#স্বপ্ন_কেনার_দামে
সমাপ্তি
অরণীর মাথা ভনভন করে ঘুরছে। রেস্টুরেন্টের ঘটনা যে এভাবে ভাইরাল হতে পারে তেমন কোন সম্ভবনা ওর মাথায় উঁকিও দেয়নি। চৈত্রের খড়খড়ে শুষ্ক জমিনে হঠাৎ বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে যেমন তৃষিত মাটি তা শুষে নেয়। সেভাবেই অরণীর শুষ্ক হৃদয় শুষে নিয়েছিল বহুদিন পর বর্ষণ হওয়া রিদমের ভালোবাসার বৃষ্টি। অরণী জানে এই পৃথিবীর কেউ তাকে বুঝবে না। কেউ বোকা বলবে, কেউ স্বার্থপর কেউ বিরক্ত হবে। এই যেমন শিখা সেই কখন থেকে অরণীকে বোকা, গাধা বলে ভর্ৎসন করছে। অরণী কাউকে বোঝাতে পারবে না কতদিন, কতদিন ধরে সে অপেক্ষায় ছিল রিদমের ফিরে আসার।সেই ভালোবাসা ডাক, স্পর্শ পাওয়ার জন্য সে কতটা আকুল ছিল। কত নির্ঘুম রাত ভোর হয়েছে শুধু এই কামনায় যে কোন একটা মিরাকল হোক। তার রিদম আবার তার কাছে ফিরে আসুক।
রিদমের দোষগুলো সে জানে, বরং আর দশজন থেকে বেশিই জানে। রিদম জেদি, একরোখা, কখনোই নিজের ভুল স্বীকার করে না, ওভার রিয়াকশন দেখানো, ড্রামা করে। আর এই সবই রিদমের চারিত্রিক ত্রুটি। আর হ্যাঁ, রিদমের ভালবাসাটা কখনোই নির্মল ছিল না। অনেক বেশি শরীর কেন্দ্রিক ছিল। কিন্তু অরণীতো ভালোবেসেছে। বোকার মতোই বেসেছে। হয়তো নেশাগ্রস্তই হয়েছে এই মাদকময় ভালোবাসার। যা ওকেই তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেবে। সব বুঝেও তো সে হারিয়ে গিয়েছে সেই বিষময় মাদকতায়। এ যেন জেনেশুনে নিজেকে ক্ষয় করে দেওয়া।
“অরণীপু, কী ভাবছিস? আমি কী বলছি কানে যাচ্ছে তোর আপু? এই ঘটনা কী পরিমাণ ভাইরাল জানিস? আর তুই বলছিস তুই সত্যি সত্যি এই ছেলের বৌ! কেমন ফালতু ছেলে, কাঁটাচামচ দিয়ে আত্মহত্যা করতে আসে। আরে সাহস থাকলে ছুরি দিয়ে পোঁচ দে।”
“শিখা, যা নয় তা বলিস না। রিদম একটু বেশি ইমোশনাল। তাই হুট করে এমন করছে। টেবিলে কাঁটাচামচ ছিল তাই তুলে নিয়েছে। যে ইমোশনাল ছেলে, ছুরি থাকলে আসলেই পোঁচ দিত গলায়। আর এখানে ওর কী দোষ? ও আমাকে অন্য কারও সাথে দেখে পাগল হয়ে গিয়েছে। ওর জায়গায় আমি থাকলে আমিও হয়তো এমনই করতাম। ও কী ভেবেছিল এমন কিছু হবে। এই ভিডিওতে তো ওকেও কতটা হাস্যকর রূপে প্রেজেন্ট হচ্ছে। ওর বাসায় কী কম সমস্যা হবে? এর আগে একবার বন্ধুদের কারণে রিসোর্টে ফেঁসে গিয়ে ওর কত ঝামেলা হয়েছিল। কেউ ওর আবেগটা বোঝারই চেষ্টা করবে না। আবারও ওর মনটা ক্ষতবিক্ষত করে দেবে।”
“ওহ্ মাই গড! আপু এই ছেলে ঐ ড্রাগ কেলেঙ্কারিতেও ছিল? অরণীপু, তুই সত্যি এত পাগল। না আমার সাথে ইয়ার্কি করছিস? ফুপা জানলে তোর কী অবস্থা করবে জানিস? আর বারবার কীসের কচুর আবেগের কথা বলছিস তুই। আবেগ না ছাই। সস্তা নাটক করছে। এমন ছেলেমেয়ে রোজ দেখি ভার্সিটিতে। তোর জগতটা অনেক ছোট আপু। তাই হয়তো বুঝতে পারছিস না। পাবলিক ভার্সিটিতে পড়ি, তিনটা টিউশনি করি। আমি বললাম আপু, এসব আবেগ টাবেগ না। পুরোই নাটক। তুই পরে কষ্ট পাবি।”
“পেলে পাব। তাতেও সুখ আছে। ভেবে নেব এটাই আমার সুখ। তুই রিদমকে চিনিস না। আমি ওকে দুই বছর ধরে চিনি। আমি জানি ও কতটা ইমোশনাল। তুই বুঝবি না।”
“তুই ওর আবেগ বুঝেছিস তো! তাতেই চলবে। আমার না বুঝলেও হবে। অরণী আপু সত্যি তুই কবে এত গাধা হলি! প্রেম করলে বুঝি মানুষ আসলেই মানুষ এত গাধা হয়ে যায়! তুই বুঝতে পারছিস না কতটা ড্রামা বাজ এই লোক। উল্টো সাফাই গাইছিস। ভয় লাগছে না তোর? ফুপার কানে গেলে বা তোর হবু বরদের বাড়িতে এই ঘটনা জানাজানি হলে কী অবস্থা হবে ভেবেছিস। এটা তো নিজেরা কথা বলেও সুন্দর সমাধান করতে পারতি। তোর প্রেমিকের এভাবে রেস্টুরেন্টে নাটক করার কী দরকার ছিল?”
“শিখা না জেনে কাউকে দোষ দেওয়া সহজ। তুই রিদমকে কতটা জানিস। এর আগেও সে আমাকে বিয়ে করার জন্য ঘুমের ঔষধ খেয়ে মরতে গিয়েছিল। সেদিন ওকে বিয়ে না করলে ও খারাপ কিছু করে ফেলতো। এখানেও রিদম হঠাৎ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ও এমনিই। দোষ তো সেই ফালতু লোকের যে ভিডিও করেছে। এটা নির্ঘাত কর্ণারে বসা সেই লোকটার কাজ। মাহিদ সাহেব ভিডিও বন্ধ করতে বলার পরও যে করেনি। বলার পর অন্যরা ফোন রেখে দিয়েছিল, কিন্তু লোকটা তাও শুনেনি। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন পাবলিক করার আগে এরা একবারও ভাবে না।”
“অরণী আপু যে অবুঝ, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা যায়। কিন্তু যে বুঝেও না বোঝার ভান করে। তাকে বোঝানো অসম্ভব। কয়টা ঘুমের ঔষধ খেয়েছিল তোর হিরো? দশটা? বিশটা? না ত্রিশটা? কোন হাসপাতালে পেট ওয়াশ করছে? যার একবার স্টোমাক ওয়াশ হয় সে জীবনে আর আত্মহত্যার নাম নিবে না। নিজের চোখে নিজের বান্ধবীকে দেখেছি কী ভয়ানক সেই আত্মহত্যার চেষ্টা। সত্যিকারে যে আত্মহত্যা করে সে একটা একটা বড়ি খেয়ে নাটক করে না। চল নিচে যাই। বাসায় সবাই ভাববে এতক্ষণ ছাদে কী করি।”
নিচে এসে বুঝতে পারে খারাপ কিছু হয়েছে। সমস্ত বাসার পরিবেশ থমথমে। অরণী আর শিখা বাসায় ঢুকতেই অরণীর দাদী হইহই করতে করতে এগিয়ে আসেন।
“অরণী, কই ছিলি? তোর ফোনও বাসায়। এই সব আধা পুরুষ মেয়েদের সাথে মিশে মিশে তোর এই অবনতি হইতেছে। এমনো এই মেয়ের সাথে তুই। এর পাল্লায় পড়ে এসব উল্টাপাল্টা কাম-কাজ শুরু করছোস না?”
শিখা চলে যেতে উদ্ধত হয়। অরণীর দাদী শিখাকে পছন্দ করেন না। শিখার সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি করা, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সাথে জড়িয়ে থাকা, ছোট করে কাটা চুল, জিনসের প্যান্ট আর ফতুয়া পরে চলাফেরা করা। কোন কিছুই ওনার পছন্দ নয়। অরণীর সাথে আবার শিখার দারুণ বন্ধুত্ব ওনার ভালো লাগে না। ওনার মনে হয় শিখার মতো স্বাধীনচেতা মেয়ে অরণীকে নষ্ট করে ফেলবে। পারতপক্ষে তাই এখন ফুপুর বাসায় আসে না শিখা। আজও আসতো না যদি না অরণীর ভিডিও ওর চোখে পরতো। জামিল সাহেব টেবিলে মাথা দিয়ে চুপচাপ বসে ছিলেন। মাথা তুলে বলেন, “শিখা বসো। অরণীর ভিডিও দেখেছ? তাই নিয়ে কথা বলছিলে?”
“আসসালামু আলাইকুম ফুপা। জ্বি। আসলে আমার এক বন্ধু দেখালো ভিডিওটা। আমি তাই জানতে আসলাম ঘটনা কী। অরণীকে কেউ বিয়ের আগে বিরক্ত করছে কিনা। এমন ঘটনা তো অনেক হয়। বিয়ে হলে বখাটে ধরনের কেউ উৎপাত করে।”
“কোন বখাটের উৎপাত না। অরণীর জামাই ওকে নিতে এসেছে। আমিও ঠিক করছি তোমার বোনকে তার শ্বশুর বাড়ি এক কাপড়ে পাঠিয়ে দেব। একজন আমার মেয়ের জন্য আত্মাহুতি দেবে তা তো ঠিক না। তাই না?”
জামিল সাহেব চুপ করো যান। চুপ করে থাকে শিখাও। অরণীর শরীর কাঁপছে। পায়ের নিচে মাটি যেন দুলছে। বাবা কী সহজ মুখে কঠিন সব কথা বলছে। বাবার এই রূপ অরণীর অচেনা। অথচ অরণী ভেবেছে জামিল সাহেব হইচই করবেন, হয়তো থাপ্পড় মারবেন।অথচ একদম ঠান্ডা স্বরে কথা বলছেন। উপস্থিত সবাইও যেন এমন রূপে ভড়কে গিয়েছেন। কারও মুখে কথা নেই। বরং হইচই, মারামারি হলে বোধহয় সব স্বাভাবিক মনে হতো। অথচ এখন কেমন ভয়ংকর নিরবতা চারদিকে। ছেলের এমন শান্ত কিন্তু দৃঢ় কথায় অরণীর দাদীও কেমন কথা হারিয়ে ফেলেন। হুমায়রা নেই। যখন থেকে শুনেছেন অরণীর বিয়ে ভেঙে গিয়েছে তখন থেকে শ্বাসকষ্টটা যেন হঠাৎ শুরু হয়েছে। মাহিদের বোন ফোন করেছিল একটু আগে। হুমায়রা বেগমকে জানিয়েছেন অরণী বিবাহিত। এত বড় অপবাদটা কিছুতেই বিশ্বাস করেননি, দৃঢ় কণ্ঠে বলছেন সবকিছু মিথ্যে, সব বিয়ে ভাঙার জন্য কোন বখাটের সাজানো নাটক। অথচ জামিল সাহেবের মুখটা দেখেই বুঝে গিয়েছেন, খুব বড়ো একটা কিছু হয়েছে। তখন থেকে হাঁপানির টান উঠে শয্যাশায়ী। অরণীর মামী হুমায়রাকে রুমে নিয়ে ইনহেলার দিয়ে আধশোয়া করে রেখেছেন। জামিল সাহেবের মা হুমায়রা আর তার ভাই ভাবীদের কিছু কড়া কথা শোনাতে চেয়েছিল। কিন্তু জামিল সাহেব সেটাও দেননি। অরণীর দাদী মুখ খুলতেই বলেছেন,
“আম্মা। কাউকে কিছু বলবেন না। সবার আগে আমি অরণীর সাথে কথা বলবো।”
নিজেকে কেমন নিঃস্ব আর অপরিসীম চাপে নুয়ে পরা একজন মানুষ মনে হচ্ছে। পুরোটা স্প্রিন্ট সামনে থেকে দৌঁড়ে এসে যেন হঠাৎ করে ছিটকে গিয়ে হেরে গেলেন। স্বামী হিসেবে হুমায়রার কাছে হয়তো টেনেটুনে পাশ মার্ক পান। কিন্তু বাবা হিসেবে নিজের সেরাটাই দিয়েছেন। বুঝতে পারছেন না, ঠিক কোন জায়গাটায় কমতি ছিল। অরণী, তার গর্ব তার অহংকার। অমিয়ের চেয়েও অরণীকে ভালোবেসেছেন। কোনদিন ছেলে আর মেয়ের মাঝে পার্থক্য করেননি। আঙ্গুল ধরে ক্লাস ওয়ান থেকে এইচএসসি পর্যন্ত মেয়েকে স্কুল কলেজ নিয়ে গিয়েছেন। উত্সবে পরিবারের সবার চেয়ে দামী পোশাকটা অরণীর জন্যই ছিল। অরণীকে কখনো স্কুল কলেজ থেকে পিকনিকে যেতে দেননি নিরাপত্তার ভয়ে। তাই ছুটির দিনে নিজেই বেড়াতে নিয়ে যেতেন। কিছু কিছু সময় ছেলেমেয়ের সাথে কঠোর হয়েছেন তাদেরই ভালো চেয়ে। আজ অরণী যখন ডাক্তার হওয়ার দ্বারপ্রান্তে তখনো ভালো একটা পরিবারে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ভেবেছেন পিতার ভূমিকায় তিনি জিতে গিয়েছেন। অথচ অরণী এভাবে তাকো হারিয়ে দিবে তা যেন কল্পনায়ও আসেনি।
লক্ষী, বাধ্য, মিষ্টি মেয়ে অরণী, যে মা বাবাকে না বলে একটা বন্ধুর বাসায় পর্যন্ত যায় না। সো লুকিয়ে বিয়ে করেছে, সেই বিয়ের কথা প্রায় মাস চারেক লুকিয়েও রেখেছে, আরেকটা বিয়ের জন্য সব চেপে গিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে, শপিং করছে! এসব কোন কিছুর হিসেবই তিনি মেলাতে পারন না। কাকে দোষ দেবেন, আর কেনই বা দিবেন। অফিসের লোকজন থেকে বন্ধু বান্ধব, কত মানুষ ভিডিওটা পাঠিয়েছে ইনবক্সে। তিনি তারপরও বিশ্বাস রেখেছেন তার মেয়ে নির্দোষ। মাহিদের বাবা ফোনে বলেছেন তারপরও ওনার মনে হয়েছে কিছু একটা ভুল হয়েছে। কিন্তু যখন রিদম ওনাকে ফোন দিয়ে অরণীকে চায়। তখন রিদমকে জেলের ভয় দেখিয়েছেন, বলেছেন প্রমাণ দিতে। না হলে আসলেই জেলের ভাত খাওয়াবেন। জবাবে রিদম অরণীর আজকের পাঠানো ম্যাসেজের স্ক্রিনশট আর কাবিননামার ছবি পাঠিয়ে দেয়। মাহিদও নিশ্চিত করে অরণী রিদমের কাছেই যেতে চেয়েছে বারবার। এরপর অবিশ্বাস করার কোন জায়গা থাকে না। শুধু নিজেকে লুকাতে ইচ্ছে হয়, নিজেকে বড়ো প্রতারিত মনে হয়। সন্তানের স্নেহের কাছে যেন ক্রোধ পরাজিত হয় তাই চাইছেন। তারপরও মনকে বোঝাতে পারছেন না।
জামিল সাহেব কতক্ষণ মাথা নিচু করে ছিলেন বলতে পারেন না। হঠাৎ করে বুঝতে পারেন কত জোড়া চোখ ওনার উপরই নিবদ্ধ। সবাই শ্বাস আটকে অপেক্ষা করছেন তিনি কী করবেন তা দেখার জন্য। এখন থেকে কী এমনই হবে! তামাশা হয়ে যাবেন সবার কাছে! কাল পর্যন্ত যারা তাকে ভয় পেত আজ তারা সামনে পেছনে উপহাস করবে! এই যে শিখা এমন ছেলেদের মতো চলাফেরা করে, কতদিন এই নিয়ে অরণীর মামাকে কথা শুনিয়েছেন। মেয়েকে শাসন করতে বলেছেন, মেয়েকে মেয়ের মতো বড়ো করতে বলেছেন। বড়ো বোনের মেয়ে যখন রেজাল্ট খারাপ করতো, বলতেন অরণীর কাছে পড়া বুঝে নিতে। ছোট বোনের ছেলেটা আড্ডা বাজিতে সময় নষ্ট করে ভৎসনা করে বলেছেন অরণীর মতো হতে। সন্তান নিয়ে কী তিনি বড়ো বেশি অহংকারী হয়ে গিয়েছিলেন! তাই বুঝি আজ তার শাস্তি পেলেন।
হু হু করে কান্নায় বুক ভেঙে আসে জামিল সাহেবের। মাথা নত করে বসে থাকতে হবে। এমন দিনও বুঝি দেখতে হতো।
“কেন অরণী, কেন করলি এমন? আমি কী কখনো খারাপ বাবা ছিলাম? যেই মেয়ে একটা কলম কিনতে গেলে আমাকে জিজ্ঞেস করতো, সে না জানিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করলো। সব গোপন রাখলো। আবার এভাবে একটা তামাশা করে সারা দুনিয়ার কাছে ছেট করলো। কী অপরাধ ছিল আমার? এর চেয়ে তুই চায়ের সাথে একটু বিষ মিশিয়ে দিতি। আমি শান্তিতে মরে যেতাম। এভাবে মানুষের চোখের সামনে লজ্জায় মরার চেয়ে লাখো গুণ ভালো ছিল।”
অরণীর মামা, চাচারা এসে জামিল সাহেবকে ধরেন। বাবার জন্য অরণীর হৃদয়টা খান খান হয়ে যায়। এ কী করলো সে!
জামিল সাহেব কেঁদেই চলেছেন। ভেতরের রুম থেকে হুমায়রারও বিলাপ ভেসে আসে। অরণীর মামা বলেন, “জামিল ভাই, আপনি নিজেকে সামলান। অরণী একটা ভুল করছে। আমরা সমাধান করবো। বোঝাই যাচ্ছে এই ছেলে ভালো না। অরণী বোকাসোকা মেয়ে ফাঁদে পরে গিয়েছে। আমরা বড়োরা যদি মেয়েকে ফেলে দেই, মেয়ের ক্ষতি হবে। অরণী এদিকে আয়, বাবার কাছে মাফ চা। এখুনি।”
অরণী ছুটে এসে পায়ের কাছে বসে। বাবাকে এভাবে কোনদিনও কাঁদতে দেখেনি অরণী। হেঁচকির জন্য কথা গুছিয়ে বলতে পারছে না। “আব্বু। আব্বু, ও আব্বু। আমার ভুল হইছে। আব্বু।”
“অরণী, আমি ঐ ছেলেকে ওর মা বাবাকে নিয়ে আসতে বলছি বাসায়। আজ রাতেই সিদ্ধান্ত হবে। হয় তুই এই বিয়ে ভাঙবি। না হয় একবারে এই ছেলের হাত ধরে বিদায় হবি। আমি একেবারে মেয়েকে বিদায় করবো।”
“আব্বু এমন করো না প্লিজ। আব্বু।”
অরণীর চাচাও বলেন, “ভাইয়া এত তাড়াহুড়ায় সিদ্ধান্ত নিয়েন না। ছেলের পরিবারের খোঁজ খবর নেন। যেহেতু বিয়ে করেই ফেলছে সেহেতু এভাবে হুট করে কিছু করা যাবে না। আমরা খোঁজ নেই। যদি ছেলে আর তার পরিবার ভালো হয়, সুন্দর ভাবেই বিদায় করবো। মানুষ তো কত কথা বলে। আমরা সুন্দর করে সব সমাধান করলে মানুষ সব ভুলেও যাবে। কিন্তু এভাবে মেয়েকে বিদায় দিলে সারা জীবনের জন্য মেয়েটা ঐ পরিবারে ছোট হয়ে যাবে। আর খারাপ হলে আমরা বিয়ে ভেঙে দেব। কিন্তু আগে খোঁজ খবর তো নেই।”
“কিসের খোঁজ খবর। এই ছেলে ঐ রিসোর্টেও ছিল জানিস। মদ গাঁজা টানা ছেলে।”
“আব্বু, রিদম খারাপ না। ঐ জন্য পুলিশও ওকে ধরেনি। অন্যরা ড্রাগস নিয়েছিল।”
একটা চড় এসে পড়ে অরণীর গালে। গালে চার আঙুলের ছাপ বসে গিয়েছে অরণীর। এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও এবার আর পারেন না জামিল সাহেব। এখনো এই মেয়ে ঐ ছেলের পক্ষ নিচ্ছে।
“তোর আর একটা কথাও আমি শুনতে চাই না বেয়াদব মেয়ে। জাহান্নামে যা। আজই হয় ঐ ফালতু ছেলের সাথে বিদায় হবি না হয় ডিভোর্সের জন্য রাজি হবি। মাঝে আর কোন কথা হবে না। আমার বাড়ির বাইরে গিয়ে তুই যা মন চায় কর।”
রাত দশটা বেজে এগারো মিনিট। আকাশী সাদা সালোয়ার কামিজে বড়ো মলিন মুখে বিদায় হয় অরণীর। সাথের লাগেজটা শিখা গুছিয়ে দিয়েছে। কী কী দিয়েছে ব্যাগে জানে না অরণী। তবে জানে এই বাড়ি থেকে এইটুকুই তার শেষ স্মৃতি। তার বিয়ের জন্য বানানো সাত ভরির সেটটাও দিয়ে দিয়েছেন জামিল সাহেব। মেয়ের জন্য বড়ো শখ করে বানিয়েছিলেন। হুমায়রা অর্ধমৃত অবস্থায় খাটে পড়ে আছে। একটা ঘোরের ভেতর দিয়েই যেন রিদমের সাথে বেরিয়ে এসেছে অরণী। বুঝতে পারছে খুব কঠিন আর কাঁটাময় পথই বেছে নিয়েছে অরণী। এমন কনে বিদায় না কোন মেয়ে চায়, না এমন বরণ। রিদমের মা বাবার মুখই বলছে কতটা আনন্দের হবে তার নতুন শুরু। অরণী কী পারবে শুধু ভালোবাসার উপর ভর করে এই পথ পাড়ি দিতে!
(শেষ)