তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব–৪৯ Writer তানিয়া শেখ

0
420

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৯
Writer তানিয়া শেখ

বন মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙল ইসাবেলার। ঘুমে ভারী চোখের পাতা। টের পেল পাশ থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে আছে। মাদাম আর ও পাশাপাশি ঘুমায়, কিন্তু মাঝ খানে যথেষ্ট জায়গা রেখে। ইসাবেলা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুমাতে অস্বস্তিবোধ করে। মাদাম কি আজ জড়িয়ে ধরেছে ঘুমের ঘোরে? আগে এমন তো হয়নি! একটু নড়েচড়ে উঠল। হঠাৎ মনে পড়ল রাতের কথা। শেষবার ও নিকোলাসের সাথে ছিল। তবে কী! চকিতে তাকাল। দৃষ্টি স্থির হয় ওর পেটের ওপরের পুরুষালি লোমশ হাতটার দিকে। ওর সমস্ত শরীর হিম হয়ে এলো। নিঃশ্বাস ফেলছে খুব আস্তে।
মাথাটা ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে পাশের ব্যক্তিটির মুখ দেখার চেষ্টা করল। বাইরে কুয়াশা কাটেনি৷ ঘরের ভেতর আলসে অন্ধকার। জানালা বরাবরের মতো পর্দায় ঢাকা। পাশে শায়িত ব্যক্তিটির মুখ স্পষ্ট দেখতে না পেলেও ও নিশ্চিত ব্যক্তিটি নিকোলাস। এতক্ষণে সোঁদা মাটির গন্ধটাও পেল। ইসাবেলার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। নিকোলাসের হাতটা পেটের ওপর থেকে সরাতে গিয়ে অবাক হয়। প্রাণহীন হিমশীতল হাতটা। নিকোলাসের হাতের স্পর্শ এর আগেও বহুবার পেয়েছে। তখন সাধারণ মানুষের মতোই উষ্ণ ছিল, কিন্তু এখন ও যেন মৃত। কোথাও শুনেছিল মানুষ মরে গেলে দেহ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। নিকোলাস কি মৃত এখন? ঠিক ওই মানুষগুলোর মতো? নিকোলাস জীবন্মৃত কথাটা ভেবে ততটা খারাপ লাগেনি যতটা কেবল মৃত এই কথাটা ভেবে লাগল। কেন খারাপ লাগল মৃত ভাবতে? বিছানা ছেড়ে নামল। তারপর ঘুরে দাঁড়ায় বিছানার দিকে। নিকোলাস ওর দিকে একপাশ হয়ে শায়িত। ওর মাথার কালো চুল এলোমেলো। ইসাবেলা খেয়াল করে, নিকোলাসের চুল বেশ লম্বা হয়েছে আগের তুলনায়। কপাল ছুঁয়ে কতগুলো চুল চোখের ওপর পড়েছে। মুদিত চোখেও কেউ এমন মুগ্ধ করতে পারে? নিজের ভাবনাকে কষে ধমক দিলো ইসাবেলা। গলা ঝেড়ে দৃষ্টি সরাতে গিয়ে থেমে যায়। নিকোলাসের ঠোঁটের একপাশ কুঁচকে গেছে। থুতনির টোলটা আরো বেশি চোখে পড়ে। এটাকে কি মুচকি হাসি বলে? না! ইসাবেলা যে এতক্ষণ তাকিয়ে আছে সেটা টের পেয়ে ওমন দুষ্টু হাসি হাসছে। ওর হাসি ইসাবেলার অঙ্গ জ্বালিয়ে দেয়।

“ডোন্ট ফ্লাটার ইওরসেল্ফ। আপনার চাইতেও সুদর্শন পুরুষ আমি দেখেছি।”

ইসাবেলার বিদ্রুপ ভালোভাবে নিলো না নিকোলাস। চোয়াল কঠিন হলো। ওর ঠোঁটের দুষ্টু হাসি মুছে দিতে পেরে মনে মনে বিজয়ীর হাসি হাসল ইসাবেলা। দরজার কাছে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিকোলাসের রুষ্ট মুখ দেখে মুচকি হেসে বেরিয়ে এলো বাইরে।

এই পুরোনো কাঠের বাড়ির চারপাশের ঘন বৃক্ষগুল্মের সারি। বারান্দা পর্যন্ত উঠে এসেছে পরগাছা। রেলিঙের এখানে ওখানে বরফ ছড়িয়ে আছে। বারান্দার দরজার মুখের দুপাশে বুনো গাছের পাতা ঢেকে আছে বরফে। সামনের বরফের মাঝে মাঝে সবুজ ঘাসগুলো দেখা যায়। আরো সামনে ঘন কুয়াশা। বাইরে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। ইসাবেলা আরেকটু অপেক্ষা করে। একটু পর সূর্য উঁকি দিতে পাতলা বরফ ছড়ানো ঘাসের ওপর পা রাখল। ঘর থেকে বেরোনোর আগে বুটজোড়া পরতে ভোলেনি। বাড়ির এদিক ওদিক ঘুরে হতাশ হয়। বুঝতে পারে নিকোলাস ওকে নিয়ে এসেছে বেনাসের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। এখান থেকে একা ফিরে যাওয়া অসম্ভব।

সূর্যের তেজ বাড়তে অদূরের কুয়াশা কেটে সবুজ অরণ্য দৃশ্যমান হয়। ইসাবেলা বাড়িটির সামনে পড়ে থাকা স্যাঁতসেঁতে শুকনো গাছের গুড়ির ওপর বসল। এখান থেকে পাহাড়ের সামনে এবং নিচটা দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের এত ওপর থেকে নিচটা দেখতে চমৎকার সুন্দর । সাদা আর সবুজে যেন মিতালি গড়েছে। অদূরের নিবিড় অরণ্যের মাঝে শেষ হয়ে গেছে নীল আকাশ। ইসাবেলা আনমনে অনেকক্ষণ বসে রইল সেখানে। এই নির্জনতা, একাকিত্ব হতাশার অন্ধকারে ঠেলে দেয়। সেই হতাশা, যার শুরুটা ছিল পিটারের চলে যাওয়ার পর।
বসে বসে কত কী ভাবতে লাগল। সবচেয়ে বেশি ভাবে নিজের দুর্বল মনটাকে নিয়ে। ও আর কাওকে ভালোবাসতে চায় না, নিকোলাসকে তো নয় ই। ঈশ্বরের দাসী ইসাবেলা, আর নিকোলাস ঈশ্বরদ্রোহী। ওদের মধ্যে যা হবে সব পাপ। নিকোলাস অভিশপ্ত। ইসাবেলা চায় ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট জীবন। নিকোলাসের সঙ্গ ওর জীবন বদলে দিয়েছে। ওর ভেতরের সরলতা, পবিত্রতা খর্ব হয়েছে। মা আন্না মেরিও আজকের ইসাবেলাকে দেখে খুশি হবেন না। দুঃখ পাবেন তাঁর নিস্পাপ মেয়েটির নির্মমতার কাহিনি শুনলে।
মায়ের মলিন মুখ ভেবে বিষণ্ণ হয়। নিকোলাসকে মা আন্না মেরিও কোনোদিন মেনে নেবেন না। নিকোলাস পিটার নয়, নিকোলাস মানুষ নয়, নিকোলাস পিশাচ। চোখ দুটো ভীষণ জ্বলতে লাগল। পিটার যদি সেদিন ফেরারি না হতো তবে নিকোলাস ওর জীবনে আসত না। ইসাবেলাকে এই কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হতো না।

“আমি তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না পিটার, কোনোদিন না।”

ইসাবেলার গাল বেয়ে উষ্ণ বারিধারা বয়ে গেল। উঠে পাহাড়ের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়। এই মুহূর্তে এখান থেকে লাফিয়ে পড়লে জীবনের সকল সংকট দূরীভূত হবে। আন্না মেরিও, পিটার ও নিকোলাস কারো কথা ওকে আর ভাবতে হবে না। মৃত্যু! পিটার চলে যাওয়ার পর এই শব্দটা বহুবার ভাবিয়েছে ওকে। বহুবার মৃত্যুকে চেয়েছে। হৃদয় ভাঙার কষ্টের চাইতে কি মৃত্যুকে বরণ করার কষ্ট বেশি? মৃত্যুর পর আবার বাঁচার সুযোগ থাকলে এই প্রশ্নের জবাব ইসাবেলা খুঁজে নিতো। আগাগোড়াই ও ভীতু। সেদিন হৃদয় ভাঙার কষ্ট গলাধঃকরণ করেছিল মৃত্যু ভীতি এড়াতে। আজ কী করে নিজের মনকে বাঁচাবে দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়া থেকে? কী করে নিকোলাসের সান্নিধ্যে এসে ওর আকর্ষণকে উপেক্ষা করবে? যে ওর মধ্যে থেকে পিটারের প্রতি ভালোবাসা ম্লান করে দিতে পারে, সে সব পারে। ইসাবেলাকে ভালোবাসতে বাধ্যও করতে পারে।

“না না, ভালোবাসি না, ভালোবাসব না।”

ইসাবেলা বেখেয়ালে একেবারে পাহাড়ের শেষ প্রান্তে চলে এলো। আরেক পা এগোলেই খাদে গিয়ে পড়বে। এই মুহূর্তে সেই হুঁশ ওর নেই। মনটা বড়ো অশান্ত। মস্তিষ্ক অস্থির।

“বেলা!” পেছনে নিকোলাসের আতঙ্কিত গলার স্বরে মৃদু কম্পিত হয় ইসাবেলা। ভাবনার সুতো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে বাস্তবে। কিন্তু এই বাস্তবতা ওকে শান্তি দেয় না। নিকোলাসের উপস্থিতি আরো বেশি বিষণ্ণ করে।

“পালিয়ে যা নিকোলাস কাছ থেকে। অনেক দূরে পালিয়ে যা।”

ভেতরের সেই আহ্বানে অজান্তে সামনে পা বাড়ায়। পাহাড় থেকে শূন্যে ভাসতে ভয়ে দুচোখ বন্ধ করল। মৃত্যু! অবশেষে কি মৃত্যু হবে ওর? ডানা মেলা পাখির মতো নিজের দেহের ভার ছেড়ে দেয় শূন্যের ওপর। কিন্তু ওর মন বলছে ও এবারো মরবে না। নিকোলাস ওকে মরতে দেবে না। ঠিক তাই হলো। কোমরে নিকোলাসের বাহুবন্ধন টের পাচ্ছে ও। দুহাতে শক্ত করে নিকোলাসের বুকের কাপড় মুঠোবন্দি করেছে। রাগে গজগজ করছে নিকোলাস। নিরাপদ স্থানে আসতে চোখ মেলল ইসাবেলা। নিকোলাসের নীল চোখজোড়া রাগে রক্তবর্ণ হয়েছে।

“কেন এমন করলে, বেলা?”

“আপনার কাছ থেকে দূরে যেতে।”

আনত মুখে আস্তে আস্তে বলল ইসাবেলা। কিছুক্ষণ কথা বলতে ভুলে গেল নিকোলাস। তারপর আচমকা ওর চোয়াল চেপে ধরে বলল,

“কী ভেবেছিলে? মৃত্যু আমাদের মাঝে দুরত্ব তৈরি করবে?”

“করবে না?” চোয়ালের ব্যথা গিলে পালটা প্রশ্ন ছোঁড়ে ইসাবেলা। নিকোলাস কাষ্ঠ হাসল।

“নির্বোধ বেলা।”

ইসাবেলা প্রতিবাদ করার আগেই নিকোলাস ওকে পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। ভয়ে চিৎকার করে ওঠে ইসাবেলা। নিকোলাস ওর হাত ধরে ফেলল সাথে সাথে। শূন্যে ঝুলছে ইসাবেলা। নিচে গভীর খাদ। পড়লে মৃত্যু অবধারিত।

“হাত ছেড়ে দেবো?” নির্লিপ্ত গলায় বলল নিকোলাস। ইসাবেলা কেঁদে দেয় শব্দ করে।

“না, প্লিজ।”

“কাঁদছ কেন? তুমিই তো একটু আগে মরতে গিয়েছিলে।”

“আমার মাথা ঠিক ছিল না। ভুল হয়েছে। প্লিজ আমাকে ওপরে তুলুন নিকোলাস।”

“ওপরে? না, ওপরে এলে আমাদের মাঝের দুরত্ব ঘুচে যাবে। তুমি তো সেটা চাও না, বেলা।”

“আমি নির্বোধ, আমার ভুল হয়েছে। প্লিজ নিকোলাস।”

ইসাবেলা অঝোরে কাঁদতে লাগল। নিকোলাস তবুও তুললো না। বলল,

“আগে বলো কেন আমার কাছ থেকে দূরে যেতে চাও? যদি মিথ্যা বলেছ, বেলা! বলো।”

“আ,,আম,,উমম” ইসাবেলা তোতলাতে লাগল। ওর হিচকি উঠে গেছে। নিকোলাস হাত ঢিল করতে ইসাবেলা আরো জোরে কেঁদে দেয়। হড়বড়িয়ে বলে,

“আপনাকেভালোবেসেফেলবএইভয়ে।”

“কী? স্পষ্ট করে বলো এবং ধীরে সুস্থে।”

“আপনাকে ভালোবেসে ফেলব এই ভয়ে।” কথাটা বলতে বলতে ওর গাল লাল হয়ে ওঠে। নিকোলাস সাথে সাথে টেনে আনল ওপরে। বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।

“বেলা, বেলা।”

নিকোলাসের গলা দিয়ে আর কোনো শব্দ আসে না। এই কি আনন্দ? একেই খুশিতে বাক্যহারা হয়ে যাওয়া বলে? ইসাবেলা হিচকি তুলে কাঁদছে। ওর মুখটা আঁজলা ভরে তুলে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চোখের জল মুছে দেয় নিকোলাস। ইসাবেলার গোলাপি ঠোঁট লাল হয়ে উঠেছে। কাঁপছে থরথর করে। নিকোলাস ঝুঁকে ওর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলে,

“একটা চুমু খাব, বেলা। শুধু একটা।”

চমকে ওঠে ইসাবেলা। ঠোঁট চেপে মুখের ভেতর ঠেলে সজোরে দুদিকে মাথা নাড়ায়।

“একটা চুমুতে ভালোবাসা হয় না। হবে না।” নিকোলাস বলল। ইসাবেলা ঢোক গিলে আবারো প্রত্যাখ্যানের করবে বলে নিজেকে প্রস্তুত করে। কিন্তু মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,

“সত্যি একটা চুমুতে ভালোবাসা হবে না তো?”

“একদম না। বিশ্বাস না হলে ট্রাই করেই দেখো।”

নিকোলাস ঠোঁট নামিয়ে আনতে ইসাবেলা মাথা পেছনে নেয়। আপত্তি জানাতে চায়, কিন্তু ওর ঠোঁটের দিকে চেয়ে সব গুলিতে ফেলল। বলল,

“শুধু একটা কিন্তু।”

“শুধু একটা।”

ইসাবেলা দুচোখ বন্ধ করে কম্পিত গলায় বলল,

“আচ্ছা, শুধু একটা।”

মুহূর্তে নিকোলাসের ঠোঁট নেমে আসে ওর ঠোঁটের ওপর। ইসাবেলার ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। চোখ দুটো বিস্ফোরিত। অবশ হয়ে এলো অঙ্গ। নিকোলাস প্রথমে ওর ঠোঁট তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত মুখের ভেতর আধিপত্য বিস্তার করে।

ভুল বলেছে নিকোলাস। একটা চুমুতেও ভালোবাসা হয়ে যায়। ইসাবেলার মনে পড়ল এই একটা চুমুই ওর প্রথম চুম্বন। নিকোলাস ওর প্রথম চুম্বন অধিকার করে নিয়েছে। চুম্বনের মাঝেই ফের কাঁদতে শুরু করল ও।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here