লীলাবালি🌺 #পর্ব_২১ আফনান লারা

0
499

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_২১
আফনান লারা
.
কুমিল্লায় এসে যেখানে বাস থামার কথা তার দুই মাইল আগে বাসের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেলো।অনেকক্ষণ বসেও কোনো কিছুর উন্নতি হচ্ছেনা দেখে যাত্রীরা কেউ কেউ নেমে চলে যেতে লাগলো।কেউবা বসে অপেক্ষা করছে স্টেশন পৌঁছার।বিকালের শেষ সময় এখন। ধীরে ধীরে অন্ধকার নামছে।
জুথি জানালার কাঁচে মাথা ঠেকে ঘুমাচ্ছিল। অর্ণব ফোন বের করে একটা মজার ভিডিও দেখছিল।একটা শব্দে জুথির ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ঝাপসা চোখে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে পথে কিছু বন্যফুল নজরে আসলো।সাদা রঙের।তবে সেটা অনেকদূরে।এই রোড পেরিয়ে আরেকটা রোড ও পের হতে হবে।গাড়ী ঠিক হতে আধ ঘন্টা লাগবে শুনে জুথি অর্ণবকে বললো উঠে দাঁড়াতে সে নামবে।অর্ণব ওকে যেতে মানা করার সত্ত্বেও সে ঘাউরামি করে ওকে উঠিয়ে নিজেই চললো ফুল আনতে।
সবাই বাস থেকে ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছে।অর্ণবের বাসা দূরে তবে এরকম আর কতক্ষণ বসে থাকা হবে?যেখানে সিএনজি নিলেই প্রবলেম সলভড্।
তাই সে নিজের ব্যাগ আর জুথির ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলো বাস থেকে।দরকার হলে স্টেশন পৌঁছাতে একটা রিকশা নিবে তারা।জুথি রোড একের পর একটা পেরিয়ে ফুলগুলোর কাছে এসে দুটো ছিঁড়ে মাথায় লাগালো।অর্ণব রোড দেখতে দেখতে পার হয়ে এদিকে আসছিল।রোড পেরিয়ে কাছাকাছি এসে জুথিকে সাদা ফুল মাথায় পরতে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।সাদা থ্রি পিসের সাথে মাথার সাদা ফুলটা যেন একটা সৌন্দর্য্যটাকে পরিপূর্ণ রুপ নাম দিয়েছে।জুথি হাত নাড়িয়ে বললো’কোথায় হারিয়ে গেলেন?ব্যাগ এনেছেন কি জন্যে?’

-“মনে হয় আরও বসে থাকতে হতো।তাই ব্যাগ নিয়ে চলে আসলাম।রিকশা একটা নেবো এখন।আপনার চাচার বাসা কোন জায়গায়?’

-“ওসব পরে।আগে আমার একটা ইচ্ছা পূরণ করবেন?’

-“কি ইচ্ছা?’

-“এটা নদী না??আমাকে প্লিজ এই সেতু দিয়ে ঐ যে নিচে নামার জায়গা আছে ওখান থেকে একটু ঘুরিয়ে আনবেন?’

-‘অসম্ভম।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।এটা সম্ভব না।আপনার কি ডর-ভয় নাই?ওখানে কত খারাপ লোক থাকে!’

-“একজন পুরুষ আপনি।একটা মেয়েকে বাঁচাতে পারবেননা?’

-‘অবশ্যই পারবো।কিন্তু আমার মতন ১০জন পুরুষ একত্রিত হলে আমার দ্বারা সম্ভব হবেনা আপনাকে বাঁচানো।তাই বলছি বিপদের দিকে ঝুঁকবেননা।আমার সাথে আসুন।
রিকশা নিয়ে স্টেশন অবধি গিয়ে আমি আপনাকে সিএনজি ধরিয়ে দেবো’

-“না না না।আমি কিছু শুনতে চাইনা।দেখুন লঞ্চ স্টিমারের আলো কি সুন্দর লাগছে ভিউটা।আমি কাছ থেকে দেখবো।প্লিজ!’

জুথি অর্ণবের সামনে হাতজোড় করতে লাগলো।অর্ণব বাধ্য হলো রাজি হতে।নিজের ট্র্যাভেল ব্যাগটা আর জুথির ব্যাগটা এক হাতে নিয়ে চললো ওর পিছু পিছু।বেশি ভারী না।পালকা বেশ ব্যাগগুলো।
জুথি সেতু থেকে উঁচু নিচু পথ ধরে নিচে নেমে গিয়ে সেকি লাফালাফি তার।অর্ণব একটা শুকনো জায়গায় বসে পড়েছে ঘাসের উপর।তার জানা আছে জুথি এই লাফালাফি অনেক সময় ধরে করবে।এখানে কোনো মাটি নেই।সব বালু!সাদা বালু।
লাল বালু।ট্রাক কতগুলো আশেপাশে থেমে আছে।আবার দূরে বন দেখা যায়।
ফোন বের করে দেখলো মায়ের মিসড্ কল।ব্যস্ত হয়ে সে কল ব্যাক করেছে।মাকে জানালো তার আসতে আরও কিছু সময় লাগবে।রাত হতে পারে।
জুথি ছবি তুলতে তুলতে কেথায় যন চলে গেছে।সামনে ওকে না দেখতে পেয়ে অর্ণব চিন্তিত হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো।ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সামনের জঙ্গলের দিকে ছুটলো সে।অনেকটা পথ ছুটে এসে জুথিকে কোথাও পেলোনা ।বুকের ভেতর হাজারটা ভয়ানক সংকেত আড়ি পাতছে।ওর যদি কিছু হয়ে যায়?
দু মিনিটের ব্যবধানে কই চলে গেলো মেয়েটা!! অন্ধকার নেমে আসছে।অর্ণবের কপাল ঘেমে একাকার।জুথির চিন্তায় মনে হয় পাগল হয়ে যাবে সে।হঠাৎ করে পেছন থেকে জুথি লাফ দিয়ে এসে বললো,’ভীতুর ডিম!’

অর্ণব ভয় পেয়ে কেঁপে উঠলো।জুথি হাসতে হাসতে বললো,’কি ভাবলেন আমায় দস্যু ধরে নিয়ে গেলো?হিহিহিহি!!’

অর্ণব জুথির কান টেনে ধরে বললো,,’এরকম শয়তানি আর করবেননা বলে দিলাম।’

জুথি হাসতে হাসতে নিচে মাটিতে বসে পড়েছে।অর্ণব কপাল মুছে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারলো তারা জঙ্গলের ভেতরে চলে এসেছে।
জুথি হাসি থামিয়ে অর্ণবের দিকে চেয়েছিল।অর্ণব মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পথ খুঁজছিল।
জুথি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,’একটা কথা শুনবেন ভাইয়া?’

-“কি??আর কি শোনাবেন?’

-“আপনাকে আমার লাগবে!’

অর্ণব চমকে গেলো কথাটা শুনে।নিচে তাকিয়ে বললো,’মানেহ?’

-“মানেটা পানির মতন স্বচ্ছ।আপনাকে আমার চাই’

-“কি করবেন?’

-‘বিয়ে করবো’

অর্ণব তাচ্ছিল্য করে হেসে জুথির হাতের কব্জি ধরে ওকে নিচ থেকে তুলে দাঁড় করালো তারপর বললো,’পথ খুঁজতে হবে।ফান করার সময় না এটা’

জুথি অর্ণবের হাত ধরে ওকে আটকে সামনে এসে বললো,’আই এম সিরিয়াস’

অর্ণব জুথির চোখে চোখ রেখেছে।সন্ধ্যার অন্ধকারে ওর চোখ স্পষ্ট দেখা গেলো না।কানের সাদা ফুলটা উজ্জ্বলিত হয়ে আছে।অর্ণব দম ফেলে বললো,’দেখা যাক কি হয়’

কথাটা বলে সে হাঁটা ধরেছে।
জুথি আবারও হাত ধরে ওকে আটকে বললো,’আমি অপেক্ষায় থাকবো আপনার।ঢাকায় আমার সঙ্গে ফিরবেন না?’

অর্ণব পেছনে তাকিয়ে বললো,’সাজিয়ে নেবো’

জুথি আর কিছু বললোনা।মুচকি হেসে ওর সঙ্গে চললো।তাদের সামনে দিয়ে পাঁচ ছয়জনের মতন বয়স্ক লোক হেঁটে যাচ্ছিলো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে।অর্ণব নদীতে থাকা স্টিমার আর লঞ্চের আলো খুঁজতেছিল।ডাক শোনা গেলেও দিশ করতে পারছিল না কোন পাশ থেকে আওয়াজ আসছে।
মুরব্বীর সে দল ওদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল সেসময়ে। দু পক্ষ থেমে গেলো।জুথি কোণার একজনকে দেখে চিনতে পারলো।ছুটে গিয়ে সালাম দিয়ে বললো,’চাচ্চু আমি জুথি।’

লোকটা জুথিকে দেখে খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেছেন।ওর সালাম নিয়ে কেমন আছো আম্মু এটা বলে অর্ণবের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো।জিজ্ঞেস করলো ও কে।

-“আব্বু অর্ণব ভাইয়ার সঙ্গে আমাকে এখানে পাঠিয়েছিল’

-“ওহ হ্যাঁ!বলেছিল আমায়।এই সেই অর্ণব??ভালো হলো তোমাদের সঙ্গে এখানে দেখা হয়ে গেলো।চলো আমার সঙ্গে। আমার বাড়ি এই তো সামনেই।’

জুথি জিভে কামড় দিয়ে বললো,’অনেক ছোট বয়সে এসেছিলাম বলে কিছুই মনে নেই’

-‘তোমরা মেইন রোড ছেড়ে এই জঙ্গলের মধ্যে কেন আসলে?আমাদের বাড়ির দিকেও তো মেইন রোড নেই।উল্টে ফেরত যেতে হতো তোমাদের’

জুথি চোরের মতন দাঁড়িয়ে আছে।চাচ্চু ওর এমন লুকিয়ে পরা দেখে বললেন,’বুঝলাম।তোমার সেই দুষ্টুমি এখনও গেলোনা?আচ্ছা চলো তোমরা দুজন।বাড়িতে ইলিশ ভাজা খাবাে একসাথে।আমি এদিকে আসলাম টাটকা মাছ নিতে।ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলাম।চলো দেরি করা যাবেনা’

-‘আঙ্কেল আমি যেতে পারবোনা।আমার বাড়ি উল্টো দিকে।জুথিকে খু্ঁজতেই এদিকে আসলাম।ও হারিয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণ আগে ‘

-“তুমি একা যেতে পারবে?’

-‘পারবো সমস্যা নেই’

-“সাবধানে যেও।আমার এই টর্চটা রাখো।অন্ধকারে তোমার যেতে অসুবিধা হবে।এই জায়গা সুবিধার না।আর শোনো আমি হাতের ডান পাশ দেখাচ্ছি এইদিকে ভুলেও যাবেনা’

অর্ণব মাথা নাড়ালো।জুথি যেতে যেতে অন্ধকারে অর্ণবের হাত একবার ধরলো।অর্ণব মুচকি হেসে ওর চলে যাওয়া দেখছে।
টর্চটা সামনে ধরে অর্ণব হাঁটা শুরু করলো।এখানে নেটওয়ার্ক থাকলে জিপিএসের হেল্প নেওয়া যেতো।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর একটা সুপারি গাছ দেখতে দেখতে যাওয়া ধরতেই থেমে গেলো সে।লাল রঙের ফিতা ঝুলানো এই সুপারি গাছটা সে ঐ জায়গায় দেখেছিল যেখানে জুথিকে বিদায় দিয়েছিল।কেমন লাগে এখন?ঘুরেফিরে একই জায়গায় কি করে এলাম আমি!!ধুর!কত দেরি হয়ে গেলো!’

আঙ্কেল কোন দিকে যেতে মানা করেছিলেন যেন?হাতের ডান দিকে?
কিন্তু আমি যেখানে দাড়িয়ে আছি তার থেকে ডান দিকে কোন পথ?
ধুর!একটা হলেই হলো!’

অর্ণব সোজা হাঁটা ধরলো আবার। অনেকটা পথ আসার ওর একটা লঞ্চের আলো দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো সে।হাঁপাতে হাঁপাতে লাইট অফ করলো কারণ আলোতে ভরে আছে ওদিকটায়।কোনোমতে একটা মেইন রোড পেলেই বাড়িতে যেতে পারবে।বাড়িতে যেতেও আবার সময় লাগবে।যা মনে হচ্ছে অনেক দূরে চলে এসেছে সে।কপাল মুছতে মুছতে নদীর কিণারায় এসে দাঁড়ালো সে।এখন হাঁপাচ্ছে।
এতক্ষণ ছুটে ছুটে আসছিল এদিকে।
দূরে আলো আরও বেশি মনে হলো।অনেক বেশি আলো দেখা যাচ্ছে।যেন মেলা বসেছে।ঝিকমিক করছে আলোয়।
অর্ণব সেদিকেই চললো।হয়ত ওখানের আশেপাশে মেইন রোড পাবে।এর আগে কখনও সে এই জায়গায় আসেনি।কিছুই চিনছেনা।সে আলো মাখা ঝিকমিক করা জায়গাটা থেকে একটা গান শোনা যাচ্ছিল।কান খাড়া করে চেষ্টা করলো সে শুনার জন্য।মানুষ মুখে মুখে গাইছে।
কি দিয়া সাজাইমু তোরে
নাক চাইয়া নাকফুল দিমু
পান্না লাগাইয়া সই গো
পান্না লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে
মাথা চাইয়া টিকা দিমু
জড়োয়া লাগাইয়া সই গো
জড়োয়া লাগাইয়া সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে
লীলাবালি…. লীলাবালি….

গানটা বুঝতে পেরে অর্ণব হেসে ভাবলো ওখানে বুঝি বিয়ে হচ্ছে।সাজগোজ দেখে মেলা ভাবলো।
সেসময়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে কতগুলো মেয়ে ছুট লাগলো ওদিকে।সবার মুখে হাসি।সবার পরনে হলুদ লালের মিশ্রনের শাড়ী।চুলে খোঁপা সবার।অর্ণব কৌতূহল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছে।সামনের দিকে স্টেজ সাজিয়ে অনেকজন বসে আছে সেখানে।লীলাবালি গাইছে স্টেজের পেছনে টিনের ঘরের সামনে থাকা সমাবেশের নারীরা।তাদের দেখা না গেলেও কণ্ঠ শুনে বুঝে নিলো গানটা নারীরাই গাইছেন।
সবার গায়ের পোশাক দেখে অর্ণব ঢোক গিলে পিছিয়ে যেতে লাগলো।এখানে যারা আছে সবাই দস্যু না তো!!
কি বিপদ!কোথায় এলো সে।!!হাতিয়ার দেখেই যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে ওর।মুখে হাত দিয়ে ঘুরে কমলা রঙের বেড়া দেওয়া জায়গার ওপারে দিয়ে পালালো সে।
আর জীবনে এদিকে আসবেনা ভাবতে ভাবতে পেছনে তাকিয়ে ছুটছিল।হঠাৎ সামনে একটা বাঁশের খাম্বার সঙ্গে ধাক্কা লেগে পাঞ্জাবি আটকে গেলো বাঁশে থাকা পেরেকের সঙ্গে।পাঞ্জাবি ছুটাতে ছুটাতে অর্ণব কানে শুনতে পেলো ‘কনে তৈরি!!!’

কিছুতেই পাঞ্জাবি ছাড়াতে পারছেনা অর্ণব।তখন একটা বয়স্ক লোক এসে অর্ণবের পাঞ্জাবিটা পেরেক থেকে ছাড়িয়ে বললো,’শহরের মানুষ নাকি?আমাদের মতন গরীবদের বিয়ে দেখতে আইলেন?আবার না দেখেই পালান?তা হবেনা’

লোকটার পরনে লুঙ্গি ছিল।উদম গা তার।হাতে আবার কাঠের লাঠি।
লোকটা অর্ণবের হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে গেলো স্টেজের দিকে।
যেতে যেতে বললো,’দেখো!!শহরের এক ব্যাটা আইছে আমাদের দস্যুদের আস্তানায়।’

সবার চোখ গেলো অর্ণবের দিকে।অর্ণব মনে মনে ভাবছে আজ তার রেহায় নেই।
চলবে♥
মেঘ বলেছে বৃষ্টি নামবে বইটি অর্ডার লিংক
https://www.facebook.com/Bookshelfsc/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here