লীলাবালি🌺 #পর্ব_২৬

0
476

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_২৬
আফনান লারা
.
ফোন টেবিলের উপর রেখে অর্ণব নিজের মাথার চুল টানছিল অনেক সময় ধরে।আজ মাথার যন্ত্রণা সারছেনা।হাতুড়ি দিয়ে মাথাটাকে বাড়ি মারতে পারলে হয়ত শান্তি হতো।তিনটা বেজে গেছে।চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই।কুসুম এপাশ ওপাশ করতে করতে অর্ণবের জায়গায় এসে ঘুমাচ্ছে এখন। অর্ণব দরজা আস্তে করে খুলে বাসা থেকে চলে গেলো।সোজা মসজিদে।
সেখানে বসেছিল ঈদের নামাজ শুরু হবার আগ অবধি।সেটা পড়েও বসে ছিল সে ওখানেই।বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করেনা তার।শরীর খারাপ লাগছে।এখন ঘুম পাচ্ছে।একটু শুলে হয়তবা মনে শান্তি ফিরে আসতো।মসজিদের টাইলসের কারণে ঠান্ডা আরও বেশি করে লাগছে।
যার সাথেই দেখা হয় সেই বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে। আচমকা হয়ে যাওয়া ঘটনায় সকলেই চমকে আছে ।এবার সে উঠে হাঁটা ধরলো।পথে দেখা হয়ে গেলো আজিজ আর ফজলুলের সাথে।ওরা অর্ণবের বাল্যকালের বন্ধু।
দেখার সাথে সাথে ওকে থামিয়ে তারা বসিয়ে দিলো পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে।হেসে হেসে জিজ্ঞেস করলো বিয়ের কথা।পাড়া প্রতিবেশী যারা এসেছিলেন কাল রাতে বিয়ে দেখতে তারা বিয়ের কথা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।অর্ণব কোনোমতে তাদের পিছু ছাড়িয়ে বাড়ি ফিরে আসলো এই বলে যে পরে কথা বলবে।এখন তার শরীর খারাপ করছে।সত্যি তাই।নিজের রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে শূন্য বিছানায় দেহটাকে এলিয়ে দিলো সাত পাঁচ আর ভাবলোনা।বিছানায় কুসুম ছিলনা।বরং রুমেই ছিলনা।পুকুর ঘাট থেকে গোসল করে সে রান্নাঘরে মায়ের পাশে বসে পিঠা বানানো দেখছিল।
বাবা চায়ের কাপ হাতে দরজার কিণারায় এসে দেখলেন অর্ণব ঘুমোচ্ছে। নামাজ পড়ে ওকে আসতে দেখেছিলেন তিনি।আবার চলে গেলেন ওখান থেকে।অন্য দিন হলে ধমকিয়ে বলতেন সেমাই খেতে আয়।কিন্তু আজ আর ডাকলেননা।
কুসুম মিশু ভাবীর একটা খয়েরী রঙের শাড়ী পরেছে।চুলের পানি ঠিকঠাক করে না মুছে ছেড়ে দিয়ে রেখেছে।ওর মা বললেন তারা আজ চলে যাবেন।কিন্তু অর্ণবের মা তাদের আজ থেকে যেতে বলেছেন।কলি কোথা থেকে যেন ছুটে এসে কুসুমের কানে ফিসফিস করে জানালো অর্ণব ফিরে এসেছে।কুসুম এমন ভাব করলো যেন সে শোনেই নাই কথাটা।
মিশু ওর দু হাতে পিঠার আর সেমাইয়ের বাটি ধরিয়ে দিয়ে বললো অর্ণবকে দিয়ে আসতে যেহেতু ও কাল রাতে কিছু খায়নি। এখন নিশ্চয় খাবে।কুসুম আস্তে আস্তে রুমের কাছাকাছি এসে উঁকি মেরে দেখলো।অর্ণব গভীর ঘুমের অতলে।তা বুঝতে পেরে জোরে হোঁটে ভেতরে গিয়ে টেবিলে খাবার রেখে কুসুম এবার আস্তে আস্তে কাছে এসে অর্ণবকে দেখতে লাগলো।মুখটা কুসুমের বালিশ দিয়ে ঢেকে চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল সে।কুসুম কম্বলটা টেনে ওর গায়ে ঢেকে দিতে গিয়ে ওর ভেজা চুল সবগুলো পিঠ থেকে গড়িয়ে অর্ণবের গলায় গিয়ে পড়লো।সাথে সাথে ও জেগে গেছে।কুসুম তার চুল মুঠো করে ধরে আবার পিঠে নিয়ে গিয়ে মুখে হাত দিয়ে চুপ করে আছে।অর্ণব গলা মুছতে মুছতে মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে।চোখ লাল হয়ে আছে তার।ঠিক করে ঘুমোতে পারেনা আর এখন যা একটু ঘুম এসেছিল তাও ভেঙ্গে গেলো।কুসুম চুপ করে আছে দেখে অর্ণব কিছু না বলে আবার আগের মতন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে।কুসুম আস্তে করে বলে দিলো,’সেমাই ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।কোরবানির কাজে সবার সাথে যাবেন না?’

অর্ণব উত্তর দিলো না।কুসুম চলে যাওয়া ধরলো কিন্তু তখন আবার ওর ফোন জ্বলতে দেখে থামলো সে।আজ ফোন টিপে রিসিভ করে একেবারে কানে ধরলো কুসুম।

-‘কি সমস্যা আপনার?আমি কয় হাজার বার ফোন করেছি?মৃদুল ভাইয়া পর্যন্ত আমার ফোন ধরছেনা।আজব মানুষ তো আপনি!সেই জঙল থেকে সুস্থ সবল ভাবে বাড়ি পৌঁছেন কিনা তা জানার কি কোনো অধিকার নেই আমার?আমার সাথে কথা বললে কি আপনার বাবা মা আপনাকে কথা শোনা তো?নেটে তো আসবেন না জানি।কি হলো কথা বলছেন না কেন?’

কুসুম আগামাথা কিছুই বুঝলোনা।এত বকবক করা মেয়েটা কে হতে পারে তা ওর মাথায় আসলোনা।ভাবলো অর্ণবের অফিসের বুঝি কেউ।কিন্তু এমন ঝাড়ি যে দিলো মনে হয় কাছের কোনো বান্ধুবী।
এতসব ভাবতেছিল সে। তখন জুথি আবার চেঁচিয়ে বললো,’আপনার বাড়ির এড্রেস দিন।আমি আপনার বাড়ি ঘুরতে আসবো, যা হবার তখন সামনা সামনি হবে’

কুসুম এবার বললো,’উনি তো ঘুমাচ্ছেন।উঠলে বলে দেবো।আপনার নাম কি বলবো?’

জুথি একটা মেয়ের আওয়াজ শুনে এবার ভাবতে লাগলো কে ধরেছে।জিভে কামড় দিয়ে ভাবলো ওর বাড়ির কেউ কিনা।ওকে চুপ হতে দেখে কুুসুম আবার বললো,’কি হলো, বলুন আপনি কে?’

-‘অর্ণব ভাইয়াকে বলবেন আমি মৃন্ময়ী ‘

কুসুম আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিলো।
জুথি অর্ণবের খুব কাছের কেউ হতে পারে কিনা সেরকম কিছু তার মাথায় তখন আসলোনা।ওর অফিসের লোক ভেবেই চলে গেলো মায়ের কাছে।অর্ণব আবারও ঘুমের রাজ্যে পৌঁছে গেছিলো যার কারণে এত বড় ঘটনার সামিল হলোনা।কোরবানির সময় হয়ে আসায় বাবা এবার নিজে এসে ধমক দিয়ে বললেন,’আজ যে ঈদের দিন সেটা কি ভুলে গেছিস?কি হলো তোর?’

অর্ণব এবার উঠে বসেছে।এক ঘন্টার ঘুমে দুজন এসে উঠিয়ে গেছে।মনে হচ্ছে বিয়ের সাথে সাথে শান্তি নামক বস্তু জীবন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।আর দেখা মিলবেনা।
—-
বাবা আর অর্ণব চলে গেছে।মা পথে ওকে থামিয়ে জোর করে ওর মুখে পিঠা একটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।খালি পেটে আর একটু সময় থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যেতো সে।
কুসুম ভয়ে আর ওর সামনে গেলোনা।কেমন যেন ভয় করে।যেভাবে তখন ঘুমের চোখে তাকিয়ে ছিল।
ফোন যে এসেছিল ঐ আপুর সেটা কখন বলা উচিত উনাকে?
কুসুমের কাছে এখন ওটাই একমাত্র উপায় অর্ণবের সাথে দ্বিতীয়বার আলাপ করার।
সব কাজ শেষ হতে বারোটা বোজে গেলো।অর্ণব হাত ধুয়ে রুমে ঢুকেছে।সবার আগে ফোন হাতে নিলো।জুথির ছাপ্পান্ন টা মিসড্ কল ছিল।
শেষের কলটা রিসিভ হয়েছে দেখায়।অর্ণব ভাবলো কে ধরেছে।পরে কুসুমের কথা মনে পড়ায় ওকে ডাক দিলো।কুসুম ছুটে আসলো।হাতে তেঁতুলের ছড়া।অর্ণব ফোন দেখিয়ে বললো,’তুমি আমার ফোন ধরেছো?’

-“মিননয়ি আপু ফোন দিছিল।আমি বলছি আপনি ঘুমে’

-‘মিননয়ি মানে?ওহ মৃন্ময়ী! তুমি তারে বলছো তুমি কে?’

-“নাহ সেটা তো জিজ্ঞেস করেনি।’

-“আর কি বলছে?”

-“শুরুতে এক গাদা ঝাড়ি দিছিলো।তার এক লাইন বুঝেছিলাম।বলছিল বাড়ির কি যেন দিতে।উনি তাহলে আসবেন’

-‘ঠিক আছে যাও’

কুসুম মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।অর্ণব ভাবলো কুসুম হয়ত পাল্টা জিজ্ঞেস করবে মেয়েটা কে কিন্তু সে তা না করে আরো একবার তার কম বয়সী আর অবুঝ হবার প্রমাণ দিয়ে চলে গেলো।অর্ণব বিছানায় হাত রেখে একটু হেল দিতে গিয়ে হাতের নিচে কি যেন পেয়ে পেছনে তাকালো।কুসুমের চুলের ক্লিপ।সেটাকে সরিয়ে এবার লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো।কুসুম আবার উঁকি মেরে বললো,”সেমাই খাবেন?’

-‘না ‘

-‘পাকন পিঠা খাবেন?’

-‘না’

-‘চা খাবেন?’

-‘তোমায় খাব।আসো!’

অর্ণবের কথা শুনে কুসুম আর ওখানে রইলোনা।ভয় পেয়ে পালিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাওয়া ধরতেই মিশু ভাবীর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো।ভাবী দুষ্টু করে হাসি দিয়ে বললো,’কি গো?বর দৌড়ানি দিলো নাকি?’

-“না বললো খেয়ে ফেলবেন আমায়’

ভাবী হাসতে হাসতে সোফায় বসে পড়লেন ধপ করে।তার হাসি শুনে মা খুন্তি হাতে রান্নাঘরে থেকে উঁকি দিয়ে বললেন,”কিরে মিশু হাসিস কেন?কি হলো?’

মিশু হাসির জন্য কথা ও বলতে পারছেনা।মা এবার কুসুমের দিকে চেয়ে বললেন,’কিরে?কেন হাসতেছে এমন?’

-‘কি জানি।আমি তো শুধু বললাম উনি আমায় বলেছেন খেয়ে ফেলবেন’

কথাটা শুনে মায়ের মুখটা লাল টুকটুকে হয়ে গেলো।চুপচাপ আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন তিনি।
মিশু আরও বেশি করে হাসছে।মনে হয় হাসতে হাসতে আজ মরেই যাবে।
কুসুমের মা এইসব কথা শুনে ওর হাত ধরে টেনে ভেতরের রুমে নিয়ে এসে বললেন,’তোর কি আর কোনোদিন কান্ডজ্ঞান হবেনা?কোথায় কি বলতে হয় তা জানিস না?এগুলো কোন ধরনের কথা কুসুম?জামাই তোকে কি বলে না বলে কাউকে আর কোনোদিন বলবিনা!কি বললাম মনে থাকবে?’

কুসুম মাথা নাড়ালো।এবারও বুঝলোনা খেয়ে ফেলবে কথাটা এত হাসির যদি হয়ে থাকে তবে মা ওকে বকলো কেন?
অর্ণবকে সুযোগ পেলে জিজ্ঞেস করবে।কারণ এদের আবার জিজ্ঞেস করে সে আর হাসির মুখপাত্র হতে চায়না।চুপচাপ আবারও রুমে উঁকি মেরে অর্ণবকে দেখতে লাগলো সে।
অর্ণব বারান্দার গ্রিলের সাথে লেগে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।পুরো বাড়িতে গোশত রান্নার ঘ্রান মমম করছে।কুসুমের খুব খিধে পেলো।সকালে সেমাই খেয়েছিলো।গরুর গোশতের প্রতি আলাদা টান ওর।গিয়ে একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে আসলো।এখনও রান্না হয়নি বলে পুনরায় অর্ণবকে উঁকি মেরে দেখতে চলে আসলো।এছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই আপাতত। মা আর মিশু ভাবী রান্নাঘরের কাজ সামলাচ্ছেন।বাবারা বাহিরে।আর কলি টিভি দেখতে দেখতে সোফায় শুয়ে আছে।অর্ণবের ফোন আবারি জ্বলতে দেখে কুসুম ফোন হাতে নিলো।আবারও জুথির কল।
সাইলেন্ট ছিল বলে অর্ণব জানলোনা তার কল এসেছে।কুসুম রিসিভ করে ওর কাছে গিয়ে বললো,’ধরুনন, মিননয়ি আপু মনে হয় ফোন করেছে’

অর্ণব চোখ বড় করে ফোনের দিকে তাকালো।সেকেন্ডের সময় উঠছে।জুথি সব শুনছে।সাথে সাথে অর্ণব ফোন নিয়ে কেটে দিলো কল।তারপর বললো,’আমার ফোন ধরবেনা আর কোনোদিন।যদি কেউ ফোন করতে করতে বাড়িও চলে আসে তাও ধরবানা।বুঝেছো?

-‘কিন্তু মিননয়ি আপু…’

-‘ওর নাম নিবানা।আচ্ছা তোমার জানতে ইচ্ছে করেনা ও কে?’

কুসুম বললো,’আপনার অফিসের বান্ধুবী’

-‘আর কিছু হতে পারেনা?’

-“আর কি হবে?বউ তো আমি’

অর্ণবের মুখের কথা আবারও হাওয়া।এই মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন কথা বলে বসে যে মুখের কথাটা আর মুখে থাকেনা।বাপ বাপ বলে গলা দিয়ে পেটে চলে যায় আবার।
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here