#চিত্ত_চিরে_চৈত্রমাস
#মম_সাহা
পর্বঃ বিশ
(৪৯)
আজ সূর্য তার উত্তপ্ততা দু’হাত ভরে উজাড় করেছে বেকার যুবকদের জ্বা*লিয়ে দেওয়ার নামে। পথে-ঘাটে চাকরির খোঁজে হন্তদন্ত হয়ে অনবরত ছুটে যাওয়া বেকারদের বেলা সূর্য মানুষের মতন কঠোর হয়েছে। উত্তাপে সে ঝলসে দিতে চাচ্ছে বেকারদের দূর দূরান্তে হেঁটে যাওয়ার শক্তিকে। তবে বেকাররা সূর্যের চেয়েও তেজী হয়। মাথায় বেকারত্বের যে বোঝা, এই বোঝার চেয়ে আরও বেশি কঠিন তাদের কাছে কিছুই মনে হয় না। পেটে ক্ষুধা, পকেটে বাবার ওষুধের লিস্ট, হাতে প্রেমিকার বিয়ের কার্ড, মাথায় দায়িত্বের ভারী বস্তা- এসবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না সূর্যের তেজ।
চাকরির ছয় নাম্বার পরীক্ষা টাও আজ দিয়ে দিলো বাহার। মাঝে সে অনেক ছুটাছুটি করেছে একটা চাকরির জন্য, কত রাত ঘুমিয়েছে ফুটপাতে! রাতের রাস্তার ভয়ঙ্কর শীতলতায় বুকে বেঁধেছিলো নিউমোনিয়ার সংসার। তবুও সে থামে নি। এখানে ওখানে যোগ্যতার বটবৃক্ষ ঝাঁকিয়ে করেছিলো চাকরির সন্ধান। অথচ বাহার তখন জানতোই না ‘টাকার তৈরী এই অযোগ্য শহরে, যোগ্যতা কেবল নিরেট নিশ্চুপ,মূল্যহীন,পরিত্যক্ত কবর।’ আজ বাহার তা জানে। তবে আজ তার একটা চাকরির জন্য তেমন হাহাকার নেই। বেকারত্ব তো সব কেড়েছে, এখন বেকারত্বের হাহাকার বাহারের ভেতর ছুঁতে পারে না। চাকরির চিন্তায় আজকাল তার আর রাত জাগতে হয় না। তবে আজ হুট করে মনে হলো চাকরি তার প্রয়োজন। পায়ের নিচের একটা শক্ত ভিত্তি প্রয়োজন। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে বেকারত্বের অভিশাপে কুকুরবিড়াল হয়ে বেঁচে থাকাটা জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। আর একজন পুরুষের ব্যর্থতা সমাজের কাছে হাস্যকর।
মাথার উপর রোদের প্রখরতা। ঘামে ভিজে গেছে শরীরের খুব সস্তার টি-শার্ট খানা। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল লেপ্টে গেছে পরম অবহেলায় কপালের মধ্যিখানে। সিগারেটে ঝলসানো ঠোঁট গুলো আর গালে চাপদাড়ির অবাধ বিস্তারে বাহার ভাইকে কেমন অবহেলায় হারানো নিদারুণ কোনো সুন্দর নির্দেশন লাগছে। যাকে দেখতে দেখতে কাটানো যাবে শত সহস্র যুগ।
হুট করেই প্রচন্ড পথচারীদের ভীড়ের মাঝে বাহারের মাথায় আর রোদ লাগছে না। সে হাঁটছে, তার তালে তাল মিলিয়ে একটা ছায়াও হাঁটছে। বিরাট ছায়া। বাহার অবাক হয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো কাঁধ সমান চুল গুলো ঝুঁটি করে খুব সাদামাটা পোশাকে কি সুন্দর হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা! কপালে অবস্থানরত ভ্রূদ্বয় আপনা-আপনি কুঁচকে গেলো বাহারের। অবাক কণ্ঠে সে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“এই যে মেয়ে, এখানে কী?”
চিত্রা বাহারের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে ডান হাতে ধরে রাখা রঙিন ছাতাটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“রোদ্রের মাঝে ছায়া হতে এসেছি। এইযে গরম আপনাকে কেমন নাজেহাল করে দিয়েছে, তা তো আমার মোটেও ভালো লাগে না।”
“রোদ ভালো, রোদে শোক ভুলে যাওয়ার ঔষুধ থাকে। অতিরিক্ত রোদ মাথায় থাকলে শোক তখন মস্তিষ্কে বিচরণ করতে পারে না। কিন্তু আমরা বরাবরই শীত পছন্দ করি। অথচ শীতলায় শোক গাঢ় হয়। যারা অতিবও বিষণ্ণতায় ভুগে, তাদের উচিৎ সারাদিন রোদের দাবানল সহ্য করে পথ থেকে পথান্তরে ঘুরে বেড়ানো।”
“আচ্ছা বাহার ভাই, এত মানুষের ভীড়ে যে এমন হেলেদুলে হাঁটছেন, বিরক্ত লাগে না?”
“এই হাজার মানুষের ভীড়ে থাকলে একাকীত্ব অনুভব হয় কম। মনে হয় আমার মানুষ না থাক, অনেক মানুষ তো আমার আশেপাশে আছে। জীবনকে পজিটিভ অনুভব করাও, তবেই না বেঁচে থাকা স্বার্থক।”
চিত্রা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো এই বেকার যুবকটার দিকে। কে বলেছে এ শহর কেবল অর্থের পূজারী? এই যে, কিছু কিছু কিশোরীর মনে বেকার বাহার ভাইরাই তো একরাশ প্রশান্তি।
চিত্রাকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আড়চোখে তাকালো বাহার। ফিচলে কণ্ঠে বললো,
“এভাবে তাকিয়ো না মেয়ে, দুর্বলতা হানা দেয়। আচ্ছা মেয়ে, তুমি আজকাল বুকের বা’পাশটায় উঁকিঝুঁকি দেও কেনো! হেতায় কেনো তব বিচরণ?”
বাহারের প্রশ্নে লজ্জায় লাল হলো চিত্রার মুখ। বাহার ভাই দারুণ অস্বস্তি দিতে জানে।
হাঁটতে হাঁটতে পথিমধ্যে বাদামও খেলো দু’জন। ভাগাভাগি হলো আরও কিছু অনুভূতি। অষ্টাদশীর জন্য এই যেন ঢের।
(৫০)
অবনী বেগম দেশে ফিরেছেন পাঁচদিন হতে চললো। স্বাভাবিক, সহজ-সরল জীবন যাত্রায় সে ফিরে এসেছেন। ভিনদেশে যা চোখ দেখেছে তা সে ভিনদেশেই যেন রেখে এসেছে। সে খবর কাউকে জানায় নি সে, কাউকেই না।
বাড়িটাতে আবার কিছুটা গমগমে ভাব। কেবল মুনিয়া বেগমের শূণ্যতা টা হুটহাট বেশ অনুভব হচ্ছে। এত খোঁজখবর করেও মানুষটার কোনো খবর পাওয়া গেলো না। চৈত্রের গল্প যেমন বৈশাখে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, তেমন মিলিয়ে গেলো মানুষটা। কত গুলো দিন মানুষটা ছাড়া দিন কাটাচ্ছে সওদাগর বাড়ি!
রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত অবনী বেগম। তাকে হাতে হাতে সাহায্য করে দিচ্ছে চিত্রা। অহি আপা ভার্সিটিতে গেছে, নাহয় সেও সাহায্য করতো। আজকাল রোজা সওদাগরকে রান্নাঘরে তেমন দেখা যায় না। বেশ অদৃশ্য এক ক্ষমতার দাপট যেন পেয়ে বসেছে তাকে। না চাইতেও সবটা কেবল তার ইশারায় হচ্ছে। আর এসবের সবচেয়ে ভুক্তভোগী মানুষটা হলো চিত্রা৷ হুট করেই চোখের বালি হয়ে গিয়েছে সে।
রান্নাঘরের ভয়াবহ রকমের গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার চিত্রা। ছোটো মুখটা কেমন শুকিয়ে গেলো। মা হীনতার অভাব যেন তার পুরো মুখমন্ডলে বিস্তার করছে। বাড়ির সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় মানুষ দোয়েলের মায়া লাগলো চিত্রার জন্য। সেই কিশোরী দোয়েল বেশ মায়া মায়া কণ্ঠে বললো,
“চিত্রা আপা,আপনে ঘরে গিয়া একটু গোসল করেন। কেমন ঘাইমা গেছেন! আমি তো আছি এইহানে, চাচীরে আমি আগায় পিছাই দিমু।”
অবনী বেগমও চুলায় খুন্তি নাড়তে নাড়তে চিত্রার দিকে তাকালো। শ্যামলা মুখটা গরমে কেমন লাল হয়ে গেছে মেয়েটার! অবনী বেগমও আদুরে স্বরে বললো,
“হ্যাঁ চিত্রা, যাও তোমার ঘরে। গোসল করো। গরমে কি অবস্থা হয়েছে তোমার! রান্নাঘরে এ জন্য আসতে না বলি। যাও যাও।”
চিত্রা পেয়াজের শেষ টুকরোটা কাটতে কাটতে বললো,
“এইতো যাচ্ছি, আরেকটু।”
অবনী বেগম আর কিছু না বলে কেবল হতাশার শ্বাস ফেললেন। বাড়িতে আসার পর, বাড়ির নিবিড় পরিবর্তন টা সে বেশ সুক্ষ্ম ভাবে খেয়াল করেছে। আর বেশিরভাগ সদস্য কেমন যেন এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে নির্দ্বিধায়। একমাত্র তুহিনের জন্য পরিবর্তন গুলো ধারালো ভাবে করতে পারছে না রোজা সওদাগর। ক্ষমতার লোভ সবচেয়ে বড় লোভ। এই লোভে মানুষ চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে যায়।
পেয়াল গুলো সুন্দর করে কেটে ছোটো চাচীর সামনে রাখলো চিত্রা। অবনী বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো,
“চিন্তা করো না, চিত্রা। তোমার আম্মু ফিরে আসবে। সে তোমাকে এক মিনিটও চোখের আড়াল রাখতে পারতো না, হয়তে অভিমান হয়েছে খুব তাই এতদিন যাবত তোমার থেকে দূরে।”
অনেক গুলো দিন পর কারো স্নেহের হাত পেতেই অষ্টাদশীর প্রগাঢ় অভিমান ঠোঁট ফুলিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। কিন্তু সে বের করতে দিলো না। বরং অমলিন একটা হাসি দিয়ে বললো,
“মা হয়তো দূরে আছে কিন্তু আমি সবসময় অনুভব করি তাকে। তুমি চিন্তা করো না চাচী। আমি ঠিক আছি।”
অবনী বেগম আর কিছু বলার আগেই চিত্রা রান্নাঘর থেকে প্রস্থান করলো। দীর্ঘশ্বাসে ভারী হলো পরিবেশ। হাসি-খুশি পরিবারটার আদলে থাকা মানুষ গুলোর নির্মমতা বেরিয়ে আসছে যেন ভদ্রতার মুখোশ ঠেলে।
(৫১)
ঝিম ধরা ভারী সন্ধ্যা, বৈরী তার বিবর্ণ বাতাস। অহি কাঁধের ব্যাগটা মুঠোয় চেপে ধীর গতিতে হাঁটছে। আজকাল চিত্রাকে তাদের বাড়ির গাড়িটা দেওয়া হয় না যাতায়াতের সুবিধার জন্য। মেয়েটার হাতে টাকাও বোধহয় নেই। অহি দিতে চাইলেও নেয় না। হেঁটে হেঁটে, বাসে চেপে যাতায়াত করে সে। কলেজ বাসা থেকে কাছেই, রিক্সা দিয়ে আসা যাওয়া করা যায়, হেঁটেও আসা যায় কিন্তু কোচিং বেশ খানিকটা দূরে। গাড়ি ছাড়া উপায় নেই। চিত্রার আবার বাস ট্রাভেলিং সহ্য হতো না। বমি করে ভাসিয়ে দিতো। অথচ আজ এ মেয়েটা নির্দ্বিধায় আসা-যাওয়া করছে সে বাসেই। চিত্রার প্রতি এমন অন্যায়ের নিরব প্রতিবাদে অহিও বাড়ির গাড়ি ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে।
অহির দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। সারা রাত-দিন পড়াশোনা করেও তার তৃপ্তি মিলছে না। পরীক্ষার হলে গেলেই সে যেন সব ভুলে যায়। কি একটা অবস্থা!
“এই যে মিস, শুনেন প্লিজ।”
পরিচিত কণ্ঠ নিরব রাস্তায় যেন ঝঙ্কার তুললো। অহির ঝিমিয়ে থাকা চিত্ত মিনিটেই চঞ্চল হয়ে উঠলো। কপাল কুঁচকে বিরক্ত ছড়িয়ে গেলো তার সারা মুখে। পায়ের গতি থেমে গিয়েছে ততক্ষণে।
নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন নওশাদ খুব দ্রুত এগিয়ে এলো, অহির পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো। মুখে তার বিরামহীন সেই হাসিটা। কণ্ঠে মধুরতা। পাশে এসে দাঁড়িয়েই মিষ্টি হাসি বজায় রেখেই বলল,
“পরীক্ষা কেমন হলো শুনি?”
অহির চোখ-মুখে তখন আঁধার করা বিরক্ত। কণ্ঠ ঝাঁঝালো করে সে উত্তর দিলো,
“আপনাকে বলতে হবে!”
“হ্যাঁ, বলতে হবে বলেই তো জিজ্ঞেস করা।”
নওশাদের স্বাভাবিক উত্তরে অহির চোখেমুখে ধরা দিলো বিষ্ময়। লোকটা পাগল টাগল নাকি? ঝাঁঝালো কণ্ঠ আর স্বাভাবিক কণ্ঠের পার্থক্যও বুঝে না নাকি!
বিরক্ত হয়ে আবার নিজ গন্তব্যে হাঁটা ধরলো সে। নওশাদও পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“আপনি যেন কোন ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট?”
“সাইকোলজি।”
“বাহ্, তবে তো রীতিমতো মানুষের ভেতরের তথ্য বুঝার বিশেষ ক্ষমতা আপনার আছে তাই না?”
নওশাদের কথায় থামলো অহি। বুকে দু’হাত ভাঁজ করে বলল,
“হ্যাঁ আছে। বলেন আপনার কি বলে দিতে হবে?”
নওশাদ কতক্ষণ মিছে মিছে ভাবুক মানুষ হলো। অতঃপর বেশ জয়ী একটা হাসি দিয়ে বললো,
“বলেন তো আমি আজ নীল রঙের পাঞ্জাবি কেনো পড়েছি?”
অহি নওশাদের মুখের দিকে তাকালো। তারপর পা থেকে মাথা অব্দি একবার চোখ বুলিয়ে কর্কশ কণ্ঠে জবাব দিলো,
“আপনি বিশেষ কোনো কারণ ভেবে নীল রঙটা পরেন নি। হুট করে মন চেয়েছিলো তাই পরেছেন। আর কিছু?”
নওশাদ বেশ অবাক হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বলল,
“বাহ্, বুঝলেন কীভাবে?”
“কারণ যখন কেউ শুনে আমরা সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করছি তখন তারা আমাদের অভিজ্ঞতা যাচাইয়ের জন্য হুট করেই একটা অহেতুক প্রশ্ন করে যে প্রশ্নের উত্তর হয়তো বিশেষ কিছু না অথবা তাদের জানা নেই এমন কিছু।”
অহির আড়চোখে তাকিয়ে উত্তর বলার ভঙ্গিমা টা বেশ উপভোগ করলো নওশাদ। হাসিরা আরও বিস্তৃতি লাভ করলো। সে কণ্ঠ খাদে নিয়ে বলল,
“আমার মায়ের আপনাকে পছন্দ হয়েছে, জানেন?”
নওশাদের কথায় হুট করেই হেসে উঠলো অহি। হাসতে হাসতে বলল,
“আহা, ভর সন্ধ্যে বেলা মিথ্যা বলছেন কেনো?”
নওশাদ বেশ অবাক হলো তবে কণ্ঠে গো ধরে রেখেই বলল,
“না সত্যিই এটা।”
“উহুম, মিথ্যে এটা।”
“কীভাবে বুঝলেন?”
নওশাদের বিস্মিত অবস্থা দেখে অহির হাসি স্রোত বাড়লো। হাসতে হাসতে সে বলল,
“সাইকোলজির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিসেব আমাদের জানা আছে। আপনি সচারাচর হাত দুলিয়ে কথা বলেন, মানে সত্যি কথা গুলো। অথচ এই কথা টা বলার সময় আপনার দু’হাত স্থির ছিলো আর চঞ্চল হাসিটা কেমন গুমোট ছিলো। খুব সম্ভবত আপনার মায়ের আমাকে পছন্দ হয় নি এমন কথা সে আপনাকে জানিয়েছেন যার দরুন আপনি আমাকে উল্টোটা বলে পরীক্ষা করছিলেন। নাহয় এমন একটা কথা আপনার মাথায় এত দ্রুত আসতো না।”
নওশাদ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো কেবল। মেয়েটা দারুণ বুদ্ধিমতী। সত্যিই নওশাদের মা আজ কথায় কথায় অহির উচ্চতার কথা বলেছে। ছোটো-খাটো অহির উচ্চতা মহিলার বেশ অপছন্দ হয়েছে সেটাই জানিয়েছেন।
নওশাদকে চুপ মেরে যেতে দেখে অহি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আর কিছু বলবেন, মিস্টার?”
“আপনাকে আমার ভালো লাগে, সেটা জানেন?”
অহি ভড়কালো না নওশাদের এমন কথায় বরং বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“এটাও মিথ্যে।”
নওশাদ অবাক হলো। মাথা দুলিয়ে বললো,
“না, এটা সত্যিই। নাহয় এভাবে আপনার পিছু নিতাম বলুন?”
“সে তো আপনি আমাকে জানার আকাঙ্খা থেকে পিছু নিয়েছেন, ভালো লাগা থেকে না৷”
নওশাদের চলন্ত পা আবার থেমে গেলো। হ্যাঁ এটা ঠিক যে অহিকে জানার ইচ্ছেটা তার ভেতর আছে। কিন্তু পরেরটাও তো সত্যি। কিন্তু অহি তা মানতে নারাজ। কয়েক প্রকার বাকবিতন্ডার পর নওশাদ মুখ ছোটো করে বলল,
“আপনার সাইকোলজি সব দিয়েছে, অনুভূতি বুঝার ক্ষমতা কি দেয় নি?”
চিত্রা হাসতে হাসতে বলল,
“আমার সাইকোলজির মতে নওশাদ সাহেবের অনুভূতি বেশ স্বল্প। আর এত স্বল্প অনুভূতি জাহির করা বোকামি।”
“আপনি পাষণ্ড।”
কথা খানা বলেই উল্টো দিকে হাঁটা ধরলো নওশাদ। অহি হাসতে হাসতে নিজেকেই নিজে বলল,
“ভালোবাসার মানুষকে অব্দি ভালোবাসা ছেড়ে দিলাম, পাষণ্ড না হলে কি পারতাম! আপনি তো দু’দিনের অনুভূতি নিয়ে আসছেন।”
ছোটো শ্বাস ফেলে দু’কদম এগিয়ে যেতেই কেউ ছুটে এলো তার কাছে। অহি অবাক হয়ে পাশের মানুষটার দিকে তাকালো। ফর্সা নওশাদ সাহেবের মুখ লাল হয়ে গেছে দৌড়ানোর কারণে। সে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে অথচ মুখে আগের হাসিটা। হাঁপাতে থাকা অস্থির কণ্ঠ নিয়েই সে বলল,
“আচ্ছা আপনার সাইকোলজি মতে আপনাকে পটানোর কিছু ট্রিকস দিবেন?”
অহি অদ্ভুত ভাবে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে হা হা করে হেসে উঠলো। সেই হাসির ঝঙ্কারে নওশাদের সাথে মুগ্ধ হলো নিশ্চুপ রাস্তাটাও।
(৫২)
সন্ধ্যার নাস্তার আয়োজনে মুখরিত ড্রয়িংরুম। চিত্রা আর দোয়েল মিলেই আয়োজন করেছে। তুহিনও আজ বাসায়। সবাই ই সোফায় বসে আছে কেবল চাঁদনী আপা বাদে। আপা বোধহয় ঘরে।
চিত্রা যখন নাস্তার প্লেট টা টেবিলের উপর রাখলো তখন তুহিনের গুরুগম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
“চিত্রা, আর কিছুদিন বাদে না পরীক্ষা? তুই এসব কেনো করছিস?”
চিত্রা নাস্তার প্লেট টা টেবিলে রেখে বড় চাচীর দিকে তাকালো। বড় চাচীই তাকে পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠিয়ে এনেছেন বিকেলের নাস্তা তৈরী করার জন্য। এখন এটা ভাইজান জানলে হয়তো তুলকালাম হতে পারে তাই সে চুপ করে রইলো। তন্মধ্যেই পরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ওমা তুহিন, তোমার মা নেই এখন বাড়িতে, এই সুযোগে চিত্রাকে একটু কাজ শিখাতে হবে না? বলো?”
দরজার কাছে বাহার ভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলো চিত্রা সাথে বাহার ভাইয়ের এহেন কথা। কিঞ্চিৎ ভড়কে গেলো উপস্থিত সবাই কেবল হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো তুহিন। অবাক কণ্ঠে বলল,
“কাজ শিখাতে হবে মানে? ওর আবার কিসের কাজ? পড়াশোনা আছে না!”
“পড়াশোনা আছে নাকি? আমি ভেবেছি তোমাদের মা যাওয়ার সাথে সাথে ওর পড়াশোনাটাও নিয়ে গেছে। নাহয় মানুষের হুকুমে এমন উঠ-বস করতো!”
বাহার ভাই সচারাচর আসে না বাড়ির ভেতরে। আজ এসেই এমন অদ্ভুত কথা বলছে যার দরুন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুহিন। সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। একবার বোনের দিকে আরেকবার বাহার ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। অবস্থা বেগতিক দেখে রোজা সওদাগর বোকা বোকা হেসে বলল,
“আরে কি যে বলো না, বাহার। তা তুমি এখানে যে! বিশেষ কাজে এসেছো?”
“আমি কি-যে বলি না আন্টি। যা সঠিক তা-ই বলি। চোখ থাকতে অন্ধ হওয়াটা তোমায় মানায় না, তুহিন। তোমার বোন কি করছে না করছে, কে কি করাচ্ছে খোঁজ রাখো। ভাই হয়েছো তো দায়িত্ব কেন অবহেলা করছো! মায়ের হারানো তে ব্যথিত হয়ে বোনের সুখ তো সব উড়িয়ে দিচ্ছো। অথচ মেয়েটা সুখ প্রিয়।”
বহুদিন পর কেউ চিত্রার হয়ে কথা বললো, এই অনাকাঙ্খিত আনন্দে চোখে অশ্রু জমলো। মাথা নত করে সে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা চালালো সে অশ্রু। তুহিন বুদ্ধিমান ছেলে, সে ততক্ষণে বাড়ির ভেতরের পরিবেশের কথা কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছে। চেয়ার ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ালো। চিত্রার কাছে গিয়ে মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে শক্ত কণ্ঠে বললো,
“কিরে চিত্রা, তোকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে কে? বড় চাচী নাকি ছোটোচাচী? নাকি ফুপি? কে বল?”
চিত্রা ছোটো মানুষ, আদুরে ভাব তার শরীরে তো এখনও আছে। সে ভাইজানের বাহু আঁকড়ে কেঁদে দিলো। আপন মানুষের পরিবর্তনের নিরব অভিযোগ যেন জানালো ভাইকে। তুহিনের রাগ চড়ে বসলো মাথায়। বোনকে এক হাতে ধরে টেবিলের সব খাবারের প্লেট এক এক করে ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেঙে গেলো সেসব প্লেট। কাঁচের গ্লাসটা বড়োচাচীর পায়ের সামনে আছাড় মেরে আঙ্গুল উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল,
“আপনাদের যদি কাজ করতে মন না চায় তবে নতুন কাজের লোক নিন। একজনের জায়গায় দু’জন নিন। আপনাদের সাহস কীভাবে হয় আমার বোনের উপর এসব হুকুম তালিম করার? কে আপনি? সাহস কি করে হলো আপনার চাচী?”
তুহিনের এমন রাগে উপস্থিত সবাই ভীত। কেবল স্থির রইলো বাহার। মাঝে মাঝে কিছু কথা সঠিক মানুষের কানে দিতে হয়।
বড়ো চাচীরও ততক্ষণে অপমান আকাশ ছুঁয়েছে। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“তুহিন, ভদ্রতা ভুলেছো? কাকে কি বলছো তুমি? আর তোমার বোনকে কাজ করাবো না কেনো? সে কোনো রাজপ্রাসাদ থেকে আসে নি। রাজপ্রাসাদের মেয়েরা তো অন্যদের বাড়িতে মানুষ হয় না, তাই না? সামান্য একটা ব্যাপারকে এ মেয়ে কি বিশ্রী করে তুললো? স্বার্থপর মেয়ে।”
টেবিলের কাঁচের উপর গ্লাস গুলো ফেলে ভেঙে চুরমার করে ফেললো সব এক নিমিষেই তুহিন। বড় চাচীকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো,
“আপনি তো কোনো রাজপ্রাসাদ থেকে আসেন নি। আপনার বাপেরও কোনো জমিদারি ছিলো না। কন্যার ভার সামলানোর ক্ষমতাও তার ছিলো না। বস্তিতে থাকতেন, এক রুমের খুপরিতে। ভুলে গেছেন অতীত? আবার আমার বোনকে নিয়ে আপনি বাজে কথা বলছেন। পেটে ঘি পরতেই পান্তা ভাতের কথা ভুলে ক্ষমতা দেখাচ্ছেন!”
অপমানে গা ঘিনঘিন করে উঠলো রোজা সওদাগরের। ছেলে-মেয়ে দুটোকে কি সে কম ভালোবাসা দিয়েছিল? অথচ আজ কি কথা বলছে তারা!
তন্মধ্যেই নুরুল সওদাগর সশব্দে চড় বসালেন ছেলের গালে। এই প্রথম সে তার ছেলের গায়ে হাত তুললো। অফিস থেকে এসে ছেলের এমন রূপ দেখেই মূলত সে হতভম্ব।
তুহিনের চোখ তখন ভয়ঙ্কর রকমের লাল। ফর্সা মুখে তখন তুমুল আক্রোশ। চিত্রা ছুটে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যেতে নিলেই সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা টলমলে চোখের চাঁদনী আপা তার হাত ধরে আটকে দিলো। চিত্রা হাত ঝারা দিয়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করার সময়ই ভারী কিছু পরে যাওয়ার শব্দ হলো। পিছু ফিরে তাকাতেই চিত্রার চক্ষু চড়কগাছ। বড় আপার শরীরটা নিচের সিঁড়িতে পরে আছে। ভারী পেটটা ধরে তার হৃদয় বিদারক চিৎকার। র* ক্তে রঞ্জিত হলো সাদা ফ্লোর।
#চলবে
[২৪০০+শব্দ। এবার আর অভিযোগ থাকবে না আশাকরি]