#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩১
Writer তানিয়া শেখ
লিভিয়ার সব কথা নিকোলাস শুনেছিল। প্রথমদিন থেকেই এই ভদ্রমহিলাকে ওর পছন্দ হয়নি। চোখের দৃষ্টিতে যেন কপটতার জাল। নিকোলাস মানুষের মুখ দেখলে অনেক কিছু আন্দাজ করতে পারে। লিভিয়াকে দেখে ওর সুবিধার মনে হয়নি। ধীরে ধীরে এ বাড়ির সবার প্রতি ওর মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। এমনকি ওই ডক্টর, যে সময় পেলে ইসাবেলাকে দেখতে আসে তাকেও ও সন্দিগ্ধ চোখে দেখছে। ইসাবেলাকে অবশ্য এসব ও বলেনি, বুঝতেও দেয়নি। বিপদ আশঙ্কা করেও এ বাড়িতে থাকার মানে হয় না জেনেও আছে। ইসাবেলার পায়ের ক্ষত এখনও শুকায়নি। এই অবস্থা ওকে নিয়ে হঠাৎ করে কোথাও যেতে পারছে না। তবে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে আশপাশে।
“লিভিয়া চলে গেল। আমাদেরও এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।”
ইসাবেলা জানালায় মুখ করে বসে আছে। নিকোলাস বিছানায় বসে ছিল চুপ করে। এবার উঠে দাঁড়ায়। ফার্স্ট এইড বক্সটা হাতে তুলে এগিয়ে যায় ইসাবেলার দিকে। ওর পায়ের কাছে অনুচ্চ টুল এনে বসল। আহত পা’টা তুলে কোলে রাখতে মৃদু কেঁপে ওঠে ইসাবেলা। নিকোলাস ভুরু কুঁচকে তাকাতে লজ্জা আড়াল করে বলল,
“জবাব দিলেন না? আমার কিন্তু সত্যি ভয় হচ্ছে এখানে থাকতে।”
“আমি থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই, বেলা।”
ইসাবেলার ফ্রকটা হাঁটুর ওপরে তুললো। হাত রাখল উন্মুক্ত পায়ের ত্বকে। শক্ত করে ঠোঁট চেপে ধরেছে ইসাবেলা। নিকোলাস প্রতিদিন এমনই করে স্পর্শ করে। ওর কাছে এটা হয়তো সাধারণ ব্যাপার কিন্তু ইসাবেলার কাছে নয়। শিহরিত হয় নিকোলাসের হাত পায়ের নগ্ন ত্বকে পড়তে। নিকোলাস ড্রেসিং করছে একমনে। ইসাবেলা অনিমেষ চেয়ে আছে ওর দিকে। লম্বা নাক, ঘন কালো ভুরু আর ওই লাল ঠোঁট। নিকোলাসের ঘন কালো চুলের কিছুটা উড়ে এসে পড়েছে কপালের ওপর। কী অবলীলায় খেলছে ওর কপালে! বড্ড হিংসে হলো চুলগুলোর ওপর ইসাবেলার। ওর দৃষ্টি ফের গিয়ে থামে নিকোলাসের ঠোঁটের ওপর। পিশাচ হবে ভয়ংকর, কদাকার। এমন সুদর্শন কেন হলো?
“ঠিক আছো তুমি?”
“হুঁ?” চমকে ওঠে ইসাবেলা। নিকোলাস এখনও চোখ তুলে তাকায়নি।
“ঠোঁট ফুলাচ্ছ কেন?”
ঠোঁটে হাত উঠে এলো ইসাবেলার। সত্যি তো ও ঠোঁট ফুলিয়ে আছে। জোরপূর্বক হেসে বলল,
“এটাকে ঠোঁট ফুলানো বলে না, পাউট বলে। এই দেখো?” ইসাবেলা পাউট করে দেখায়।
নিকোলাস একপলক দেখে মুচকি হাসে। ইসাবেলা ওর হাসি দেখে বোকার মতো হাসে। তারপর বলে,
“আপনার হাসি কিন্তু চমৎকার সুন্দর। যে কোনো মেয়ে পাগল হয়ে যাবে।”
“তুমি পাগল হয়েছ?”
“হুঁ?” অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ইসাবেলা। নিজের বলা কথাতে ও বেশ লজ্জিত হলো। কেন যে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল কথাটা! নিকোলাসের মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হলো। ড্রেসিং শেষে ওর পা আস্তে করে নিচে রাখল। ফ্রকটা নামিয়ে দিলো নিচে। ইসাবেলা সোজা হয়ে বসল। পায়ে যেন এখনও নিকোলাসের রুক্ষ, কঠিন হাতটার স্পর্শের রেশ রয়ে গেছে। বক্সটা হাতে নিয়ে উঠে গেল নিকোলাস।
“ব্যথা কী এখন তেমন নেই?”
“আছে তো। কেন?”
“ড্রেসিংএর সময় ব্যথা অনুভব করছ না কেন তাহলে? আজ আমি ইচ্ছে করে ক্ষতর ওপর তুলো সামান্য জোরে চেপেছিলাম। তোমার কাছ থেকে কিন্তু ব্যথা ট্যাথার প্রতিক্রিয়া পেলাম না।”
ইসাবেলা হাতটা ব্যান্ডেজের ওপর রেখে আঙুলে মৃদু চাপ দিতে চোখ মুখ শক্ত করে তোলে। ভীষণ ব্যথা! তাহলে তখন কী হয়েছিল? তখন কেন টের পায়নি কিছু?
“বেলা?”
“উম, মনে হয় কিছু ভাবছিলাম। গভীর ভাবনায় ডুবে গেলে এমনটা হয় সচরাচর।”
“আর ইউ সিওর?” নিকোলাস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়। ইসাবেলা চট করে মুখটা জানালার দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, অবশ্যই।”
নিকোলাস এখনও দৃষ্টি অনড় রেখেছে ওর দিকে। গভীর ভাবনা না ছাই! ওর ব্যথা ভোলার কারণ ছিল নিকোলাস। বেশ ভালোভাবেই সেটা জানে নিকোলাস।
“বেলা?”
“হুম?”
ক্ষণিক নীরবতা নামল ঘরময়। ইসাবেলা এখনও নিকোলাসের দিকে ফেরেনি। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে নিকোলাস সবটা ধরে ফেলেছে। একটুখানিই তো দেখেছে। ওইটুকু দেখলে কী হয়? ও তো আর নিকোলাসের মতো ঠোঁট বাড়িয়ে চুমু খেতে যায়নি!
“বিছানায় এসে শুয়ে পড়ো।”
হাঁপ ছেড়ে বাঁচে ইসাবেলা। নিকোলাস দরজার দিকে যেতে ও বলল,
“এই পা নিয়ে বিছানা পর্যন্ত কীভাবে যাব?”
ভাবলেশহীন মুখে তাকায় নিকোলাস। কঠিন গলায় বলে,
“সব ব্যাপারে এত পরনির্ভরশীল কেন তুমি, হ্যাঁ? কী ভাবো? আজীবন তোমাকে কোলে করে ঘুরে বেড়াব? এক পা আহত হয়েছে অন্য পা তো ঠিক আছে। চেষ্টা করো নিজে নিজে।”
বলেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল নিকোলাস। ইসাবেলার চোখ ছলছল করছে। খুব আঁতে লাগল নিকোলাসের কথা। অন্য পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে ব্যথায় ককিয়ে উঠল। টলমল চোখের জল এবার গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। পায়ের ব্যথার চেয়ে নিকোলাসের কথার ব্যথা বেশি লেগেছে ওর। আহাত পা হেঁচড়ে চললো বিছানার দিকে। খুব কষ্ট হলো কিন্তু হার মানল না। কারো ওপর বোঝা হয়ে থাকার মতো কষ্ট দুটো নেই পৃথিবীতে। বিছানায় বসে পা’টা মেলে দিলো। সাদা ব্যান্ডেজের খানিকটা রক্তে ভিজে গেছে। ঠোঁট কামড়ে কান্নার শব্দ দমালো। শারীরিক মানসিকভাবে নিকোলাস বহু আঘাত দিয়েছে ওকে। কিন্তু আজকেরটা অন্য সবটার মতো ছিল না। শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল। কাঁদতে কাঁদতেই একসময় ঘুমিয়ে গেল।
লিভিয়ার এই বাড়িটির পেছনের দিকে বিশাল অরণ্য। ডান দিকে সরু লেক। বেশ ফাঁকা ফাঁকা বসতি আশেপাশে। নিকোলাসের রক্তনেশা চেপেছে। ক্রোধ বাড়ছে প্রচণ্ড বেগে। রক্ত প্রয়োজন ওর। তৃষ্ণা মেটাতে রক্ত প্রয়োজন। হাওয়ায় মিশে গিয়ে থামল একটি বাড়ির সামনের সবজি খামারে। এক যুবতী এই ভর বিকেলে সেখানে বসে আগাছা পরিষ্কার করছে। নিকোলাস আশেপাশে সতর্কে দেখল। কেউ নেই। ধোঁয়ার কুন্ডলি হয়ে যুবতীর চতুর্দিকে ঘুরতে লাগল। মেয়েটি প্রথমে খেয়াল করেনি। ভয়ংকর গোঙানির শব্দে আঁতকে ওঠে ও। দ্রুত দাঁড়িয়ে যায়। সূর্যের আলোর তেজ বেশ কমে এসেছে। তারমধ্যে চারপাশ ঘুরতে থাকা ধোঁয়াটা ওর নজরে এলো। সাথে ভয়ংকর গা শিওরে ওঠা চাপা হাসি। মেয়েটি উলটো দিকে দৌড়াবে ওমনি নিকোলাস ওকে ধরে ফেলে। টেনে নিয়ে যায় জঙ্গলের মধ্যে।
“প্লিজ ছেড়ে দাও আমাকে।”
নিকোলাসের ভেতরকার পিশাচটা লোভে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে থাকে। মেয়েটাকে একটা গাছের সাথে দাঁড় করিয়ে ওর গলা চেপে ধরে। নিকোলাসের জ্বলন্ত লাল চোখ, রক্তিম ঠোঁটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে শ্বদন্ত। ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল মেয়েটির মুখ। আকুতি করে,
“আমি গর্ভবতী, আমায় মেরো না। দোহাই তোমার।”
নিকোলাসের চোখ যায় ওর হাত রাখা পেটের ওপর। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল আরেকবার। কানের কাছে ঝুঁকে এসে বলল,
“তবে তো আজ আমার মহাভোজ।”
মেয়েটি কিছু বুঝার আগেই তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত বসিয়ে দেয় ওর ঘাড়ে। চিৎকার করে নিস্তব্ধ জঙ্গল কাঁপিয়ে তোলে মেয়েটি। খানিক পরেই সব আগের মতো শান্ত হয়ে যায়। মেয়েটির ফ্যাকাশে দেহ পড়ে আছে নিচে। নিকোলাসের শরীর চাঙা হয়ে ওঠে। ঘুরে দাঁড়াতে মেয়েটির দুর্বল গলার স্বরে থেমে যায়।
“আমার সন্তান! আমার সন্তান!”
নিকোলাস ঘুরে দাঁড়ায়। মেয়েটির চোখ বোঁজা। হাতটা পেটের ওপর। এখনও সামান্য রক্ত অবশিষ্ট ওর দেহে। এতে কি বাঁচবে ওর সন্তান?
“বাঁচুক কিংবা মরুক তাতে আমার কী?”
“যদি বেলা এই ঘটনা জেনে যায়?” নেকড়ে সত্ত্বা প্রশ্ন করে। পিশাচ বলে,
“ও সব জানে। আমি কী ও ভালো করেই জানে। নতুন কিছু নয় এসব ওর কাছে? আমি এমনই। এমনই নির্মম, নিষ্ঠুর আর স্বার্থপর আমি।”
“তারপরেও ও তোমাকে পছন্দ করেছে, বিশ্বাস করে এখন।”
“কী বলতে চাইছ?”
“তোমার তৃষ্ণা তো মিটেছে তবে এই মেয়েকে বাঁচালে ক্ষতি কী? হয়তো এই কারণে বেলার ভালোবাসাও পেয়ে যেতে পারো একদিন।”
“ভালোবাসা! তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। কারো ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। আমি একে বাঁচাব না।”
নিকোলাস ধোঁয়ার কুন্ডলি হয়ে গলে যায় গাছের সারির ফাঁকে। কিছুদূর গিয়ে ফের ফিরে এলো। মেয়েটি অচেতন পড়ে আছে এখন। কোলে তুলে নিলো ওকে। মেয়েটির অচেতন মুখে চেয়ে বলে,
“তোমাকে আমি বাঁচাচ্ছি কেবল করুণা করে। আর কিছু না।”
নেকড়ে সত্ত্বা ফিক করে হেসে উঠতে রাগে গোঙানি দিয়ে ওঠে নিকোলাস।
“চুপ করো নয়তো একে এখনই ছুঁড়ে ফেলতে আমার বাধবে না।”
পিশাচদের ভরসা নেই। সুতরাং নেকড়েটা চুপ করে গেল।
চলবে,,,
নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো🤷♀️