তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব–৬৬

0
408

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬৬
Writer তানিয়া শেখ

শূন্যে ভাসছে ইসাবেলা। চোখদুটো একটুকরো কালো কাপড়ে বাঁধা। একা নয় ও। ওকে জড়িয়ে ধরে আছে নিকোলাস। কিছুক্ষণ আগে কথা বলতে বলতে হঠাৎ এক টুকরো কালো কাপড় হাতে নিয়ে নিকোলাস বলেছিল,

“বিশ্বাস কোরো আমায়, বেলা?”

“নিজের চাইতেও বেশি।” জবাব দিয়েছিল ইসাবেলা। মিথ্যা বলেনি ও। দু চোখ বন্ধ করে নিকোলাসকে বিশ্বাস করে এখন। নিকোলাস সন্তুষ্ট হয়েছিল জবাব পেয়ে। ওকে নিয়ে শূন্যে ভাসল। গন্তব্য এখান থেকে বেশ দূরে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে নির্দিষ্ট গন্তব্যের কাছে গিয়ে নামল। পায়ের নিচে নরম ঘাস অনুভব করছে ইসাবেলা। পা ভিজে যায় শিশিরবিন্দুতে। আসার পূর্বে চটি জোড়া পরতে ভুলে গেছে। নিকোলাস ওর হাত ধরে সামনে এগোতে লাগল। কৌতূহল দমাতে না পেরে ইসাবেলা বলল,

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

“বড্ড অধৈর্য তুমি, সুইটহার্ট। আরেকটু সবুর কোরো সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে।” কানে আলতো চুমু দিয়ে চাপা গলায় বলল নিকোলাস। ইসাবেলা মৃদু কম্পিত হলো ওর উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে। গলা ঝেড়ে বলল,

“হু! তোমায়ও একদিন এমন করে চোখ বেঁধে কোথাও নিয়ে যাব। সেদিন দেখব কত ধৈর্য তোমার।”

“তোমার ক্ষেত্রে একেবারে ধৈর্য নেই আমার।” ইসাবেলার হাতের পল্লবে চুমু দিলো নিকোলাস। তারপর আবার বলল,

“তবে কোনো একদিন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ তোমাকে দেবো। তখন চোখ বাঁধো অথবা যা ইচ্ছে হয় কোরো। কিছু মনে করব না।”

নিকোলাস সম্মোহনী গলায় বলল। ওর কথার অর্থ বুঝতে পেরে লাজে রাঙা হয়ে ওঠে ইসাবেলা। গলা দিয়ে আর কথা বেরোয় না। ওর লাজুক মুখ দেখে মুচকি হাসে নিকোলাস। থেমে যায় মূল গন্তব্যে এসে৷

“পৌঁছে গেছি আমরা।” চোখের বাঁধন খুলে দেয় নিকোলাস। ইসাবেলা সামনে চেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সরু এক ঝিরির পাশের ঘন সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত সমতলে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। শুধু এদিককার ঘাসগুলো শুকনো। সামনে কাঠ পুড়ে আগুন জ্বলছে। একটু দূরে তাবু টানানো। তাবুর সামনে সাদা চাদর বেছানো। তার ওপরে সাজানো আছে চিজবোর্ড, ফুল এবং পাশে রাখা বাস্কেটে কুকিজ, শ্যাম্পেইন। শুল্ক পক্ষের চাঁদের আলো নিকোলাসের এই রোমান্টিক প্রয়াসকে আরও খানিক সফল করেছে।

সেই ছোটোবেলা থেকেই ইসাবেলা এমন একটা পিকনিক ডেট-এর স্বপ্ন দেখেছে৷ একসময় মনকে বুঝিয়েছিল সবার সব স্বপ্ন পূরণ হয় না। মনের গোপনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নটা নিকোলাস পূরণ করবে ওর কল্পনাতেও আসেনি। খুশিতে ইসাবেলার চোখ ছলছল করে ওঠে। নিকোলাসের দিকে তাকাল। বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে ওকে। ইসাবেলার দিকে সরাসরি তাকাচ্ছে না। ঘাড়ে হাত নেড়ে বলল,

“তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা বেলা। এর আগে প্রেম কিংবা ডেট কোনোটাই করা হয়নি। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা একেবারে নেই। কিন্তু আমি চাই তোমার সাথে সবকিছু উপলব্ধি করতে । সকল অনুভূতি ভাগ করে নিতে চাই তোমার সাথে। এই যে এসব আয়োজন করেছি সবটাই নিজের ধারণা থেকে। মনে বলছিল তোমার পছন্দ হবে।”

ইসাবেলা আচমকা ওর গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে।

“বুদ্ধু, শুধু পছন্দ হয়েছে? তোমার মতোই তোমার ধারণার প্রেমে পড়ে গেছি। ভালোবাসি তোমাকে, খুব খুব ভালোবাসি।”

নিকোলাস স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। শক্ত করে জড়িয়ে নিলো ইসাবেলাকে। ওর মাথার একপাশের স্কার্ফের ওপর চুমো দিয়ে বলল,

“ভালোবাসি, ভালোবাসি এবং ভালোবাসি।”

কাপড়ের ওপরে বসল মুখোমুখি দুজন। ইসাবেলার দৃষ্টি প্রথমে গেল ফুলদানিতে। ডেইজি, আপেল ব্লসম, রেড টিউলিপ ও রেড রোজের গুচ্ছ না ছুঁয়ে পারল না। নাকের কাছে এনে সুবাস নিলো। এরপরে চোখ গেল সামনের চীজবোর্ডের ওপরে। চীজ, বেরি, সসেজ, ড্রাইফ্রুট, অলিভ, চাটনি ও আপেল দিয়ে সাজানো বোর্ডটি। ইসাবেলা ওখান থেকে একটা বেরি টুপ করে মুখে দিয়ে হেসে তাকাল নিকোলাসের দিকে। আরেকটা তুলে নিয়ে বলল,

“খাবে?”
নিকোলাস মুচকি হেসে মাথা দুদিকে নাড়ায়। পাশের বাস্কেট থেকে শ্যাম্পেইনের বোতল হাতে ছিপি খুলে ওয়াইন গ্লাসে ঢাললো। এগিয়ে দিলো ইসাবেলার দিকে। তারপর নিজের জন্য একটা গ্লাস ভরে সামনে এগিয়ে বলে,

“চিয়ার্স, আমাদের প্রথম ডেট-এর জন্য।”

ইসাবেলা নিজের হাতের গ্লাসটা নিকোলাসের গ্লাসে লাগিয়ে একই কথা বলল। আগেও ইসাবেলা শ্যাম্পেইন পান করেছে, কিন্তু আজকেরটা যেন ভিন্ন রকম। এর স্বাদ অনন্য। শুধু এই শ্যাম্পেইন কেন? এখানে যা আছে সব অন্যরকম। এই রাতের প্রকৃতিও আলাদা, শিহরণ জাগানো, হৃদয় দোলা দিয়ে যাওয়া এক রাত। শীত আসন্ন। রাত বাড়তেই ঠাণ্ডার প্রকোপ বাড়তে লাগল। হাঁটু সমান চকলেট কালার ফ্রক আর ওপরে পাতলা একটা সোয়েটার জড়ানোর ইসাবেলার গায়ে৷ রাতের হিম বাতাস কাঁপিয়ে দেয় ওকে। নিকোলাস ওঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে বলল,

“ওঠো।”

ইসাবেলা ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। নিকোলাসের ঠোঁটের কোণে সারাক্ষণ লেগে আছে ক্ষীণ সম্মোহনী হাসি। এই সুদর্শন যুবকের রূপে বার বার মুগ্ধ হয় ইসাবেলা। এত দেখেও যেন মন ভরে না।
নিকোলাস ওকে নিয়ে এলো তাবুর ভেতরে। বিছানা পাতা সেখানে।

“আজ কি আমরা এখানে থাকব?” বলল ইসাবেলা। নিকোলাস এখনও ওর হাত ধরে আছে।

“যদি তোমার আপত্তি না থাকে।”

“আমার আপত্তি নেই। তোমার সাথে পৃথিবীর যে কোনোখানে থাকতে পারব আমি।” নিকোলাসের বুকে মাথা রাখল। হাতটা ওর হাতের ওপর। নিকোলাস সেটাতে চুম্বন করে। দুজনে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ল পাশাপাশি। নিকোলাসের গলায় মুখ গুঁজে আছে ইসাবেলা। ওর মাথার স্কার্ফ আস্তে আস্তে খুলে ফেললো নিকোলাস। চুলে হাত বুলাতে লাগল। একসময় বলল,

“বেলা, ঘুমিয়ে পড়েছ?”

“উঁহু।” নাক ঘষলো ওর গলায় ইসাবেলা। নিকোলাস একটু যেন কেঁপে ওঠে। গলা ঝেড়ে বলে,

“কাল আমাকে জার্মানি ফিরতে হবে। আমি_” ওর কথা শেষ না হতেই তড়াক করে উঠে বসে ইসাবেলা।

“তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে নিকোলাস?” আতঙ্কে ওর চোখে। অবোধ শিশুর মতো ঠোঁট ফুলিয়ে ফেললো। নিকোলাস ধীরে ধীরে উঠে বসল। দুহাতে বুকে টেনে নিয়ে বলল,

“কে বলেছে ছেড়ে যাচ্ছি?”

“তুমিই তো বললে জার্মানি ফিরতে হবে।”

“ফিরতে হবে মানে একেবারে ছেড়ে যাওয়া না পাগলি মেয়ে। আবার আসব আমি। বলেছিলাম না, আমি যতদূরেই যাই গন্তব্য তোমার কাছেই।”

ইসাবেলা এবার সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে ওকে। গলা ধরে আসে। নিকোলাস ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“বেলা।”

“হুম।”

“গার্লফ্রেন্ড হবে আমার?”

ইসাবেলা মুখ তুলে রেগে তাকায়।

“এতদিন কী ছিলাম তাহলে?”

নিকোলাস হাসল। বলল,

“এটাই ছিলে কিন্তু জিজ্ঞেস করা তো হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মতি চাচ্ছি।”

“ওহ!”

ইসাবেলা ফের শুয়ে পড়ল। নিকোলাস ভুরু কুঁচকে বলল,

“ওহ? এটা তো জবাব হলো না।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে? ঠিকঠাক জবাব দাও বেলা।” নিকোলাস ওকে টেনে উঠিয়ে সামনে বসায়। এতবড়ো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে এমন গা ছাড়া জবাব কেউ দেয়? ইসাবেলা জবাব না দিয়ে গুম মেরে বসে রইল। নিকোলাস মৃদু ধমকের সুরে ফের জবাব চাইতেই সশব্দে কেঁদে ওঠে। বেকায়দায় পড়ল নিকোলাস। গার্লফ্রেন্ড হবে কি না জবাব চেয়েছে। তার জন্য কাঁদতে হবে কেন?

“বেলা, কান্না থামাও।”

ইসাবেলা আরও জোরে কাঁদছে। শেষে উপায় না পেয়ে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দিলো। কান্নার শব্দ গিলে নিলো নিকোলাস। ইসাবেলা আস্তে আস্তে কান্না থামিয়ে দুহাতে নিকোলাসের গলা জড়িয়ে ধরে। আশপাশটা যেন মুহূর্তে তপ্ত হয়ে ওঠে। আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল ইসাবেলা। ঠোঁট ছেড়ে নেমে এলো নিকোলাসের গলায় তারপর আরও নিচে। পরনের শার্ট খুলতে নিকোলাস খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে।

“বেলা! কী করছ?”

গলা শুকিয়ে এলো ইসাবেলার। আসলেই! কী করছে ও? শ্যাম্পেইনের প্রভাব পড়েছে। দ্রুত হাত ছাড়িয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে ওঠে। শ্বাস ভারি হয় ওর। শারীরিক সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই ইসাবেলার। এই নিয়ে কম কথা শোনেনি। নিজের শরীর নিয়েও হীনম্মণ্যতায় ভুগেছে সবসময়। আজ তবে কী হলো? ও কী তৈরি শারীরিক সম্পর্ক করতে? নিকোলাসের জন্য তৈরি ও? মায়ের কথা মনে পড়ল তখনই। মা বলেছিলেন,

“বেলা, তোমার শরীর মন্দিরসম। মন্দির যেমন একমাত্র ঈশ্বরের পূজার জন্য তৈরি। তোমার দেহও তেমনই একজন পুরুষের, তোমার স্বামীর।”

তাড়াতাড়ি মুখ লুকিয়ে উলটো দিকে শুয়ে পড়ে ইসাবেলা। মায়ের এই শিক্ষাকে ধর্ম বলে মেনে এসেছিল এতদিন। আজ এতটা দুর্বল হলো কেন? লজ্জায় ওর মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম। নিকোলাস যেন বুঝতে পারল। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।

“আমার দিকে ফেরো বেলা।”

ইসাবেলা মাথা নাড়ায়। ফিরবে না। নিকোলাস জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর থুতনি তোলে।

“তাকাও আমার চোখে।”

সিক্ত চোখের পাতা তুলে তাকায় ইসাবেলা। নিকোলাস শুধায়,

“একটু আগে যা হয়েছে তারজন্য লজ্জিত তুমি?”

মৃদু মাথা নাড়ায় আনত মুখে ইসাবেলা। নিকোলাস জানে ইসাবেলা সতী। ভয়, হীনম্মণ্যতা থাকবে স্বাভাবিক। তাই তো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে ওর কাছাকাছি এলে। জোর দেয়নি শারীরিক সম্পর্কে। সহজ হলে আপনাতেই সব হবে। আজ হঠাৎ ওর ওমন বোল্ডনেস ওকে বিস্মিত করে। ইসাবেলা এখনও তৈরি নয় ওর জন্য। ওকে ওর চেয়ে ভালো জানে নিকোলাস। ঝোঁকের বসে কিছু করে ইসাবেলা অনুশোচনা করুক নিকোলাস চায় না সেটা। থামিয়ে দিয়েছিল সে জন্য। ও যে সঠিক কাজ করেছিল তার প্রমাণ ইসাবেলার এখনকার আচরণ। ওর চোখেমুখে পাপবোধ ফুটে উঠেছে। সতী বলে শারীরিক সম্পর্কে ভয়, লজ্জা থাকতেই পারে কিন্তু পাপবোধ কেন থাকবে? ও কী সম্পূর্ণভাবে নিকোলাসকে চায় না? পিশাচ বলে ওর দেহকে ঘৃণা করে? চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল নিকোলাসের ।

“কেন?” জানতে চাইল নিকোলাস। নিজের মায়ের শিক্ষা ধীরে ওর সামনে প্রকাশ করে ইসাবেলা। স্বামী ভিন্ন কাওকে দেহ সমর্পণ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল চার্চের গিয়ে। আজ তা ভঙ্গ করতে যাচ্ছিল বলে অনুতাপের শেষ রইল না।

“তাহলে তুমি আমাকে চাও না?” নিকোলাসের প্রশ্নে চমকে তাকায়। ঢোক গিলে বলে,

“চাই, তোমাকেই চাই। কিন্তু_”

“কিন্তু এভাবে নয় তাইতো?”

ফের মাথা নাড়ায় ইসাবেলা। আজ এই ঘটনা ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে নিকোলাসকে ও কতটা চায়। কিন্তু ধর্ম বিসর্জন দিয়ে চাইতে গেলেই যে থমকে যায় বিবেকের দংশনে। নিকোলাস নিশ্চয়ই এমন মেয়েকে চাইবে না। অপেক্ষা করবে না বিয়ে পর্যন্ত। আদপে কী বিয়ে করতে চায় ও? অবিশ্বাসী ও। বিয়ে নামক সামাজিক, ধর্মীয় বন্ধনে বাঁধতে ঘোর আপত্তি করবে। কেন ভাবেনি এই কথাগুলো আগে ইসাবেলা! এখন কী হবে? কী করে এগোবে এই সম্পর্ক? এই সম্পর্কের ভবিষ্যতই বা কী?

ইসাবেলা সরাসরি তাকায় নিকোলাসের দিকে। গভীর ভাবনায় ডুবে আছে ও। ও কী ইসাবেলার মতোই ভাবছে? দুজনের দৃষ্টি তখনই এক হলো। মুখে না বললেও ওরা যেন পরস্পরের মনের কথা বুঝে নিলো। কেউ আর কোনো কথা বলল না।

কঠিন নীরবতা নামল চারপাশে। অদূরে হায়েনার ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ। হিটলার চুক্তি ভঙ্গ করে রাশিয়া দখলের প্লান কষেছে। কয়েকটি শহর ইতোমধ্যে দখলে নিয়েছে। ওদের অতর্কিত আক্রমণে জোসেফ স্ট্যালিন খানিকটা ভড়কে গেছেন। তার সৈন্যরা সুবিধা করে উঠতে পারছে না হিটলারের সৈন্যদের সাথে। হিটলাকে বিশ্বাস করা ভুল ছিল। সেই ভুলের মাশুল গুনছেন এখন তিনি। হিটলারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ছিল নিকোলাসের। ও দেশের ওপর কর্তৃত্ব করবে আর ওর ওপর করবে নিকোলাস। তারপর একে একে পৃথিবীর সমস্ত দেশের ওপর অধিপত্যে গড়ে তুলবে৷ সেসব দেশের প্রধানরা হবে ওর হাতের পুতুল। এমনই পরিকল্পনা করে এসেছিল এতদিন। কিন্তু ইদানীং ও বদলে যাচ্ছে। শুধু ও নয় ওর চিন্তা-ভাবনা, মন মানসিকও বদলে যাচ্ছে। এর কারণ ইসাবেলা। ইসাবেলা ছাড়া আর কিছুতে ওর মন লাগে না। ক্ষমতার লোভ এখন আর আগের মতো ওকে আকর্ষণ করে না। মানুষ থাকতে কৈশোরে একটা সুখী পরিবারে স্বপ্ন দেখতো। মা, ম্যাক্স ও নোভা ছাড়াও একজন সঙ্গিনীকে কল্পনা করতো সেই পরিবারে। যদিও কাওকে তখনও মনে ধরেনি। কিন্তু মনে মনে একজনের ছবি আঁকত। ঠিক ওর মায়ের মতো কোমল, সরল একজন ওর জীবনে আসবে। আহামরি সুন্দর না হোক ওকে ভীষণ ভালোবাসবে। পাশে থাকবে বিশস্ততার সাথে। যাকে একসময় বিয়ে করবে, সন্তান হবে। একসাথে বৃদ্ধ হবে দুজন, হাতে হাত রেখে শেষ নিঃশেষ ত্যাগ করবে। জীবনের বুঝি অন্য ভাবনা ছিল। অতি সাধারণ সেই চাওয়াটুকুও অপূর্ণ রয়ে যায়। মায়ের দেখানো পৃথিবী পালটে দেয় ওর পিতা। চোখের নিমেষে ভয়ংকর নির্মমতার কালো ছায়া ওকে গ্রাস করে ফেলে। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সব স্বপ্ন। পাপের নরকে বিসর্জন দেয় নিজের আত্মাকে। অন্তঃসারশূন্য নিকোলাস। ওর আত্মার দখল শয়তানের মুষ্টির ভেতর। আত্মা ছাড়া মানুষ হওয়া যায় না। সামাজিকতা কেবল মানুষকেই মানায়। এই সমাজে নিকোলাস এখন বেমানান। ইসাবেলার মতো একজন ছিল মানুষ নিকোলাসের স্বপ্নের সঙ্গিনী। এখন এই নিকোলাসেরও। বড্ড অসময়ে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ভবিষ্যৎ না ভেবেই এতদূর এগিয়েছে ওরা৷ এতদূর যে এখন আর পেছন ফেরার সুযোগ নেই। বাহুর ওপর ইসাবেলা হাত রাখতে চমকে ওঠে নিকোলাস।

“আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী নিকোলাস?”

“আমি জানি না বেলা।” হতাশ গলায় বলে,

“আমাদের সম্পর্কের নিশ্চিত কোনো ভবিষ্যৎ আমার জানা নেই। আমার ভয় হয় একদিন না আমার কারণে তোমাকে সব হারাতে হয়। ধর্ম, সমাজ, পরিবার হয়তো জীবনও। আমি সত্যি মন থেকে তা চাই না। একটু আগে জানতে চেয়েছিলাম তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড হবে কি না। এই অল্প সময়ের ব্যবধানে সব কেমন বদলে গেল। এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাকে ছাড়াই তুমি হয়তো ভালো থাকবে।”

“আর তুমি? আমাকে ছাড়া তুমি ভালো থাকবে?”

নিকোলাস কথা বলে না। ইসাবেলা কাছে এলো। গালের একপাশে হাত রেখে বলল,

“ছেড়ে যাওয়ার কথা বোলো না আমাকে নিকোলাস। আমি বোধহয় মরেই যাব তোমার বিরহে এবার।”

“আমিও বেলা। তুমিহীন আমিও ধ্বংস হয়ে যাব।”

“তাহলে আর ছেড়ে যাওয়ার কথা বলব না আমরা। ওয়াদা করো সামনে যত বাধা আসুক একে অপরের হাত ছাড়ব না।”

“ওয়াদা। তুমি আমার, তোমার হৃদয় আমার। আমার বেলাতেও একই কথা।”

পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে ওরা। খানিক পরে ইসাবেলা বলল,

“আবার কবে ফিরবে?”

“সপ্তাহে খানেক পরে।”

“নিকোলাস।”

“হুম?”

“আমি তোমাকে চাই, সম্পূর্ণভাবে।”

নিকোলাস ওর মুখ দুহাতের মাঝে তুলে চোখে চোখ রাখল। ইসাবেলা মন থেকেই কথাগুলো বলেছে। ওর চোখের চাহনিতে সেই আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট।

“ঈশ্বরকে দেওয়া তোমার প্রতিজ্ঞার কী হবে? আমি পরে তোমার মাঝে অনুশোচনা দেখতে পারব না বেলা।”

“তবে কী পুরোপুরি তোমাকে পাব না আমি? আমাকে পেতে ইচ্ছে করে না তোমার?”

“তুমি ধারণাও করতে পারবে না কতটা চাই তোমাকে। কিন্তু আমার চাওয়া পূরণ করতে তোমাকে পাপী হতে দিই কী করে? একটু সময় দাও। কথা দিচ্ছি সব ঠিক করে দেবো। আমি তুমি শীঘ্রই পুরোপুরি এক হব। আমাদের মাঝে না থাকবে শারীরিক দুরত্ব আর না এমনি দুরত্ব।”

ইসাবেলা নিরাশ মুখে তাবুর ওপরে শূন্য চোখে চেয়ে আছে। জীবনটা জটিল কেন? যা চায় কেন সহজে মেলে না? ঈশ্বরের কাছে করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে পাপ হবে। ইসাবেলা বরাবরই পাপ করতে ভয় পেয়েছে, কিন্তু আজ এই ক্ষণে পাপের ভয়ের চেয়ে বড়ো ভয় নিকোলাসকে হারিয়ে ফেলার। এই শারীরিক দুরত্ব পাছে নিকোলাসকে ওর থেকে আরও দূর করে না দেয়!

“তুমি বড্ড বেশি ভাবছ, বেলা। বলেছি তো সব ঠিক করব আমি। বিশ্বাস হয় না আমাকে?” বলল নিকোলাস।

“খুব হয়। কিন্তু _”

নিকোলাস বাকি কথা বলার জন্য ওর ঠোঁটদুটোকে সুযোগ দিলো না। বাইরে জ্বলতে থাকা আগুন নিভে গেল ধীরে ধীরে। জ্যোৎস্না স্নাত রাতটা ক্রমশ গাঢ় হয়। দুজনের হৃৎস্পন্দনের শব্দ আর ঘাসে শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ মিলেমিশে একাকার এই নিশুতিতে।

চলবে,,,

বিশ্রীরকমের রাইটিং ব্লকে পড়েছি। বহুকষ্টে কয়েকশ শব্দ লিখেছি তারপর আবার ডিলেট করেছি। গত কয়েকদিন এই চলছিল। আজ লিখেও পুরোপুরি তৃপ্তি পাইনি। তবে আপনাদের ভালো লাগলে ভালো লাগবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here