চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস #মম_সাহা অন্তিম পর্ব

1
483

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস
#মম_সাহা

অন্তিম পর্ব

(৮৪)

কথায় আছে, সময় এবং স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। শীতের রিক্ততা নিয়ে নভেম্বর মাস বিদায় নিয়েছে। তার মাঝে বাহার ভাইয়ের কেইসটা আবারও দু একবার কোর্টে উঠেছিল কিন্তু ফলাফল সেই আগের জায়গাতেই। চিত্রার শরীর ধীরে ধীরে অনেকটা ভেঙে গিয়েছে। শরীর জুড়ে ভর করেছে অসুস্থতা। তবুও রোজ নিয়ম করে থানায় যায়, রোজ রোজ দেখা হয় না বাহার ভাইয়ের সাথে তবুও সে বসে থাকে। সারাদিন গিয়ে যখন সন্ধ্যা নামে প্রকৃতির বুকে তখন ক্লান্ত পায়ে সে বাড়ির দিকে চলে আসে। এর মাঝে দু একবার সেই রাজনৈতিক নেতার সাথে কথাও হয়েছে চিত্রার তবে আর বিশেষ কোনো লাভ নেই। সুখের বেলা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে চিত্রার জীবনে।

সময়টা উনিশেই ডিসেম্বর। সওদাগর বাড়ি কৃত্রিম আলোয় জ্বলজ্বল করছে। আগামীকালই অহি আপার বিয়ে। বিয়েটা আর পেছানো হয় নি। জীবনকে জীবনের ধারা অনুযায়ী চালিয়ে নিতেই হবে সে যতই কষ্ট হোক না কেন। সন্ধ্যার আমেজ তখন প্রকৃতিতে, শীতটাও মাখো মাখো হয়ে এসেছে। ছোটো চেরি, অয়ন ছোটোছুটি করছে ড্রয়িংরুম জুড়ে সাথে আত্মীয় স্বজনের সাথে আসা তাদের বয়সী বাচ্চারা। রান্নাঘরে তুমুল রান্নার আয়োজন। মিঠে আওয়াজে সাউন্ড বক্স বাজছে ছাঁদে। মানুষ হারানো শোকটাকে লুকিয়ে সবাই ই কৃত্রিম আনন্দ দেখাচ্ছে। আফজাল সওদাগর প্রায় শয্যাশায়ী। অসুস্থতা লেগে আছে কত গুলো দিন যাবত। সেই জন্যই এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ের আয়োজন। ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের সে একটু বেশিই ভালোবাসেন। জীবনে হয়তো অনেক খারাপ কাজ করেছে কিন্তু যাকে ভালোবাসা দিয়েছে তার প্রতি কোনো ক্ষেত্রেই সে কৃপণতা করে নি।

সাজগোজে কিঞ্চিৎ ব্যস্ত অহি। তাকে টুকটাক এগিয়ে দিতে ব্যস্ত চাঁদনী আপা। গায়ের হলুদের অনুষ্ঠানে সকলে হলুদ রঙেরই জামাকাপড় পড়েছে। হলদিয়া রঙে রঙিন আজ সওদাগর বাড়ি। অনেক গুলো দিন পর মিছে আনন্দ হলেও হচ্ছে তো কিছু ভালো। চাঁদনী আপা তার হাতের কালো ক্লিপ টা অহির মাথায় গুঁজতেই লতা বেগম ধীর গতিতে হাজির হলেন সে ঘরে। নিজের শাশুড়ীকে দেখে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেলো চাঁদনী, চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
“মা, উঠছেন কেন? কিছু প্রয়োজন হলে ডাক দিতেন আমাকে। হাঁটু ব্যাথা কমেছে আপনার?”

লতা বেগম বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষীণ হেসে বলে,
“কত আর ভালো লাগে বলো শুয়ে থাকতে? বিয়ে বাড়িতে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না তাই একটু হাঁটাহাঁটি করতে এলাম। সাজাচ্ছো নাকি ওকে?”

চাঁদনী কাঠের চেয়ার টা এগিয়ে এনে শাশুড়ীকে সযত্নে বসিয়ে দিতে দিতে বললো,
“হ্যাঁ, মা। মেয়েটা তো সাজগোজ কিচ্ছুটি পারে না। সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকলে কীভাবে পারবে বলুন তো? তাই সাজিয়ে দিচ্ছি।”

“আজ তুমিও নাহয় একটু সেজো।”

শাশুড়ীর কথায় চাঁদনীর হাসি হাসি মুখটা ক্ষাণিক চুপসে এলো। হাসিটা কেমন চলে যাবে যাবে ভাব, তবুও ক্ষীণ হাসি ধরে রেখে বললো,
“এইতো, আমার সাজার আর কি আছে, যেমন আছি তেমনই থাকি।”

“কার জন্য কষ্ট পাচ্ছো তুমি? যে তোমার কষ্টের কোনো দাম দেই নি, ভাবে নি তোমার কথা, তার জন্য কষ্ট পাচ্ছো!”

“মা, থাকুক না সেসব।”

কথাটা বলতে বলতে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চাঁদনীর চোখ বেয়ে। লতা বেগম কোমড় ব্যাথা নিয়ে উঠে গেলেন। চাঁদনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কাঁদছো কেন! কেঁদো না। কান্নার অপমান তোমার চোখে শোভা পায় না। জানো, বেশ প্রাপ্ত বয়সেই আমি বিয়ে করেছিলাম। তারপর তো তোমার শ্বশুর মা°রা গেলেন। আমি ঘূনাক্ষরেও তার জন্য তোমার বাবাকে দ্বায়ী করি নি। দোষ তো মানুষ মাত্রই হয়। সন্তান সামলাতে আমার কষ্ট হতো না, একাই হয়তো আমার ছেলেটাকে মানুষ করতে পারতাম কিন্তু বিধবা হাতে সমাজ চালানো যে অনেক কষ্টের। না পেরে দ্বিতীয় বিয়েটা করলামই। উনি মাহতাবকে ভীষণ ভালোবাসতেন, আমি কখনো বুঝতেই পারি নি মাহতাব এভাবে ভেঙে পড়েছে ভেতর ভেতর, তাহলে আমি কখনোই এ কাজটা করতাম। একটা বার যদি বুঝতাম আমার ঐ শান্ত ছেলেটা মানতে পারে এসব তাহলে ওর শৈশব টা আমি আরও সুন্দর করার চেষ্টা করতাম। মা হিসেবে তো আমি ব্যর্থ। কোথাও না কোথাও সবকিছুর জন্য আমিই দ্বায়ী। আমি আরেকটু সচেষ্ট থাকলে এত গুলো প্রাণ আজ এমন হাহাকারে পুড়তো না। আমায় তুমি ক্ষমা করো মা।”

কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ মহিলার চোখ বেয়েও গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। চাঁদনী মুখ ডুবালো শাশুড়ীর বক্ষ মাঝে। মানুষটা বেশ শক্তপোক্ত ধরণের ছিলেন কিন্তু একটা ঘটনা মানুষটাকেও কেমন ভেঙে দিয়েছে!

লতা বেগম চোখের অশ্রু মুছতে মুছতে বললেন,
“এই পুরো দুনিয়ায় আমার আর কেউ নেই। আমার ছেলের এমন ঘটনার পরও তুমি আমার অনেক যত্ন করেছো। আমি আমার শেষ সময়টাতে তোমার ভরসায় আরামে কাটাতে চাই। আমি তোমাকে জোর করবো না বিয়ে করতে, তোমার জীবনে তুমি যেটা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, ঠিক সেটাই করবে। তোমার বোনের কাল বিয়ে, ওর বিদায়ের পর পর আমরাও চলে যাবো নিজেদের বাসায় কেমন? মা-মেয়ের একটা ছোটো সংসার হবে। অনেক গল্প করবো, বৃষ্টি এলে দু’জন ছুটে চলে যাবো ছাঁদে, ভিজে চুপচুপে হয়ে বাসায় আসবো, দু’জনের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠবে যখন, তখন আমরা দু’জন দু’জনকে বকে দিবো। তুমিও একা, খুঁটি নেই তোমার। বিয়ের পর বাবার বাড়ি কেবল আত্মীয়ের বাড়ির মতন। তুমি এই মায়ের সাথে আমাদের দু’জনের বাড়িতে থাকবে৷ তুমিও একা আমিও একা, আমরা দু’জন দু’জনের সঙ্গী হবো। কে বলেছে বেঁচে থাকতে হলে অনেক মানুষ দরকার? দিনশেষে বুক শীতল হওয়ার মতন একজন মানুষ হলেই যথেষ্ট। যাবে না বলো আমার সাথে?”

চাঁদনী এই ষাটোর্ধ্ব মহিলাটাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, “যাবো, মা।”

অহি কেবল চুপ করে দেখলো সবটা। আনন্দ অশ্রু দু এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে। হুট করে তার মনে হলো, অনেকদিন এমন করে সে মায়ের বুকে মাথা রাখে না। কত গুলো দিন মা বলে ডাক দেয় না। আর কত অভিমান পুষে রাখবে মনে। জীবনটা তো বড্ড ছোটো, মান অভিমান করে কাটিয়ে দিলে জীবনটা যে আর উপভোগ করা যাবে না। হলুদ শাড়ির কুঁচিটা হাতের ভাঁজে চেপেই অহি ছুটে গেলো মায়ের কাছে। একবার নাহয় শৈশবে ফেরা যাক। মায়ের বুকের মাঝে একবার নাহয় স্বর্গ খোঁজা যাক।

অবনী বেগম সবে নিজের ঘরের আলমারি থেকে গয়নার বক্স বের করে রাখছিলেন। মেয়েটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে তো অন্যের বাড়ি পাঠাতে হবে। মা হয়ে তো সে মেয়েটাকে কম অবহেলা করে নি, পরের মা নাহয় তাকে আগলে রাখলো।

ভাবনার মাঝেই অহি কোথা থেকে যেন ছুটে এসে লুটিয়ে পড়লো অবনীর বুকের মাঝে। অবনী বেগম অসাবধনতা বশত পিছিয়ে গেলেন দু’পা। শক্ত করে আলমারিটা চেপে ধরে নিজের অবস্থান ঠিক করলেন। অতঃপর হলুদিয়া পাখির ন্যায় নিজের মেয়েকে বুকের মাঝে লুটিয়ে পড়তে দেখে অবাক দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। কেমন নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারলেন না সে এরকম দৃশ্যটা। কত গুলো দিন পর মেয়েটা এমন ভাবে বুকের মাঝে এসে পড়লো! ঠিক কত গুলো দিন না, কত গুলো বছর পর এমনটা হলো তা মনে নেই অবনী বেগমের। সে কেমন ঘোরে চলে গেলেন! কিন্তু যখন সে অনুভব করলো অহি কাঁদছে তখন উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। আদুরে হাতে মেয়েকে আঁকড়ে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
“কী হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন? অহি? কেউ কিছু বলেছে?”

মায়ের এমন আদুরে ছোঁয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক অহি কেমন বাচ্চা হয়ে গেলো। মায়ের বুকে মাথা রেখেই ক্রন্দনরত স্বরে বললো,
“তোমাদের ছেড়ে যাবো ভাবলেই আমার কষ্ট লাগে, আম্মু।”

অবনী বেগম স্মিত হাসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ছেড়ে কোথায় যাচ্ছো! আমাদের তো তুমি তোমার বুকের মাঝে পুষে রেখে নিয়ে যাচ্ছো। এটাকে কী আর ছেড়ে যাওয়া বলে?”

অহি মাথা নাড়ালো কিন্তু কোনো কথা বললো না আর। অবনী বেগমও খুব গোপনে শ্বাস ফেললেন। যাক, অবশেষে কিছুটা প্রাপ্তি তার খাতাতেও এসে যোগ হলো।

(৮৫)

হলুদ শাড়ি টা সাদামাটা ভাবে শরীরে জড়িয়ে থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা। শরীরটা আগের মতন তত গোলগাল নেই। শুকিয়ে গেছে খু্ব। পিঠের চুল গুলো এখন প্রায় কোমড়ের কাছাকাছি। এতদিন খেয়াল করে নি সে। আজ চুলে হাত দিয়ে হঠাৎ করে চুলের এই অগাধ পরিবর্তন দেখে সে বেশ অবাক হলো। নিজের প্রতি কতটা ছন্নছাড়া হলে দেহের পরিবর্তন গুলোও চোখে লাগে না! নিজের কথা ভেবেই একটা আফসোসের শ্বাস বেরিয়ে এলো। নিজের প্রতি নিজের খুব মায়া হলো, আহারে জীবন!

বরাবরের মতনই থানার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা। অনেক আকুতি মিনতি করার পরও তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। সে তবুও ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো বাহিরে। আজ নুরুল সওদাগর থানায় নেই, কোথাও একটা গিয়েছে। তাই বাহার ভাইয়ের সাথে দেখা করাটা আরও কঠিন হয়ে গেছে। চিত্রা তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। তন্মধ্যেই পুলিশের জীপ গাড়িটা এসে থামলো থানার সামনে। তুমুল শব্দ তুলে এসেছে সেটা। চিত্রার দৃষ্টি গেলো সেখানে। নুরুল সওদাগর ব্যস্ত পায়ে নেমে দাঁড়ালো গাড়ি থেকে। গাড়ীটা সাইড করতেই সে ব্যস্ত পা চালিয়ে থানায় প্রবেশ করতে নিলেই চিত্রাকে দেখে থেমে যায়। অবাক কণ্ঠে বলে,
“তুমি এখানে কেন?”

“দেখা করতে এসেছি বাহার ভাইয়ের সাথে।”

নুরুল সওদাগর একবার নিজের হাত ঘড়িটার দিকে তাকালেন। রাত আটটা দশ বাজে। এতক্ষণে বোধহয় বাড়িতে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে কিন্তু মেয়েটা সব ছেড়ে ছুঁড়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। হতাশার শ্বাস ফেললো নুরুল সওদাগর। শান্ত কণ্ঠে বললো,
“আগামীকাল ওর ফাঁ° সি। আজ তো আর দেখা করার নিয়ম নেই। এটা আইনবিরোধী।”

“কত কিছুই তো আইনবিরোধী হয়, তবুও তো মানুষ সে কাজ গুলো করে। তবে আজ নাহয় আপনিও একটু করুন।”

নুরুল সওদাগর আর কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন, তার একটু পরই একজন কনস্টেবল এলেন, রাশভারী কণ্ঠে বললেন,
“তুমি কী চিত্রা?”

চিত্রা যেন আশার আলো দেখলো। সে ভাবলো আব্বু হয়তো পারমিশন দিয়েছেন, এই হয়তো তাকে ভেতরে যেতে বলবে। কিন্তু তার ভাবনাকে হতাশায় ভরিয়ে দিয়ে কনস্টেবল গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“বাহার ছেলেটার কাল ফাঁ° সি। তাই আজ আর তাকে কারো সাথে দেখা করতে দেওয়া হবে না।”

চিত্রার চোখে টলমলে অশ্রুর ভীড় দেখা দিলো। ভীষণ অসহায় কণ্ঠে বললো,
“স্যার, একটা বার দেখা করতে দিন। এই যে দেখছেন না আমি সেজেছি, তা আমার বাহার ভাইকে দেখাবো। একটা বের একটু কথা বলবো। দেন না।”

“মা, তুমি বাসায় ফিরে যাও। বড় স্যার নির্দেশ দিয়েছে যেন দেখা করতে দেওয়া না হয়।”

চিত্রার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা মুক্তোর মতন অশ্রু ঝরে পড়লো। বিবশ কণ্ঠে বললো,
“স্যার, আপনার বড় স্যারকে বলে দিবেন, কখনো যদি আমি মা°রা যাই, তবে সেটা সবার কাছে মৃত্যু হলেও আমার কাছে হবে খু°ন। বাবা নামক লোকটা আমাকে বাঁচাতে দিলো না।”

কনস্টেবল অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো চিত্রার দিকে। চিত্রার চোখে তখন অশ্রুদের বর্ষণ। লোকটার বোধহয় মায়া হলো মেয়েটার জন্য, রোজ রোজ এমন কান্না করতে দেখে মেয়েটাকে। দেখা হবে না জেনেও প্রায় সময় ঠাঁই বসে থাকে এই থানার সামনে। কেমন একটা উন্মাদনা মেয়েটার মাঝে! চিত্রা চলে যেতে নিলে ক্ষীণ স্বরে ডাক দেয় কনস্টেবল। চাপা স্বরে বলে,
“অনেক ভালোবাসো তাই না ছেলেটাকে?”

চিত্রার বাঁধ ভেঙে কান্না আসে। ঠোঁট চেপেও সংবরণ করতে পারে না সেই কান্নার স্রোত। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে দেয় সে, কেমন আহাজারি করে বলে,
“তারে ছাড়া আমার বাঁচতে ইচ্ছে হয় না যে, স্যার। এতখানি ভালোবাসি। আজ কত গুলো দিন আমি ঘুমাতে পারি না, কোনোরকমের বেঁচে থাকা যাকে বলে। তাকে যে আমার লাগবে, খুব করে লাগবে স্যার।”

বয়স্ক লোকটার মুখেও কেমন ব্যাথার ছাপ। চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল কণ্ঠে বললো,
“তোমাদের মতন বড় বড় লোকেদের মেয়েদের এমন মধ্যবিত্ত ছেলেদের মায়ায় আটকাতে নেই, মা। দু’জনকেই তখন কষ্ট সহ্য করতে হয়। কেন যে তোমরা বুঝো না।”

“বুঝ দিয়ে কী আর ভালোবাসা হয়, স্যার!”

লোকটা তাকিয়ে রইলো এই অষ্টাদশী মেয়েটার দিকে। যার চোখে মুখে কেমন বেদনার হাহাকার। বড্ড মায়া হলো। কিন্তু মেয়েটার বাবারই কিনা একটুও মায়া হয় না! এত পা° ষা°ণ কীভাবে হয় মানুষ! দীর্ঘশ্বাসে ভারী হলো প্রকৃতি, করুণ স্বরে লোকটা বললো,
“আর তো আজকের রাতটা, আম্মু। এরপর তুমি চাইলেও আর তোমাদের দেখা হবে না। তখন কীভাবে থাকবে?”

চিত্রার কান্না হঠাৎই থেমে যায়। কেমন অদ্ভুত কণ্ঠে বলে,
“একসাথে থাকবো কথা দিয়েছি যে, স্যার! তাহলে আলাদা হই কেমন করে? এই পৃথিবী আমাদের সুখ দেখতে পারে নি, ঐ জগৎ নিশ্চয় এত স্বা°র্থপর হবে না, তাই না?”

বৃদ্ধ লোকটা তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। এই ছোটো মেয়েটার বুকের মাঝে পুষে থাকা আস্ত এক ভালোবাসার সাম্রাজ্য দেখে অবাক হয় সে। এই একুশ শতকে এসেও কেউ এমন ভালোবাসতে পারে! তা যেন ভাবনার বাহিরে ছিলো। কিন্তু উপরওয়ালার ইচ্ছে হয় তো অন্যকিছু। আফসোসের শ্বাস ফেলে লোকটা বলে,
“তুমি বরং কাল বারোটার দিকে একবার এখানে এসে ঘুরে যেও। শেষ দেখাটা নাহয় দেখে যেও। যেভাবে হোক আমি তোমার সাথে তার দেখা করিয়ে দিবো। আজ তাহলে যাও।”

চিত্রা আর জেদ করলো না। কী সুন্দর মেনে গেলো! ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রাস্তার দিকে। কোনো ব্যস্ততা নেই, তাড়া নেই তার। কেবল পথচলা। ‘শেষ দেখা’ শব্দটা তার কানের মাঝে ঝনঝন শব্দ তুলে কেবল বাজতে লাগলো। সে আজও বিশ্বাস করতে পারছে না, বাহার ভাইয়ের সাথে তার আর দেখা হবে না। চাইলেই আর বাহার ভাইয়ের পুড়ে যাওয়া ঠোঁটের দিকে লাজলজ্জা খেয়ে তাকিয়ে থাকা হবে না, বেসামাল কথা বলে বাহার ভাইকে লজ্জা দেওয়া আর হবে না। আর কিছু হবে না, মানুষটাই আর থাকবে না, পুরো পৃথিবীতে এত ‘না না না’ কেন? কেন এত নি°ষ্ঠু°রতা! চিত্রার মনে এক্কাদোক্কা খেলা বাহার ভাইয়ের জীবনেই কেন এত বিধ্বস্ততা থাকবে! তবে কী সত্যিই, বড় লোকের মেয়ে চিত্রাদের বাহার ভাইদের ভালোবাসতে নেই! দারিদ্রতা কী তবে মরণব্যাধি!

সোডিয়ামের আলোয় কুয়াশাময় রাস্তা কেমন ধোঁয়াটে দেখালো। সেই অস্বচ্ছ রাস্তার দিকে চিত্রার ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া, তারপর ধোঁয়াশার মধ্যে কেমন হারিয়ে গেলো সে! এমন করেই বোধহয় হারিয়ে যেতে হবে ভবিতব্য না মানতে পারে। পুরো পৃথিবী জানিয়ে দিলো, ভালোবাসা ফুল নহে, তা কেবল ভুল।

(৮৬)

গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান তখন মাঝামাঝি পর্যায়ে। চিত্রা অচঞ্চল পায়ে ছাঁদে এসে দাঁড়িয়েছে। সবার থেকে একটু দূরেই দাঁড়ানো। অহি আপার হাসি হাসি মুখ, হলুদ গাল গুলো। কত সুন্দরই না লাগছে! চিত্রারও তো এমন একটা রাতের স্বপ্ন ছিলো। তবে, সব স্বপ্ন কী আর পূরণ হয়! এটাও নাহয় না হলো।

এত ব্যস্ততার মাঝে দূরে দাঁড়ানো নির্জীব চিত্রার দিকে চোখ যায় অহির। হাসি হাসি মুখটার হাসিটা আরও বিস্তৃতি লাভ করে, কণ্ঠ বেশ ক্ষাণিকটা উঁচুতে তুলে সে ডাক দেয়,
“এই চিত্রা, এখানে আয়। আপাকে হলুদ লাগাবি না?”

না চাওয়া স্বত্তেও চিত্রা কৃত্রিম হাসি নিয়ে এগিয়ে যায় আপার কাছে। অহি আবার ডান পাশটাতে বসতেই চিত্রার এক আত্মীয়, সম্পর্কে ফুপি হয়, সে বেশ ঠেস দিয়ে বলে,
“কিরে চিত্রা? তোর হাবভাব তো সুবিধার লাগছে না! কেমন দেবদাস, দেবদাস ভাব। ছ্যাঁকা খেলি নাকি?”

মহিলার ঠাট্টা মাখানো কথায় হাসির ঢল নেমে গেলো উপস্থিত জায়গায়। কেবল হাসলো না সওদাগর বাড়ির কেউ, কেবল অসহায় চোখে তারা তাকিয়ে রইলো চিত্রার দিকে। তাদের হাসিতে তাল মেলালো চিত্রা, দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো,
“কেন ফুপি, ছ্যাঁকা খেলে কী তুমি মলম লাগিয়ে দিতে পারবে?”

মহিলাও কম যায় না, ঝরঝরে কণ্ঠে সে উত্তর দিলো,
“তুই আমাদের আদরের ভাইঝি, মলম লাগাতে না পারি, শুনতে তো পারি নাকি?”

“মলমই যদি না লাগাতে পারো, তবে শুনে কী লাভ! সেই তো ক্ষত আরেকটু বাড়ানোর কাজই করবে। থাক নাহয়, আমার ক্ষত আমারই।”

এবার আর মহিলার মুখে হাসিটা দেখা গেলো না। সে চোখ মুখ বাঁকা করে বললো,
“এত বড় বড় কথা কেন বলছিস রে! এতটুকু একটা মেয়ে!”

“এতটুকু একটা মেয়েকে তুমিই বা এমন বড় কথাটা বললে কেন ফুপি?”

মহিলা বেশ বিরক্ত হলো চিত্রার কথায়। মুনিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বললো,
“মেয়ে তো বানাও নি যে আগুন বানিয়েছো।”

মুনিয়া বেগম অন্যসব মায়ের মতন মুখ অন্ধকার করলেন না বরং বেশ সুন্দর একটা হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন,
“আগুন না হলে তো অন্য আগুন তাকে পুড়িয়ে দিতো। তাই বানালাম আর কি।”

সওদাগর বাড়ির সবার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি দেখা দিলো। নতুন উদ্যমে জমে উঠলো আবারও অনুষ্ঠান। চিত্রা খুব ধীরে অহির গালে লাগিয়ে দিলো একটু হলুদ। অহি কেবল তাকিয়ে দেখলো মেয়েটাকে। এই মেয়েটার দিকে তাকালে মনেহয়, অহি ঠিক মতন ভালোবাসতে জানেই নি। কই, ভালোবাসার মানুষটার এমন নির্মম পরিণতি জেনেও তো সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে, আর অন্যদিকে মেয়েটা কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে!

অহি আপাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্মিত হাসলো চিত্রা। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“কিছু বলবে আপা?”

“তুই বাঁচতে পারবি তাকে ছাড়া?”

অহির প্রশ্নে চমকায় না চিত্রা। কেবল অন্যমনস্ক হয়ে বলে,
“সেটা সময় বলবে।”

“তুই কী জানিস, আমিও বাহার ভাইকে ভালোবাসি?”

“একটু একটু জানি বোধহয়।”

“তবে তোর মতন আমি এমন নিস্তেজ হতে পারলাম না কেন? তবে কী কম ভালোবেসেছি?”

আপার বাচ্চামো প্রশ্নে হাসলো চিত্রা। আপার গালে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো,
“তুমি যতটা ভালোবাসতে পেরেছো, ততটা ভালো আমিও বাসতে পারি নি। বিচ্ছেদ মানুষের মাঝে দু রকমের প্রভাব ফেলে। কেউ বিচ্ছেদ সহ্য করতে না পেরে শক্ত হয় আর কেউ মুক্তি খোঁজে মৃত্যুর মাঝে। তুমি হলে গিয়ে প্রথম জন।”

“আর তুই কী তবে দ্বিতীয় জন!”

অহি আপার প্রশ্নের উত্তর দিলো না চিত্রা। যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো এখানে, তেমন ভাবেই নিঃশব্দে ছাঁদ থেকে নেমে গেলো নিচে। নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিলো। হাঁটুর মাঝে মুখ ডুবিয়ে বললো,
“আপনারে ছাড়া এই বাড়ির ছাঁদে যেতেও আমার দমবন্ধ হয়ে যায় বাহার ভাই। আর সেই আমি কেমন করে এই বিশাল পৃথিবীতে থাকবো?”

(৮৭)

ডিসেম্বরের বিশ তারিখ। প্রকৃতিতে ঘন হয়ে আসা মেঘের বিচরণ। ঝড় আসবে বোধহয়। শীতকালে বৃষ্টির দেখা মেলে না তবে আজ সকাল থেকেই আকাশের মন খারাপ। সকালের আকামে কেমন সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব। সাদা পাঞ্জাবির পকেটে দামী ফোনটা ঢুকিয়ে হেলতে দুলতে বিরাট হোটেলটায় ঢুকে পড়লো নামীদামী সেই নেতা। আজ আরও একটা জয়ের সেলিব্রেশন করতে তার মেয়ে সঙ্গী দরকার। ভালো একটা মেয়ে এসেছে। বৃষ্টিমুখর এই জয়ের উদযাপন ভীষণ ভালো ভাবেই করা যাবে ভেবেই তৃপ্তির ঢেকুর তুললো সে। সচারচর সে নিজের সাথে কয়েকজন ছেলে রাখলেও এ সময়টা একা উদযাপন করে। তাছাড়া এমন খবর লিক হয়ে গেলেও সমস্যা। তাই এই সময়টা সে একা থাকে।

চির পরিচিত বিশাল রুমটাতে প্রবেশ করতেই অবাকে হা হয়ে যায় নেতা সাহেব। ঘুটঘুটে আঁধারের মাঝে কেমন মোমবাতি জ্বালানো। একদম মোহনীয় পরিবেশ। আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় সুঠামদেহী লোকটা। এত বিশেষ আয়োজনে কখনো নারী ভোজ করা হয় না। তবে আজ এমন বিশেষত্ব দেখে তার চোখ ধাঁধিয়ে আসে। সাদা বিছানার উপর সাদা শাড়ি পড়া ঘোমটা দেওয়া রমণীকে দেখে তার তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে গেলো ঠোঁটে। ঘোর ঘোর দৃষ্টিতে সে এগিয়ে এলো রমণীর দিকে। নে°শাক্ত কণ্ঠে বললো,
“বাহ্, নতুন বউয়ের সাজে কখনো মা** দের বসে থাকতে দেখি নি। তোমার শরীর আমাকে বড্ড টানছে। তোমার মুখটা দেখি।”

রমণী এমন বাজে সম্বোধনের পরেও খিলখিল করে হেসে উঠলো। সারাঘরে যেন মুক্তো ঝরলো সেই হাসির শব্দে। নেতা সাহেব মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। রমণী খাট থেকে নেমে গিয়ে টেবিলের উপর থাকা দুধের গ্লাস এনে নেতা সাহেবের ঠোঁটের সামনে ছুঁইয়ে দিলো। ঘোরের মাঝে থাকা নেতা সাহেব রমণীর কোমড় জড়িয়ে খেয়ে নিলো সে দুধটুকু। তৃপ্তিতে তৃপ্তিতে ভরে উঠলো তার চারপাশ। আরও একবার সুখের সাগরে ভেসে যাওয়ার প্রস্তুতিতে মত্ত হয়ে গেলো সে।

(৮৮)

কমিউনিটি সেন্টারে মানুষের তুমুল ভীড়। কনে কখন আসবে সে উন্মাদনায় মুখিয়ে আছে সবাই। সবার টান টান উত্তেজনার সমাপ্তি ঘটিয়ে অবশেষে হাজির হয় অহি। তাকে নওশাদ হাত ধরে গাড়ী থেকে নামায়, চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
“পাক্কা দেড় ঘন্টা লেইট! এতক্ষণ কোথায় ছিলেন!”

অহি শরীরের শাড়ি ঠিক করতে করতে বললো,
“পার্লার থেকে তো সেই কখন বেরিয়েছি কিন্তু এত জ্যাম ছিলো যে আসতে আসতে এতটা সময় লেগে গেলো।”

নওশাদকে কথাটা বলেই চাঁদনী আপার দিকে তাকালো অহি, ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“আপা, পড়নের শাড়িটা ব্যাগে। ঠিক করে রেখো তো।”

চাঁদনী মাথা দুলিয়ে গাড়ীর কাছে চলে আসে, অহি ততক্ষণে স্টেজের দিকে চলে গিয়েছে। চাঁদনী শাড়ির ব্যাগটা ধরে টান দিতেই শপিং ব্যাগটা ছিঁড়ে শাড়িটা নিচে পড়ে গেল। কপাল কুঁচকে শাড়িটা উঠাতেই অল্প কিছু লাল রঙের দাঁগ দেখে বিরক্ত হয় সে। মেয়েটা এত অযত্ন কেমনে করে! সাদা শাড়িটার মাঝে কেমন বিদঘুটে লাল দাঁগ ফেলে দিয়েছে!

(৮৯)

দুপুর প্রায় একটার কাছাকাছি। কোনো রকমের হাঁপিয়ে ওঠা শরীরটা নিয়ে থানার সামনে দাঁড়ালো চিত্রা। বুকের মাঝে ভয়। বাহার ভাইকে কী নিয়ে চলে গেলো!

থানার কাছটাতে এসে দাঁড়ালো চিত্রা। বাহার ভাইকে গাড়িতে তুলে ফেলেছে। গাড়ীটা কেবলই ছাড়তো। চিত্রা কোনোমতে গাড়ীটার সামনে দাঁড়াতেই গতকাল রাতের কনস্টেবল টা গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়ালো, ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“এত দেরী করে এসেছো! কতক্ষণ যাবত তালবাহানা করে গাড়ীটা আটকে রেখেছি জানো? দাঁড়াও বড় স্যারকে জিজ্ঞেস করে আসি এখন আর তাকে গাড়ী থেকে নামতে দেওয়া যাবে কিনা।”

চিত্রা মাথা নাড়াতেই লোকটা নুরুল সওদাগরের কাছে চলে গেলেন। কী যেন বললে কতক্ষণ। অনেকটা সময় বাকবিতন্ডার পর লোকটা আবার ব্যতিব্যস্ত পায়ে গাড়ীর ভেতরে গিয়ে বাহার ভাইকে বের করলেন।

চিত্রার হৃৎপিন্ড হুট করেই যেন থেমে গেলো। মানুষটার মুুখে কেমন মায়াবী হাসি! চিত্রাও আজ কাঁদলো না। হাসিমুখে এগিয়ে গেলো মানুষটার দিকে, উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,
“কেমন লাগছে বলুন আমাকে?”

বাহার আপাদমস্তক দেখলো চিত্রাকে। তারপর মিষ্টি হেসে বললো,
“একদম মেঘের মতন।”

চিত্রা খিলখিল করে হাসলো, ঠাট্টা করে বললো,
“আকাশে যাবো তো, তাই মেঘ হয়েছি।”

“আকাশ তোমার জন্য নহে, মেয়ে। ছোটো জীবনে অনেক পাওনা বাকি তোমার।”

“যেখানে আপনাকেই আর পাওয়া হলো না, সেখানে অনেক পাওনা আমার কাছে অনর্থক।”

“দু একটা না পাওয়া থাকতে হয় জীবনে।”

“আপনাকে পেয়ে গেলেই আমার না পাওয়াদের মুক্তি হতো।”

বাহার ভাই আর কোনো উত্তর দিলো না। কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো চিত্রার দিকে। হাসি হাসি মুখটা নিয়েই বললো,
“ভাবতেই খুব অবাক লাগে মেয়ে, আমাদের আর কখনো দেখা হবে না। আমার এর জন্য কোনো আফসোস নেই, আমার আফসোস কেবল, তুমি ভালোবেসে কী কষ্টটাই না পেলে!”

এতটুকু কথাই হয়তো যথেষ্ট ছিলো চিত্রার মুখের হাসি কেড়ে নিতেই। ছোটো চিত্রা যে অনেক চেয়েও পারলো না কান্না আটকাতে। বাহার ভাইয়ের ডান হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। চিৎকার দিয়ে বললো,
“আমার বুকের মাঝে ক্ষত করে পালাচ্ছেন, বাহার ভাই? এজন্যই বোধহয় বলেছিলেন আপনাকে জ্বালালে আমি নিজেও জ্বলে যাবো তাই না। এই পৃথিবী অনেক নিষ্ঠুর জানেন তো, বাহার ভাই। আপনার জন্য আমি চির জীবন শোক পালন করে ম°রার মতন বেঁচে থাকতে পারবো না। বুকের ভেতর আস্ত একটা বাহার ভাই পুষে রাখা আমি, বাহার বিহীন বাঁচতে পারবো না। আমায় কেন এমন পর করে দিলেন!”

রঙ্গনার চোখের পানি মুছে দিলো বাহার ভাই। খুব যত্নে, আদুরে হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কে বলেছে পর করে দিয়েছি? আমি তো তোমার অস্তিত্বে মিশে আছি, রঙ্গনা। এই-যে, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে যে তৃপ্তি পাবে, সেই তৃপ্ততায় আমি থাকবো। তোমার ছাঁদের ফুল গাছ গুলোতো, হাসি হাসি ফুলের মায়ায় আমি থাকবো, আমি থাকবো তোমার উদাস বিকেলে, আমি থাকবো তোমার নির্ঘুম রাত গুলো তে, আমি থাকবো তোমার বারান্দার অযত্নের ফুলের টবে, আমি থাকবো তোমার সাদা শাড়ির আঁচল মাঝে, তোমার চুলের খোপায়, চুড়ির ভাজে আমি থাকবো রঙ্গনা। তোমার বুকের মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা হয়ে আমি থেকে যাবো চিরকাল রঙ্গনা। তোমার চোখের কান্না হয়ে আমি আছি।”

“অথচ আমি যে আপনাকে রঙিন বসন্তে চেয়েছিলাম।”

“বসন্তেই তো আছি, রঙ্গনা। চৈত্রমাসের মতন। কিছুটা শুষ্ক, ফেঁটে যাওয়া মাটির খড়ার মতন হয়ে। তোমার যতবার মনে হবে আমি নেই, ততবার তোমার মস্তিষ্কে আমি আছি। কাঁদছো কেন রঙ্গনা? সবাই যে চিরদিন থাকে না।”

“বাহার ভাই যে সবার মাঝে পড়ে না। ও বাহার ভাই, আমার অনেক ব্যাথা হচ্ছে বুকে। থেকে যান না প্লিজ। থেকে যান। আপনাকে আমি খুব গোপনে রেখে দিবো। পৃথিবীর বুক থেকে আড়াল করে রেখে দিবো আমি। থাকুন না, বাহার ভাই।”

“নিয়তি যে আমার হাতে নেই। তবে আমার আর কোনো আক্ষেপ নেই মেয়ে বরং এটা ভেবে শান্তি যে, টুপ করে ম°রে গেলে, টুপটাপ বৃষ্টিতে আমার ভিজে কবরের উপর ছাতা ধরে রাখার একজন মানুষ এই পৃথিবীতে আছে। আমার কবর যত্নে রাখার মানুষ আমি রেখে যাচ্ছি এখানে। পৃথিবীর প্রতি এই কৃতজ্ঞতা আমার থেকে যাবে।
শুনো, মেঘের বেশে থাকা রঙ্গনা,
কাঁচের ফাটল মানায়, তোমার না।”

চিত্রা যখন আরেকটু জড়িয়ে ধরবে বাহার ভাইকে, ঠিক সেই মুহূর্তে সশব্দে গাড়ির ইঞ্জিন চালু হলো। নিষ্ঠুর ভাবে বেজে উঠলো বিদায়ের ঘন্টা। চিত্রার হাত থেকে টানতে টানতে নিয়ে গেল বাহার ভাইকে। আর দেখা হবে না। মানুষটার মুখের হাসিটা চাইলেও আর দেখতে পারবে ভেবেই হাউমাউ কান্না জুড়ে দিলো চিত্রা। গগণ ফাটানো চিৎকার। সাথে প্রলাপ বকে বলছে,
“আব্বু, আমার কবর খানা বাহার ভাইয়ের কবরের পাশে করবেন। আপনার কাছে আমার শেষ আবদার আব্বু, আমায় আপনি বাহার ভাইয়ের পাশে ঠাঁই দিয়েন।”

বাহার ভাই গাড়ীর মাঝেই সুর তুললেন, দৃষ্টি তার রঙ্গনাতেই আবদ্ধ। হুট করেই শীতের আকাশে ঝুম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার রঙ্গনা। সে রঙ্গনার পানে নির্মিশেষ তাকিয়ে থেকে বাহার ভাই গাইলেন,
“দূর আকাশে চান্দের পাশে,
ঝলমল করে তারা,,
আমার কেউ না-ই রে বন্ধু
কেবল তুমি ছাড়া।”

(৯০)

বিয়ের বাড়িতে খুশির আমেজ। বৃষ্টিমুখর আবহাওয়ায় অনুষ্ঠানে কেমন মাখো মাখো ভাব। অহির হাতে কলম, বুক তার কাঁপছে। যেখানে একটা জীবনের শেষ আজ, সেখানে আরেকটা জীবনের নতুন পথচলা শুরু। অহি চোখ বন্ধ করলো, চোখের পাতায় ভেসে উঠলো ছন্নছাড়া বাহার ভাইয়ের মায়া মায়া মুখের আদল। কখনো তার খিলখিল হাসিতে পরিপূর্ণ থাকা মুখ, কখনো তার সিগারেটে পুড়ে যাওয়া ব্যাথা গুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো অহির হৃদয় জুড়ে। অহি তপ্ত শ্বাস ফেললো, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা, মন বলে উঠলো,
“আজ শেষ মুহূর্তে আমি আবার শুরুর কথাটা বলছি, শেষবারের মতন ভালোবাসি। এই সূর্য, চাঁদের সত্যিটার মতন আমি আপনারে ভালোবাসি। শেষ বেলা এসেও আমি আপনারে ভালোবাসি বাহার ভাই। আপনার প্রতি আমার যে ভালোবাসা তা আমি বোধহয় ভুলে গিয়ে কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। থাকুন না আপনি খুব গোপনে।”

আফসোসের দীর্ঘশ্বাসের ভার সামলে সাইন করে ফেললো সে। অবশেষে বাহার ভাইকে হৃদয়ে পুষে আরেকজনের জীবনে পদার্পণ করেই ফেললো। এটাই তো জীবন, ভাসতে ভাসতে যেতে হয় ভাসানপুর।

(৯১)

পুরো বাড়িতে অবনী বেগম একা। সবাই এখনো বিয়ের অনুষ্ঠানে। সে বাড়িতে এসেছে চিত্রার জন্য। মেয়েটাকে সেন্টারে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে সে ভেবেছিলো মেয়েটা বাড়ি এসেছে কিন্তু বাড়িতে এসে দেখে বাড়িতে কেউ নেই। অগোছালো বাড়িটাকে তাই গুছিয়ে নিচ্ছে। মেয়ে জামাইকে আজ এ বাড়িতেই রাখা হবে আফজাল সওদাগরের আবদারে।

ফুলদানী টা গুছাতে গুছাতে বাড়ির কলিংবেলটা সশব্দে বেজে উঠলো। অবনী বেগম ব্যস্ত হাতে খুলে দিতেই একজন অপরিচিত ভদ্রলোককে চোখে পড়লো। লোকটা তাকে দেখেই একটা খাম এগিয়ে দিলো। খামটা দেখেই মনে হচ্ছে কোনো অফিসিয়ালি কিছু। অবনী বেগম সাইন করলেন। খামটা দরজায় দাঁড়িয়েই খুললো। খুলতেই তার চোখে অশ্রুদের ভিড় জামলো। বাহারের চাকরি টা হয়ে গিয়েছে। এবং সেই লেটারই এসেছে। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। প্রাণের বিনিময়ে কী তবে সৃষ্টিকর্তা চাকরি টা দিলেন! কী তার মহিমা! শাড়ির আঁচল দিয়ে যেই না চোখ মুছে দরজাটা বন্ধ করতে নিবেন, সেই মুহূর্তে দরজার সামনে বর্তমানে উপস্থিত হওয়া মানুষটাকে দেখে সে দু’পা পিছিয়ে গেলেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে, এলোমেলো অনুভূতি নিয়ে কোনো রকমে উচ্চারণ করলেন,
“আ আমজাদ!”

ফর্মাল পোশাকে থাকা আমজাদ ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো অবনী বেগমকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমি একবারে চলে এসেছি, অবু। আমি আর তোমাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না। তোমার মতন কেউ হয় না, কেউ না।”

অবনী বেগম কেবল বিস্মিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েই রইলেন। তার যেন বিশ্বাস হলো না ঘটনাটা।

(৯২)

তুমুল বৃষ্টি ধারায় চুপচাপ ভিজে চলছে চিত্রা। হাতের নুপুর জোড়া রেখে দিয়েছে বাহার ভাইয়ের বোনের কবরের উপর। দু’টো কবরের মাঝখানে সে বসে আছে। কি যেন বলছে, হাসছে আবার হুট করে কেঁদে দিচ্ছে। বুকের মাঝে ব্যাথাদের তোলপাড়। তুমুল শীতের মাঝে ভিজে শরীর নিয়ে আবার কেঁপে কেঁপেও উঠছে কিঞ্চিৎ।

মাটিতে মাখামাখি তার শরীর। চোখের উপর ভাসছে কয়েকমাস আগের তার জীবনের হাসিখুশি চিত্র গুলো। বাহার ভাইয়ের গিটারের শব্দ, এলোমেলো গানের সুর। বন্ধ চোখের পাতা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। চিত্রা হাসতে হাসতে হাতের মুঠোয় থাকা ব্লে° ড টা বের করে বা’হাতের রগ বরাবর চেপে ধরলো। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে করুণ স্বরে বললো,
“আল্লাহ্, আমার সকল অভিযোগ আমি রেখে গেলাম তোমার দরজায়। এই পৃথিবী আমাদের বাঁচতে দিলো না আল্লাহ। তোমার তৈরী এই পৃথিবীর বড্ড নিষ্ঠুর। আমাদের মতন মানুষ যে সহ্য করতে পারে না সে নিষ্ঠুরতা। তুমি আমায় ক্ষমা করো আল্লাহ। তোমার ঐ দুনিয়ায় আমার ঠাঁই হবে জেনেও আমি পাপ করছি৷ কী করবো বলো? এমন ভাবে আদৌও বাঁচা যায়! বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে মৃত্যু যে কতটা কঠিন, তা কেউ জানবে না। কেবল তুমি জানবে তোমার বান্দার হাহাকার। এ পৃথিবী বাহার ভাই আর চিত্রার সংসার তৈরী করতে দিলো না। মানুষ গুলো আমার আপন হয়েও হইলো না। বাহার ভাই শুনছেন, আপনাকে রঙ্গনা বড্ড বেশিই ভালোবাসে। তাই তো সে আপনার মিছে পাপ মুছতে না পেরেও মুছে ফেলেছে সে পাপীকে। ভালোবাসি বাহার ভাই।”

হাতের চাপ শক্ত করার আগেই পেছন থেকে কোমল পুরুষালী কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো,
“আমিও তোমায় ভালোবাসি রঙ্গনা। ঠিক চৈত্রমাসের মতন। যে চৈত্রমাস বসন্ত আনে ধরায়, ঠিক সেই চৈত্রমাসের মতন। আমাদের সংসার হবে রঙ্গনা। তুমি আমার চিত্ত চিরে চৈত্রমাসের কারণ, তুমি আমার শত ভুলের আকাশ ছোঁয়া বারণ। আমাদের সংসার হবে মেয়ে। কাঁদছো কেন মেয়ে, সংসার করবে না?”

চিত্রা পেছনে ঘুরে বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“বাহার ভাই!”
(৯৩)

বিরাট হোটেলের সাদা বিছানায় র° ক্তের স্রোত। নুরুল সওদাগর তন্নতন্ন করে খুঁজছে বিরাট রাজনৈতিক নেতার খু° নের রহস্য। তন্মধ্যে তার ফোনে কল এলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে সে ফোন উঠাতেই দেখলো উপর মহল থেকে কল। নুরুল সওদাগর ফোন ধরেই সালাম করতে অপর পাশ থেকে কর্কশ কণ্ঠে বড় অফিসার বলে উঠলেন,
“আপনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নাকি একজন ফাঁ° সির আসামী পালিয়েছে!”

“জি স্যার!”

“ধ্যান কোথায় থাকে আপনাদের? আপাতত ঐ আসামীর তদন্ত বাদ দিয়ে মিস্টার শেখরের খু° নের তদন্ত করুন এবং ঐ আসামীর ছবি পুরো শহরে ছাপিয়ে রেড লাইট এলার্ট জারী করুন।”

“ইয়েস স্যার।”

ফোন কেটেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো নুরুল সওদাগর। তার বিশ্বস্ত সেই কনস্টেবল এসে রাশভারী কণ্ঠে বললো,
“স্যার, বাহারের ছবিটা কখন ছাপাবো!”

নুরুল সওদাগর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“আজ রাতের পর। ওরা ঢাকা ছাড়ুক, তারপর নাহয়।”

“বড় স্যার কল দিলে কী বলবেন?”

“আহা, চিন্তা করো না শাহাবুদ্দিন, আপাতত এই বিশিষ্ট নেতার খবরেই তোলপাড় হবে মিডিয়া। বাহার তো অন্যান্য আসামীর মতনই নরমাল। তাকে নিয়ে ঝড়টা তেমন আসবে না। এখন সব প্রেশার পড়বে এ খু° নটা নিয়ে।”

কনস্টেবল এবং নুরুল সওদাগর কুটিল হাসি দিলেন। দু’জন লেগে পড়লো খু° নের রহস্য নিয়ে। তন্মধ্যে নুরুল সওদাগরের পায়ের নিচে কিছু পড়তেই তিনি থেমে গেলেন। এক টুকরো সাদা চুড়ি। নুরুল সওদাগর চুড়িটা উঠিয়ে খুব গোপনে পকেটে গুঁজে নিলেন। মনে মনে বললেন,
“অনেক হেঁটেছি আইনের পথে, দুর্নীতির এ জীবনে সৎ হওয়াটা মহা পাপ। বাবা তোমার কথা শুনেছে, চিত্রা। দু একবার চোখ বন্ধ করে আইন ভঙ্গ করে দেখেছে। এর চেয়ে শান্তি কিছুতেই নেই। তোমাদের সুখের সংসার হোক। তোমার বাহার ভাই তোমারই থাকুক। বাবা তোমায় ভালোবাসবে না ভালোবাসবে না করেও ভালোবেসেছে। তুমি ভালো থেকো, পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া বেকার বাহারদের গল্পে।”

কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া বেকার বাহার ভাইরা ভালো থাকুক। খুব গোপনে হলেও তারা ভালো থাকুক। চিত্রাদের গল্পে তারা রোজ রোজ বাঁচুক, হাসুক। বেকারত্বের অভিশাপেও যেন বাহাররা না হারায়। ভালোবাসার কাছে যেন এমন করেই হেরে যায় সকল আইন, সকল স্বার্থপরতা। ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনো আদালত এ পৃথিবীতে নেই। তোমরা যতই স্বার্থপর হও, তোমাদের এই ভালোবাসার কাছে এসে থামতেই হবে। বেকার বাহারদের হাত ধরে পথ চলে দেখো, একদিন তারা তোমায় পুরো পৃথিবী দেখাবে। রঙ্গনাদের প্রাপ্তিতে, অহিদের অপ্রাপ্তিতে আপনি থেকে যান বাহার ভাই, আমরা রেখে দিবো।

{সমাপ্ত}

[প্রিয় পাঠকমহল, প্রথমে আমি দুঃখীত একটা বিশাল বড় ভুলের জন্য। বাহার ভাইয়ের যে কেইস প্রসেসিং টা দেখিয়েছি, বর্তমানে আমাদের দেশে কখনোই একটা কেইস এত দ্রুত এগিয়ে যায় না। আমি এটা ভীষণ দ্রুত দেখিয়েছি তাই ক্ষমাপ্রার্থী উপন্যাসটার দ্রুতটাই কাজটা করতে কিছুটা বাধ্য হয়েই এটা করেছি।

যদি বাহার ভাইকে বইয়ের পাতায় আনি তবে এই ভুল টা শুধরে নিয়ে আরেকটু গভীরভাবে আনবো। ততদিন অব্দি অপেক্ষা করুন।

আর বাহার ভাইকে এত ভালোবাসার জন্য ভালোবাসা নিবেন।]

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here