চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস #মম_সাহা পর্বঃ চব্বিশ

0
307

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস
#মম_সাহা

পর্বঃ চব্বিশ

চিত্রার আধো রহস্য মাখা কথা আধা-ই রইলো। সে পুরোটা বিশ্লেষণ করলো না বাহারের কাছে, কেবল কতক্ষণ বিজ্ঞ ব্যাক্তিদের মতন ভাবুক হয়ে রইলো। যেন রাজ্যের ভাবনায় মত্ত সে!

হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা পেরিয়ে রিকশা নিলো বাহার। দু’জনই রিকশায় উঠে বসলো। নিস্তব্ধ রাস্তা, হুড়মুড় করে বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে আদুরে ভাবে। বাহার চুপ করে রইলো, সাথে চুপ রইলো চিত্রাও। আকাশে রূপোর থালার মতন চাঁদ। অক্টোবর এসেছে বিরাট জ্যোৎস্না নিয়ে। ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে শরীরে ক্লান্তিটাও ক্ষাণিক বিশ্রামে গেলো। কয়েকদিন পর তো আবার শীত আসবে। শীতকাল চিত্রার বেশ প্রিয়। কেমন মিষ্টি অলসতায় কাটে। চিত্রা আবার বেশ অলসতা প্রিয়।

দু’জনের নিশ্চুপ ভাবনার মাঝে রিকশা এসে থেমেছে চিত্রাদের গলির মুখে। চিত্রা ঝটপট বাহার ভাই টাকা বের করার আগে নিজেই রিকশা ভাড়া দিয়ে দিলো। তা দেখে বাহার কিঞ্চিৎ হাসলো। পকেট থেকে সিগারেট বের করে তা দুই ঠোঁটের ভাঁজে চেপে লাইটার জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,
“বেশ চালাক হচ্ছো যে!”

বাহারের বাক্যের মানে চিত্রার ঠিক বোধগম্য হলো। মুচকি হেসে সে বললো,
“আপনার সাথে থাকি, আর চালাক হবো না?”

“তা বেশ ভালো। চালাক হতে ক্ষতি কি! তবে চিন্তা নেই, চাকরি পেলে তোমার রিকশা ভাড়ার দায়িত্বটা আমি নিজের কাঁধে নাহয় নিয়ে নিবো।”

“আপনি চাকরি করবেন?”

হাঁটকে হাঁটতেই বাহারের দিকে তাকিয়ে চিত্রার প্রশ্ন। বাহার পায়ের কাছের খালি বোতলটা তে ছোটো লা* থি দিয়ে বললো,
“ভাবছি তো করবো। রিকশা ভাড়াটা দেওয়ার জন্য হলেও চাকরি করা জরুরী।”

“তারপর আমায় বিয়ে করবেন তো, বাহার ভাই?”

চিত্রার প্রশ্নে বাহার বিশেষ অবাক হলো না। কারণ সে জানে, বয়ঃসন্ধিরা আবেগ প্রকাশ করতে ভীষণ পছন্দ করে। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ তার প্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে একটু বেশিই বেহায়া হয়ে যায়। চিত্রাও তার বাহিরে না।

বাহারকে চুপ থাকতে দেখে চিত্রা আবার প্রশ্ন করলো,
“আমি আপনার এতটাই অপছন্দ?”

“তুমি তো তোমার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে তাই না? ঐ যে ভদ্র সুশীল ছেলেটাকে।”

বাহারের ঠাট্টা মাখানো কথায় ছোটো হয়ে এলো চিত্রার মুখ। ক্ষীণ স্বরে সে বললো,
“আমার তো অ-ভদ্র আপনিটাকেই পছন্দ।”

“বয়ঃসন্ধির আবেগ দিয়ে ফাঁসাতে চাচ্ছো?”

“একদম না, অষ্টাদশীর ভালোবাসা দিয়ে ফাঁসাতে চাচ্ছি।”

বাহার আর উত্তর দিলো না। চিত্রা মন খারাপ করে বললো,
“চাকরি টা হবে তো?”

“তোমার সাথে সংসার করতে হলে, চাকরিটা হতেই হবে, তাছাড়া উপায় নেই। আচ্ছা, তোমার বাড়ির চিলেকোঠার ঘরের মতন একটা ঘরে কী কী আসবাবপত্র লাগবে বলো তো? সংসার সম্পর্কে ধারণা কম তো!”

বাহারের এমন অপ্রত্যাশিত কথায় হতভম্ব চিত্রা। চোখ-মুখে খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সে চমকে যাওয়া কণ্ঠে বললো,
“এ জন্যই কি চাকরির খোঁজ করছেন?”

“তোমার ভাই বেকারের কাছে তার বোনকে দিবে? যদি দেয় তাহলে নাহয় খোঁজ না করলাম।”

চিত্রা কিছুক্ষণের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেলো। বাহার ভাই এত সহজে মেনে যাবে তা যেন তার ধারণার বাহিরে ছিলো। চিত্রা আর কিছু বলতে গেলেই থামিয়ে দিলো বাহার। ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“বাড়ি এসে পরেছে, ভিতরে যাও। সংসার করতে হলে ভালো রেজাল্ট চাই, নাহয় সেসব চিন্তা বাদ।”

চিত্রা এতক্ষণ এতটাই অবাক হয়ে ছিলো যে সে যে নিজের বাড়ির গেইটের সামনে চলে এসেছে তা তার খেয়ালই ছিলো না। বাহারের কথায় আশপাশ তাকিয়ে দেখলো সত্যিই সে তার বাড়ির সামনে। বাহার চিত্রাকে আর কিছু না বলে সোজা হাঁটা ধরলো। চিত্রা বেশ উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলো,
“বাহার ভাই, আপনি আমার পুরো জীবনের লাল কালির পূর্ণতা যা জ্বলজ্বল করবে আমার প্রাপ্তির খাতায়।”

বাহার অবশ্য কথাটা শুনেও ফিরে তাকালো না। চিত্রা কতক্ষণ বাহারের ফেরার অপেক্ষা করে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। বাহার বুঝলো, তার পিছে যে অষ্টাদশীর ছায়া নেই। বাহার আকাশের দিকে তাকিয়ে বেশ বিষণ্ণ, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“রঙ্গণা, তুমি আমি বিশাল অপ্রাপ্তির জীবনে হয়তো আরও একটা অপ্রাপ্তি। বাহারদের অনেক স্বপ্ন ঠিকই থাকে, কিন্তু তা ঝরে যায় রাতের আঁধারে। তুমি সকাল অব্দি থাকলেও পারো, রঙ্গণা। বাহার খারাপ, তবে তার স্বপ্ন না। আমাদের একটা ছোটো সংসার হলে খারাপ হয় না, আমি অপ্রাপ্তির জোয়ারে গা ভাসিয়ে কিঞ্চিৎ প্রাপ্তি পেয়ে যেতাম তোমায় পেয়ে। আফসোস! বাহারদের জীবনের স্বপ্ন গুলো ঐ দূর আকাশের চেয়েও দূরের। যা ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। তুমি নাহয় মেয়ে, বৃষ্টি হয়ে দিও ছুঁয়ে।”

বাহারের কথা গুলো কি শুনলো রঙ্গণা? হয়তো না। তাতে কি? একটা গোটা রাত তো দেখলো সংসার সাজানোর স্বপ্ন কত সুন্দর হয়! একটা গোটা আকাশ তো জানলো, অপ্রাপ্তিদের কত বেদনা হয়!

(৬১)

মহিনের কেইসটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আরও সপ্তাহখানেক আগে। একদম গোলকধাঁধায় মতন এটা একই জায়গায় কেমন ঘুরপাক খাচ্ছিলো, তাই তো বন্ধ করে দেওয়া হয়। মহিনের ভাই মাহতাবই বন্ধ করে দিতে বলে। এই গোলকধাঁধায় আর কতদিনই বা ঘুরপাক খাবে? এরচেয়ে থেমে যাক সব ঝামেলা। নুরুল সওদাগররা লাস্টে আরেকটা ক্লু পেয়েছিলো যে এ* সিড নিক্ষেপ করা ছেলেদেরকে অনবরত যে সিম থেকে ফোন দেওয়া হতো সেই সিমটা কার নামে। ইনভেস্টিগেশন করতে গিয়ে দেখা গেলো ঐ দুই ছেলের মাঝেই একজনের আইডি কার্ড দিয়ে সিমটা কেনা হয়েছিলো। কাকে ধরবে আসামি হিসেবে? ঐ ছেলে দু’ টোকেও তো খু* ন করা হয়েছে। পরপর তিনজন মানুষকে একই ব্যাক্তি খু* ন করেছে কিন্তু সঠিক, স্বচ্ছ প্রমাণের অভাবে বন্ধ হয়ে গেলো ইনভেস্টিগেশন।

তপ্ত দুপুরে বিরক্ত ভঙিতে মাহতাব এসে বসলো তার ঘরে। চাঁদনী নিচ থেকে ঠান্ডা শরবত নিয়ে এলো। আজকাল মাহতাব হুট করেই কেমন রেগে যায়। মেজাজ চরম খিটখিটে থাকে তার। চাঁদনী মাহতাবের হাতে লেবুর শরবতটা ধরিয়ে দিয়ে আঁচল দিয়ে মাহতাবের মুখের ঘাম মুছিয়ে দিতে নিলেই তার হাত আটকে দেয় মাহতাব। চাঁদনী কিঞ্চিৎ অবাক হয়, উদগ্রীব হয়ে বলে,
“কী হয়েছে তোমার? অফিসে ঝামেলা হয়েছে?”

মাহতাব শরবত টুকু খেয়ে বেশ শব্দ করে টেবিলের উপর গ্লাসটা রাখে। তপ্ত শ্বাস ফেলে কর্কশ মেজাজে বলে,
“চাকরিটা চলে গিয়েছে।”

চাঁদনী বেশ অবাক হলো। মাহতাব সবসময়ই বেশ কর্মঠ লোক। তার চাকরী যাওয়ার তো কথা না। ব্যতিব্যস্ত হয়ে সে বললো,
“চাকরি চলে গিয়েছে মানে? কেনো?”

“মানুষ কি একজনের ভালো আরেকজন সহ্য করতে পারে? পারেনা। যেমন তোমার মা পারে নি চিত্রার ভালো সহ্য করতে তেমন অফিসের কিছু মানুষ আমার ভালো সহ্য করতে পারে নি। চিত্রার ঘর ছাড়তে হলো আর আমার চাকরি।”

চাঁদনী বেশ অবাক হলো তার স্বামীর কথায়, বেশ শক্ত কণ্ঠে ও বললো,
“তুমি কিসের সাথে কি মেলাচ্ছো, মাহতাব? আমার মা তোমার গুরুজন হয়, সম্মান দিয়ে কথা বলো।”

“যে নিজেই নিজের সম্মান রাখতে পারে না, তাকে আবার কিসের সম্মান দিবো হ্যাঁ? তোমার মা বলে তো আর সে অন্যায় করে পাড় পেয়ে যাবেনা তাই না?”

মাহতাবের কথায় তুমুল তাচ্ছিল্যের সুর। চাঁদনী হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো তার স্বামীর দিকে। অবশ হয়ে আসে তার অনুভূতিরা। সে বিধ্বস্ত কণ্ঠে কেবল বলে,
“মাহতাব!”

মাহতাব উত্তর দেয় না, গটগট পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। চাঁদনী কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখে।

(৬২)

বনানীর বিলাসবহুল এক ফ্লাটের ডাইনিং রুমে রাতের খাবারের আয়োজনে বেশ তৃপ্তি নিয়ে আহার করছে ছোটো এক সুখী ফ্যামিলি। এই পরিবারটা নওশাদের। মা-বাবা আর নওশাদকে নিয়েই তাদের ছোটো পরিবার।

নওশাদ খেতে খেতে তার মা নওরিন খাতুনের দিকে তাকিয়ে বেশ আয়েশি ভঙিতে বললো,
“মা, তোমাদের কিছু বলার ছিলো।”

নওরিন খাতুন তখন মাছের কাঁটা বাছায় ব্যস্ত। ছেলের কথায় ছেলের দিকে তাকালে, হাস্যোজ্জ্বল মুখ মহিলার। মিষ্টি করে শুধালো,
“কী কথা?”

“তোমরা আমার বিয়ে নিয়ে উঠে পরে লেগেছো, সেই সম্বন্ধেই কথা।”

নওশাদের বাবা ইলিয়াস খান খাবার চিবুতে চিবুতে বললেন,
”ও হ্যাঁ ভালো কথা মনে করেছো, নুরুলদের বাড়ি থেকে তো আর কোনো খবর পেলাম না। আজই নাহয় একবার কল দিয়ে জিজ্ঞেস করবো।”

“জিজ্ঞেস পরে করো, আগে আমার কথা শুনো বাবা।”

“কী কথা?”

বাবার প্রশ্নের উত্তর দিতে সামান্য সময় নিলো নওশাদ। অতঃপর বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমরা সেদিন যখন নুরুল আঙ্কেলের মেয়েকে দেখতে গেলাম, সেখানে গিয়ে আমার পাত্রীকে পছন্দ নাহয়ে তার বোনকে পছন্দ হয়ে গিয়েছে। নুরুল আঙ্কেলের ছোটো ভাইয়ের মেয়েকে। বিয়ে করলে আমি ওকেই করবো।”

নওশাদের কথা শুনতেই খাওয়া থামিয়ে দিলেন নওরিন খাতুন। সে বেশ জোরেই বলে উঠলেন,
“অসম্ভব। অমন খাটো মেয়েকে তোমার কীভাবে পছন্দ হয়! কেমন বোকাসোকা হাবভাব! আমি রাজি না এই প্রস্তাবে।”

“আমি রাজি, মা। সেটাই কি যথেষ্ট না?”

ইলিয়াস খান নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। নম্র কণ্ঠে বললেন,
“রাগছো কেন নওরিন? মেয়েটা তো সুন্দরই। আর নওশাদ যেহেতু পছন্দ করেছে সেহেতু,,, ”

নওরিন খাতুন খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মুখে অগাধ গম্ভীরতা ঢেলে বললেন,
“অসম্ভব মানে অসম্ভব। মেয়েটার মাঝে কেমন সাদামাটা ভাব। কখনোই আমি ওরে মানবো না।”

“আমি তো মানছি তাহলে তোমার সমস্যা কোথায়?”

নওশাদও খাবার টেবিল থেকে উঠতে উঠতে মায়ের বিপরীতে কথা বলে উঠলো। ছোটোখাটো কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি। ইলিয়াস খান বার বার পিছু ডাকলেন ছেলের অথচ সে একটুও দাঁড়ালো না। ঠান্ডা মানুষ রেগে গেলে এই একটা ঝামেলা। নওরিন খাতুনও ফুসতে ফুসতে ঘরে গিয়ে দোর দিলেন।

(৬৩)

বৃষ্টির মৌসুম বলে রাতে চিত্রাদের বাসায় খিচুড়ির আয়োজন করা হয়েছে। চেরিকে নিয়ে অহিও এসেছে ওদের বাসায়। মাহতাব এসেছে। একটা হৈচৈ পরে গেছে ছোটো ফ্লাটটাতে। রান্নাঘরে ব্যস্ত মুনিয়া বেগম। তার হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে চিত্রা ও অহি। তুহিন ও মাহতাব ড্রয়িং রুমে বসে হরেক রকমের গল্প জুড়ে দিয়েছে।

বাহারকেও বেশ কয়েকবার আসতে বলার পর অবশেষে সে আসার জন্য রাজি হয়েছে। বাহিরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। অহির ফোনে টুংটাং ম্যাসেজের আনাগোনা। নওশাদের ম্যাসেজ দেখে অহি আর রিপ্লাই দেয় নি। উদ্দেশ্য হাতের কাজ শেষ করে রিপ্লাই দিবে। এমনেতে সে বিকালে কথার ছলে বলেছিলো আজ এ বাসায় আসবো, তবুও নওশাদের অত জরুরি তলবের মানে খুঁজে পেলো না সে।

বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে বাহার যেই না চিত্রাদের বিল্ডিং এ প্রবেশ করতে নিবে, সেই মুহূর্তেই তার চোখে পরলো ফর্সা, সুন্দর পরিচিত পুরুষ দেহের প্রতিচ্ছবি। বাহারের কপালে ভাঁজ পড়লো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আপনি নওশাদ না?”

নওশাদ এতক্ষণ ভিজে একাকার। সামনের পুরুষটির মুখে হুট করে নিজের নাম শুনে সে বেশ চমকালো। থতমত খেয়ে বললো,
“হ্যাঁ, আমি নওশাদ। আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?”

বাহার ফিচলে হাসলো। রহস্য করে বললো,
“চেনার কথাও না। তা এতরাতে এইখানে কী?”

বাহারের প্রশ্নে কিছুটা হোঁচট খেলো নওশাদ। কি বলবে ভেবে না পেয়ে কতক্ষণ আমতা-আমতা করলো। অতঃপর কোনো উছিলা খুঁজে না পেয়ে বোকা বোকা কণ্ঠে বললো,
“অনেক বৃষ্টি তো, তাই এখানে দাঁড়িয়েছি।”

“বনানীতে বুঝি দাঁড়ানোর জায়গা নেই? সোজা ধানমন্ডি এসে পড়েছেন দাঁড়ানোর জন্য!”

নওশাদ অবাক হলেন। সামনের ছেলেটা যে তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানে তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। মাথা এপাশ ওপাশ ঘুরাতে ঘুরাতে সে কথা খুঁজে বেড়ালো। বাহারও ঠাঁই দাঁড়িয়ে দেখলো নওশাদের কান্ড। নওশাদকে এখানে দেখে যতটা বিস্মিত হওয়ার কথা ছিলো সে ততটা বিস্মিত হলো না কারণ এর আগে অহির সাথে প্রায় কয়েকবারই সে নওশাদকে দেখেছে। তাই হয়তো নওশাদের এখানে আসার কারণও আঁচ করতে পেরেছে। বাহারের বরাবরই ষষ্ঠীয় ইন্দ্র বেশ প্রখর। বাহার তাই নওশাদকে স্বাভাবিক করার জন্য বললো,
“অহির সাথে দেখা করবেন? তাহলে উপরেই চলুন।”

নওশাদ আবারও থতমত খেলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আপনি অহিকেও চিনেন?”

“চিনবো না? বেশ বুদ্ধিমতী মেয়ে সে। আপনি ভীষণ ভাগ্যবান বলা চলে।”

বাহারের চেয়ে নওশাদও বোধহয় কিছুটা কম চতুর না। তাই তো সে কায়দা করে বলে ফেললো,
“আপনি তাহলে অমন ভাগ্য ফেরালেন কেনো?”

এবারও যেন বাহার অবাক হলো না কারণ সে জানে, বাহারের প্রতি অহির যে মুগ্ধতা সে মুগ্ধতা অহি প্রকাশ না করে থাকতে পারবে না। আমরা যখন একটা মানুষকে ভালোবাসি, তখন চাই মানুষটাকে আগলে রাখতে, গোপনে রাখতে। আর আমরা যখন একটা মানুষের উপর মুগ্ধ হই তখন চাই সেই মুগ্ধতা প্রকাশ্যে আনতে। ছড়িয়ে দিতে আরও একটা মানুষের সামনে। অহি দুটোই করেছে। ভালোও বেসেছে, মুগ্ধও হয়েছে। তাই সে সব জায়গায় মুগ্ধতা না ছড়ালেও কিছু কিছু জায়গায় ঠিক প্রকাশ করেছে।

নওশাদ আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে চুপ করে রইলো। অহির ভাষ্যমতে তার ভালোবাসার মানুষটা কিছুটা অগোছালো, এলোমেলো, গা ছাড়া স্বভাবের। মেপে হাসে, ঠাট্টাও করতে জানে আর সামনের পুরুষটির কাছে সেই সব গুণই বিদ্যমান। ঢিলটা যে খুব ভুল দিকে ছুঁড়ে নি, তা বুঝতে বাকি রইলো না নওশাদের।

তন্মধ্যেই বাহারের হা হা হাসি ভেসে এলো। হাসতে হাসতে সে বললো,
“ভাগ্যের সাথে মানানসই না হলে যত ভালো জিনিসই আসুক, ভাগ্য তা গ্রহন করে না। যেমন অহি ম্যাচুয়ার্ড, সে আমাকে যতটুকু বুঝে ততটুকুও আমায় কেউ বুঝে নি। তাতে কি? ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় মনের শান্তি। অহি আমার চিন্তা ভাগ করতে পারলে মানসিক শান্তির কারণ হতে পারবে না কখনো।”

নওশাদ যে খুব ভুল আন্দাজ করে নি তা বাহারের কথায় বুঝা গেলো। বাহারের কথার গম্ভীরতা বেশ ভালো লাগলো নওশাদের। তাই তো সে মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
“সে জন্য আপনি ধন্যবাদ প্রাপ্য। ভাগ্যিস সে আপনার মানসিক শান্তি হয় নি, তা হলে তো পরে আমাকেই অশান্তিতে কাটাতে হতো।”

বাহার আর নওশাদ সমস্বরে হেসে উঠলো।

(৬৪)

ভেজা শরীর নিয়ে চিত্রাদের ফ্লাটে প্রবেশ করলো বাহার। কিছু কুশলাদি বিনিময় করেই চলে গেলো তুহিনের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে। বৃষ্টির পানিতে ভেজার পর একটু গোসল না করলে কেমন কেমন যেন লাগে। বাহার ঘরে যাওয়ার আগে অহিকে একটু ইশারা করে তার সাথে যেতে। অহি অবশ্য এতে অবাক হয়। বাহার ভাই কখনো আকারে ইঙ্গিতে কথা বলার মানুষ না।

অহি গরে ঢুকতেই বাহার গলা পরিষ্কার করলো, ঠাট্টার স্বরে বললো,
“তোমার জন্য কে যেন অপেক্ষা করছে নিচে।”

অহি অবাক হলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“কে!”

“বনানী থেকে ধানমন্ডি আসার গল্প।”

বাহারের হেয়ালি কথায় কপাল কুঁচকালো অহি। আর প্রশ্ন না করেই সে দ্রুত প্রস্থান করলো রুম থেকে। বাহারও নিজের পকেট থেকে টুকটাক জিনিসপত্র বের করে গোসল করতে চলে গেলো। এর আগও এ বাড়িতে সে দু একবার গোসল করেছে, তাই তার টি-শার্ট এখানে আছেই।

দীর্ঘ পনেরো মিনিট পর প্রশান্তিকর গোসল দিয়ে বের হলো বাহার। চোখে-মুখে তৃপ্তি। কিন্তু বের হয়েই চিত্রার টলমলে চক্ষু যুগল দেখে সে থেমে গেলো। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে প্রশ্ন করলো,
“কী হয়েছে?”

চিত্রা উত্তর দিলো না, তবে মাথা নিচু করে আগের জায়গায় ই দাঁড়িয়ে রইলো। বাহার এতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। কপাল কুঁচকে বললো,
“এখানে দাঁড়িয়ে কোন জামাই মরার শোকে কাঁদছো? কাঁদার জন্য কি বাহিরে জায়গার টান পড়েছে?”

বাহারের দিকে অভিমানীনি চোখ মেলে তাকালো চিত্রা। হাতের ভাঁজে চেপে রাখা কাঁঠালী রাঙা খামটা মেলে ধরে তাচ্ছিল্য করে বললো,
“আপনি তবে আমায় ভালোবাসেন না, বাহার ভাই?”

চিত্রার হাতে নিজের অতিব মূল্যবান খামটা দেখেই সাথে সাথে ছিনিয়ে নিলো বাহার। ধমক দিয়ে বললো,
“কারো জিনিস জিজ্ঞেস না করে ধরেছো কেন?”

“দুঃখীত বাহার ভাই।”

বাহার মাথায় তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। সে জানে চিত্রা জেনে বুঝে ধরে নি, তবুও তার রাগ কমলো না।

চিত্রা কেবল এই অপরিচিত বাহার ভাইকে দেখলো। যার খামের মাঝে ছিলো ভালোবাসার বার্তাসহ চিঠি আর একটা নুপুর আর চোখে ক্রোধ।

#চলবে

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস
#মম_সাহা

বোনাস পর্ব

(৬৫)

তুমুল বৃষ্টির ছাঁটে বিরক্ত অহি। আর কিছু অপ্রয়োজনীয় মিথ্যে অজুহাতে বাহিরে এসে নওশাদের দেখা পাওয়ার পর হতভম্বও সে। লোকটার ফর্সা ফর্সা মুখ কেমন লাল হয়ে গিয়েছে! অনেকক্ষণ যাবত হয়তো ভিজছে! অহি দ্রুত গিয়ে নওশাদের মাথার উপর ছাতা ধরলো। বৃষ্টির অবাধ্যতায় কতখানি ভিজেও গেলো সে। বিরক্ত এবং অবাক কণ্ঠে সে প্রশ্ন করলো,
“আপনি এখানে কী করছেন!”

ঠান্ডায় নওশাদের নাক-মুখ বসে যাওয়ার উপক্রম। তবুও অনেক কষ্টে বললো,
“আপনাকে দেখতে এসেছি!”

“আপনি আমাকে দেখতে বনানী থেকে ধানমন্ডি এসেছেন! বনানী থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব জানেন তো?”

“আপনি বনানী থেকে ধানমন্ডির দূরত্ব দেখছেন অথচ আমার ভালোবাসার গুরুত্ব দেখছেন না! এ কেমন অবিচার আপনার? দয়া করে নাহয় একটু দয়া করুন, আমায় নিয়ে ভাবুন, আমায় একটু নাহয় ভালোবাসুন।”

নওশাদের কণ্ঠে তুমুল আকুলতা। অহি বিরক্ত হলো। এমন পা* গলামো কিংবা বাচ্চামো তার কখনোই পছন্দ না। তবুও লোকটা এসব করছে!

অহিকে চুপ থাকতে দেখে কথা বললো নওশাদ। আকুতি করে বললো,
“আমার প্রতি কী আপনার একটুও মায়া হয় না?”

“না, হয়না।”

প্রশ্নের জবাবে অহির কাঠকাঠ উত্তর। নওশাদ তপ্ত শ্বাস ফেললো। ভারিক্কী গলায় বললো,
“তাহলে এখনি এখান থেকে যান। আমার ভালোবাসার প্রতি যার দয়া নেই, তার যেন আমার প্রতিও কোনো করুণা নাহয়।”

নওশাদের কথার এই আকাশ-পাতাল পরিবর্তনে প্রায় থতমত খেয়ে গেলো অহি। স্তম্ভিত হয়ে বললো,
“কী করছেন? টিনএজারদের মতন আচরণ করবেন না।”

“ভালোবাসার আচরণের আবার পার্থক্য আছে নাকি? ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি গম্ভীর কিংবা টিনএজারও হতে রাজি।”

“আমার এসব পছন্দ না কিন্তু।”

“তাহলে চলুন, বিয়ে করি?”

নওশাদের হঠাৎ এমন প্রস্তাবে অহি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। কেমন হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো! অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“কী!”

“চলুন না, বিয়ে করে ফেলি।”

অহি গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলো। এই মুহূর্তে নওশাদ ফাজলামো করছে বলে তো মনে হয় না কিন্তু কথাটা যে সত্যি সত্যি বলছে তাও বিশ্বাস হচ্ছে না। বনানী থেকে এই রাতে ছুটে এসেছে কি কেবল এই কথাটা বলার জন্য? এত পা* গলাটে চিন্তা! অহি তপ্ত শ্বাস ফেললো, শীতল কণ্ঠে বললো,
“যেখান থেকে আসছেন, সেখানে ফিরে যান। এসব করে আমার মনে বিরক্তের সৃষ্টি করছেন, তাছাড়া আর কিছুই না।”

“কোথায় ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন! যেখান থেকে এসেছি সেখানে ফিরে যেতে হলেও আমার আপনাকে চাই।”

“আমাকে চান? কেনো চাইবেন? ভালো লাগে বলে?”

“না, ভালোবাসি বলে।”

নওশাদের সহজ স্বাভাবিক উত্তরে অহির তেজের ভাঁটা পড়লো। হাল ছেড়ে দেওয়া ভাবে বললো,
“আচ্ছা মানলাম ভালোবাসেন বলে। তা, ভালোবাসলেই কি পেতে হবে এমন কোনো কথা আছে? ইতিহাসে এমন কতই তো হয়েছে যে তুমুল ভালোবাসার পরও একজন আরেকজনকে পায় নি। তাহলে আপনারই কেন পেতে হবে?”

“ইতিহাসে বিচ্ছেদ ছিলো বলে আমিও অপ্রাপ্তি রাখবো তা ভাবছেন কেনো? বার বার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হবে তারও কোনো মানে নেই। ইতিহাস যারা রটেছে তারাও মানুষ। তারা নাহয় রটেছে অপ্রাপ্তির ইতিহাস, আমরা নাহয় রটবো প্রাপ্তিরটা।”

“আমায় পেয়ে কি আর এমন হবে বলুন? আমাকে এখন হয়তো ভালো লাগছে কিন্তু একসাথে সংসার করার পর আর নাও ভালো লাগতে পারে।”

“আপনাকে পেলে তেমন কিছুই হবে না। কেবল পাওয়া না পাওয়ার এই পৃথিবীতে, আপনাকে পেয়ে গেলে আমার সব পাওয়া হয়ে যাবে।”

এমন একটা অনুভূতি মাখানো কথা শোনার পর আর কথা খুঁজে পেলো না অহি। বিরক্ত দেখাতে গিয়ে দেখলো কি আশ্চর্য! তার বিরক্ত লাগছে না। তবুও সে মিছে বিরক্তের ভাব ধরলো। নাক-মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো নিজের বিল্ডিং এ। নওশাদ পেছন থেকে চিল্লিয়ে বললো,
“আপনি বিয়ের জন্য রাজি না হলে আজই আমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার জান দিয়ে দিবো।”

অহি গোপন হাসলে। মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
“বৃষ্টিতে ভিজলে কেউ ম* রে না। ভিজতে থাকুন।”

“বৃষ্টিতে না ম* রলেও আপনার ঐ হাসিতে ঠিকই ম* রেছি।”

অহি আর পিছু ফিরলো না। চলে গেলো নিজের ফ্লাটে। নওশাদের কথাটা সে নেহাৎই হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো। ভাবলো নওশাদ হয়তো মজা করেই বলেছে। কিন্তু অপরদিকে নওশাদ নাছোড়বান্দা তা যে জানা নেই রমণীর।

(৬৬)

মন খারাপের আকাশে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো অভিমানেরাও। চিত্রা বাহারের তীক্ষ্ণ কথা হজম করে চুপ করে ছিলো। কিন্তু তার চেয়েও বেশি তাকে চুপ করিয়েছে বাহারের আনা অন্য কারো জন্য নূপুর আর চিঠি। চিঠিটা পড়তে পারে নি তবে যতটুকুই দেখেছে মুগ্ধতা ভরা ছিলো। কারো জন্য খুব যত্নে লিখেছিলো চিঠিটা। বাহার চিত্রাকে ছাড়াও অন্যকারো কথা চিন্তা করছে ভাবলেই অষ্টাদশীর বক্ষ মাঝে তুমুল তোলপাড় শুরু হয়। প্রিয় মানুষের ক্ষেত্রে আমি একটু বেশিই স্বার্থপর হই। সব ভাগ করা মানুষটাও প্রিয় মানুষের ভাগ সহ্য করতে পারে না। কিন্তু বাহার ভাইকে তা জানিয়ে লাভ নাই। মানুষটা তো এমনই, অনুভূতি বুঝলেও প্রকাশ্যে তার মূল্য দেই নি কভু। অথচ সেই বাহার ভাইয়ের জন্যই অষ্টাদশীর এত হাহাকার!

ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে ছোটোখাটো একটা আড্ডার আসর বসলো। কিন্তু চিত্রার মন বসলো না সেই আসরে। সে কাজের নাম দিয়ে উঠে চলে গেলো। তখনও প্রকৃতিতে ভরা বর্ষণ। বারান্দার ছোটো ছোটো শিকের জানালা গলিয়ে হাত ভিজাতে পারছে না বলে চিত্রার মন আরও খারাপ হলো। কেবল দেখেই যেতে হলো নিবিড়ে সেই বর্ষণ ধারা।

তন্মধ্যেই চিত্রা নিজের পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো। মানুষটাকে দেখার আগেই মানুষটার গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ভালোবাসা যখন মানসিক শান্তি নাহয়ে মাথা ব্যাথার কারণ হয়, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় সে ভালোবাসার মানুষটি ভুল।”

চিত্রা কণ্ঠের মালিককে চিনলো কিন্তু এ মানুষ এমন কথা বলতে পারে ভেবেই তার অবাক লাগলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“দুলাভাই, আপনি!”

চিত্রার বিস্মিত মুখ দেখে হাসলো মাহতাব। পকেটে হাত গুঁজে হেলতে দুলতে চিত্রার সামনে এসে দাঁড়ালো। ছোটো একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“ভালোবাসার মানুষ ভুল হলে ভালোবাসা ফুল নাহয়ে কাঁটা হয়ে রবে কিন্তু শালীকা।”

চিত্রা কথা বললো না। দুলাভাই কিছু বুঝতে পারলো কিনা ভেবেই তার বুক কাঁপলো। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“কী বলছেন এসব?”

“তোমাদের বয়সই এমন যে এটা বলতে হচ্ছে। শোনো, কোনো সম্পর্ক যদি তোমায় ব্যাথা দেয়, তিল তিল করে মা* রে তবে তুমি বরং সে সম্পর্কটাই মে* রে ফেলো। মনে রেখো, ভুল কারণে নিজে মরার চেয়ে, ভুল কারণটার মৃত্যু হওয়া ভালো।”

চিত্রা কি বুঝলো কে জানে, কেবল অনবরত মাথা নাড়ালো। চিত্রাকে খুশি করতে হাস্যোজ্জ্বল মাহাতাব বলে উঠলো,
“চলে আজ রাতের রাস্তা ঘুরবো, বৃষ্টিতে ভিজে আইসক্রিম খাবো। যাবে?”

চিত্রা কতক্ষণ ভেবে রাজি হয়ে গেলো। এতক্ষণের মন খারাপ টা তার হুট করেই ভালো হয়ে গেলো।

(৬৭)

তখন প্রায় মধ্যরাত। চিত্রাদের ফ্লাটে কেবল অহি আর মুনিয়া বেগম রয়েছে। চিত্রা, চেরি, মাহতাব, তুহিন তো কিছুক্ষণ আগেই বের হয়েছে রাতের রাস্তা ঘুরার জন্য। বাহার ভাইও তার পরপর বেরিয়ে গিয়েছে। অহি, মুনিয়া বেগম নিজেদের মতন ঘুমিয়ে পড়লো।

রাত তিনটে, হুট করে সশব্দে বেজে উঠলো অহির ফোন। কড়া ঘুমটা হঠাৎই হালকা হয়ে এলো ফোনের শব্দে। অহি বিরক্ত হলো, চোখ-মুখ কুঁচকে ফোনটা রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে বাহার ভাইয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“আমায় ভালোবাসো অহি?”

অহির ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কে হুট করে এমন কথাটা কেমন ভোঁতা ভোঁতা অনুভূতির সৃষ্টি করলো। ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্ক জেগে উঠলো সেকেন্ডের মাঝেই, অহি চুপ থেকে রয়েসয়ে উত্তর দিলো,
“ভালোবাসতাম, এখন ভালোবাসা ছেড়ে দিয়েছি।”

উত্তর টা শুনে ফোনের অপর পাশের বাহার ভাই কি একটু হাসলো! হ্যাঁ হয়তো হাসলো। ক্ষীণ হেসে বললো,
“এটা তোমার জীবনের সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। আরেকটা উত্তম সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলো তো ঝটফট।”

অহি ভ্রু কুঁচকালো, প্রশ্নাত্মক কণ্ঠে বললো,
“কী?”

“তোমাদের বাড়ির নিচে যে ছেলেটা বৃষ্টিতে ভিজেছে এই মাঝ রাত্তি অব্দি, তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফেলো। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুমি অনবরত ছুটে চলা ঘড়ির কাটা, আমার মতন বেকার বাহারের জন্য থেমে থাকা তোমার মানায় না। আমরা তো বেকার মানুষ। আমরা হলাম অযত্নের কংক্রিট।

মানুষ ভাবে পাথর মন, দিলাম নাহয় একটু ভেঙে,
ক্রেংকিটের আড়ালেও হৃদয় নরম,মানুষ কি আর তা জানে?

একটা মৃত্যুর স্বাদ পেতে, বেকার মরে রোজ,,
তাই তো সমাজ নিয়ম করে আমাদের স্বপ্ন করছে ভোজ।

ফ্যানের সাথে কি যেন ঝু* লে, ডাকে মোরে মুক্তি হেথায়,
বাঁচবার সাধ বেকারেরও আছে, সে কথা কি সমাজে বিকায়?

যোগ্যতার সার্টিফিকেট তাচ্ছিল্যে ভাসে, অযোগ্যদের কাছে,
একটা চাকরি না পেলে, বেকারদের প্রেমও মিছে।

তোমাদের অবশ্য সে পিছুটান নেই, প্রেম মিছে হওয়ার ভয় নেই। মধ্যরাতে তোমার দোরে ভালোবাসা চাওয়া মানুষটাকে আজ নাহয় একটা কিছু বলেই দেও। মুক্তি নাহয় প্রেমের মৃ* ত্যু।”

অহি চুপ করে বাহার ভাইয়ের কথা শুনলো। অপর পাশ থেকে কল টা কাটতেই সে ওরনা টা জড়িয়ে সাবধানে ফ্লাটের দরজা আটকে নিচে নেমে গেলো। তখনও বৃষ্টি পড়ছে বিরতিহীন ভাবে।

বিল্ডিং ছেড়ে রাস্তায় নামতেই জুবুথুবু নওশাদকে চোখে পড়লো অহির। বেচারা শীতে কাঁপছে। অহি বেশ শক্তপোক্ত মুখ নিয়ে এগিয়ে গেলো নওশাদের কাছে। শক্ত কণ্ঠে বললো,
“আপনি না গিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে ভিজছেন? এসব করে আপনি কী বুঝাতে চাচ্ছেন?”

“আমায় বিয়ে করে নিলেই তো পারেন। বাঁচিয়ে নিন না আমায়।”

অহির মুখে তুমুল কাঠিন্যতা। কর্কশ কণ্ঠে বললো,
“আমার জন্য যে ছেলেটা মধ্যরাত অব্দি এমন পা* গলামো করতে পারে তাকে ফেরানোর সাধ্যি আমার নেই। এত রাতে কাজী অফিস খোলা থাকবে তো?”

নওশাদ ভেবেছিল এবারও বরাবরের মতন প্রত্যাখ্যান আসবে কিন্তু অহির কথায় সে হতভম্ব। নওশাদের হতভম্ব ভাব দেখে অহি ঠাট্টা করে বললো,
“বিয়ে কি করবেন না শহীদ হওয়ার ইচ্ছে এখনও আছে?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here