোদের সাথে তো আমার ক্লাস আছেই, তাহলে মিস করার কথাটা মিথ্যে। এবার বলতো কি কারনে এসেছিস? কাকে জ্বালানোর প্ল্যান করেছিস?”
স্যার ভ্রু নাচালেন আদির দিকে তাকিয়ে।
“স্যার, আসলে যাচাই করতে এসেছিলাম যে সবকিছু আমার মনে আছে কিনা।”
“তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি আদি, তুই শুধু শুধু আমার এখানে আসিসনি!”
আদি কিছু না বলে একবার সুমনার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করলো। আদির তাকানো দেখে সুমনা মনেমনে রেগে বোম। জানে, ওকে জ্বালাতেই আদি এই ক্লাসে এসেছে। আদিকে উদ্দেশ্য করে খুব খারাপ ভাষায় দুটো গালি দিয়ে দিলো সুমনা নিচু স্বরে। পাশের মেয়েটা ওকে টোকা দিলো-
“তুমি কি কিছু বলছো আমাকে?”
সুমনা মাথা নাড়ে। আদি স্যারের প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেনা। তাই স্যার মুচকি হেসে আদিকে ক্লাস রুম থেকে বের করে দেয়। সুমনা মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচে। যাক বাবা! এখন তো বাঁচা গেল? ঐই শয়তান ছেলে কি না কি করবে কে জানে? আনমনে ব্যাগ থেকে খাতা বের করার জন্য ব্যাগে হাত ঢোকাতেই হাতের উপর কিছু একটা নড়ে উঠলো। সুমনা তাড়াতাড়ি হাত বের করতেই দেখলো হাতে একটা তেলাপোকা ঝুলছে। সুমনা আআআআআ করে চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত ঝাঁকি দিলো। সেই তেলাপোকা যেয়ে পড়লো আরেক মেয়ের গায়ে। সেও কোনো কিছু না বুঝে দিলো চিৎকার। তেলাপোকাটা ঝারতেই আরেকজনের গায়ে। পুরো ক্লাস জুড়ে তেলাপোকা উড়ে বেরাতে লাগলো। শেষে এক ছাত্র তেলাপোকাটা ধরে পায়ের নিচে পিষে মারলো। ক্লাসে একটা হুলুস্থুল পরে গেছিলো। সেটা ঠান্ডা হতেই স্যার সুমনাকে কষে ধমক দিলেন। এতো বড় হয়েও কেন বাচ্চাদের মতো আচরণ করলো সুমনা? সুমনা সায়েন্স এর স্টুডেন্ট, সে কেন তেলাপোকা ভয় পাবে? স্যার বারকয়েক আফসোসের শব্দ করলো। বাকি ক্লাসের ছেলেমেয়েরা হাসছিলো মিটিমিটি সুমনার দিকে তাকিয়ে।
সুমনা জানে এ কাজ কে করেছে। তার ব্যাগে তেলাপোকা কে রেখেছে। সুমনার ইচ্ছে হলো একবার বলে, স্যার এ কাজ আপনার প্রানপ্রিয় ছাত্র আদির। সে আগেও বদ ছিলো এখনো আছে। আমার সাধের চুলগুলো নষ্ট করেও ওর বদমায়েশি কমেনি। এখন আবার আমার পিছনে লেগেছে। কেন? আমার পরিচয় বের করার জন্য। আরে বাবা! আমাকে দিয়ে তোর কি কাজ? তুই নিজের মতো থাক আমাকেও থাকতে দে। এতো কেন চুলকানি তোর আমাকে নিয়ে? আমাকে কি এখানেও শান্তি মতো পড়তে দিবি না নাকি? সুমনা নিজের মনে বিরবির করে।
*******
সকালের দিকে সুমনাদের ক্লাস থেকে চিৎকার চেচামেচি শুনে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ মন ভরে হাসছিল আদি। এখন ক্লাস শেষে বেড়িয়ে আবার সুমনাকে ধরার প্লান ছিলো। মাঝে মামুন এসে বাগরা দিলো-
“দোস্ত, তোর সাথে কথা আছে।”
“বলে ফেল।”
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে আদি।
“আমার না ঐ মেয়েটাকে খুব পচ্ছন্দ হইছে?”
“কোন মেয়ে?”
আদির হাত থেমে গেলো। সে অবাক হয়ে মামুনের দিকে তাকালো।
“ঐই যে, সেদিন তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম না?”
আদির মুখ হা হয়ে গেলো, সে হা মুখ নিয়ে মামুনের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেও, মনে মনে
আদির ইচ্ছে হলো এক ঘুষি দিয়ে মামুনের নাকটা ফাটিয়ে দিতে। কত্তোবড় সাহস ওর, ও সুমনার দিকে নজর দেয়? ও জানেনা! সুমনা কে? পরক্ষণেই আদি মনে মনে নিজেকে গালি দেয়। সে কেন এতো উত্তেজিত? নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলো-
“আচ্ছা! সুমনা কে? আর মামুন কিভাবে জানবে সুমনার ব্যাপার?”
“দোস্ত! কি হইছে তোর? এমন স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন? কি হইছে রে? আমি কি ভুল কিছু বলে ফেলেছি?”
মামুন আদিকে ধরে ঝাকি দিলো। আদি তাড়াতাড়ি করে নিজের হা করা মুখটা বন্ধ করলো। সে আবার নিজের ব্যাগ গোছানোতে মন দিলো। মনেমনে গুছিয়ে নিচ্ছে মামুনকে কি বলবে।
“আদি, কিছুতো বল?”
“কি বলবো? তোর জীবন তোর ইচ্ছা, এখানে আমার বলাতে কি আসে যায়?”
“তবুও?”
“আচ্ছা, জানতে যখন চাইছিস তাহলে বলি, কি বলিস?”
“হ্যা বল না?”
উৎসাহী হলো মামুন।
“দেখ দোস্ত! এইসব ব্যাপারে এরকম হুটহাট ডিসিশন নিতে হয় না। আর তাছাড়া, ঐই মেয়ে নাকি তোকে নাচিয়ে ছেড়েছে? তুই কেন ওকে নিয়ে ভাবছিস? ও তো সারাজীবন তোকে নিজের ইশারায় নাচাবে?”
“দোস্ত! এই রকম একটা আগুন টাইপ মেয়ের সাথে সারাজীবন নাচতেও মজা লাগবে!”
“এটা তুই কি বললি! এটা কোন পুরুষ মানুষের মতো কথা বলছিস? তুই এতো ভালো সাবজেক্ট এ পড়িস, ভবিষ্যতে না জানি কত ভালো চাকরি করবি? তুই কেন আগে থেকেই একটা মেয়ের সাথে নাচার জন্য রেডি থাকবি? ছি ছি, এরকম ম্যান্দা মারা নাকি নাকি হাফ লেডিস চিন্তা তোর? আগে জানতাম না, জানলে…”
খেঁকিয়ে ওঠে আদি। মামুন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খায়। খুব একটা অপরাধী মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই দেখে আদি মুখ নিচু করে একটু হেঁসে নেয়। মামুন অসহায় মুখ করে বলে-
“কিন্তু আমার যে ওকে ভালো লেগে গেছে?”
“ভালো লেগে গেছে মানে কি? ওকে ছাড়া বাঁচবি না নাকি? ও মাই আল্লাহ! মামুন, তোকে আমি কি ভেবেছিলাম আর তুই কি বেরুলি?”
“দোস্ত! এভাবে বলছিস কেন?”
“তো কিভাবে বলবো? মামুন! ইউ নটি বয়, কেন তোমার ওকেই পচ্ছন্দ হলো? দুনিয়ায় আর কোনো মেয়ে কি নেই?”
মেয়েদের মতো নাকি সুরে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলে আদি। মামুন আদির দিকে তাকালো অবাক চোখে-
“এভাবে মেয়েদের মতো কথা বলছিস কেন, আদি?”
“ভালোভাবেই বলছি! তোর সাথে কথা বলতে আমার আপাতত একটুও ভালো লাগছে না। আমি গেলাম। ”
আদি গটগট করে হেঁটে বেড়িয়ে এলো। পেছনে বিস্মিত মামুন ভাবছে, এই ছেলের আবার কি হলো, এতো রেগে গেলো কেন?
আদি গেলো ফাস্ট ইয়ারের ক্লাস রুমের দিকে। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে সে, এই সুমনার সাথে একটা ফয়সালা করতেই হবে। ভার্সিটিতে আসতে না আসতেই সবার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে কেন সে?
ফাস্ট ইয়ারের ক্লাসরুম ফাঁকা। দু চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। এরমধ্যে দু-তিনটে ছেলে মেয়ে গোল হয়ে বসে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছিলো। আদি সেদিকে এগিয়ে গেলো –
“তোমাদের ক্লাস শেষ?”
আদিকে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে গেলো, আফটারঅল আদি সিনিয়র ব্যাচ। একটা মেয়ে জবাব দিলো-
“জ্বী, ভাইয়া?”
“সুমনাকে কোথায় পাওয়া যাবে?”
“সুমনা?”
তিনজনই একসাথে বলে ওঠে। আদি মাথা চুলকায়। এরা তো মনেহয় সুমনা নামে চিনবে না? কি যেন নাম বলেছিলো সেদিন? কি যেন! কি যেন! মাথা চুলকে সুমনার ভালো নাম মনে করার চেষ্টা করে আদি। হঠাৎ মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, মনে পরেছে। ও চট করে মেয়েটাকে বলে-
“আজরা জাবিন।”
“ওহ, ককরোচ গার্ল?”
“ওর নাম ককরোচ নাকি?”
আদি অবাক হলো। বাহ! একদিনেই এতো বিখ্যাত?
“আজই তো ককরোচ নিয়ে হইচই হলো, তখনই ওর এই নাম দিলাম আমরা। ও তো একটু আগে বেরুলো। বাসায় চলে গেছে হয়তো আর না হলে ওয়াশরুম গেছে। ও বাড়ি যাওয়ার আগে একবার অবশ্যই ওয়াশরুম যায়। এটা ওর রুটিন।”
“কেন? ওর কি ডায়াবেটিস আছে নাকি?”
আদির কথা শুনে ওরা খিলখিল করে হেঁসে উঠলো।
“তা তো জানিনা,ভাইয়া? জিজ্ঞেস করা হয়নি।”
“ওকে থ্যাংস।”
আদি রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। মেয়েদের ওয়াসরুমে তো যাওয়া যাবে না। কাউকে দিয়ে খবর নিতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে একবার ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। সাড়ে তিনটে বাজে, এইসময়টা ক্যাম্পাস খুব ঝিমিয়ে থাকে। মেয়েদের ওয়াশরুমের কাছে এসে কিছুক্ষন আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকলো আদি। মেয়েরা বেরুচ্ছে ঢুকছে,কিন্তু সংখ্যায় কম। বেশিরভাগই পরিচিত মুখ। অপরিচিত এক মেয়ে ঢোকার সময় ডাকলো আদি-
“আপু কোন ইয়ার?”
“ফাস্ট ইয়ার।”
খুশিতে আদি বাকবাকুম হয়ে গেলো।
“আপু, একটা কাজ করে দিতে পারবে?”
“জ্বী ভাইয়া, বলুন?”
“তুমি একটু খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাও তো, আজরা জাবিন নামে ওয়াশরুমে কেউ আছে কিনা? আমার কথা আবার কিছু বলো না,কেমন? এমনিতেই জাস্ট নাম জিজ্ঞেস করবে, পেলে আমাকে বলবে।”
“ঠিক আছে।”
মিনিট পাঁচেক পর মেয়েটা বেরিয়ে যাওয়ার সময় খবর দিলো-
“না ভাইয়া, ভেতরে কেউ নেই। ”
“ওহ,ঠিক আছে। থ্যাংকু আপু।”
মেয়েটা হেঁসে চলে গেলো। আদির রাগ লাগলো, আজও ধরা গেলো না মেয়েটাকে? ভাবতে ভাবতেই সামনে তাকিয়ে দেখলো সুমনা হেলতে দুলতে হেঁটে আসছে ওয়াশরুমের দিকে। আদি ওকে দেখে পিলারের আড়ালে লুকালো। লুকিয়েই দেখলো সুমনা ওয়াশরুমে ঢুকছে। আদি কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে মাথায় নিজের প্ল্যান সাজিয়ে নিলো। বিরবির করে বললো-
“আজ তোমাকে খাঁচায় ভরেই ছাড়বো পাখি! দেখি তুমি কিভাবে পার পাও? আজ নিজের পরিচয় তোমাকে দিতেই হবে!”
চলবে—–
©Farhana_Yesmin