শ্রেয়সী লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা পর্বঃ৩৬

0
304

শ্রেয়সী
লেখাঃখাইরুন নেছা রিপা
পর্বঃ৩৬

শিশির চিন্তিত মুখে হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারি করছে। মনটা কেন যেন চাইলেও স্থির রাখতে পারছে না। বারবার ঘুরে ফিরে নানা কুচিন্তা মাথায় আসছে। একটা বাচ্চাকে পৃথিবীতে আনার জন্য বিন্দুকে কতই না সাফার করতে হয়েছে, কত অপমান, কত লুকোচুরি কত কিই না করে শেষমেশ একটা বাচ্চার স্বপ্ন দেখে দু’জন মানুষ। কারো স্বপ্ন আড়ালে রয়ে যায় আর কারোরটা পূর্ণ হয়ে গিয়েও কতশত বাঁধা অতিক্রম করতে হয়। ভাবতে ভাবতেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো শিশির। তখনই দেখা মিললো সাজেদা বেগম আর সাহেদ আলীর।
–কী অবস্থা শিশির? কী হয়েছে বিন্দুর?”
শিশিরের মুখটা একদম ছোট হয়ে আছে। বেশ মায়া লাগলো সাজেদা বেগমের। একটু কাছে এসেই নরম গলায় বললো,
–মন খারাপ করো না। বল কী হয়েছে?”
–মা বিন্দু ওটিতে আছে। ওর সিজার হচ্ছে। ”
–কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কেন?”
শিশির সবটা খুলে বললো। সব শুনে সাজেদা বেগম চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে বললেন,
–মেয়েটার কপালে বোধহয় সুখ আর রইলো না।”
সাজেদা বেগমের এই কথাটায় শিশির যেন আরও ভেঙে পড়লো। নিজেকে আজ খুব অযোগ্য মনে হচ্ছে বিন্দুর। কেন সে পাড়লো না আর একটু যত্নবান হতে? তাহলে তো আজ এত বড় অঘটনটাই ঘটতো না। শিশির আর কোনো কথাই বলতে পারলো না। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মনে একটা খটকা লাগলো সাজেদা বেগম মেয়েকে শিশিরের কাছে বিয়ে দিয়ে আজ কী পস্তাচ্ছেন! শিশিরের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম! এই মুহূর্তে আর বেশি কিছু ভাবতে পারছে না।

অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অপারেশন সাকসেসফুল হলো। বিন্দু একটা প্রিম্যাচিউর বেবী জন্ম দেয়। বিন্দুকে বেডে শিফট করানো হয় আর বেবীকে রাখা হয় আইসিইউ তে একটা কাঁচের ভেতর তুলোর মধ্যে। শিরিনা বেগমকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো। শিশির কিছু কেনার জন্য কেয়ক মিনিটের জন্য বাহিরে বের হলো আপাতত ডিম, কলা আরও কয়েক পদের ফল নিয়ে ফিরে এলো। বিন্দু আপতত কিছুই খেতে পারবে না। ওর স্যালাইন চলছে। শিশির এসে ওর মাকে সবকিছু দিয়ে খেতে বলে নিলো। এরপর একজন নার্সের মাধ্যমে আই সি ইউ তে গেল৷ একটা সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু। অন্যান্য বাচ্চাদের মতো পরিপক্কতা আসেনি৷ চোখগুলো এখনো ভালোভাবে ফুটেনি৷ আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কাঁচের ভেতর পুরো শরীরটাই তুলো দ্বারা আবৃত্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো শিশিরের বুক চিঁড়ে । ভাগ্য এ কোন খেলায় মেতেছে তাকে নিয়ে। হতাশ হয়ে ফিরে গেল ডাক্তারের চেম্বারে।
–ডাক্তার বাবীর কী অবস্থা? ”
–দেখুন বেবীর অবস্থা আশংকা জনক। এখনো চোখ ফুটেনি৷ এছাড়াও তেমন বেশি পরিপক্কতা আসেনি। আধেও বাঁচবে বলে মনে হয় না। তবে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। যদিও বাঁচে তবে সুস্থ হতে সময় লাগবে।”

ডাক্তারের বলা কথাগুলো তে যেন শিশির ভরসা হারিয়ে ফেললো। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হৃদয়জুড়ে ভাংচুর হতে লাগলো। কী থেকে কী হয়ে গেলো। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। আজ কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে। সবাই তাকে ভুল বুঝছে। তখনকার সাজেদা বেগমের কথাগুলোও কড়া নাড়তে লাগলো। কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছেন তিনি! সেই থেকে ভয়টা আরও ঝেঁকে বসেছে। আর বেবীর কিছু হয়ে গেলে যদি ওনারা অন্য কিছু ভাবেন! ক্রমে ক্রমেই সব আশা যেন ভেঙেচুরে যাচ্ছে শিশিরের। শেষ রক্ষা বোধহয় আর হবে না!

শিশির বিন্দুর কেবিনে ঢুকলো। বিন্দু যেন এতক্ষণ শিশিরকে দেখার জন্যই ছটফট করছিলো। শিশির এগিয়ে গিয়ে কাছে বসতেই অভিমানের সুর বাজলো শিশিরের কানে!
–এতক্ষণে আপনার আসার সময় হলো?”
সাজেদা বেগম ওদের একটু প্রাইভেসি দেওয়ার জন্য কেবিন ত্যাগ করলেন।

শিশির বিন্দুর বাঁ-হাতটা নিজের মুঠোয় পুরে নিলো। আলতো করে তাতে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো,
–একটু বাবুর কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের একটা মিষ্টি মেয়ে হয়েছে বিন্দু। ”
বিন্দুর চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। শিশির মুগ্ধ হয়ে বিন্দুর হাসি দেখলো। একটু ঝুঁকে বিন্দুর কপালে চুমু খেল। বিন্দু হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললো,
–ওকে একটু নিয়ে আসুন না আমি একটু দেখবো।”
মুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে গেল শিশিরের। এখন কী বলবে বিন্দুকে! আমতা আমতা করে বললো,
–বাবু অসুস্থ ওর ট্রিটমেন্ট চলছে।”
কথাটা শুনেই মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল বিন্দুর। শিশির দেখতে পেলো বিন্দুর চোখের কোণ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। শিশিরের খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো।
–সব আমার দোষ। কেন যে সেদিন না দেখেই দরজা খুলেছিলাম। তাহলে আজ অন্তত আমার বাবুটা সুস্থ থাকতো।”
বলতে বলতেই বিন্দু জোরে কেঁদে ফেললো।
–প্লিজ বিন্দু তোমার এখন এভাবে কাঁদা ঠিক না। সেলাইয়ের জায়গায় সমস্যা হবে৷ ”
শিশির চোখের জল মুছে দিলো। এর মধ্যেই সবাই এসে কেবিনে প্রবেশ করলো। শিশির সবাইকে দেখে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে আসলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে রিদিও সেখানে এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু কেউই রিদিকে পাত্তা দিলো না। বরং রিদিই সবাইকে আগ বাড়িয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলো। শিরিনা বেগম তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসলেন রান্না করে নিয়ে যেতে হবে তাই। শিশির,সাজেদা বেগম হসপিটালেই রয়ে গেল। রিদিও শিরিনা বেগমের সাথে চলে গেল। রিদি অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করলো কিন্তু শিরিনা বেগম একটা উত্তরও দিলো না।বাড়িতে এসেই রিদি চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
–সমস্যা কী তোমার?কথা বলছো না কেন আমার সাথে?”
শিরিনা বেগমও তেড়ে গিয়ে বললেন,
–একদম চোটপাট করবি না। কী কথা বলতাম তোর সাথে?কোন আক্কেলে জিজ্ঞেস করিস বাবু কেমন আছে?তোর কী একটুও দয়া-মায়া আছে কারো প্রতি। তোর তো খালি পতি ভক্তি। থাক না তোর পতি মহাশয়কে নিয়ে অন্যদের কথা জেনে তোর কী হবে? কে মরলো, কে বাঁচলো তাতে তো তোর কিচ্ছু যায় আসে না। তোর তো খালি সোহেল হলেই চলবে। আর কাউকে দরকার নাই তোর৷ বাচ্চাটা প্রিম্যাচিউর হয়েছে। ডাক্তার ভরসাও দিতে পারছেন না। বাঁচবে না মরবে। শিশিরের দিকে তাকাতে পারছি না আমি৷ বিন্দুর অবস্থাও তেমন একটা ভালো না। অবশ্য তোকে এসব বলেও কোনো লাভ নেই। তোর তো এসব মিথ্যা মনে হয়।”
বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন শিরিনা বেগম। রিদি গম্ভীর স্বরে বললো,
–আজ যেটা হয়েছে তার জন্য আমার কী দোষ? আমি কী জানতাম ওই শয়তানটা এমন কিছু করবে?”
–না জানতি না তুই। কিন্তু সেদিন তো দিব্যি সাপোর্ট করেছিলি। ”
–মানছি ভুল হয়েছে তাই বলে এভাবে দোষ দিও না। আমি কখনোই এত খারাপ কিছু হবে ভাবিনি৷ আমি ওকে ডিভোর্স দেব মা।”
–তোর যা ইচ্ছা কর। আমি আর এসব নিয়ে কিছু বলবো না।”

শিশির সাজেদা বেগমকে বিন্দুর কাছে রেখেই থানায় চলে গেল। থানার অফিসারকে সবটা বলতেই উনি কেস ফাইল করতে বললেন। আর শিশির সেই মতো কাজ করলো। অফিসার আশ্বাস দিলেন এরেস্ট ওয়ারেন্ট তৈরি করেই
সোহেলকে ধরে আনবে। তারপর ওর যা শাস্তি হওয়ার হবে। শিশির বিরস মুখে থানা থেকে বেরিয়ে আসলো। ঘড়িতে প্রায় দু’টো বাজে। মনটা প্রচন্ড অস্থির হয়ে আছে। কোনো কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছে না। যদি সোহেলকে এই মুহূর্তে হাতের কাছে পেত তাহলে হয়তো ইচ্ছামতো পিটিয়ে নিজের জ্বালা মিটিয়ে নিতো। কিন্তু সেটাও পারছে না। একটা ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ালো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

চলবে,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here