শ্রেয়সী #লেখাঃKhyrun Nesa Ripa #পর্বঃ৩

0
667

#শ্রেয়সী
#লেখাঃKhyrun Nesa Ripa
#পর্বঃ৩

ভয়ে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে বিন্দুর। শরীর পুরো ঘেমে-নেয়ে একাকার। চোখজোড়া যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে।
সামনে রক্তচক্ষু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সাজেদা বেগম। বিন্দু কোনো রকম ঢোক গিলে তোতলাতে তোতলাতে বললো,
–ম….ম…মা তুমি?”
–হু আমি। এত তোতলানোর কী আছে? আর এত রাতে তুই ছাঁদে দাঁড়িয়ে কী করছিস?”
সাজেদা বেগমের কণ্ঠে স্পষ্ট রাগ বুঝা যাচ্ছে। তবুও একটু শান্তি লাগছে ভেবে যে সাজেদা বেগম ফোনালাপের কিছুই শুনতে পাননি। এই সুযগটা কাজে লাগতে এক বিন্দুও দেরী করলো না সে। ওমনি কয়েক লাইন কথা সাজিয়ে নিয়ে পটপট করে বলতে শুরু করে দিলো,
–কী করবে মাথাব্যথায় মাথা ছিড়ে যাচ্ছিলো কোনোভাবেই ঘুমাতে পারছিলাম না। বিধুকে এত করে বললাম একটু চুলে বিলি কেটে দে তোমার মেয়েটা একটুও শুনলো না। ভেংচি কেটে বললো,”আমি পারবো না আমার ঘুম পেয়েছে।”তাই আর সহ্য করতে না পেরে ছাঁদে চলে এসেছি।”
মেয়ের ক্লান্ত ভঙিতে বলা কথাতে মনটা নরম হয়ে এলো সাজেদা বেগমের। শান্ত স্বরে বিন্দুর উদ্দেশ্যে বললেন,
–এখনও কী খুব মাথাব্যথা করছে?”
–অনেকটাই কমে গেছে।”
–রুমে চল আমি মাথা টিপে দিচ্ছি। আরাম লাগবে। বিন্দু মনে মনে দোয়া-দুরদ পড়তে পড়তে মায়ের পিছুপিছু নিচে নামলো। আজ বড় বাঁচা বেঁচে গেছে সে। আর একটু হলেই সব রহস্য সাজেদা বেগমের কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত। তখন হাজারটা মিথ্যে বলেও কোনো লাভ হতো না। সাজেদা বেগম রোগা-পাতলা হলেও খুব রাগী একজন মানুষ। কথায় কাজে কখনো ওনার নড়চড় হয় না। মেয়েদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করলেও শাসনের সময় তিনি একজন বিচারকের ভূমিকাই পালন করেন। আর যখন যে কথা বলবেন সেটা নিয়ে দ্বিতীয়বার কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।

রুমে এসে বিন্দু মায়ের কোলে মাথা রাখলো। সাজেদা বেগম চুলের গোড়া আস্তে আস্তে করে টেনে দিতে লাগলেন। বেশ আরামই লাগছে বিন্দুর। চোখজোড়াতে ঘুমেরা লুকোচুরি করছে। বিন্দু তাদের পাত্তা না দিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে বসলো,
–মা কাল কী ছেলেদের বাড়িতে এ বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে যাবে?”
–হ্যাঁ। ”
–কে কে যাবে, তুমি কিছু জানো?”
–এইতো সুমির খালাতো-চাচাতো ভাই-বোন আরও হয়তো অনেকে যাবে।”
–মা?”
–কী হয়েছে? কথা না বলে ঘুমাও।”
–মা আমি আর বিন্দু যাব না?”
–নাহ্!”
–কেন মা?”
–বিন্দু তুই ভালো করেই জানিস আমি যেটা বলি সেটাই হয় তবুও এত প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? আর এত বড় মেয়েদের বিয়ে বাড়িতে যাওয়া একদম ভালো না। কখন কী দূর্ঘটনা ঘটে সেটা তো বলা যায় না। আর বিপদ তো বলে -কয়ে আসে না। যখন আসে সব শেষ করে দিয়েই তবে বিদায় নেয়। আমি আর এ বিষয়ে কোনো কথা যেন না শুনি। তোর মামা-মামী কেউ সে বাসায় যেতে বললে বলবি,
“ভালো লাগছে না যেতে।” তবুও যদি বেশি জোড় করে আমি তো আছিই।”

বিন্দু আর কিছুই বলার সাহস পেল না। কারণ সে তার মায়ের সম্পর্কে পূর্ণ অভিজ্ঞতা আছে। একবার বিন্দু ওর এক বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে ওদিকে সাজেদা বেগমও ওনার কথায় অটল কিছুতেই বিন্দুকে যেতে দিবে না। এ নিয়ে বিন্দু সেদিন রাগ করে ফুলদানি মেরে ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙে ফেলেছিল। সেদিন সাজেদা বেগম বিন্দুকে এত মার মেরে ছিল যে ওর পিঠের কয়েক জায়গা ফেটে গিয়ে পুরো রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল। সাজেদা বেগম কাজের জিনিস নষ্ট করা একদম পছন্দ করেন না। ছেলে-মেয়েদের এসব জেদ তিনি মোটেও পছন্দ করেন না। সেদিন বিন্দুর এ অবস্থা দেখে তিনি নিজেও খুব কেঁদেছিলেন।

পরেরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই বিন্দুর নাম্বারে কলের ওপর কল দিতে লাগলো শিহাব। কিন্তু প্রতিবারই ফোনটা বন্ধ আসছে। গতকাল রাতেও কিছু না বলেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল সেই থেকে কতবার যে বিন্দুর ফোনে ট্রাই করেছে তারও হিসেব নেই। প্রতিবারই ফোন বন্ধ আসছে। ঘড়িতে এখন আটটা বাজে এখনো কী বিন্দু ঘুম থেকে ওঠেনি, নাকি কোনো বিপদ-টিপদ হয়েছে আবার। চিন্তার মাঝেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ভেবেছে বিন্দু কল করেছে পরক্ষণেই দেখলো শিশিরের কল।
–হ্যাঁ শিশির বল?”
–কিরে কথা হয়েছে তোর?”
–হুম।”
–হ্যাঁ বলছে?”
–হু।”
–কী হ্যাঁ, হু করছিস? আর তোর কথা এমন শোনাচ্ছে কেন?”
–বিন্দুর সাথে কথা বলছিলাম রাতে হঠাৎই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। সকাল আটটা বাজে এখনও পর্যন্ত একইভাবে ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে। চিন্তা হয় না বল?”
–আরেহ পাগল চিন্তা করিস না। হয়তো কোনো কারণে ফোন বন্ধ রেখেছে। কালকে তো ও তোকে আগে ফোন করেছিল তাই না?”
–হু। ওর কাছে তো আমার ফোন নাম্বার ছিল না।”
–যাইহোক দেখবি আজও ও আগেই নিজ থেকে ফোন করবে তোকে। অত চিন্তা করিস না। টেক কেয়ার।”
–হুম।”
ফোন রেখেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শিশির। সত্যিই ভাগ্য বলেও একটা কথা থাকে।সবার ভাগ্যে তো আর সব লেখা থাকে না। আর সেটাই হয়েছে তার জীবনে। তাড়াতাড়ি ঝটপট রেডি হয়ে নিলো স্কুলে যাওয়ার জন্য।
–মা, ওমা কই তুমি?”
–কিরে কিছু বলবি?”
–এখন চোখের কী অবস্থা? পানি পরে?
–নাহ্। এখন একটু আরাম পাচ্ছি।”
–মা আমি কিন্তু সব কাথা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেব। আমি এখনো মরে যাইনি যে তোমাকে এতটা কষ্ট করতে হবে। তুমি শুধু আমার জন্য একটু দোয়া করো। হাইস্কুলের নিবন্ধন পরীক্ষাটা দিয়েছি যদি পাস করতে পারি তাহলে ইনশাআল্লাহ আমার চাকরিটা হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য্য ধরো তুমি। আমাকে সাহায্য করা লাগবে না তোমার। আমাকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজেরই বিপদ বাড়াচ্ছো।”
ছেলের মমতাময়ী কথাগুলো শুনে চোখে পানি চলে আসলো শিরিনা বেগমের। অনেক বেশি পূন্য করলেই হয়তো এমন একটা হীরের টুকরো ছেলে পাওয়া যায়।
–এই দেখো এখনো চোখ থেকে পানি পড়ছে আর বলছে উনি নাকি ভালো বুঝতেছেন।”
এ পর্যায়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না শিরিনা বেগম। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
–আর কত করবি তুই। সেই ছোটবেলা থেকেই সংসারেরে হাল ধরেছিস৷ কত কষ্ট করে পড়াশোনা করেছিস, সংসার চালিয়েছিস। আর কত করবি?”
শিশিরের চোখেও পানি চিকচিক করছে। কিন্তু কোনোভাবেই সেটা মাকে দেখানো যাবে না। চোখের পানি মুছে ফেলে শান্তা গলায় মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
–একদম কাঁদবে না তুমি৷ আমার দেহে যতদিন রক্ত-মাংস আছে ততদিন তোমাকে আর রিদিকে কিচ্ছু করতে হবে না। আর ভুলেও কখনো কাঁদবা না তাহলে চোখে আরও সমস্যা বাড়বে। তখন কিন্তু আমাকেই কষ্ট করতে হবে। আমার যদি ভালো চাও তাহলে লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমি যা বলবো তাই শুনবে।”

শিশির কথাগুলো শুনে মুখে হাসি ফুটলো শিরিনা বেগমের।
–আচ্ছা আমি গেলাম।”
–ভালোভাবে যাস। আর বাইক একদম জোড়ে চালাবি না”
–আচ্ছা। ”

বিন্দুর ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল নয়টা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে ফ্রেস হয়ে নিচে নামলো। নাস্তা করে এসে ফোনটা ওপেন করতেই একটার পর একটা ম্যাসেজ টোন বাজতে শুরু করলো। বিন্দু অবাক হয়ে ম্যাসেজগুলো দেখছে। একরাতের ভেতর এতগুলো ম্যাসেজ। আর দেরী না করেই ডায়াল করলো শিহাবের ফোনে। ওমনিই নাম্বারটা বিজি আসলো। বিন্দু কল কেটে অপেক্ষা করতেই শিহাবের ফোন থেকে কল আসলো। বিন্দু ফোন রিসিভ করে শঙ্কিত কণ্ঠে বললো,

–হ্যালো।”
–কী দরকার ছিল ফোনটা অন করার। চিরকালের জন্য অফ করে দিলেই তো পারতে? আর আমিও কারো একটু কণ্ঠস্বর শোনার জন্য অনন্তকাল পর্যন্ত ফোনে ট্রাই করে যেতাম।”
শিহাবের উৎকণ্ঠা কথাবার্তা শুনে বিন্দুর বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। না চাইতেই একটু বেশিই বোধহয় কষ্ট দিয়ে ফেলেছে শিহাবকে। বিন্দু মসৃণ গলায় বললো,
–আসলে কাল আপনার সাথে কথা বলতে গিয়ে মা দেখে ফেলেছিল। তাই ভয় পেয়ে ফোনটা যে বন্ধ করেছি অন করতে মনে ছিল না। স্যরি… আমার ভুল হয়ে গেছে। আর এমন হবে না। এবারের জন্য কি ক্ষমা করা যায় না?”

শিহাব গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
–উঁহু যায় না? আমি যে এতটা সময় কষ্ট পেয়েছি তার কী হবে? আগে সেটার সময় দাও তবেই মাফ করবো। নয়তো না।”
বিন্দু মৃদু গলায় বললো,
–আপনিই নলে দিন আমাকে কী করতে হবে?”
–উমমম। আমাকে তুমি করে বলতে হবে। তবেই মাফ করবো। নয়তো মাফ পাবে না।”
–এতখানি শাস্তি না দিলেই কী নয়?”
–না নয়।”
–সবে তো কালকেই দেখা হলো আর আজই তুমি করে বলতে হবে?”
–হু হবে৷ কাল দেখা হয়েছে বলে কী হয়েছে? এখন তো আমি তোমার কাছের একজন বন্ধু। তাহলে সমস্যা কোথায়?”
–এখন পারবো না। আস্তে আস্তে ট্রাই করবো।”
–ওকে ফাইন। আজকের মতো মাফ। এখন বলো কেমন আছো?”
–আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”
–ভালো। ব্রেকফাস্ট হয়েছে?”
–হুম। আপনার?”
–হ্যাঁ। আজ তুমি তো আসবে গায়ে হলুদের তত্ব নিয়ে?”
বিন্দু মন খারাপ করে বললো,
–নাহ্।”
–কেন?”
–মা বলেছে যেতে দিবে না।”
–আন্টিক বুঝিয়ে বলো।”
–সম্ভব না। মা যা বলে সেটাই শুনতে হয়।”
–যাক বাবা আজ আরও ভাবলাম তোমার সাথে দেখা হবে তা আর হলো না।”
–থাক সমস্যা নেই কাল তো দেখা হচ্ছেই।

“আপু, এই আপু মা তোকে ডাকছে। কোথায় তুই?” (বিধু)
বিধুর কণ্ঠ পেয়েই বিন্দু শিহাবের উদ্দেশ্যে বললো,
–এখন ফোন রাখি। মা ডাকছে পরে কথা হবে।”
–আচ্ছা। বাই।”
–বাই।”

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here