স্বপ্ন_কেনার_দামে #দ্বিতীয়_খন্ড পর্ব ১১

0
222

#স্বপ্ন_কেনার_দামে
#দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব ১১

অরণী কাঁদতে শুরু করেছে। রিদমের হাত এখনো গলার কাছেই। রেস্টুরেন্টের সবাই হা করে তামাশা দেখছে। কেউ কেউ লাইভে চলে গিয়েছে। এমন ভাইরাল বিষয় কী মিস করা যায়! রিদম একটু অন্যমনস্ক হতেই মাহিদ টান দিয়ে গলার কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে দেয়।

“রিদম সাহেব। বাইরে চলুন। যথেষ্ট সিনক্রিয়েট করেছেন। অরণীকে বাসায় দিয়ে আসি। তারপর নিজেরা সিদ্ধান্ত নেন কী করবেন। চলুন বাইরে চলুন। আপনি নাকি আবার ডাক্তার মানুষ। একটা ছুরি গলায় ধরলেও বুঝতাম। ধরলেন কী কাঁটাচামচ। লোক হাসানোর বাকি কী রাখলেন। অরণী চলো নামিয়ে দেই। আমিও আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাববো।”

অরণী আর কারও নামিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা করে না। নিজেই ছুটে বের হয়ে যায়। মাহিদও বিল মিটিয়ে দিয়ে বের হয়। রিদম টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে নিশ্চল বসে থাকে। রেস্টুরেন্টের কেউ ওকে ঘাটায় না। রিদম বুঝতে পারছে আজকের বিষয়টা বাড়াবাড়িই হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বড়ো ছেলে সুলভ কোন ম্যাচুরিটি নেই কেন তার আচরণে! ছোটোবেলায় বাবা বিদেশ থাকাকালীন বিত্তবৈভবের যে সংস্পর্শ পেয়েছিল, তার রেশ ছিল কিশোর বয়স পর্যন্ত। বাবা ভালো পরিমাণ টাকা সাথে করে এনেছিলেন। একমাত্র ছেলে হিসেবে ছোটোবেলায় তাই যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। অভাববোধ বুঝতে শিখেছে যখন আস্তে আস্তে বাবার জমানো টাকা শেষ হয়ে তলানিতে নেমেছে। ততদিনে বয়স ষোলো পেরিয়ে সতের। তারপরের তিনবছরও টুকটাক জমি, গয়না বিক্রি করে ভালোই জীবন উপভোগ করেছে তাদের পুরো পরিবার। এখন হঠাৎ করে যখন সবাই আশা করে রিদম খুব বুঝদার হবে, বড়ো ছেলে সুলভ দায়দায়িত্ব কাঁধে নেবে। রিদমের কেন জানি তা ভালোই লাগে না। নাটক, নভেলের সেই আদর্শ বড়ো পুত্র হওয়ার কোন শখ তার নেই।
রিদমের বাবা একসময় দু’হাতে আয় করেছেন আর দশজন প্রবাসীর মতো। সে সময় ঢাকা শহরে দাদার পাঁচতলা বনেদি বাড়ি। বুঝতেই পারেনি জীবন সবসময় এক রকম যাবে না। রিদমের বড়ো বোনের বিয়েতেও তাই গয়না, ফার্নিচার সহ উপহার গিয়েছিল লাখ দশেক টাকার।
আর এখন পরিবারের সমস্ত খরচ নির্ভরশীল দাদার রেখে যাওয়া বাড়ির দু’টো ইউনিটের ভাড়া। একসময় যা বনেদি বাড়ি ছিল, কালের বিবর্তনে তাই পুরনো, আগের দিনের বাড়ি। রিদমের মাও এই অভাবের সাথে তাই মানিয়ে নিতে পারছে না এই সাত বছরেও। সবাই আশা করে আছে রিদম তাদের দিন ফেরাবে। অথচ রিদম কী করছে তা সে নিজেও জানে না। কখনো ড্রাগ কেলেঙ্কারিতে নাম আসছে তো কখনো রেস্টুরেন্টে এমন অদ্ভুত কান্ডকারখানা করে ফেলছে। এমন অবস্থা চললে জুনের এফসিপিএসও ক্লিয়ার করা হবে না। ইন্টার্নির পর ভালো একটা কাজের জন্য হন্যে হয়ে আছে। প্রাইভেট চেম্বারে বেতন নাই বললেই চলে। আট ঘন্টার বিনিময়ে অফার করে বারো হাজার। যা দিয়ে নিজের হাত খরচ চলাই দায়। ছয় হাজার টাকা যাতায়াত আর টুকটাক খরচের জন্য রেখে বাকিটা মাকে দেয়। এই ছয় হাজারে পরিবারে কিছুই হয় না। অথচ রিদমের মনে হচ্ছে অরণীকে না পেলে সব বৃথা, সব মিছে। পরিস্থিতি বলে অরণীর হাতটা ছেড়ে দেওয়াই ছিল ভালো। কিন্তু বারবার হৃদয় চিৎকার করে বলছে তার ডিগ্রি চাই না, চাকরি চাই না, এই মুহূর্তে শুধু অরণী চাই, শুধুই অরণী! রিদম সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, বাসায় যতই হাঙ্গামা হোক, মা চলআর বোনকে অরণীর কথা খুলে বলবে। মা কী ছেলের কষ্টটা বুঝবে না!

অরণী বাসায় ঢোকার আগে যতটা সম্ভব নিজেকে ঠিকঠাক করে নেয়। কান্না গিলে ফেলেছে পথে আসতে আসতেই। অমিয় দরজা খুলে দিতেই বাসায় ঢুকে মায়ের মুখোমুখি হওয়ার আগে ওয়াশরুমে চলে যায়। খুব ভালো করে গোসল করে। জমানো যত কান্না, অসহায়ত্ব, অভিমান আর অভিযোগ আছে সবকিছু এই পানির স্রোতে ধুয়ে ফেলতে চায় যেন। অরণী সহসা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ওর কী করা উচিত। যা কিছু হয়েছে তারজন্য সে মাহিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে। মাহিদকে অনুরোধ করবে একটা বাহানা করে বিয়ে ভেঙে দিতে। অরণী বাবা মাকে বোঝাবো আপাততঃ বিয়ের জন্য চাপ না দিতে। বরং অরণী পোস্ট গ্রাজুয়েশনের জন্য পড়া শুরু করবে। এইসব পরীক্ষার প্রস্তুতিতে একবছর সময় অন্তত যদি বের করতে পারে, ততদিনে রিদম নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করে নেবে সংসার চালানোর মতো। তার পোস্ট গ্রাজুয়েশন হয়ে গেলে বিশ হাজার টাকা ভাতা তো সেও পাবে। সবমিলিয়ে নিশ্চয়ই সামলে নিতে পারবে। আজ রিদম যে সিনক্রিয়েট করলো, তারপর তার উচিত রিদমের চেহারাও আর না দেখা। কিন্তু অরণী মনকে বোঝাবে কী, মন যে উল্টো ওকে রিদমের ভালোবাসাটুকুই দেখাচ্ছে। যতবার মনে হচ্ছে রিদম ওর জন্য নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছে, ততবার যুক্তি আবেগের কাছে হেরে যাচ্ছে।

“অরু, আর কতক্ষণ গোসল করবি? আধাঘন্টা হলো। কী এত গোসল করছিস বুঝি না।”

“বিয়ার কইন্যা আমার নাতনি। একটু তো এখন সময় নিবোই হুমায়রা। তুমি আমার নাতনির পিছনে পইরো না আর। নাত জামাই এর জন্য একটু রূপচর্চা করতেছিল তাই নারে অরণী?”
অরণী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বল। দাদী হেসে ওঠেন। অরণীর বিয়ের তোড়জোড় শুরু হওয়ার পর থেকে ওনার মন ভালো। একটা বয়সে এসে মানুষ নাতি নাতনির বিয়ে নিয়ে দারুণ উত্সাহী হয়ে ওঠেন। অরণীর দাদীও তার ব্যতিক্রম নয়। অরণী ওনার বড়ো নাতনি। এরপর আর কোন নাতি নাতনির বিয়ে দেখবেন কিনা কে জানে। আর তাই অরণীর বিয়ে নিয়ে ভীষণ আনন্দে আছেন। ছেলোর বৌ হুমায়রার সাথে কথায় কথায় মান অভিমান আপাততঃ বন্ধ রেখেছেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ের এই আয়োজনের সময় হুমায়রাকে বরং সাহস দিচ্ছেন, বুদ্ধি দিচ্ছেন। শ্বাশুড়ির এই রূপ দেখে হুমায়রাও বিস্মিত। তবে তার ভালোও লাগছে, বিয়ের এত বছরে সম্ভবত এই প্রথম টানা এতদিন শ্বাশুড়ি কোন দোষ না ধরে আছেন। ঘরে বৌ শ্বাশুড়ির দ্বন্দ্ব নেই বরং কেমন একটা শান্তি শান বলেই হয়ত জামিল সাহেবও এখন হুমায়রার সাথে খটমট করেন না। সবমিলিয়ে বাসার পরিবেশটা যেন কী সুন্দর, ঠিক যেমনটা অরণী আর অমিয় চেয়েছে সবসময়। অরণীর মনটা খারাপ হয়ে যায়, কী হবে যখন সবাই জানবে মাহিদ বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। মাহিদ ভালো মানুষ মনে হয়েছে অরণীর কাছে, তিনি নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন। একট কষ্ট পাবে সবাই হঠাৎ বিয়ে ভেঙে গেলে। কিন্তু অরণীকে সহজ ভাবে বিয়ে ভাঙাটা মেনে নিতে দেখলে আবার নিশ্চয়ই সবাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এই সাময়িকী কষ্টটা কেটে যাবে তখন। মাহিদের মতো দাদী রিদমকেও নাত জামাই বলে আহ্লাদ করবেন।

একটু অপেক্ষা। অরণী একফাঁকে ছাদে গিয়ে মাহিদকে ফোন দিয়ে সব বুঝিয়ে বলে অনুরোধ করবে, ওর চর রিদমের বিয়ের কথা এখন বাসায় বলা সম্ভব না। তাই যেন মাহিদ বাসায় বলে সেই অরণীকে এখন বিয়ে করতে চায় না। রিদম ম্যাসেজ দিয়েছে

“অরণী, আমার অরু। ” দিল ওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে”। আমার দুলহান কী তার দিল ওয়ালার সাথে যাবে না? একটু অপেক্ষা করবে না?”

অরণী ছোট করে উত্তর দেয়, “দুলহান সবসময় দিলওয়লারই ছিল। অপেক্ষায় থাকবো জন্মান্তর। ”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here