লীলাবালি🌺 #পর্ব_৮১,৮২

0
443

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮১,৮২
আফনান লারা
৮১

পাসপোর্ট অফিস থেকে বের হতে হতে বেশ সন্ধ্যা নেমে গেছে।ব্যস্ত নগরী ঢাকার রাস্তার ব্যস্ততা যেন সবেমাত্র শুরু।কুসুমের হাত শক্ত করে ধরে কদমের পর কদম ফেলছে অর্ণব।উদ্দেশ্য একটা সিএনজি পাওয়া।
বাসে করে যাওয়া যেতো,বাস ভাড়া সিএনজির তুলনায় অনেক কম।যেখানে বাস ভাড়া ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা সেখানে সিএনজি ভাড়া দুইশ টাকা।কিংবা তার ও বেশি।এরপরেও সিএনজি করে যাবার আরও অনেক কারণ আছে।কুসুম বাসে জার্নি করতে পারবেনা এই অসুস্থ শরীর নিয়ে।কষ্ট হবে তার।মূলত এ কারণেই সিএনজির খোঁজ করা।
খুঁজতে খুঁজতে ফুটপাত শেষ হয়েছে,শেষ হয়েছে ব্যস্ত রোড ও।অথচ এখন পর্যন্ত সিএনজির দেখা মিলছেনা।কুসুমকে একটা দোকানের বাহিরে দাঁড় করিয়ে সে নিজেই একটু সামনের দিকে দেখে আসতে গেলো।

প্রেমিক- প্রেমিকা,প্রবীণ,পথশিশু।বলতে গেলে এই জায়গায় মানুষের অভাব নেই।শান্ত হয়ে দাঁড়ানো দায় হয়ে যায়।অর্ণব কোথায় যে গেলো,এখনও আসার নাম নিচ্ছেনা।এদিকে মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সহজবোধ্য ঠেকছেনা।তাই সে একাই ঐ জায়গা ছেড়ে হাঁটা ধরলো সামনের দিকে।যেদিকে অর্ণব গিয়েছে সেদিকে।কিছুটা পথ এসে দেখলো পথ শেষ।বিশাল বড় বাউন্ডারি মাটি থেকে উপর পর্যন্ত।তবে কি তার ভুল হলো কোথাও?পেছনে ফিরে আবার সেই দোকানটা সে দেখলোনা যেটার সামনে এতক্ষণ সে অপেক্ষা করেছে।ঐদিনকার মতন আজও কি সে হারিয়ে গেছে?তবে কি করে আবার খুঁজে পাওয়া যাবে উনাকে?
কপালের ঘাম মুছে উল্টো পথে হাঁটা ধরলো সে।কোথাও অর্ণবকে দেখা যাচ্ছেনা।এদিকে মাথা ঘুরছে জোরে জোরে।যেন এক্ষুনি নিচে পড়ে যাবে।
মাথায় হাত দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলাকে সে জিজ্ঞেস করলো উনি সাদা পাঞ্জাবি পরা কাউকে দেখেছেন কিনা।ভদ্র মহিলা প্রথমে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে ছিলেন।
এই শহরে শত শত ছেলের গায়ে সাদা পাঞ্জাবি দেখা যায়।তবে এই মেয়েটা কোন ছেলের কথা জানতে চাইছে??
তিনি উত্তর দিতে চাইলেন কিন্তু তার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে কুসুম।
অর্ণব একটা সিএনজিকে দাঁড় করিয়ে আগের জায়গায় ফিরে এসেছে কুসুমকে নিয়ে যেতে। এসে দেখলো কুসুম ওখানে নেই।এই জায়গায়,এই সিচুয়েশনে ওকে হারিয়ে ফেললে বিষয়টা কত মারাত্নক হবে তাই ভেবে মাথায় হাত চলে গেছে তার।
ওর চিন্তায় বিভোর হয়ে ফুটপাত ছেড়ে মেইনরোডে নেমে পড়েছে সে।
ওর নাম ধরে কয়েকবার ডাকার পর কিছুদূর আসতেই মানুষের ভীড় নজরে পড়লো।কুসুম হতে পারে কিনা,তার কিছু হয়েছে কিনা এসব ভাবনার সঙ্গে যুদ্ধ করে সে ঐ ভীড়ের কাছে এসে উপস্থিত হলো।ঐ ভদ্র মহিলা কুসুমের মাথা তার কোলে রেখে বোতল থেকে পানি নিয়ে ছিঁটাচ্ছিলেন।অর্ণব সামনে থেকে মানুষ সরিয়ে নিচে বসে এক টানে কুসুমকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো।ওর মুখে ছিঁটানো পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,’কি হয়েছে ওর?’

‘আমাকে হয়ত তোমার কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, আমি কিছু বলার আগেই অজ্ঞান হয়ে গেলো।ওর কি হও তুমি?’

‘স্বামী’

কথাটা বলে অর্ণব ওকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো।দাঁড় করিয়ে রাখা সিএনজিতে এনে তুললো ওকে।ওরা এখন যে জায়গায় সেখানে দূর দূরান্তেও কেনো হাসপাতাল নেই।থাকলেও সেটা বহুদূর। কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় বাবাকে কল করে জানতে চাইলো এই মূহুর্তে কি করবে সে।বাব ওকে জলদি বাসায় চলে আসতে বললেন কুসুমকে নিয়ে।তাই করেছে সে।ওকে নিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসলো।মিশু ভাবী আর মা মিলে ওর হাত পা ঘঁষে,চোখ মুখে পানি দিয়েও জ্ঞান ফেরাতে পারলেন না।
বাধ্য হয়ে কাছের একটা ফার্মেসী থেকে ছোটখাটো একজন ডাক্তার ডেকে নিয়ে এসেছে সাগর ভাইয়া।
অর্ণব কুসুমের ডাক্তারকে দু তিনবার ফোন করেছে।তিনি ব্যস্ত থাকার ফলে রিসিভ করলেননা।
ব্রেইন টিউমার শুনে সাগর ভাইয়ার আনা ডাক্তার ভয়ে কোনো চিকিৎসা করেননি।বললেন যে হাসপাতালে ওর চিকিৎসা করানো হয়েছিল সেটাতেই নিয়ে যেতে।এখন কিছু করলে যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে তো সবাই ওনাকেই দোষারোপ করবে।
অর্ণবকে কুসুমের কাছে রেখে সবাই বাহিরে বসে কথা বলছিল।সাগর এম্বুলেন্সে খবর দিচ্ছে।কুসুমের মা চিৎকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন।
—-
‘কুসুম!শুনতে পাও!!কি হয়েছে তোমার?বলবেনা?দেখো আমি তোমার পাশে।তোমার হাত ধরেছি।তাকাবেনা?লজ্জা পাবেনা?তোমার শরীর নড়ছে তো,বেশ দেখছি।ঠিকঠাক শ্বাস নিচ্ছো তাহলে কেন চোখ মেলে তাকাওনা কুসুম?’

কুসুমের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথাগুলো বলছিল সে।সেসময়ে মা ঢুকতে চেয়েছিলেন রুমে।ওকে আবেগী দেখে আর ঢুকলেননা।একা থাকতে দিলেন।
অর্ণব কুসুমের হাতের তালু ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,’দেখো আমাকে ভয় দেখাবেনা।আমি জানি তুমি এখনই আমার দিকে তাকাবে।ফ্যাল ফ্যাল করে।তাকাও’

এরপরেও কোনো উন্নতি হচ্ছেনা দেখে অর্ণব কুসুমের আরও কাছে এসে বসলো।ওর ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বললো,’আমি কিন্তু জুথিকে কখনও ছুঁইনি,মোট কথা জীবনে কোনো নারীকে ছোঁয়া হয়নি এমন করে।তোমায় ও ছুঁতাম না।কিন্তু তোমার চোখ বন্ধ অনেক সময় ধরে তো!যেটা আমার সহ্য হচ্ছেনা।আমার অস্বস্তি হচ্ছে।তোমার চোখ মেলাতে হবে।তার জন্য আমার মন আমাকে যে পথ দেখায় আমি সে পথেই চলবো।আমি জানি তুমি রাগ করবেনা আমার এই কাজে।দেখো এখনও সময় আছে চোখ মেলে তাকাও নাহলে যেটা ভাবছি সেটাই করে নেবো’

কুসুম চোখ মেললোনা।অর্ণব ওর মুখটা ধরে তাকিয়ে আছে।
জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে কুসুমের মুখ থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,’আমি এটা পারবোনা যাও।আমাকে দিয়ে হবেনা।তুমি চোখ মেলো।আমাকে দিয়ে এত বড় সাহসের কাজ হবেনা।এত পরীক্ষা নিওনা।দেখো আমি কত কষ্টে আছি।একবার দেখো’

সব রেখে দু মিনিট চোখ বন্ধ করে বসে ছিল সে।কুসুম যেন পাথর হয়ে গেছে।ওর এমন নিস্তব্ধ হয়ে থাকা তার গায়ে আগুনের লাভার মতন ঝরছে।
দম আটকে কুসুমের দিকে ফিরে বসলো পুনরায়।অসহায়ের মতন ওর দিকে আরও কিছু সময় তাকিয়ে থেকে মাথা এগিয়ে এনে ওর ঠোঁটের খুব কাছে গিয়ে থামলো।সিনেমায় দেখে চুমু দিলে নায়িকার জ্ঞান ফিরে।
এটা সিনেমা নয়,বাস্তব।
তবে তাই হোক।সিনেমার মতন না হোক।
কুসুমের পিঠে হাত রেখে ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো সে।
নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আস্তে আস্তে বললো,’আমায় আর একটিবার দেখো,আমি যে তোমার চোখ বন্ধ আর দেখতে পারছিনা।’

‘আমি তো ভাল আছি’

কুসুমের কথা শুনে অর্ণবের অশ্রু ঝরা থামলো।ওকে বুক থেকে সরিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
কুসুম অর্ণবের এমন হাল দেখে অবাক হয়ে আছে।কেমন অবস্থা করে রেখেছে সে নিজের সামান্য কিছু সময়ের মধ্যে, এটা দেখে সে আশ্চর্য হয়ে বসে আছে।
—-
আজ ভোরে রওনা হবে জুথি আর তার পরিবার।বাবাকে কিছু জানানো হয়নি।সারপ্রাইজ দেবে মা তাই।
এদিকে জুথি মৃদুলের চিন্তায় শেষ।সে চায়না মৃদুল জানুক।

এদিকে এয়ারপোর্টের পাশাপাশি একটা হোটেলে রুম ভাঁড়া নিয়েছে মৃদুল।কাল সকালে গিয়ে এয়ারপোর্টে বসে জুথিকে ভিডিও কল দেবে।সে চায় জুথিকে হাতেনাতে ধরতে।হবু শাশুড়ির সাথে আলাপ ও হয়ে যাবে। একটা বুদ্ধি করে আগে থেকে কল করা বন্ধ রেখেছে সে।
এদিকে জুথি ভেবেছে ও হয়ত সব ভুলে কাজে ব্যস্ত বলে আর কল করছেনা।
তার কল না করার কারণ ওর কাছে অজানা।
—-
‘তুমি জানো? আমার তো জানটাই বের হয়ে আসছিল’

‘হুম বুঝতে পারতেছি’

‘কেন এমন ভয় দেখাও বলো তো??আমি তো ভেবেছিলাম!’

‘মরে গেছি,তাই তো?’

‘না,তা কেন ভাববো?।’

কুসুম হাত বাড়িয়ে অর্ণবের চোখের পানি মুছে দিয়ে ওকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরেছে।
তখন কুসুমের মা কাঁদতে কাঁদতে আসতেছিলেন কুসুমকে একবার দেখতে।ওদের এমন অবস্থায় দেখে তিনিও চলে গেলেন অর্ণবের মায়ের মতন।ঢুকলেননা ভেতরে।

‘জানো আমি তোমায় বড্ড ভালবেসে ফেলেছি।তোমার বন্ধ চোখজোড়া আমার জানটা নিয়ে যাচ্ছিল আর একটুর জন্য।
আমার দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।তোমায় ছাড়া কিসের মাঝে ছিলাম এতক্ষণ তা যদি তুমি দেখতে।বিশ্বাস করো!!মৃন্ময়ীর বেলায় আমার এই অনুভূতি হয়নি,তাকে হারিয়ে আমার এই কষ্ট হয়নি যতটা আজ হচ্ছিল।তুমি বিশ্বাস করো আমি তোমাকেই ভালবেসেছি,এর আগে কাউকে না।’

চলবে♥

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৮২
আফনান লারা
.
অর্ণবের মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনে কুসুম কি বলবে না বলবে ভেবে পাচ্ছিলনা প্রথমে।
মনে হলো সে বুঝি আবেগের বশে কিংবা ওর অসুখে গলে এমনটা বলছে।আজ পর্যন্ত সেসবই তো ভেবে এসেছে সে। কিন্তু আজ ওর অশ্রুসিক্ত চোখ সত্যি কথা বলছে।
ওর চোখের পানি প্রতিটি ফোঁটা বলে দিচ্ছে ওর বলা কথা সত্য, অনুভূতি সত্য!এগুলো আবেগ হতে পারে না।
কুসুম যখন ওর অনুভূতিগুলোকে সত্যি হিসেবে গ্রহণ করে নিলো তখন তার চোখের পানি অর্ণবের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে গেছে।
অর্ণব ওকে কাঁদতে মানা করার পরও সে তার কান্না বন্ধ করতে পারেনি।
কিছু সময় বাদে ভাঙ্গা গলায় কুসুম বললো,’আমি আপনার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি নিজের অজান্তেই।আমায় মাফ করে দিয়েন,আমি আপনাকে বুঝতে পারিনি’

অর্ণব মুখে হাসি ফুটিয়ে ওর থুঁতনি টেনে দিয়ে বললো,’তুমি যে অবুঝ! ভালোবাসার কথা এতদিনে বুঝতে পেরেছো এইতো অনেক! না বুঝলে তো এখন আমার বসে বসে তোমায় বুঝাতে হতো। এমনিতেও ক’দিন ধরে কম জ্বালাওনি, খালি এক কথা… তার অসুখ বলে তার কেয়ার করি আমি। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে চড় মেরে গালের বারোটা বাজিয়ে ছাড়তে, পরে মনে পড়ে এমন সাধের গাল দীর্ঘ এক বছর ধরে লাল বর্ণ ধারণ করে থাকবে ‘

সেসময়ে অর্ণবের মা দরজার ওপাশ থেকে বললেন,’ রাজ্যের কথা বলার জন্য সারারাত পড়ে আছে। মেয়েটা না খেয়ে আছে। ওকে খাওয়াতে হবে,তুই হাত মুখ ধুয়ে আয় যা। কুসুমের মা ওকে খাইয়ে দেবে ততক্ষণে’

অর্ণব কুসুমের হাত ছেড়ে নেমে জুতা পরছিল।তখন কুুসম ওকে দেখে মিটমিট করে হাসছিল।
সেটা বুঝতে পেরে অর্ণব ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,’ তাহলে এতদিন পর আপনার নজরে পড়েছে সুন্দর বরটাকে’

‘আমি সবসময় আপনাকে দেখি, তফাৎ হলো আপনি লক্ষ করেন না কখনই। হয়তবা লক্ষ্য করেন কিন্তু জানেন না কি লক্ষ করেন।
ঠিকভাবে বলতে পারবেন আমি কাল কি রংয়ের দুল পড়েছিলাম?? ‘

‘উমমমমমম…লাল?’

‘না’

‘ নীল? গোলাপী?’

‘ আসলে আমি এক সপ্তাহ ধরে কোনো দুলই পরি না।’

কথাটা শুনে অর্ণব চোরের মতো একটা লুক নিয়ে ওইখান থেকে পালিয়ে চলে গেলো।
কুসুমের তাতে একটুও খারাপ লাগেনি। ওর অন্য কোনো দোষই তার কাছে দোষ বলে মনে হয় না কখনোই। সেই অনেক বছর আগ থেকেই অর্ণবে সকল দোষ ভুলে যাবার খাতায় রাখে।
—-
মা লোকমা তুলছিলেন আর হাসছিলেন।কুসুম প্রথমে খেয়াল করেনি।পরে মাকে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করে বসলো।

‘হাসছি কারণ জামাই তো তুই বলতে পাগল’

কুসুম অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো পাগলের কি দেখেছে মা।

‘দেখা লাগে??তোর অজ্ঞান হওয়া নিয়ে সে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলো।আমরা তোকে নিয়ে কি কান্নাকাটি করবো তার অবস্থা দেখে আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি থেকে কি হবে।খেতে না বললে সে এখনও তোর হাত ধরে বসে থাকতো।জানিস রে মা,তোর বাবা আর আমি ভেবেছিলাম অর্ণব বাবা বুঝি আর কখনও তোকে মেনে নেবেনা,কিন্তু আজকালকার দৃশ্য একেবারে আলাদা কথা বলে।সে তো তোর জন্য পাগল হতে বসলো।
আমি জানতাম তুই ওকে তোর প্রেমে ফেলতে বাধ্য করবি’

‘আমি তো কিছু করিনি’

‘তুই যেটা করিসনি সেটাতেই মুগ্ধ হয়েছে।আর কিছু করতেও হবেনা।যে পাগল হবার সে কাশি দিলেও পাগল হয়।’

কুসুমের মাথার উপর দিয়ে গেলো সব।চুপচাপ খাবারটা খেয়ে অপেক্ষা করছে অর্ণবের আসার।
ওখানে অর্ণবের মা ওকে জোর করে আটকে রেখে পেট পুরে রাতের খাবার খাওয়াচ্ছেন।দুই ছেলেকে একসাথে পেয়ে আজ রান্নার পদে এলাহি কান্ড।
যদিও মিশু রেঁধেছে সব।অর্ণবের খাওয়াতে মন ছিল না একটুও।সে বারবার ছুঁতো খুঁজছিল কুুসুমের কাছে গিয়ে বসার।কিন্তু তাকে কেউ এক বিন্দু নড়তেও দিচ্ছেনা।একের পর এক পদ এনে হাজির করছে সামনে।
টেংরা মাছ,মুরগী,চিংড়ি ভুনা।
ভাত খাওয়া শেষ হবার পর এবার খেতে লাগিয়ে দিয়েছে ফিরনি।
পেটে খিধে থাকায় সবার জোরাজুরি কাজে দিয়েছে।তাকে যা যা দিচ্ছে সেসবই সে খেয়ে ফেলছে।
ফিরনির শেষে দম ফেলে অবশেষে রেহায় মিললো তার।সোজা কুসুমের রুমের দিকে এসে ঢুকতে যাওয়া ধরতেই দেখলো দরজা বন্ধ।
আশ্চর্য হয়ে এদিক সেদিক তাকালো একবার।হঠাৎ দরজা বন্ধ করার কি কারণ তাই তো মাথা দিয়ে ঢুকছেনা।কলি দু পাশে দুটো বেনি করে নামতা পড়তে পড়তে যাচ্ছিলো।অর্ণব ওকে থামিয়ে জানতে চাইলো দরজা বন্ধ কেন।

‘বুবু তো গোসল করে’

‘তাই বলে রুমের দরজা বন্ধ রেখেছে কেন?’

‘বাহহ রে আপনি জানেন না??আপনার বাথরুমের দরজার ছিটকিনি ভেঙ্গে গেছে।আপনার আম্মা আজকে ঐখানে গোসল করতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে একেবারে ছিটকিনি ভেঙ্গে ফেলছে’

কথাটা বলে কলি ফিক করে হেসে ফেললো।অর্ণব এবার বুঝতে পারলো মেইন দরজা লাগানোর মানে।তাই সে অপেক্ষা করছে বাহিরে দাঁড়িয়েই।হঠাৎ সাগর ভাইয়া সেখানে এসে বললেন,’আমি এসেছি, কোথায় আড্ডা দিবি,তা না করে বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিস?এই মেয়েটাকে বিয়ের ভয়ে তুই তিন বছর ঘর ছাড়া ছিলি?বিশ্বাস করতে বড্ড কষ্ট লাগে’

অর্ণব মাথা চুলকে ভাইয়ার পিছু পিছু চললো।সে ভেবেছিল ভাইয়া হয়ত নিচে বাগানের দিকে যাচ্ছে।কিন্তু নাহ, যেটা নিয়ে ভয় থাকার সব সময় সেটাই ঘটে।ভাইয়া সোজা ছাদের দিকে যাচ্ছিল।অর্ণব হাত ধরে থামিয়ে তাকে যেতে মানা করেছে।সে কারণ জানতে চাইলো।
পরে শেয়ালের কথা শুনে অর্ণবকে রেখেই এক দৌড় মেরেছে সোজা বাসার ভেতর।
শেয়ালকে অর্ণব যেমন ভয় পায় তার দ্বিগুণ সাগর ভয় পায়।
মিশু সাগরকে এমন ছুটে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।
সাগর ইশারা করে বলে দিছে যেন সত্যিটা না বলে।বউয়ের সামনে ভীতু হওয়া মন্দ মানে মহামন্দ।
সারাজীবন ধরে খিলখিল করে হাসবে আর বলে বেড়াবে তার স্বামী শেয়ালে ভয় পায়।
অর্ণব এবার বুঝতে পেরেছে ভীতু হওয়া তার ভাইয়ার স্বভাব থেকে পেয়েছে।
এখন মিশু ভাবীকে তো কিছু একটা বলে বোঝাতে হবে।তাই অনেক ভেবে বললো,’ঐ আসলে আমি ভাইয়াকে দৌড়ানি দিয়েছিলাম।ভাইয়া একটা দুষ্টু কথা বলেছে তো তাই।ঐ কথাটা কি সেটা তোমায় বলতে পারবোনা।’
—-
চুলে গামছা বেঁধে বিছানাটা একটু ঝেড়ে নিচ্ছে কুসুম।বালু বালু মনে হয়েছিল।ওপার থেকে অর্ণব আর সাগরের হইহুল্লড় শুনে সে আর ওর অপেক্ষায় নেই।
এতদিন পর বড় ভাইকে পেয়েছে অর্ণব।এরকম মজা করাই স্বাভাবিক।
কুসুম ভাবলো হয়ত সে অনেক রাত পর্যন্ত ভাইয়ার সাথে গল্প করবে।
কিন্তু তখনই বিছানা করার সময় তার কাজে বাধা দিলো অর্ণব নিজে এসে।
ওর হাত থেকে বালিশ কেড়ে নিয়ে অগ্নিময় চাহনি নিক্ষেপ করে বললো,’তোমায় কে বলেছে ওমন শরীর নিয়ে কাজে নামতে?ঘরে মানুষের কি অভাব পড়েছে?’

‘এই টুকুন কাজ করলে মরে যাব না’

‘মরার কথা সারাদিন বলতে থাকলে সে মানুষ সহজে মরেনা।’

কুসুম কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আপনি চান আমি মরি?’

‘সেটা কখন বললাম?’
—–
‘কিরে গালে হাত রেখে বসে আছিস কেন?মৃদুল ফোন করেছিল বুঝি?’

‘না আম্মু,সেটাই তো সমস্যা। হুট করে কেমন বরফের মতন ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।ভিডিও কল,শুধু কল তো দূরে থাক একটা মেসেজও করছেনা।তার কি হলো,বা এর কারণ কি হতে পারে সেটাই মাথায় ধরছেনা।’

‘এ তো ভাল।হয়ত সে ধরে নিয়েছে তুই দেশে ফিরবিনা তাই সে অন্য একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে’

ফ্লাইটের আর আধা ঘন্টা বাকি।জুথি ফোনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ফোনটাকে উল্টে পাল্টে শেষে মৃদুলকে একটা কল দিলো।
রিং কয়েকবার হবার ওর সে রিসিভ ও করেছে।

‘হুমমম….. হ্যালো বলো’

‘ঘুমাচ্ছেন?’

‘এত রাতে আর কি করবো?একটু চিল করছি।বাসা থেকে দূরে এসেছি।তা হঠাৎ কল দেবার কারণ?’

জুথি ভাবলো মৃদুল ট্যুরে গেছে।তাই খুশি হয়ে বললো,’আপনার এমন শীতল ভাব কেমন যেন লাগছিল।কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছিলাম না’

‘এত ঢংয়ের বাক্য পেশ না করে,বলে দিলেই পারো তুমি আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো’

জুথি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একবার মায়ের মুখটা দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’মোটেও না,রাখছি।আমি শপিংয়ে এসেছি’

‘শপিংমলে মাইকে বলতেছে নেক্সট ফ্লাইট ৩০মিনিট পর?’

জুথি জিভে কামড় দিয়ে ফোনটাই রেখে দিলো।মৃদুল এত চালাক কেন!!
মা পপকর্ণ খাচ্ছিলেন।জুথির দিকে চেয়ে বললেন,’ওরে পছন্দ করিস?’

‘একদম না’

‘বড় জার্নি করার আগে মানুষ কেবল আপন মানুষকে কল করে খোঁজ নেয়।বুঝলে!তোমার আগে দুনিয়া আমি দেখেছি,আমার দেখার দিন দীর্ঘ, সুতরাং আমায় বুঝিয়ে লাভ নেই এতো।সে যাই হোক,আমার কাজ কেবল চার হাত এক করে দেওয়া’
—–
খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে দুজনে।দরজা বন্ধ হবার পরও বাহিরে থেকে মিশু ভাবীর হাসি শুনা যাচ্ছে,মায়ের সাথে কি নিয়ে যেন হাসছেন।
কুসুম তার হাতের বালা দুটোকে ধরে দেখছে চুপ করে।আর অর্ণব ওর শাড়ীর আঁচলে গিট্টু বাঁধতে ব্যস্ত।

‘আচ্ছা যদি বলি আমার থেকে কিছু চাও।তুমি কি চাইবে?’

‘কেন দেবেন? ‘

‘কিছু দিতে মন চাইলো তাই’

‘সত্যি দেবেন?’

‘হুমমম।বলে দেখোইনা’

‘আমি যদি মারা যাই তবে ঐ জবা ফুলগাছটার তলায় আমার কবর দিবেন?’

কুসুমের মুখ থেকে এই কথা শুনে অর্ণবের ভীষণ রাগ হলে।হনহনিয়ে চলে গেলো বিছানা ছেড়ে সোজা বারান্দায়।কুসুম জানতোনা ও এমন রাগ করবে।সে ভাবলো, হয়ত সামান্য বকা দিয়ে দেবে। কিন্তু এ দেখি একটু বেশি হয়ে গেলো।

ঢোক গিলে ওর পিছে এসে কুসুম দাঁড়িয়েছে প্রায় অনেক সময় হলো।অর্ণব গ্রিলে হাত রেখে বাসার সামনের জায়গাটার দিকে চেয়ে ছিল।
কুসুম এক পা, একা পা করে এগোচ্ছে।শেষ পর্যন্ত ওর পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে বললো,’শরি’

‘ওটা সরি হবে,কে শেখালো?’

‘মিশু ভাবী’

অর্ণব আবার চুপ।কুসুম ওর পাঞ্জাবির একটু খানি ধরে সে নিজেও মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে।
অর্ণব টের পেয়েও কিছু বলেনি।

‘কথা বলবেন না তাহলে?’

‘না’

“”না “”””টা ঠিক করে বলতে পারেনি অর্ণব।কুসুম ওর বুকের মধ্যে নিজের সবটা জায়গা করে নিয়েছে তার আগেই।পাঞ্জাবিতে মুখ ডুবিয়ে ফেললো একেবারে।এমন ভাবে ধরলো যেন সে দম ফেলতে মুখটা উপরে তুলতে হবে।অর্ণব নিমিষেই গলে যাবার পরেও ওকে একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত ভেবে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কুসুম ওর বুকে নাকটা ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,’দেখি আজ আপনার রাগ কতকাল থাকে’
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here