তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্বঃ ১৬

0
437

তিমিরে ফোটা গোলাপ
পর্বঃ ১৬
Writer Taniya Sheikh

বেশ আয়েশিভাবে পাহাড়ের গা বেয়ে কল কল শব্দে ঝর্ণার পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে। আশেপাশে বীচবৃক্ষের সারি। পাখির কলতান আর ঝর্ণার অবিরাম ঝরে পড়ার শব্দে ইসাবেলা বিমুগ্ধ হয়। ঝর্ণার পানিতে স্নান সেরে সকালের নরম রোদে বসে থাকতে চমৎকার লাগে। দিনরাতে এই সময়টাকে সে খুব বেশি উপভোগ করে। রোদের তাপ বাড়তেই নিকোলাসের পরিত্যক্ত প্রাসাদ অভিমুখে রওনা হয়। এই ভূতুড়ে কুয়াশাজড়ানো প্রাসাদে ফেরার পর শুরু হয় বুক ঢিপঢিপানি। এখানে এসেছে এক সপ্তাহ, কিন্তু সেই ঘটনা প্রতি মুহূর্ত তাড়া করে বেড়ায়। রাতে দুঃস্বপ্নে ভর করে কর্নেলা, ওই দাস বিক্রেতারা আর সেই ভুড়িওয়ালা লোকটার ভয়ংকর রুপ এসে উপস্থিত হয়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তখন। আতঙ্কে ঘেমে নেয়ে ঘুম ভাঙে। শেষমেশ কাঁদতে কাঁদতে ভোর পার করে দেয়। ঝর্ণার পাশে বসে আর নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরের মধ্যেই দিনরাত কাটিয়ে দেয়। নীরবে এসে খাবার রেখে ফিরে যায় ভৃত্যটি। সে এলে ইসাবেলা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে, নয়তো ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। লজ্জা হয় ভীষণ। সকলের সামনে লাঞ্ছিত হয়েছে। সেই লজ্জা এখনও কাটিয়ে উঠতে পরেনি আর না সেই আতঙ্ক। সময় মতো নিকোলাস না এলে আজ ইসাবেলার কী হতো? সেসব ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। এখন যে বিপদ মুক্ত সেটা ভাবা বোকামি। কিন্তু এই প্রাসাদে কেন যেন নিজেকে নিরাপদ মনে করে। ভয় হয়, আবার মনে মনে বিশ্বাসও আছে খুব খারাপ কিছু ঘটবে না। খুব খারাপ অর্থাৎ ওই ওখানে যা ঘটেছিল। নিকোলাস রক্তপিপাসু হোক আর যাই হোক, অন্তত নারী লিপ্সু তো নয়? ওর চোখে রক্ত তৃষ্ণা দেখেছে কিন্তু নোংরা কামুকতা দেখেনি। এর অর্থ এই নয় ইসাবেলা তাকে বিশ্বাস করে। কখনোই না। তার পরে শেষ ব্যক্তি হিসেবে পৃথিবীতে এই নিকোলাস অবশিষ্ট থাকলেও ইসাবেলা তাকে বিশ্বাস করবে না।

“হুম, এই জন্যই তো এই প্রাসাদে এখনও আছো?” মনের ভেতর থেকে কেউ একজন বিদ্রুপ। ইসাবেলা কপাল কুঁচকে বলে,

“বাইরে গেলে আবার যদি বিপদ হয়?”

“তার মানে এখন তুমি বিপদমুক্ত? এই প্রাসাদ তোমার কাছে নিরাপদ। নিকোলাসের ছত্রছায়ায় থাকাকে নিরাপদ মনে করছ। তাহলে উপসংহারে কী দাঁড়াল? বলো ইসাবেলা, বলো?”

ভেতর থেকে আগত পরিহাসে ইসাবেলা মাথা ঝাঁকায়। সামান্য মাথা চুলকে ভেবে বলে,

“আমি আবার পালাব। এই প্রাসাদ, নিকোলাস কাওকে নিরাপদ মনে করি না। কিন্তু আগের মতো না ভেবেচিন্তে পালাব না। প্লান করছি কীভাবে নিরাপদে জার্মান থেকে রাশিয়ায় পৌঁছানো যায়। সেই জন্য চুপচাপ আছি। বুঝেছ?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব বুঝেছি।” ক্রুর হাসে ভেতরেরজন। ইসাবেলা ধমকে ওঠে,

“চুপ করো। সব সময় শয়তানি ইঙ্গিত করো না। অসহ্য লাগে!”

“আমি যে তোমারই অংশ বে-ল-লে।”

“তুমি বলতে চাইছ আমি শয়তানি?”

“না, আমি শয়তানি। কিন্তু আমি আর তুমি তো অভিন্ন, তাই না বেলা?” ভেতরেরজন মুচকি মুচকি হাসে। ইসাবেলা বিরক্ত হয়ে দাঁত কামড়ে বলে,

“উফ! অসহ্য তুমি, অসহ্য। আমি নিষ্পাপ একটা মেয়ে। মোটেও শয়তানি না। আমার ভাবনা থেকে বিদায় হও তুমি, বিদায় হও।”

চোখ বন্ধ করে মাথাটা সজোরে ঝাঁকি দিলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে চলল রুমের দিকে। দরজা খুলতে ভূত দেখার মতো চমকে যায়। বিছানার পাশের ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে নিকোলাস। মাথা চেয়ারের পেছনে, মুখটা ঊর্ধ্বমুখে, দৃষ্টি মুদে আছে। পা ছড়িয়ে দিয়েছে সোজাভাবে, হাতদুটো উরুর ওপর স্থির। সেদিনের ঘটনার পর আজই প্রথম দেখল ইসাবেলা তাকে। বেশ সুস্থ দেখাচ্ছে আজ। দরজায় দাঁড়িয়ে নিকোলাসের আপাদমস্তক ভালো করে দেখতে লাগল। পরনে নীল ফ্রককোট, তার ভেতরে ওয়েস্ট কোট, নিচে লম্বা প্যান্ট আর বুট জুতো। কে বলবে এ মানুষ নয়? কে বলবে এই শান্ত ভাবের আড়ালে লুকিয়ে আছে হিংস্র এক হায়েনা। হঠাৎ মনে হলো, পৃথিবীর সকল ভয়ংকর বস্তুই কি প্রবল আকর্ষণীয় হয়? না আকর্ষণীয় বস্তু ভয়ংকর হয়?

“নিকোলাস কিন্তু বস্তু নয়, ব্যক্তি।” ভেতরেরজন খিক করে হেসে ওঠে। ইসাবেলা চাপা স্বরে নিজের সেই দ্বিতীয় সত্তাকে ধমক দেয়,

“চুপ, শয়তানি। সব সময় ভাবনায় ফোঁড়ন কাটবে।অসহ্য।”

“বেলা।”

নিকোলাসের কণ্ঠে বেলা ডাকে ভিন্ন কিছু থাকে। ইসাবেলার কেমন যেন অনুভব হয়। সেটা ভালো না খারাপ তা অবশ্য জানে না। জেনেই বা হবে কী? ওসবে কিছু এসে যায় না। ভেতরের জনের বিদ্রুপ শোনার জন্য সতর্ক হয়। না, কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। বিজয়ের হাসি হাসল নীরবে ইসাবেলা। আসলেই নিকোলাসের কোনো ব্যাপারে এসে যায় না ওর।

“বেলা” এবার কর্কশ গলায় ডেকে উঠল নিকোলাস। ইসাবেলা একপ্রকার আঁতকে ওঠে। জবাব দেয়,

“হুঁ?”

“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

“গোসল করতে গিয়েছিলাম।”

তারপর আবার সেই নীরবতা। নিকোলাস এখনও একই ভাবে চোখ বুঁজে বসে আছে চেয়ারে। ইসাবেলা কয়েকবার ঢোক গিলে দু’ কদম এগিয়ে বলল,

“কেন এসেছ আমার কক্ষে?”

“তোমাকে দেখতে।”

“আমাকে দেখতে!” বিস্ময় ঝরল ইসাবেলার কণ্ঠে। গলা ঝেড়ে পরিহাসের সুরে বলল,

“আমাকে দেখতে না কি আমার রক্ত পান করত?”

নিকোলাস সেভাবেই বসে চোখ খুলল এবার। ঠোঁটের একপাশ বেঁকে গেল। বলল,

“নির্বোধ বেলার ঘটে আজকাল বুদ্ধিও পাওয়া যায় দেখছি। আশ্চর্য!”

“ইতর কোথাকার।”

দাঁতে দাঁত কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল ইসাবেলা। নিকোলাস হাওয়ায় মিশে ওর গর্দান চেপে ধরে রুক্ষ গলায় বলল,

“বড্ড বেড়েছ তুমি এবং তোমার জবান। কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ জানো তুমি? তোমার ভাগ্য ভালো আন্দ্রেই সুস্থ হয়েছে। ওর কিছু হলে পৃথিবীতে তোমার অস্তিত্ব থাকত না আজ। কী ভেবেছ? তোমাকে খাতির করে রেখেছি রক্ত পান করব বলে? নির্বোধ। আন্দ্রেইর সামনে তোমাকে শেষ করব বলেই বাঁচিয়ে রেখেছি। ততদিনে মৃত্যুর ভয় সারাক্ষণ অনুভব করবে এই প্রাসাদে থেকে। মৃত্যু সন্নিকটে তোমার। আর দুটো দিন। তারপরে চির মুক্তি দেবো।”

নিকোলাসের মুড সেকেন্ডে সেকেন্ড পালটায়। একটু আগের শান্ত, নির্বিকার নিকোলাসের মুখ এই মুহূর্তে কঠিন, দৃষ্টি কঠোর। ওর অতর্কিত এই মুড পরিবর্তনে ইসাবেলার অবস্থা বেগতিক। নিজের পরিণতি জেনে ভীত সন্ত্রস্ত। নিকোলাস ওর গর্দান থেকে হাত সরিয়ে নেয় মাথার পেছনে। মুখটা আরো ঘনিষ্ঠে এনে বলে,

“ভেবেছিলে আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারবে? নির্বোধ বেলা, নিকোলাসকে শেষ করার সাধ্য কারো নেই, কারো নয়। তোমার মতো বাচ্চা মেয়ের তো নয়ই। বাচ্চাদের সবসময়ই গুরুজনের কথা মেনে চলতে হয়। অমান্য করলেই শিক্ষা দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমাকে শেষ করার চেষ্টা এবং আমার বন্দিশালা থেকে পালিয়ে যাওয়ার দোষে তোমাকে শাস্তি দেবো আমি। আমাকে অমান্য, অসম্মান করার শাস্তি পাবে। যদিও যথেষ্ট শাস্তি নিজের সৌভাগ্যক্রমে ওপস! মিসটেক, সঠিকভাবে হলো দুর্ভাগ্যক্রমে পেয়েছ। সেটা একান্তই তোমার দোষে। তাই বলে আমার তরফ থেকে তোমার জন্য নির্ধারিত শাস্তি এক ফোঁটাও মওকুফ হবে না। এটাই নিকোলাসের আইন।”

ধাক্কা দিয়ে ইসাবেলাকে নিচে ফেলে চেয়ারে গিয়ে বসে। ইসাবেলার ঘাড়টা যন্ত্রণায় অসাড় হওয়ার অবস্থা। স্থির সিক্ত চোখে ফ্লোরে চেয়ে আছে। নিকোলাসের কাছে আর কী আশা করেছিল? নিরাপদে, সসম্মানে রাশিয়া পৌঁছে দেবে? তাচ্ছিল্য ভরে হাসল আপনমনে। নিকোলাস আবার আগের মতো চোখ বুঁজে শান্ত গলায় বলল,

“তোমার প্রথম শাস্তি হলো, এই পুরো প্রাসাদ পরিষ্কার করবে। ঝেড়ে মুছে ঝকঝকে করে তুলবে।”

ইসাবেলা হতবুদ্ধি হয়ে বলে,

“পুরো প্রাসাদ?”

“পুরো প্রাসাদ।”

“আমাকে কি কলের পুতুল মনে হয়? পারব না। কী করবে? মেরে ফেলবে? ও তো দুইদিন পরও মারবে। সুতরাং কোনো কাজই করব না আমি। যা ইচ্ছে হয় করো গে।”

বাবু মেরে বসে চোখ মুছে মুখ তুলল ইসাবেলা। নিকোলাস মুচকি হাসে। বলে,

“এমনিতেই কী নির্বোধ বলি? বেলা, তুমি কি মৃত্যুর আগেই কয়েকটা নেকড়ের আহার যোগাতে চাও? এই ধরো তোমার একটা হাত কিংবা পা যদি ওরা ছিঁড়ে খায়, তবে?”

ইসাবেলার গলা শুকিয়ে এলো। নিকোলাসের ভরসা নেই। ও যা বলেছে তা করতে বাধবে না। মানবিকতার বালাই নেই ওর মধ্যে। রাগে কটমট করে বলল,

“তুই একটা অমানুষ, পিশাচ”

“হ্যাঁ, আমি জানি।”

ইসাবেলা এবার নাক টানতে টানতে পরাজিত গলায় বলল,

“মানবীয় রূপ ধরে আছো। একটু মানবিক হওয়া যায় না? তোমার মধ্যে কী মন বলে কিছু নেই?”

“জীবন্মৃতদের মন থাকে না।”

“জীবন্মৃত! অর্থাৎ তুমি জীবিত আবার মৃত? এ কী করে সম্ভব? এমন কখনও হয়?”

ইসাবেলা ভাবনায় বুঁদ হয়। নিকোলাস কিন্তু চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ পর ইসাবেলা তেতে উঠে বলল,

“এই জন্যই তো আমাকে বলতে পারলে পুরো প্রাসাদ পরিষ্কার করতে। অপদার্থ, অনুভূতিশূন্য! আমি মানুষ৷ সেটাও আবার বা-চ-চা মেয়ে। এত শক্ত কাজ কী করে করব? তোমার মতো অপদার্থ, জীবন্মৃতের দ্বারাও তো এ কাজ একা সম্ভব না। চ্যালেঞ্জ নাও তুমিও হার মানবে কাজ শেষ করতে না পেরে। সাহস থাকে তো চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেখো।”

“দাসী আর মালিকে মোকাবেলা হয় না।”

“দাসী?”

“হুম, উচ্চমূল্যে কেনা দাসী।”

“কার কথা বলছ তুমি?”

“তুমিই আমার উচ্চমূল্যে কেনা দাসী বেলা।”

“কি? আমি দাসী! আবোল তাবোল বকো না। ওই খচ্চর তোমার টাকা নেয়নি। তার আগেই তো মেরে ফেলেছ।”

“সে টাকা নিলো না নিলো তাতে আমার কিছু এসে যায় না। টাকাগুলো আমি দিয়েছি। সুতরাং তুমি আমার কেনা দাসী।”

“স্বৈরচারের মতো আচরণ করছ তুমি।”

“কারণ আমি স্বৈরাচার। এবার চুপ করে কাজে লেগে যাও__”

“যদি না যাই। কী করবে হুম? ভয় দেখাবে? আমি তোমাকে ভয় পাই না। ফাঁসির আসামীর আর ভয় কীসের?”

নিকোলাস উঠে দাঁড়ায়। চোখ দুটো আগুনের ন্যায় জ্বলছে। শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে ঠোঁটের দুপাশ থেকে। ইসাবেলা এক কদম পিছিয়ে গেল। ভয় ওর চোখে স্পষ্ট। নিকোলাস ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

“ভয় পাও না?”

“না” জোর গলায় জবাব দেয় ইসাবেলা। নিকোলাস চোখের পলকে ছুটে এসে বাহু চেপে ধরে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে ইসাবেলা। হাওয়ায় উড়ে ওকে নিয়ে এলো জঙ্গলের ভেতর। চারপাশে ঘন বীচবৃক্ষ আর গুল্মলতা লতার বাহার। সূর্যের আলো এখানে নামেমাত্র উঁকি দিয়েছে। পায়ের নিচে শুকনো পাতার আচ্ছাদন। নিকোলাস মুখ নামিয়ে আনে কানের কাছে। ওর ভারী নিঃশ্বাসে কাঁধের লোমশ দাঁড়িয়ে যায়। সরে দাঁড়াতে গেলে নিকোলাস মুষ্টি শক্ত করে৷

“ছাড়ো আমাকে।” অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল ইসাবেলা। নিকোলাস চাপা সম্মোহনী গলায় বলল,

“অবশ্যই। তোমাকে ছাড়ব বলেই তো নিয়ে এলাম এখানে, বেলা।”

ভ্রু কুঁচকে তাকায় নিকোলাসের মুখের দিকে। খুব কাছাকাছি দুজনে। ওই চোখে চেয়ে হারিয়ে যায় ইসাবেলা। ভুলে যায় সব ব্যথা। সময় যেন থমকে গেছে। নিকোলাস মুচকি হেসে সামনে ঠেলে দিতে ঘোর কাটে। দেখতে পেল চাপা গর্জন করতে করতে গাছের আড়াল থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসছে কয়েকটা নেকড়ে। ইসাবেলা কিছুক্ষণ দম ফেলতে ভুলে গেল। নেকড়েগুলো বুভুক্ষু দৃষ্টিতে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। ইসাবেলা আর্ত চোখে পেছনে তাকায়। নির্বিকার, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে নিকোলাস। নেকড়ের গর্জন ধীরে ধীরে সন্নিকটে আসছে। ইসাবেলার সত্যি এবার ভয় করছে। সভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। নিকোলাস পরিহাস করে বলল,

“ভয় হচ্ছে না বেলা?”

নিকোলাস কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশ দিয়ে ভো দৌড় দেয় ইসাবেলা। নেকড়েগুলোও ছুটল পিছু পিছু। ইসাবেলা প্রাণপণে ছুটছে। ঝোপঝাড়, গাছপালা সব পেরিয়ে সামনে দৌড়াচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই। নেকড়ের গর্জনে কলিজায় পানি নেই। ভাবনা চিন্তা করার অবস্থাতেও নেই এখন। শুধু জানে দৌড়াতে হবে। হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম। দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁফ ধরে যায়। দম নিতে কষ্ট হলেও সে পা থামায় না। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত গাছের পড়ে থাকা শুকনো ডালে পা বেঁধে নিচে মুখ থুবড়ে পড়ে। শুকনো ডালের আঁচরে হাত-পা, হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে রক্তাক্ত অবস্থা। নেকড়েগুলো ঘোঁতঘোত শব্দ করে একদৃষ্টি চেয়ে আছে ওর দিকে। প্রস্তুতি নিচ্ছে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। ইসাবেলা উঠতেও গিয়ে পারে না। অগত্যা হার মানতেই হয়। নেকড়ে ওর দিকে লাফ দিতে কাঁদতে কাঁদতে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলে। একটু পর নেকড়ের আর্তনাদে সচকিত হয়ে চোখ মেলে। বিস্ময়ে চেয়ে আছে পাশে। নেকড়েটা পড়ে গোঙাচ্ছে। গলা দিয়ে রক্ত পড়ছে ওটার। নেকড়ের দেহের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাদামি চুলের এক মেয়ে। পরনে ধূসর সিল্কের কোট গাউন। কোঁকড়া বাদামি চুল খোঁপা করা।

“নোভা!”

রাগান্বিত নিকোলাস এসে হাজির হয় সেখানে। ওর পেছনে এখন বাকি নেকড়ের দল। মেয়েটি ঘুরতে ইসাবেলা চিনতে পারল তাকে। ওইদিন নিকোলাসের কফিনের পাশের কফিনে এই মেয়েটিই শুয়ে ছিল। রক্তমাখা লাল ঠোঁট মুছে বলল,

“বড়ো ভাই”

“এখানে কী করছিস তুই?”

জবাব না দিয়ে নোভা হাসি মুখে ইসাবেলার সামনে এসে বসল। ভয়ে জড়সড় হয়ে সরে যায় ইসাবেলা। নোভা বিমর্ষ মুখে বলল,

“ভয় পেয়ো না। তোমার কোনো ক্ষতি করব না আমি। হাত দাও।”
ইসাবেলা এদের বিশ্বাস করে না। নোভা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ওর নজর পড়ে ইসাবেলার হাত-পায়ের ক্ষতের ওপর। পরম মমতায় রক্তাক্ত পায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। আশ্চর্য! ক্ষত উধাও। ব্যথাও অনুভব করছে না এখন আর ইসাবেলা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নোভার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা হেসে ওর হাতটা ধরে পুনরায় বলল,

“ভয় পেয়ো না আমাকে।”

“নোভা” কুপিত দেখাল নিকোলাসকে। নোভা চোয়াল শক্ত করে জবাব দিলো,

“শুনছি আমি বড়ো ভাই।”

“কী করছ তুমি?”

“নির্দোষ, নিষ্পাপ মেয়েটাকে সাহায্য করছি। কেন এমন করছ ওর সাথে? ছেড়ে দাও ভাই ওকে।” উঠে ভাইয়ের মুখোমুখি হয় নোভা। নিকোলাস কর্কশ গলায় বলল,

“আমার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমি পছন্দ করি না। হবে তুমি আমার বোন, কিন্তু ভুলে যেয়ো না আমি তোমাদের রাজা।”

নোভা তাচ্ছিল্য ভরে হাসল,

“হ্যাঁ, সেটাই। তুমি রাজা। আমার ভাইয়ের চাইতে বড়ো কথা তুমি রাজা। রাজা মশায়, শাস্তি দিন আমাকে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করার শাস্তি তো প্রাপ্য আমার। দিন শাস্তি।”

নিকোলাসের দৃষ্টি নরম হলো। নিচু গলায় বলল,

“চলে যা এখান থেকে নোভা।”

ইসাবেলার বাহু চেপে ধরে দাঁড় করাতে নোভা নিকোলাসের হাতের ওপর হাত রাখে।

“তোকে যেতে বলেছি নোভা।”

“ওকে সাথে না নিয়ে কোথাও যাব না আমি।”

“ও আমার শিকার নোভা। শেষবার বলছি আমার কাজে হস্তক্ষেপ করিস না। সর।”

“আমিও শেষবার বলছি ওকে আমার চাই।”

ইসাবেলাকে ছেড়ে নোভার গলা চেপে হুঙ্কার করে ওঠে নিকোলাস,
“কেন? কেন ওকে চাই তোর? এমন তো না তুই মনুষ্য রক্ত পান করিস, তবে? ওকে দেখে রুচি বদল হয়েছে?”

“আমার একজন দাসী চাই ভাই। বোন হিসেবে উপহার চাইছি। তোমার এই বোনকে এইটুকু কি দেবে না?”

“না”

নিকোলাস ওর গলা ছেড়ে ইসাবেলার বাহু ধরে সামনে যাবে কিন্তু নোভা ইসাবেলার হাত টেনে ধরে।

“প্লিজ ভাই। ছেড়ে দাও ওকে। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও আমাকে দাও।”

চাপা গর্জে ইসাবেলার হাত ছেড়ে বলে,

“দুইদিন, এর এক সেকেন্ড বেশিও না কমও না। দুইদিন পর ওকে আমি ফিরিয়ে নেবো। খবরদার যদি ওকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিস?”

নোভার মুখখানি উজ্জ্বল হয়। ইসাবেলাকে কাছে টেনে ভাইয়ের সামনে নত মস্তকে বলল,

“ধন্যবাদ ভাই।”

শেষবার ইসাবেলার ফ্যাকাশে ভীত মুখ পানে চেয়ে হাওয়ায় হারিয়ে যায় নিকোলাস। নেকড়েগুলো বন মধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে। ইসাবেলা নোভার দিকে ফেরে। মেয়েটার চোখে মুখে কোনো হিংস্রতা নেই। ও যেন নিকোলাসদের একজন হয়েও আলাদা। ইসাবেলা কি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে? বিশ্বাস করবে এই মেয়েকে? সেটা কি ঠিক হবে? হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক করে মাথায়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here