#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ১৫
আজ দুইদিন হয়ে গেছে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে বিন্দু। এখন আর চিৎকার করে কাঁদে না। তবে গালের দু’পাশের শুকনো পানির রেখাও মিলিয়ে যায় না। সবসময় আদ্রই থেকে যায়। শিহাবের সাথে কাটানো সেইদিনের ঘনিষ্ট মুহূর্তগুলো সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় বিন্দুকে। শিহাবের করা সেদিনের প্রতিটা স্পর্শের কথা মনে পরতেই হৃদয়ে এক প্রগাঢ় ভাংচুর শুরু হয় বিন্দুর। আগে এই স্মৃতিগুলো খারাপ লাগতো এখন বিন্দুর কাছে মনে হয় শিহাবের থেকে পাওয়া এই ভালোবাসার স্মৃতিগুলোই বিন্দুকে নতুন করে বাঁচতে শেখাবে। এই ভালোবাসার স্মৃতিগুলো বিন্দুর পথ চলার সঙ্গী। বিন্দু নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে। সমাজ যদি তাকে চরিত্রহীনার তকমা লাগিয়ে দেয় তবুও বিন্দু একচুল পরিমানও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়বে না। প্রয়োজনে পৃথিবীর বিরুদ্ধে গিয়ে হয়েও তার মাঝের ছোট্ট প্রাণটাকে এই পৃথিবীতে আনবেই আনবে। লাগুক তাতে তার গায়ে কলঙ্কের কালিমা। তবুও সে এই কলঙ্কের ফুলকে জন্ম দেবেই। কিছুতেই শিহাবের শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলবে না। এটা যে তাদের ভালোবাসার বড় সাক্ষী। সারাজীবন শিহাবের ভালোবাসার চিহ্ন হয়েই না হয় থাকবে বিন্দুর জীবনে।
বিন্দু পা দু’টো ভাজ করে তার ওপর থুতুনি রেখে দুই হাত দিয়ে পা দু’টো জড়িয়ে ধরে খাটের মাঝখানে বসে আছে। মৃদু চোখের নোনা পানিতে স্যালোয়ারের অনেকখানি ভিজে গেছে। কারো রুমে প্রবেশ করার শব্দ পেতেই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ফললো। বিধু এসে পাশে বসলো।
–আপু।”
–হু।”
–তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”
–কেন?”
–মা তোকে নিয়ে হসপিটালে যাবে।”
–হসপিটালে কেন?”
বিধু থমথমে গলায় বললো,
–বাচ্চাটা এবরোশন করাতে হবে।”
বিধুর কথা শুনতেই আতংকে চোখ – মুখ কালো হয়ে গেল বিন্দুর। অস্বাভাবিক গলায় বললো,
–অসম্ভব। আমি কিছুতেই এ কাজ করতে পারবো না। তোরা আমাকে জোর করিস না। আল্লাহর দোহাই লাগে।”
–আপু তুই পাগল হয়ে গেছিস? একজন বাবা ছাড়া কী করে তুই এই বাচ্চার জন্ম দিবি। তাছাড়া প্রতিবেশিরা এখনো কেউই কিছু জানে না। কয়কেকদিন পর যখন তোর পেট ফুলতে থাকবে তখনই তো সবাই বাজে মন্তব্য করতে শুরু করে দিবে। তোর বাচ্চাকে সবাই অবৈধ বলবে। তোকে কলঙ্কিনী বলবে। এসব শুনতে তোর ভালো লাগবে?”
–আমি শিহাবের শেষ স্মৃতিটুকু ধরে রাখার জন্য সব করতে পারবো। মা যদি আমাকো বাড়িতে না রাখতে পারে। তাহলে বল আমি চলে যাই। প্রয়োজনে ভিক্ষা করে খাবো। তবুও আমি আমার বাচ্চাকে মারতে পারবো না।
দরজার ওপাশ থেকে সবটাই শুনলেন সাজেদা বেগম। মেয়ের কথা শুনে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেছে ওনার। হনহন করে রুমে এসেই ঠাটিয়ে এক চড় বসিয়ে দিলেন বিন্দুর গালে।
–ওনার বাচ্চা। এটা বাচ্চা না এটা পাপ, বুজলি। এটা হলো পাপ।
বিন্দু সাজেদা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে আহাজারি করে বলতে লাগলো,
–মা আমাকে ক্ষমা করো। প্লিজ মা তবুও আমার বাচ্চাটাকে মেরো না। আমি ওকে হারাতে চাই না। ও আমার শিহাবের শেষ স্মৃতি। এই স্মৃতুটুকু নিয়ে আমাকে বাঁচতে দাও।”
–চুপ একদম চুপ। আর একটা কথাও তুই বলবি মা। লজ্জা করে না পাপ করে আবার মুখে মুখে এত বুলি ছাড়োস। আমি তো হলে এতদিনে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পরতাম। তুই মরতেও পারিস না। তোর জন্য আল্লাহ মরণ রাখে নাই। এত ভালো মানুষ মারা যায় তোকে কেন বাঁচিয়ে রাখছে আল্লাহ। উনি ভিক্ষা করে খাবেন। কাকে শুনাচ্ছিস এসব তুই। তোরটা কেউ খায় না পরে। একবার বাহিরে পা দিয়ে দেখ এত সোজা না। শিয়াল, কুকুরে চিঁড়ে খাবে। এক টাকা উপার্জন করতে কত কষ্ট সেটা আপনি বুঝবেন কিভাবে। আছেন তো রাজার হালতে। বাপে ওইদিকে খাইট্টা মরে আর মাইয়্যা বিয়ার আগেই বাচ্চার জন্ম দেয় আবার কী সুন্দর বাণী দেয়। তোর যে একটা ছোট বোন আছে সেদিকে কোনো খেয়াল আছে। ওর মুখে সবাই থু থু দিবে। বলবে বিধুর বড় বোন কুকর্ম করে পেট বাজাইছে বিধুও সেইরকম হইবো। যার বোন তার মতোই তো হইবো। তুই কী চাস তোর জন্য বিধুও এসব সহ্য করুক। সবাই তোর বাবাকে আঙুল দেখিয়ে বলুক সাহেদ আলীর মাইয়্যা বিয়ার আগেই পোয়াতি। আমার কথা তো বাদই দিলাম। আমার মতো তো খারাপ মা হয় না। যদি ভালো মাই হইতাম তাহলে নিজের মেয়েকে ভালো বানাতে পারতাম। আমার তো পোড়া কপাল নিজেই ভালো না মেয়ে আবার কিভাবে ভালো বানামু।
কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন সাজেদা বেগম। বিন্দু আর কোনো টু-শব্দটিও করলো না গায়ে বোরকা জড়িয়ে নিয়ে মায়ের পিছু পিছু চললো বাচ্চাটাকে চিরতরে বিদায় দেওয়ার জন্য।
হঠাৎই শিশিরের ফোনে কল আসতেই হন্তদন্ত হয়ে ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে গেল শিশির। সহসাই প্রিন্সিপাল স্যারের সামনে পরলো। কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। একে তো দেরী হয়ে গেছে এখন আবার কতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৈফিয়ত দিতে হবে।
–কী ব্যাপার শিশির কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
–স্যার আমার এক আত্মীয়ের ক্রিটিকাল অবস্থা আমাকে এক্ষুণি হসপিটালে যেতে হবে।”
–কিন্তু তোমার ক্লাস?”
–স্যার আমি এক স্যারকে আমার ক্লাসে রেখে এসেছি।”
–ওহ্।”
শিশির প্রিন্সিপাল স্যারকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাইক নিয়ে তাড়াতাড়ি স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। প্রিন্সিপাল স্যার একটু বেশিই অবাক হলেন। শিশিরের এই আচরণ একটু বেশিই অস্বাভাবিক লেগেছে ওনার কাছে।
বিন্দু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটা পাঁচ-ছমাসের বয়সী বাচ্চার দিকে। সাজেদা বেগম ভেতরের রুমে এক নার্সের সাথে কথা বলছেন। আর বিন্দু বাহিরে একটা টুলে বসে আছে। বাচ্চাটা বারবার কী মিষ্টি করে হাসছে। আর খালি ঝাপাঝাপি করছে কোল থেকে নামার জন্য। বাধ্য হয়ে মহিলা মেয়েকে নামিয়ে দিলেন। বাচ্চাটা হাপুর করে এসে বিন্দুর বোরকাটা ধরে উঠে দাঁড়ালো। ঠোঁটে লেগে আছে বাচ্চাটার প্রশান্তির হাসি। এতক্ষণ যেন বিন্দুর কাছে আসার জন্যই এমন ঝাপাঝাপি করেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই বিন্দু ভুল প্রমাণ হলো। বাবুটা এসেছে বিন্দুর হাতে একটা বিভিন্ন কালারের পুতির ব্যাগ। আর সেটা ধরার জন্যই এমন করে ছুটে এসেছে। এসেই ব্যাগটা ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। বিন্দু ব্যাগটা দিতেই বাবুটা ব্যাগাটা দু’হাত দিয়ে ধরে মুখের মধ্যে দিয়ে কামড়াতে লাগলো। সবে দুইটা দাঁত উঠেছে। বিন্দু এক ঝটকায় কোলে তুলে নিয়ে বাবুটাকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। বাবুটার মা এসে ওমনি এক ঝটকায় বিন্দুর থেকে বাবুটাকে নিয়ে চলে গেল। বিন্দু বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো বাচ্চাটার দিকে। কী এমন করলো যে এভাবে টেনে নিয়ে গেল। হয়তো ভেবেছে বিন্দু কোনো ছেলে ধরা। ভাবতেই আনমনে হেসে উঠলো বিন্দু। হঠাৎই বিন্দুর চোখ আটকে গেল শিশিরকে এমন হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে। শিশির এসেই বিন্দুকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
–আন্টি কোথায়?”
–মা এই তো সামনের রুমে।”
শিশির বিন্দুর দেখানো রুমে হনহন করে চলে গেল। সাজদো বেগমকে কিছু না বলেই হাত ধরে টেনে সেখান থেকে বাহিরে বের করে নিয়ে আসলো।
–শিশির তুমি এখন এখানে?”
–স্যরি আন্টি আপনার হাত ধরলাম। ক্ষমা করবেন আমাকে।”
–আরেহ না না। তা তুমি এখানে কেন?”
–আপনার সাথে আমার কথা আছে আগে বাড়ি চলুন।”
–কিন্তু আমি তো এখানে একটা কাজে এসেছি। কাজটা শেষ করেই বাড়ি ফিরবো।”
–না পরে কাজ করবেন আমার কথা আগে শুনবেন তারপর না হয় যা করার করবেন। এখন আগে বাড়ি চলুন।”
একপ্রকার জোর করেই দু’জনকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে শিশিরও পিছু পিছু বাইক নিয়ে আসতে লাগলো। মনে মনে আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া আদায় করছে বিন্দু। যাক এবরোশনটা তো হলো না। সেই সাথে শিশিরকেও ধন্যবাদ জানালো মনে মনে।
সাজেদা বেগম খাটের ওপর বসে আছেন। তার ঠিক সামনা সামনি একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে শিশির। কীভাবে কথাগুলো শুরু করবে সাজিয়ে উঠতে পারছে না আজ। সবসময় খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারলেও আজ যেন সব কথাগুলো অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে যতবারই গুছিয়ে নিচ্ছে ততবারই প্রথম থেকে স্মরণ করতে গেলে সব যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। সাজেদা বেগম শিশিরের এমন নার্ভাস ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে বললেন,
–শিশির যা বলার বলে ফেল। ”
শিশির একটু অপ্রশস্ত হাসি দিয়ে বললো,
–না মানে, ইয়ে মানে। আসলে…
–হুম আসলটাই বলো। একটু তাড়াতাড়ি করো।”
–আন্টি আমি সবদিকে ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর সেটা হলো আমি বিন্দুকে আমার জীবন সঙ্গী করতে চাই। হয়তো ভাববেন যে আমি কোন সাহসে বললাম। আপনাদের পজিশন কোথায় আর আমার পজিশন কোথায়। তবুও আন্টি আমি আপনাকে এতটুকু আশ্বাস দিতে পারি, বিন্দুকে আমি সব সুখ দিয়ে ভরিয়ে দিব। কখনো ওর জীবনে দুঃখের ছাঁয়া পরতে দেব না। হয়তো বেশি খেতে দিতে পারবো না, বেশি ভালো পরতে দিতে পারবো না তবে অনেক ভালোবাসা পারবো আমি।
এক দমে কথা গুলো বলে থামলো শিশির। ভয়ে পুরো শরীর কাঁপছে শিশিরের। কপালের মাঝ বারবার ঘেমে উঠেছে। যদি সাজেদা বেগম না বলে দেন তাহলে কী হবে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো শিশির। সব যেন ভালোয় ভালোয় হয়ে যায়।
–সব ভেবে বলছো তো তুমি?”
এ পর্যায়ে শিশির এক পলক তাকালো সাজেদা বেগমের দিকে। দ্রুত চোখ নিচু করে বললো,
–হ্যাঁ, আন্টি।”
–পারবে অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান বলে পরিচয় দিতে?”
–হ্যাঁ আন্টি আমি সব পারবো।”
–কেন পারবে? বিন্দু তো আহামরী সুন্দরও নয় তাছাড়া কত বড় একটা দুর্ঘটনা ওর জীবনে ঘটে গেছে। তবুও কিসের আশায় তুমি সব কিছু পারবে?”
শিশির শুধু আস্তে করে বললো,
–‘ভালোবাসি’। খুব ভালোবাসি ওকে। ওর কোনো কিছু দেখে আমি ওকে ভালোবাসিনি। শুধু ও মানুষটা কেমন সেটা দেখেই আমি ভালোবেসে ফেলেছি। ভুলতো মানুষ মাত্রই হয়। আর এখন যে এজ এতে এই ভুলগুলো হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। এখন যদি এই ভুলটা ধরে সেই মানুষটাকে সারাক্ষণ কষ্ট দেই তাহলে সে তো আরেকটা ভুল করতে দ্বিতীয়বার ভাববে না। তাই আমি মনে করি যে ভুলটা করে ফেলেছে সেটাকে শুধরে নিয়ে নতুন কোনো ভুল যেন না হয় সেই দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। মানুষটাকে অবহেলা না করে তাকে একটু ভালোবাসা দেওয়া,একটু যত্ন করা।”
এতক্ষণে লজ্জা লাগলেও এখন নিজের মনের কথাগুলো সাজেদা বেগমকে বলতে একটুও লজ্জা লাগছে না শিশিরের। বরং মনের লুকোনো কথাগুলো শেয়ার করতে পেরে ভালোই লাগছে।
–এতই যদি ভালোবাসো তাহলে আগেই বলতে ওকে নিজের ভালোবাসার কথা।”
শিশির তড়িৎ হেসে বললো,
–আমার বন্ধু যাকে এত ভালোবাসে সেখানে কী করে নিজের ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করবো।”
সাজেদা বেগমের যা বোঝার তা বুঝা হয়ে গেল। শিশির যেন ওনাদের জীবনে কোনো দেবদূত হয়ে এসেছে। তাদের মেয়ের জীবনটাকে নতুন করে রাঙিয়ে দিতে নতুন কারো আগমন ঘটেছে। মনে মনে এক গাঢ় প্রশান্তি অনুভব করছেন সাজেদা বেগম। এমন একটা ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারলেই তিনি নিশ্চিন্ত। এই ছেলে ঠিক একদিন তার ভালোবাসা দিয়ে বিন্দুর মন জয় করবেই করবে এই বিশ্বাস মনের মধ্যে গেঁথে গেছে সাজেদা বেগমের। মনের কথাগুলো মুখে না প্রকাশ করে স্বাভাবিক ভঙিতে বললেন,
–তাহলে তোমার পরিবারকে বলে দেখ। তারা কী বলে।”
–আন্টি আপনি যদি বলেন তাহলে কালকেই আমি মা’কে আসতে বলি। আমি চাইছি বিয়েটা তাড়াতাড়িই হয়ে যাক।”
–আমিও তাই চাই।”
কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবে না। আর যারা কমেন্ট করতে কিপ্টামি করে তাদের বলছি এরপর থেকে আমিও গল্প দিতে কিপ্টামি করবো।😐
চলবে,,,,