#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস
#মম_সাহা
পর্বঃ ষোলো
(৩৯)
চিত্রার মুখে রাজ্যের বিস্ময়। অহি আপা তার ফুলের টব ভেঙেছে সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। অহি আপা হলো গিয়ে নরম মানুষ, তার দ্বারা এই শক্ত কাজ সম্ভব!
অহির দৃষ্টি তখনও পার্কের আশপাশ বুলাতে ব্যস্ত। চিত্রার বিস্ময়মাখা মুখ পানে সে একবারও ফিরে তাকায় নি। চোখের সাথে চোখ মিললেই যেন সে কত কথা বলতে পারবে না। তাই তো আজ চোখে চোখ মেলানো বারণ। এতদিনের জমানো কথার প্রজাপতিদের আজ উড়িয়ে দিতে হবে। কথা জমিয়ে রাখলে মনের উপর অত্যাচার চালানো হয়। অথচ অহি নিজের মনের উপর সে অত্যাচার করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আজ নাহয় অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটুক।
ছোট্টো একটা শ্বাস ফেললো অহি। ধীর কণ্ঠে বললো,
“ভাবিস না তোর উপর হিংসে থেকে করেছি সেসব। তোর উপর হিংসে করার কিছু নেই। বরং মায়া করার মতন বহু কিছু আছে। তবে আমার মায়া কম। কাক পক্ষীতে ছিঁড়ে খেয়েছে মায়া।”
অহি আপার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝে নি চিত্রা। কেবল ফ্যালফ্যাল নয়নে চাইলো। কথা বলার শক্তিও যেন সে হারিয়েছে। অহি আপা কী বলছে, অহি আপা কি জানে?
“আপা, তুমি ঠিক আছো?”
চিত্রার প্রশ্নে আকাশ ছোঁয়া বিস্ময়। অহি কিঞ্চিৎ হাসলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আছি ঠিক। তোকে আজ কিছু কথা বলবো চিত্রা। অনেক গুলো বছর এ কথা কাউকে বলা হয় নি। এই লজ্জা, এই আঁধারিয়া জীবনের গল্প কাউকে জানানো হয় নি। আজ তুই শুনিস সে গল্প। অহি আপার মৃত্যুর গল্প শুনে নিস খুব যতনে। কেউ তো আর জানলো না এই অহির ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মনের কথা।”
চিত্রা কেবল অপলক তাকিয়ে রইলো অহির দিকে। আপাকে আজ ঠিক চেনা যাচ্ছে না। কেমন অপরিচিত একটা আদল ভেসে উঠছে। এটা কি সত্যিই অহি আপা?
“আরে সওদাগর বাড়ির নক্ষত্রমালা যে, তা তোমরা এখানে?”
পুরুষালী কণ্ঠে দুই বোনের কথার খেই হারালো। দু’জনই তাকালো তাদের ডান দিকে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটার দিকে। এলোমেলো চুল, টি-শার্ট এঁটে সেঁটে থাকা শরীর, কাঁধে ব্যাগ আর ক্লান্ত মুখশ্রীর বাহারের দিকে।
চিত্রা এবং অহি দু’জনই অবাক হলো বাহার ভাইকে দেখে। এসময়ে এখানে বাহার ভাইকে আশা করে নি তারা। বসা থেকে দু’জনই উঠে দাঁড়ালো। অহি অবাক কণ্ঠে বললো,
“বাহার ভাই আপনি?”
“হ্যাঁ আমি। তা তোমরা দু’জন এখানে কি করছো? তোমাদের তো এসব জায়গায় তেমন দেখা যায় না।”
“আসলে চিত্রা ফুচকা পছন্দ করে তো তাই এসেছিলাম ফুচকা খাওয়াতে।”
অহির উত্তর শুনে চিত্রা গোল গোল চোখে তাকালো অহির দিকে। অহি আপা বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে জানে, এটাও চিত্রার জানা ছিলো না। আজ একের পর এক চমক দিচ্ছে অহি আপা।
বাহার এগিয়ে এসে ধপ করে বেঞ্চটাতে বসে পড়লো। আড়মোড়া ভেঙে বললো,
“তা বেশ ভালো তো। তোমাদের মধ্যে এত মহব্বত তো ঠিক দেখা যায় না, একবারে ধূমকেতুর মতন।”
কথা শেষ করেই হা হা করে উদ্ভট ভাবে হেসে দিলো বাহার ভাই। বাহার ভাইয়ের অদ্ভুত হাসির সাথে তাল মেলালো অহিও। অথচ এমন একটা বিদঘুটে ঠাট্টা অন্য কেউ করলে অহি আপা তাকে এখানেই উচিৎ জবাব দিয়ে দিতো।
চিত্রা কেবল দেখে গেলো অহি আপা আর বাহার ভাইয়ের কান্ড। তন্মধ্যেই ফুচকার প্লেট হাজির হলো। অহি নিজের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দোকানদারকে দিয়ে এসে বাহারের সামনে দাঁড়ালো। বেশ ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“আপনি কী এখন বাড়ি যাবেন, বাহার ভাই?
“হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।”
“তাহলে চিত্রাকেও সাথে নিয়ে যাবেন প্লিজ। আসলে আমার একটা দরকারী কাজ আছে তো, এখনই যেতে হবে।”
অহির অনুরোধে বাহার ভাই একবার চিত্রার দিকে তাকালো। চিত্রা এতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে ছিলো বিধায় দু’জনেরই চোখে চেখে পড়লো। বাহার সাথে সাথেই চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। এতে ছোটো হয়ে এলো চিত্রার মন। কারণ সে জানে, বাহার ভাই কখনোই রাজি হবে না। কিন্তু চিত্রাকে অবাক করে দিয়ে বাহার বললো,
“কোলে করে নিবো নাকি কাঁধে করে?”
বাহারের উদ্ভট কথার ভঙ্গিতে আবার হেসে ফেললো অহি। মুখ চেপে বললো,
“আপাতত রিক্সা করে নিলেই হবে।”
চিত্রা মুখ ফুলালো। আড় চোখে অহির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপা, তোমার না এখন বাড়ি যাওয়ার কথা? তাহলে এখন আবার কোথায় যাবে তুমি?”
অহি চিত্রার কাছে গেলো, চিত্রার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললো,
“দরকারী কাজে যাবো। টাকাটা রাখ, রিক্সা ভাড়া দিয়ে দিস। বাহার ভাইয়ের কাছে মনে হয় টাকা নেই।”
চিত্রা কেবল আহাম্মকের মতন মাথা দুলালো। অহি ততক্ষণে ঝড়ের গতিতে তাদের সামনে থেকে চলে গেলো। যেন তার কাজটা কত জরুরী। এখন না গেলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
(৪০)
কোলাহল পূর্ণ রাস্তায় একদম একা হেঁটে যাচ্ছে অহি। তার কোনো গন্তব্য নেই, না আছে নির্দিষ্ট কাজ। কেবল বাহার আর চিত্রাকে একটু একা ছাড়ার জন্য ই এ মিছে অজুহাত। আর কেউ জানুক আর না জানুক, সে তো জানে, বাহার ভাইয়ের গিটারের করুণ সুরের কথা। মাঝ রাত্তিরে বাহার ভাইয়ের দীর্ঘশ্বাসের কথা। সেখানে যদি চিত্রা এসব দূর করার চাবিকাঠি হয় তাহলে তো আর মন্দ হয় না। সবাইকে কি আর এক জনমে পাওয়া হয়? বাহার ভাই নাহয় অহির একজীবনের অপ্রাপ্তি হয়ে রইলো।
“এই-যে মিস, শুনেন প্লিজ, সিঙেল আছেন কী?”
অহির ধ্যান ভাঙলো, মনে হলো তাকে উদ্দেশ্য করেই যেন কেউ গানটা গাইলো। পথচারীর কয়েকজন আড় চোখে চাইলো। অহি ঘুরে পেছনে তাকাতেই খুব স্বল্প পরিচিত মুখটা ভেসে উঠলো। অহি অবাক কণ্ঠে বললো,
“আপনি! গানটা কী আপনি গাইলেন?”
সুন্দর দেখতে সুঠাম দেহী পুরুষ টা মুচকি হাসলো। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ মিস. আমিই গাইলাম।”
অহির চোখে-মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়লো। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“আপনি কী আমায় চিনতে পারেন নি?”
ভদ্র লোক এগিয়ে এলো, মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,
“চিনবো না কেনো? গত পরশুই তো দেখলাম আপনাকে। কালো জামা পড়নে, গোল গোল চশমায়, মিষ্টি দেখতে মেয়েটা।”
লোকটার কথার ধাঁচ পছন্দ হলো না অহির। এমন একটা ছেলের জন্য কিনা চাচা চিত্রার বিয়ে ঠিক করেছে? ছেলেটা কেমন গায়ে পড়া গোছের।
অহির চোখ-মুখ কুঁচকানোর ভঙ্গিমা দেখেই নওশাদ হয়তো কিছু আন্দাজ করলো। তাই তো বেশ ঠাট্টার স্বরে বললো,
“আপনি কী আমায় চরম অভদ্র ভাবছেন, মিস?”
অহি নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে বেশ ভদ্র ভাবে বললো,
“দেখুন মিস্টার, আপনার সাথে আমাদের পরিবারের একটা সুন্দর সম্পর্কের কথা হচ্ছে, তাই আপনার কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করছি না।”
“সুন্দর সম্পর্কে ঠাট্টা করা কি নিষিদ্ধ? চলুন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাক।”
নওশাদ ছেলেটাকে অভদ্র কখনোই মনে হয় না। বেশ ভদ্রই মনে হয়, তবুও তার অহেতুক ঠাট্টা টা অহির পছন্দ হয় নি। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে সে পা মেলালো। অহিকে হাঁটতে দেখে মিষ্টি হাসলো নওশাদ। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আপনাকে নিয়ে হাঁটা হবে মোর শত আলোকবর্ষ পথ।”
(৪১)
রিক্সার হুড উঠানো, গতি মাধ্যম, চলছে অনবরত। পাশাপাশি বসে আছে চিত্রা আর বাহার ভাই। চুপচাপ, স্তব্ধ। অন্য সময় হলে চিত্রাই কত কথার ঝুড়ি নিয়ে বসতো, কিন্তু আজ তার মনে ভীষণ শোক। কথা বলা যাবে না, আর এ পাষণ্ড পুরুষের সাথে তো আরও আগে কথা বলবে না সে।
রাস্তার দুই সারিতে কৃষ্ণচূড়া গাছের মেলা। কি সুন্দর লাল টুকটুকে ফুল হাসছে অনবরত। রিক্সার ক্রিং ক্রিং শব্দ।
নিরবতা ভাঙলো বাহার। বরাবরের মতন গা ছাড়া ভাবে বললো,
“তা রঙ্গনা, মিষ্টি তো খাওয়ালে না।”
চিত্রা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। লোকটা তাকে খুঁচিয়ে কী মজা পায়? হৃদয়ের জ্বালা বাড়িয়ে কি তৃপ্তি মেলে লোকটার?
ছোটো একটা শ্বাস ফেলে সে। বুকের ভেতর ভারী ভারী হয়ে উঠে কষ্টরা। লোকটার সাথে কথা ই বলবে না সে।
“অভিমান জমিয়ে রেখে লাভ কী? আমরা বাঁচবোই বা কতদিন?”
বাহার ভাইয়ের গম্ভীর স্বর কাঁপন ধরালো চিত্রার চিত্তে। হুট করে তাকাতেই দু’জনের চোখে চোখ পড়লো। সময়টা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মধুর হলো। নিশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো অপ্রত্যাশিত ভাবে। লজ্জারা খেলা করলো সর্বাঙ্গে।
চিত্রা চোখ সরিয়ে নিলো। বাহিরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে করতে বললো,
“অভিমান অভিযোগ নেই আমার।”
“না থাকাটাই স্বাভাবিক। পর মানুষের প্রতি অভিমান রাখতে নেই, রঙ্গনা।”
বাহারের কণ্ঠে তুমুল গম্ভীরতা। কথার এমন তীক্ষ্ণতায় অভিমান করলো অষ্টাদশীর হৃদয়। ঠোঁট ফুলিয়ে টলমল করে উঠলো চক্ষুদ্বয়।
বাহার ছোট্টো ধমক দিলো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এই মেয়ে, কথায় কথায় কান্না করার স্বভাব বদলাও। কান্নাকে সস্তা বানিয়ো না, নিজের সবটা সত্তাকে সবচেয়ে মূল্যবান রাখার চেষ্টা করবে। হোক কান্না কিংবা হাসি।”
“আমি আপনার সাথে রাগ করেছি, বাহার ভাই।”
“তো রাগ করেই থাকো। আমি কী তোমার রাগ ভাঙাতে এসেছি?”
বাহারের গা ছাড়া ভাবে চিত্রা গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। বাহার ভাই পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালাতে জ্বালাতে বললো,
“তোমায় জ্বালাতে এত সুখ লাগে কেনো? কোন দিন যেন যেচে জ্বলতে এসে ছাই হয়ে যাও।”
“আপনি জ্বালালে, ছাই হতেও রাজি।”
“শুনো রঙ্গনা, অনুভূতির এমন প্রকাশ্যে বর্ণনা আমার পছন্দ না। অনুভূতি গোপনে রাখতে হয়, তবেই না মূল্যবান হবে।”
বাহারের কথায় অপমানিত হলো চিত্রা সাথে তাজ্জবও বনে গেলো। ততক্ষণে রিক্সা এসে থেমেছে বাড়ির সামনে। চিত্রা ভাড়া মিটিয়ে দিতে দিতে বললো,
“আর অনুভূতি মেলে ধরবো না, বাহার ভাই। সবাই তো সবটার মূল্য দিতে জানেনা, আমি ভুলেই গেছিলাম।”
চিত্রার তীক্ষ্ণ কথাতেও হেলদোল হলো না বাহারের। সে বরং বেশ গা ছাড়া ভাবেই বললো,
“এই যে মেয়ে রঙ্গনা, তোমার মুখে অভিমান মানায়, অভিযোগ না।”
চিত্রা ততক্ষণে বাড়ির ভেতরে চলে গেছে। বাহার ছোটো একটা শ্বাস ফেলে। দীর্ঘশ্বাসের হাহাকার ভেসে গেলো তার সাথে। আজ টিউশনিটাও চলে গেছে। এমন মানুষের প্রেমে মত্ত হওয়া মানায়? যার বাঁচা মরারই ঠিক নেই।
আফসোস গুলো সে হাওয়ায় মিলিয়ে গান ধরে,
“জীবন দিলা কাঞ্চা বাঁশের খাঁচারই মতো,
যত্ন নেওয়ার আগে তাহা, ভাঙে অবিরত দয়াল,
ভাঙে অবিরত।”
(৪২)
আজ সারাদিন দেখা মেলে নি মুনিয়া বেগমের। প্রথমে সবাই ভেবেছিলো রাগ করে হয়তো দোর দিয়েছেন, কিন্তু যখন দরজার সামনে পর্দা সরালো তখন দেখা গেলো দরজা বাহির থেকে আটকানো। দরজা খুলে ভেতরে যেতেই শূণ্য রুমখানি জানিয়ে দিলো মুনিয়া বেগম নেই। বিছানার কিনারায় সাদা চিরকুট।
#চলবে