#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮
আফনান লারা
.
চাচির হাতে ফোন দেওয়ার সময় কুসুম খুব করে ভাবছিল ভবিষ্যতে যেটা হবে সেটা সে কি করে মেনে নিবে।ঠিক সেসময়ে হঠাৎ চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেলো।চোখ খুলতে কত সময় লেগেছে তা ওর অজানা।চোখ খুলতেই ভোরের আলো দেখতে পেলো সে।জানালার কাঁচ ভেদ করে ভোরের আলো দেয়ালে এসে লাগছে।উঠতে গিয়েও পারলোনা।হাতে ক্যানোলারের লম্বা দড়ি গিয়ে স্ট্যান্ডে ঝুলছে।কিসের যেন খচখচ আওয়াজ কানে আসলো হঠাৎ।মাথাটাকে একটুখানি তুলে পাশে তাকালো কুসুম।খয়েরী রঙের সুতোর পাঞ্জাবি পরা একজন হন্তদন্ত হয়ে ওয়ারড্রব হাতাচ্ছে।সেটারই শব্দ হচ্ছে।আচমকা পর পুরুষকে দেখে কুসুম লাফ দিয়ে উঠে বসলো।সামনের মানুষটা অর্ণব।তার লুঙ্গি খুঁজতেছে সে।কুসুম এখনও বুঝতে পারলোনা এটা কে হতে পারে।চুপ করে শুধু দেখছে।
অর্ণব লুঙ্গি নিয়ে পেছনে তাকাতেই কুসুমকে উঠে বসে থাকতে দেখে অন্ধকারে ভয় পেয়ে দেয়ালের সাথে লেগে গেছে।আবছা সব,ভোরের হালকা আলো তাও অন্যপাশে পড়েছে।মনে হয় বিছানায় কালো করে কি যেন!
তা দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বুকে থুথু দিয়ে লাইট জ্বালালো।কুসুম ও ভয় পেয়ে গেছিলো কিন্তু আওয়াজ করলোনা।
অর্ণব জোরে চেঁচিয়ে ফেলেছিল বলে পাশের রুম থেকে বাবা আর মা ছুটে আসলেন।বাবা এসে অর্ণবকে দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,’দেখলে তুমি সাগরের আম্মা?তোমার ছেলে আর কত নাটক দেখাবে?এই টুকুন একটা মেয়ে,এত সুন্দর তার চেহারা।আর সে এমন ভাব করছে যেন ভূত দেখেছে।ইচ্ছে করে ঢং করছে সে।আমি বুঝিনা এসব??’
অর্ণব বাবার কথা শুনে কুসুমের দিকে তাকালো।কুসুম ততক্ষণে বুঝে গেছে এটা অর্ণব।পিঠ দেখে চিনতে পারছিলনা প্রথমে।এখন চিনতে আর দেরি করেনি।লজ্জা পেয়ে ওড়না টানছে বারবার।অর্ণব কুসুমের দিকে একবার তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।মা এগিয়ে এসে বললেন,’আহা উঠলে কেন?সেলাইন দিয়েছে তোমায়।শুয়ে থাকো’
মা জোর করে কুসুমকে শুইয়ে দিলেন আবার।অর্ণবের বাবা এগিয়ে এসে বললেন,’দুইদিন ধরে কিছু খাওনি কেন তুমি?বাসায় এসে তো নাকি শুধু চা খেয়েছিলে।এরকম চাপা স্বভাবের হলে হবে?মুখ ফুটে বলবে তো যে বাড়ি থেকে কিছু খেয়ে আসোনি।আমরা কি করে জানতাম?
আর হুট করে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে কেউ বেড়াতে আসে?এটা তো ঠিকনা।আমি তো ভাবলাম কি না কি হলো।হুট করে জ্ঞান হারানো তো ভাল লক্ষণ না।অনেক চিন্তায় পড়ে গেছিলাম।’
কুসুম দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো।যে মানুষটার জন্য এত অপেক্ষা ছিল আজ সে এত কাছে।
তার দেখা মিললো অথচ বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও।সত্যি কি তিনি এসেছেন নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি?
অর্ণবের বাবা রুম থেকে বেরিয়ে দেখলেন অর্ণব তাদের রুমে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে চোখ বুজে।বাবা এক ধমক দিয়ে বললেন,’তুই কি করিস এখানে?’
-‘কি করবো?একটু ঘুমাতে শুইলাম।আমার রুমে তো ঐ…’
-“তো কি হয়েছে?যা ওর সঙ্গে একটু কথা বল।’
-‘আমি কিসের কথা বলবো?’
-‘যা খুশি বল যা।ভোর হয়ে গেছে আর কি ঘুমাবি তুই?আর নয়ত চল নামাজ পড়বি আমার সঙ্গে মসজিদে গিয়ে’
অর্ণব চললো বাবার সাথে।কুসুম চোখ বুজে ওর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছে।নামাজটা সেরে বাবা অর্ণবকে রেখে কোথায় যেন চলে গেছেন।অর্ণব অনেকদিন পর গ্রামের মাটিতে পা রেখেছে।একলা মনে হাঁটা ধরেছে সে।তার পুরনো কিছু বন্ধুবান্ধব মসজিদের পাশে কবরস্থানের পাশে বৈঠকখানায় বসেছিল।ওকে দেখে চিনে সবাই মিলে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরলো।কজন তো কিল ঘুষি মেরে দিয়েছে অর্ণব আসতে এত দেরি করেছে বলে।
কুসুমের সেলাইন শেষ।ক্যানোলা খোলার জন্য ডাক্তার ডাকতে হবে অথচ অর্ণবের এখনও কোনো খবর নেই।বাবা ফোন হাতে নিলেন অর্ণবকে ডাকতে।তখনই সে এসে হাজির।
-‘কি নবাবজাদা! আবার ঢাকায় চলে গেছিলেন নাকি?নামাজ হইছে কয়টায় আর এখন কটা বাজে?কই ছিলি এতক্ষণ? এত বছর বনবাদাড়ে ছিলি! কোথায় বাপের পা ধরে বসে থাকবি তা না করে বাইরে বাইরে কি?কুসুমের থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস?
আহারে!!যত ছলচাতুরী করোনা কেন।বিয়ে তোমাকে ঐ মেয়েকেই করতে হবে।
কুসুম যদি তোর ভাগ্যে থাকে যত কিছু করিস কোনো লাভ হবেনা।তুই যদি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে গিয়েও লুকাস ঐখানে তোর কুসুমের সাথে বিয়ে হবে। আমার কথা নোট করে রাখ।এখন যা ওর হাতের ক্যানোলা খোলার জন্য ডাক্তার ডেকে আন’
অর্ণব কাল রঙ করা সিমেন্টের পিলারের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বাবার লেকচার শুনছিল।হাই তুলে বললো, ক্যানোলা খুলতে ডাক্তার ডাকা লাগে নাকি?এটা তো আমিই পারবো’
-‘যে মেয়েকে দেখে ভয়ে দেয়ালে পিঠ লেগে গেছিলো তোর সেই মেয়ের হাত ধরে ক্যানোলা খুলবি তুই?উফ! সুপারি পাতার জন্য আজ সূর্যটা উঠছে কোন দিক দিয়ে তা দেখতে পারছিনা।সুমনকে ডেকে গাছগাছালি পাতলা করতে হবে’
মিশু চায়ের কাপ এগিয়ে ধরে বললো,’বাবা এমন করেন কেন?অর্ণব ছোট মানুষ বলে সবসময় বকবেন?কতদিন পরে এসেছে, কোথায় বাপ ব্যাটা মিলে গলা ধরাধরি করবেন তা না করে বকাবকি করছেন’
বাবা চশমা খুলে চেয়ারে আরাম করে বসে চায়ে চুমুক দিলেন।অর্ণব ভেতরে চলে গেছে।নিজের রুমে এসে দরজায় ঠাস করে হাত রাখলো।শব্দ শুনে কুসুম আচমকা ভয় পেয়ে উঠে বসে পড়েছে।বুকের ভেতর কাঁপছে।অর্ণব দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’কি বলেছিলেন বাবাকে?’
-“আআআআআমি কিছু বলিনি’
অর্ণব এগিয়ে এসে ওর পাশে বসে খপ করে কুসুমের হাত ধরতেই ও নড়ে উঠলো।অর্ণব মাথা তুলে বললো,’ব্যাথা?’
-“না মানে….আপনি ওভাবে ধরলেন তো তাই একটু….’
-‘কিভাবে ধরলাম??হাত তো এমন করেই ধরে।একটু কি?’
-‘কাতুকুতু লাগে’
অর্ণব একটা একটা করে টেপ খুলছে।আর প্রতিটায় কুসুম কাঁপছে।ব্যাথায় নয় লজ্জায়।অর্ণবের গায়ের ঘ্রান নাকে এসে লাগলো তখন।
সে মাথা নিচু করে তার কাজে ব্যস্ত। কুসুম কাঁপা ঠোঁটে বললো,’হহহহহহহাতটা একটু ছাড়বেন?’
-“কেন?’
-“আমার কেমন যেন লাগছে।একটু পর হাত ধরিয়েন’
-“আর কত পর?আপনি নাকি কদিন ধরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বসে আছেন আমাদের বাসায় আসার খুশির ঠেলায়।এখন খাবার না খেলে আপনাকে নিয়ে তো আমায় ঢাকা যেতে হবে।আমার বাবা আপনার দায়িত্বকে আপনার বাবা মায়ের পরে আমার ঘাঁড়ে দিয়ে দিয়েছেন।শুলেন না রাত দেড়টার সময় আমায় ধমকিয়ে নিয়ে আসলো কুমিল্লায়।’
কুসুম মাথা নিচু করে ফেললো।তারপর আস্তে করে বললো,’আমি এখনও সে বিষয়ে কারোর সঙ্গে আলাপ করিনি’
-“আর করতে হবেনা।যা বলার আমি বলবো।আপনি কেমন বলতে পারেন তার নমুনা দেখা হয়ে গেছে।’
অর্ণব শেষ টেপটা ছুটিয়ে সুচের প্লাস্টিক ফ্রেমের জায়গায় আঙ্গুল রেখে বললো,’এভাবে কাঁপতেছেন কেন?এমন করলে আমারও হাত কাঁপবে’
-“আপনি একটু পরে করিয়েন।’
অর্ণব চোখ তুলে তাকালো কুসুমের দিকে।ওর দাঁতে দাঁতে ঘষা খাচ্ছে।কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে থুঁতনিতে এসে আটকে আছে।অর্ণবের এমন সময়ে খুব হাসি আসলো তাও হাসলোনা।হাসলে কুসুম আবার কি ভাবে।ব্রু নাচিয়ে বললো,’জানালায় একটা হলুদ পাখি’
কুসুম ঘাঁড় ঘুরিয়ে তাকালো সঙ্গে সঙ্গে।তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে বললো,’কই জানালা তো বন্ধ।পাখি তো নেই’
অর্ণব মুচকি হেসে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে বললো,’কাজ শেষ’
কুসুম হাতের দিকে চেয়ে রইলো অবাক হয়ে।অর্ণব চলে গেছে।হাতটাকে বুকে ধরে হাসলো সে।সকালবেলায় কি সুন্দর একটা মূহুর্তের সঙ্গে সে পরিচিত হলো।এই সকাল আজীবন মনে রইবে।যে মানুষটার ছোঁয়া এত ভালোলাগা সৃষ্টি করলো,অথচ আজকের পর হয়ত সেই মানুষটা থেকে দূরে যাবার কথা হবে।ঝগড়া হবে,মনমালিন্য হবে,রাগারাগি হবে।তারপর আমি আমার বাড়ি আর উনি অন্য কারোর অপেক্ষায়
চলবে♥
জয়েন হোন আমাদের গ্রুপে
https://www.facebook.com/groups/260300312617922/