চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস #মম_সাহা পর্বঃ একুশ

0
311

#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস
#মম_সাহা

পর্বঃ একুশ

(৫২)

হুড়মুড় করে কেমন অবসাদের বাতাস বয়ে গেলো প্রকৃতি নিবিড় করে। হা হুতাশ মাখানো অসুস্থ বাতাস। হাহাকার করা নিস্তব্ধ বাতাস। চিত্রা লোহার গেইট টার হাতল ধরে ভেজা চোখে যেন কার পথ চেয়ে রইলো। কার ফেরার আশায় যেন উতলা হলো তার দেহের ছোট্টো হৃৎপিণ্ড খানি। চিত্রা কেবল ঝাপসা চোখে অপেক্ষা করলো কিছু সুখবরের। শরীরে জড়ানো সুতির আকাশী রঙের জামাটায় তখনও র*ক্তের দাগ। হাতে লেগে আছে শুকনো র* ক্ত।

“আম্মা, আপনে ঘরে গিয়া বহেন। রাত তিনটা বাজে এইহানে বইয়া আছেন, ঠান্ডা লাগবো তো। যান আম্মা, ঘরে যান।”

বাড়ির সবচেয়ে কমদামী মানুষ বৃদ্ধ দারোয়ান চাচার আদর মাখানো দুশ্চিন্তা চিত্রার কানে কয়েকবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে-ফিরে গেলো তার নীড়ে। চিত্রা অটল,স্থির হয়ে বসেই রইলো। বিশেষ হেলদোল দেখালো না সে। যেন তার অবহেলিত শরীরটায় অবহেলাটাই প্রাপ্য। তুখোর অবহেলায় অবহেলায় ঝল* সে যাওয়াটাই তার প্রাপ্য।

দারোয়ান চাচা হতাশার শ্বাস ফেললো, নিবিড় কণ্ঠে বললো,
“অন্তত আমার টুল টার উপরে উঠে বসেন, আম্মা।”

চিত্রা এবারও নিশ্চুপ। প্রাণহীন দৃষ্টিতে একবার তাকালো বৃদ্ধ দারোয়ানের দিকে। চোখে তখন অশ্রু কনারাও বিরতি নিয়েছে কিন্তু গাল তার তখনও ভেজা। বহু কষ্টে চিত্রা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অপরাধী সুরে উচ্চারণ করলো,
“আমি ইচ্ছে করে চাঁদনী বুবুকে ধাক্কা মারি নি, চাচা। তুমি তো আমায় বিশ্বাস করো তাই না?”

বৃদ্ধ মতিউর রহমান গোলগাল মেয়েটার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালেন। মেয়েটার দু’গালে তখনো নির্মম চ* ড়ের ছাপ স্পষ্ট। চুল গুলো বেজায় টানাটানিতে অগোছালো। বা’চোখের কোণাটাও কেমন ফুলে আছে! কি মা*রটাই না মেরেছে!

চিত্রা এবার বাঁধ ভেঙে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। নিজের ধুলোমাখা দু’হাতের মাধ্যমে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে অস্ফুটেস্বরে বললো,
“আমি ইচ্ছে করে করি নি, চাচা। আমি এত অ-মানুষ নই। চাচা গো, আপাটার কিছু হলে সে কলঙ্কের কালিতে যে আমি পু* ড়ে ছাই হয়ে যাবো। আমার সে পাপের কী হবে শাস্তি!”

বৃদ্ধ মতিউর স্বান্তনার ভাষা খুঁজে পেলো না। তার সীমাবদ্ধতা যে খুবই অল্প। সে অল্প সীমাবদ্ধতা দিয়ে দুঃখিনী চিত্রার দুঃখ মুছবার যে তার ক্ষমতা নেই। বড়জোর সে তার নিজের চক্ষুদ্বয়ের অনাকাঙ্খিত অশ্রু মুছতে পারবে।

চিত্রা কাঁদতে কাঁদতেই গেটের সাথে হেলান দিলো। হুট করে সব অনাকাঙ্খিত ঘটনা যেন তার নামেই লিখে দিলো সৃষ্টিকর্তা। এমন না হলে, খুব বেশিই কী ক্ষতি হয়ে যেতো! চাঁদনী আপার র* ক্তা* ক্ত শরীরটা সবার প্রথমে সে-ই ছুঁয়ে ছিলো। তার পিছে পিছে ছুটে এসেছিল দুলাভাইও। বাড়ির প্রত্যেকে ততক্ষণও হতভম্ব। যখন সবার মস্তিষ্কে মি* সাইলের চেয়েও দ্রুত বেগে ছুটে গেলো এই অঘটনার খবর, পুরো সওদাগর বাড়ি যেন হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কত আহাজারি, চেঁচামেচিতে কেমন ভয়ানক বিষাদপুরিতে রূপান্তরিত হয়েছিলো সওদাগর বাড়ি!

যখন নিস্তেজ হওয়া চাঁদনী আপার প্রাণ আশঙ্কায় কলিজের পানি শুকিয়ে আসছিলো সবার, তখন রোজা সওদাগর করলেন আরেক কাজ। চিত্রার চুলের মুঠি টেনে অনবরত চার-পাঁচটা চ* ড় সে বিরতিহীন ভাবে বসিয়ে দিলেন চিত্রার কোমল, তুলতুলে গাল গুলোতে। সাথে নিম্ন পর্যায়ের ভাষা। যা শোভনীয় না মায়ের মতন চাচীর মুখে। কিন্তু এসব আচরণে ধ্যান নেই চিত্রার, সে কেবল আপাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য চিৎকার করছিলো। শেষ চ* ড়টা বসানোর সময় বাহার রুখে দাঁড়ায়। কেমন অদ্ভুত সাহসের সাথে বলে, “ওর গায়ে আরেকটা চ* ড় পরলে, সে হাত নাও থাকতে পারে।” ব্যাস থেমে গেলেন রোজা সওদাগর। অতঃপর কেঁদে উঠলো সে। সবাই ছুটলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে কেবল পুরো বাড়িতে একা পরে রইলো অপ্রয়োজনীয় সদস্য চিত্রা। অবশ্য তার ফুপি,অনয় এবং চেরি রয়ে গেছে কিন্তু চিত্রার প্রতি তাদের অনীহা। রোজা সওদাগর যেতে যেতে চিত্রার পেটে তুমুল ভাবে লা* থি দিতেও ভুললেন না।

আবারও গেইটে মাথা ঠুকে কেঁদে উঠলো চিত্রা। কে জানে, তার আপাটা কেমন আছে! চিত্রার নিরাশায় পরিপূর্ণ ব্যাথার মরুভূমিতে আশার চাঁদ হয়ে এলো বাহার। বাহারের ক্লান্ত, পরিশ্রমে নেতিয়ে যাওয়া শরীরটাকে হেলদুলে আসতে দেখা গেলো।

বাহার গেইটের দিকে এসে বিধ্বস্ত চিত্রাকে দেখে হতভম্ব। অনবরত কান্নার ফলে চোখ ফুলে নাজেহাল অবস্থা। বাহারের চোখে-মুখে বিস্ময়। সেই বিস্ময় ছড়িয়ে গেলো কণ্ঠধ্বনি অব্দি। সে বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“রঙ্গনা, এখানে এ অবস্থায় কি করছো! তুমি এখনো রুমে যাও নি!”

চিত্রা কথার উত্তর দিলো না। মনের মাঝে প্রশ্নরা দানা বেঁধে আছে। কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। যদি কোনো খারাপ খবর হয়, তবে চিত্রা নিজেকে কীভাবে ক্ষমা করবে?

বাহারের প্রশ্নে উত্তর দিলো মতিউর রহমান,
“না বাবা, আম্মা যে সেই সন্ধ্যা বেলা এখানে বসেছে, এখানেই আছে। আমি কতবার কইলাম ভেতরে যাইতে, উনি পথেই বসে আছে।”

বাহার ভাইয়ের ভ্রূদ্বয় কুঞ্চিত হলো। হাঁটু ভেঙে সে বসলো চিত্রার পাশে। চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
“এই মেয়ে, এখানে এভাবে বসে আছো কেনো? মাথায় কি সমস্যা তোমার? কি অবস্থা নিজের করেছো? উঠো দেখি।”

আহ্লাদ পেয়ে গেলো চিত্রার কান্না। সে বাহার ভাইয়ের ডান হাতটা আঁকড়ে ধরে অপরাধী কণ্ঠে অনবরত বলতে লাগলো,
“আমি ইচ্ছে করে করি নি এমন, বাহার ভাই। আপনি তো আমায় বিশ্বাস করেন তাই না?”

বাহার চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো,
“আমার বিশ্বাস করার আগে তোমার নিজেকে নিজের বিশ্বাস করা উচিৎ। তুমি কেনো ভয় পাচ্ছো, অপরাধী ভাবছো নিজেকে!”

“কিন্তু তখন আমিই আপার হাত ঝাড়া দিয়ে ছিলাম। এটা তো ঠিক।”

“যা হয়েছে সেটা দুর্ঘটনা, ইচ্ছেকৃত না। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না।”

“আমাকে কেউ বিশ্বাস করছে না, বাহার ভাই।”

“আমি তো করছি। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করছি। আমি জানি, তুমি কারো বিরাট ক্ষতির কারণ হবে না।”

চিত্রার তুমুল কান্নায় এই স্বান্তনার বাণী টুকু প্রয়োজন ছিলো। কান্নার ছাটও নিমিষেই কমে এলো। চিত্রা চোখ-মুখ মুছে উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো,
“আচ্ছা বাহার ভাই, আপা কেমন আছে? আর বাবু? দশ মাস বাবুর জন্য কত অপেক্ষা করলাম, আর শেষ মুহূর্তে এসেই কিনা,,, ”

কথা বলতে বলতে আবারও চিত্রার আকাশ ভেঙে কান্না এলো। বাহার তৎক্ষণাৎ মুখ চেপে ধরলো চিত্রার। আদুরে এক ধমক দিয়ে উঠলো। মিছে রাগী রাগী স্বরে বললো,
“আরেকবার যদি কেঁদেছো, তবে এখুনি তোমাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসবো।”

বাহারের এমন অবিশ্বাস্যকর কথায় কান্নার মাঝেও হেসে দিলো চিত্রা। গোলগোল চোখে হাসতে হাসতেই বললো,
“আমাকে কি আপনার চেরি মনে হয় যে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছেন!”

“কেনো দেখাতে পারবো না ভয়? তুমি চেরি না হও চিত্রা তো।”

“হ্যাঁ, আমি চেরি না চিত্রা। কেউ বড় মানুষকে এগুলা বলে ভয় দেখায়?”

“তাহলে বড় মানুষ, তুমি কেন এমন অবুঝের মতন কাঁদছো! বড় মানুষের তো অবুঝ হওয়া সাজে না।”

বাহারের কথার জালে যে খুব বাজে ভেবে ফেঁসে গেছে চিত্রা তা আর বুঝতে বাকি রইলো না তার। অতঃপর ছোটো একটা শ্বাস ফেলে, নিবিড় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আপার কী অবস্থা, বাহার ভাই? সুস্থ আছে তো?”

বাহার মাটি থেকে উঠে চিত্রাকে ডান হাত দিয়ে টেনে তুললো। চুল গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
“তোমার আপা ঠিক আছেন। এখন রুমে গিয়ে সুন্দর মতন গোসল করে, খেয়ে ঘুমাবে কেমন?”

অগোছালো বাহারের এমন গোছানো যত্নে চিত্রার কান্নারা নির্বাসনে গেলো। সে ভদ্র মেয়ের মতন বললো,
“আচ্ছা।”

সে ভদ্রমেয়ের মতন কথা রাখলো। শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বাহার তাকে হাত ধরে ঘর অব্দি পৌঁছে দিলো।

(৫৩)

বাহার ভাই যে ভীষণ মিথ্যে কথা বলে চিত্রাকে সামলেছে তা জানা গেলো পরেরদিন হসপিটাল থেকে সবাই আসার পর। মুখ থমথমে অনুভূতি, তার প্রতি সকলের অসন্তুষ্ট চাহনি আর বড়চাচীর আক্রোশ দেখে।

গতকাল রাতে চিত্রা বাহার ভাইয়ের কথা অনুযায়ী গোসল করে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভাঙার পর দেখে ঘড়ির কাটায় সময় তখন দুপুর বারোটা। হুড়মুড় করে সে উঠে বসতেই নিচ থেকে কেমন ফুঁপানোর শব্দ এলো। কে যেন মিহি স্বরে কাঁদছে। চিত্রা হতবিহ্বল। গতকাল বাহার ভাইয়ের কথা অনুযায়ী তো আজ কান্না-কাটি করার কথা না। তাহলে!

মনের কৌতূহল মিটানোর জন্য সে দ্রুত গতিতে নেমে গেলো বিছানা থেকে। তার চেয়েও দ্রুত সে বসার রুমে উপস্থিত হলো। বসার রুমে বড় চাচীর ক্রন্দনরত মুখটা দেখেই ছলাৎ করে উঠে বুক। সে চাচীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“চাচী, কী হয়েছে? কাঁদছো কেনো?”

রোজা সওদাগরের ঝিমিয়ে থাকা আক্রোশ তুমুল হলো। চিত্রাকে তুমুল এক লা* থি মেরে বসলো। চিত্রা দু’হাত দূরে ছিটকে পরলো। তুহিন সবে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে। বোনের এহেন অবস্থা দেখে সে ছুটে এলো। আ* হত চিত্রাকে আঁকড়ে নিলো। নির্ঘুম কাটানো রাত্রির কারণে চোখ-মুখ তার কেমন হলদেটে ভাব। বড় চাচীর মন মেজাজ খারাপ তবুও বোনের প্রতি এমন আচরণ সহ্য করতে পারলো না তুহিন। কর্কশ কণ্ঠে বললো,
“আপনার হা-পা সামলে রাখবেন, চাচী। নাহয় আমার অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।”

ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় হিং* স্র হয়ে উঠলো রোজা সওদাগর। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চিত্রার গলা চেপে ধরে বলল,
“তোর জন্য আমার মেয়েটার আজ এ অবস্থা। তোর এত রা* গ না রে? খেয়ে দিলে আমার মেয়ের বাচ্চাটাকে? তোর এত খিদে?”

অবনী বেগম, অহি ছুটে এলো রোজা সওদাগরকে ছুটানোর জন্য। কেমন পৈচাশিক শক্তি যেন ধরলো তাকে। তুহিন অনেক কষ্টে হাত ছাড়ালো রোজা সওদাগরের। তুমুল পেট ব্যাথা সাথে গলা চেপে ধরায় চিত্রার মুখ নাক দিয়ে গলগল করে র* ক্ত বের হওয়া শুরু করলো।

#চলবে

[সময় করতে পারলে রাতে একটা বোনাস পর্ব দিবো। সিউর বলতে পারছি না।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here