#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#শেষপর্ব
এই মেয়ে এমন হাসিস কেন?
হাত বাড়িয়ে ডাকিস কেন?
জানিস কি তোর মুখের হাসি,
বড্ড আমি ভালোবাসি।
চুলেতে তোর মেঘ নেমেছে,
কাজল চোখে বৃষ্টি।
শ্যামল মেয়ে তোর মুখখানি,
খোদার অপরূপ সৃষ্টি।
এই মেয়েটা শুধুই আমার,
কী আচানক ব্যাপার স্যাপার।
অরু, অরু এই অরণী,
আমার বৌ, লক্ষী ঘরণী।
সকাল সকাল রিদমের এমন পাগলামি ভরা ম্যাসেজে অরুর মনটা নেচে ওঠে। “রিদমের বৌ” এই কথাটা মনে হতেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। গতকাল বিয়ে পড়ানোর সময় ফয়সাল, রিক্তা আর রিদমের দুজন কলেজ ফ্রেন্ড ছিল। যদিও সবাই কথা দিয়েছে, এখন কোন কিছু প্রকাশ করবে না, রিদমের ইন্টার্নশিপ প্রায় শেষ, আর অল্প কিছুদিন পর এফসিপিএস এর জন্য বসবে। অরণী ফাইনাল প্রফেশনাল এক্সাম দিবে। এইসব ঝামেলা শেষে নিজ নিজ বাসায় জানাবে।
অরণীর ভয় রিক্তাকে নিয়ে, এই মেয়ে তার কলিজা বান্ধবী কিন্তু কোন কথা পেটে রাখতে পারে না। অবশ্য ফয়সাল রিক্তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে কাউকে না বলতে এখন। আশা করা যায় বয়ফ্রেন্ডকে রিক্তা রাগাবে না। কাল সবকিছুই যেন একটা ঘোরের মতো ছিল। অরণী বাসায় এসে চোরের মতো পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে, মনে হচ্ছিল ওর চোখ দেখলে সবাই সবকিছু জেনে যাবে। রাতেও ভাত নেড়েচেড়ে উঠে গিয়েছে, বাবার সামনে খাবার গলা দিয়ে নামেনি। মাকে মিথ্যা বলেছে যে পরীক্ষার টেনশনে খাওয়া দাওয়া করতে পারছে না।
“অরণী, এই অবস্থা কেন চেহারার? কেমন উষ্কখুষ্ক লাগছে। নাতনি, সামনে বিয়া হবে তোর, এখন কোথায় পরিপাটি হইয়া থাকবি।”
অরণী দাদীর কথায় সতর্ক হয়ে যায়, “কার বিয়ে দাদী?”
“কার বিয়া আবার। তোর বিয়া, পরীক্ষা শেষ হোক, তারপরই তোরে বিদায় করবো। আচ্ছা এই নাত জামাই তোরে ফোন দেয় নাকি রে?”
হুমায়রা রান্নাঘর থেকে এগিয়ে আসেন, “কী বলেন আম্মা। এখন এগুলো বইলেন না। মেয়েটার সামনে পরীক্ষা, ওর আব্বু এখন বিয়েশাদির আলাপ করতে নিষেধ করছে। পরীক্ষা ঠান্ডা মাথায় দেক, তারপর এসব আলোচনা হবে।”
“হইছে তোমার আর পন্ডিতি করা লাগব না। আমার নাতনির সাথে তোমার অনুমতি নিয়া কথা বলবো। পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিব, এরপর বিয়া হইবো। এত ঢং এর কী আছে। আর তাইলে রাতে কার সাথে কুটকুট কথা বললি অরণী?”
“কার সাথে বলবো দাদী, বান্ধবীর সাথে বলছি।”
হুমায়রা ইশারায় অরণীকে উঠে যেতে বলে। অরণীর বাবা এমনি যতই রগচটা হোন, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ায় ভেদাভেদ করেননি। অমিয়র মতো অরণীর লেখাপড়ার জন্য একই রকম মনোযোগ দিয়েছেন। আর তাই চান মেয়েটা ভালোয় ভালোয় ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তার হোক। বিয়ের সকল আয়োজন তারপরই হবে। আর তাই তিনি এই মুহূর্তে অরণী পাত্রের সাথে ফোনে কথা বলুক তাও তিনি চান না। তাছাড়া ওনার মতে কোন কিছু ফাইনাল হওয়ার আগে ছেলেমেয়েকে খুব একটা মেলামেশা করুক তা ভালোও নয়। সামনে বিয়ে তো হবেই, এই ধারণা মাথায় থাকলে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়ে তাদের সীমা কতটুকু তা ভুলে যেতে পারে। আকদের আগে তাই তিনি এত ঘনিষ্ঠতা পছন্দ করেন না। অবশ্য বাবার এই রক্ষণশীল মনোভাব বরং অরণীর জন্য শাপেবর হয়েছে। পরিবারের ঠিক করা হবু পাত্রের সাথে ফোনে কথা বলাটা একটা বিব্রতকর অনুভূতি হতো, তাছাড়া রিদম জানলে একটা পাগলামি করতো।
আজ কলেজে পা দিয়ে কেমন শিরশিরে অনুভূতি হয় অরণীর। মনে হচ্ছে যেন সবাই ওকেই দেখছে। আচ্ছা রিক্তা সব বলে দেয়নি তো! দুরদুর বুকে ক্লাসে ঢুকে অরণী। সবকিছু স্বাভাবিক দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচে। এখন ক্লাসগুলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, পরীক্ষা আগে প্র্যাকটিকাল আর ক্লাসের চাপে দম ফালানোর সময় নেই। রিদমের ম্যাসেজের জবাবে “ভালিবাসি” লিখেই তাই ক্লাসে মন দিয়েছে। প্র্যাকটিকালের সময় আউটডোরে যাবে, তখন দেখা হবে। তার আগে সময় নেই। অবশ্য ব্যাগের ভেতর ফোনের একটু পরপর ভাইব্রেশন বলে দিচ্ছে রিদমের তর সইছে না।
“পাগল একটা” স্মিত হেসে ক্লাসে মন দেওয়ার চেষ্টা করে অরণী।
প্র্যাকটিকাল প্লেসমেন্ট আজ কনজার্ভেটিভ এন্ড এন্ডোডন্টিকস ডিপার্টমেন্টে। খাতা সাইন করতে হবে, কাজ প্রায় গুছানো শেষ, কিছু এক্সরে বসাবে প্রিন্ট করে, ছবি আঁকা ঠিক আছে কিনা দেখিয়ে নিতে হবে। ডেডলাইনের আগে সবকিছু শেষ না করলে খাতা সাইন করলে পরে ম্যামের পেছন পেছন ঘুরতে হবে, সাথে বকা তো ফ্রি।
“এই বৌ, একটামাত্র পতি পরমেশ্বরকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?”
অরণী চমকে ওঠে, “আস্তে বলো, কেউ শুনলে? আমি তো সার্জারিতে ঘুরে আসলাম তোমাকে পাইনি সেখানে।”
“লাইব্রেরিতে পড়ছিলাম। আমার তো সব ডিপার্টমেন্ট প্রায় শেষ, এখন শুধু এক্সটেনশনের গুলো করছি। পরীক্ষার দেরি নেই। এরমধ্যে বাসায় অশান্তি, পড়ার পরিবেশ নাই। হাউকাউ লেগেই আছে। আপা এসেছে দুই বাচ্চা নিয়ে। আপার চোখের কোণে রেডিই থাকে, একটু কিছু বললেই হলো, টপাটপ ঝরা শুরু। বাসায় আসবে খুশি খুশি, দু’দিন যেতে না যেতে মায়ের সাথে লেগে যায়। মাও দুটো কথা শুনিয়ে দেয়, এরপর কান্নাকাটি, উফ্ বিরক্তিকর।”
“বেচারি, কয়দিনের জন্য বেড়াতে আসে বাবার বাড়ি, এমন করো কেন?”
“হুম, এখন খুব দরদ। যখন আমাদের বাসায় যাবে, তখন এই ননদ ননাসের নালিশই করতে আসবে। তবে শুনো ভাই আমার এসব ক্যাচাল ভালো লাগে না। আমি বাসায় রাতে ফিরি, খাই, টুপ করে ঘুমিয়ে যাই।”
“আচ্ছা এখন আমাকে এই খাতা ঠিক করতে দাও। আজ সাইন করাবো।”
“কাজ শেষে চলো ঘরোয়া খাবারঘরে যাই। তোমাকো গরম ভাত, পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে লাঞ্চ করাবো। বেতন পেয়েছি।”
“থাক টাকাটা হাতে রাখো। ইন্টার্নি শেষে ভাতা কোথায় পাবে। পরীক্ষা দিবে খরচ আছে না। আমার মনে হয় তুমি কোচিং এ মডেল টেস্ট দেওয়া শুরু করো। কোচিং না করলেও পরীক্ষা দেওয়া দরকার, প্রাকটিস হবে।”
“অরু, তোমাকে বলা হয়নি। চেম্বারে জয়েন করছি। জানো তো আব্বু এখন কিছু করে না। শুধু দুটো বাসা ভাড়া দিয়ে ঢাকায় চলা কত কষ্ট এখন। তার উপর বসিলায় আমাদের এই পুরানো বাসার ভাড়াও বেশি না, দুইটা ইউনিট থেকে আর কতই বা আসে।”
“পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর জয়েন করতে। আর তো কয়টা দিন।”
“সমস্যা নেই ভাইকে বলেছি পরীক্ষার সময়টা ছাড় পাব। কিন্তু ইন্টার্নি ভাতা বন্ধ হয়ে গেলে আমার হাতে টাকাই থাকবে না। পোস্ট গ্রাজুয়েশনের ব্যাপারটা বাসায় সেভাবে কেউ বোঝে না।”
“আচ্ছা, বাদ দাও তুমি চাপ নিও না। একটু অপেক্ষা করো, আমি কাজ শেষে আসি।”
ঘরোয়া খাবারঘর এই ভর দুপুরে জমজমাট। অল্প টাকায় গরম গরম সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায় বলে শিক্ষার্থীদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। রিদম যখন ভাতে মাছ মাখিয়ে অরণীর মুখে তুলে দেয়, কেন জানি অরণীর চোখজোড়া পানিতে ভিজে ওঠে। কান্নাটুকু গিলে নিয়ে রিদমকে বলে, “সারা দুনিয়ার সবকিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে চেয়েছি রিদম। প্লিজ কখনো বদলে যেও না, প্লিজ।”