তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব–৭০

0
618

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৭০
Writer তানিয়া শেখ

তিনতলার একেবারে পুবদিকে ইসাবেলার নানা মার্কোভিক ম্যাক্সওয়েলের স্টাডি রুমটা।
সোজাসুজি কড়িডোর ধরে দু পা সামনে এগোলে শেষ প্রান্তের জানালাটা চোখে পড়ে। তুষার জমে সাদা আস্তরণ পড়েছে তাতে। বাইরের তীব্র ঠাণ্ডা বাড়ির ভেতরে এসে মিইয়ে গেছে ফায়ারপ্লেসের আগুনের তাপে। তাপ এমন নয় যে গায়ে ঘাম ছোটে। তবুও ইসাবেলা ঘামছে। এর কারণ ওর মনের ভীতি। নানা মার্কোভিকের স্টাডি রুমে আসার অনুমতি সকলের নেই। ইসাবেলা এসেছ নেহাৎ নিরুপায় হয়ে।কোনোভাবে যদি ধরা পড়ে যায় তবে আর রক্ষে নেই৷ কেন এখানে এসেছে? প্রয়োজন কী? আরও কত প্রশ্ন! ইসাবেলাকে সকলে স্নেহ করে ও ভালোবাসে। পরিবার এবং বংশে ভালো মেয়ে বলতে যা বোঝায় সবটাই ওর আছে। আজ ধরা পড়লে সবাই বাঁকা চোখে তাকাবে। যারা সোজা চাহনীতে অভ্যস্ত তাদের আবার বাঁকা নজর অসহ্যের ও অসম্মানের। দরজা খোলার আগে কড়িডোরের রেলিং ধরে সাবধানে নিচে তাকাল। হলঘরে এই মুহূর্তে পার্টি চলছে। তাতিয়ানা আর মাতভেইর বাগদানের পার্টি। তাতিয়ানা যে এত সহজে বাগদানে মত দেবে ইসাবেলার কল্পনাতীত ছিল। অবাক হয়েছে বাকিরাও। স্থায়ী সম্পর্কে বরাবরই অনাসক্তি দেখিয়ে এসেছে। এই ক মাসে মাতভেইর সাথে সম্পর্কের উন্নতি হলেও বিয়েতে রাজি ছিল না। কয়েকদিন আগে নানা মার্কোভিক ওকে স্টাডি রুমে ডেকে নেয়। দুজনের মধ্যে কী কথা হয়েছে এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে মার্কোভিক ঘোষণা করল আজ ওদের বাগদান হবে। তাতিয়ানাও জানালো এতে ওর অমত নেই। খুশি তো সবাই হয়েছিল। তবে মাতভেইর খুশি অন্তরিক্ষে পৌঁছায় যেন।
যুদ্ধের কারণে পার্টিটা জমে ওঠেনি। সকলেই এই যুদ্ধ নিয়ে চিন্তিত। হিটলারের সৈন্যরা ক্রমশ মস্কোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ওদেরকে রুখতে শুধু এদেশের সরকার বাধা হয়নি, আবহাওয়াও বৈরিরূপ দেখাচ্ছে। মার্কোভিক সহ বাড়ির পুরুষেরা দেশের ভবিষ্যত নিয়ে আলাপে মগ্ন। ইসাবেলা সেই সুযোগে সবার অলক্ষ্যে ওপরে চলে এসেছে। কড়িডোরের রেলিং ছেড়ে স্টাডি রুমের দরজার সামনে দাঁড়ায়। লম্বা শ্বাস নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। নিকষ কালো অন্ধকারে আবদ্ধ রুমটা। আসার সময় মনে করে একটা মোম আর দিয়াশলাই এনেছিল ইসাবেলা। এখন সেটা কাজে লাগল। এই রুমে আগে আসেনি ও। বিশাল বড়ো বুক সেলফ ভর্তি হাজার হাজার বইয়ের দিকে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইল। এত বই একসাথে পূর্বে দেখেনি। এই রুমটা বেশ পরিপাটি করে গুছানো৷ এই দায়িত্বটা পালন করে এ বাড়ির পুরাতন ও বিশ্বস্ত ভৃত্যা তিখন কারাতে। চারপাশে তাকিয়ে তিখনের কাজের প্রশংসা আপনাআপনিই করল ইসাবেলা। প্রৌঢ়া এই বয়সেও কী নিখুঁত কাজ করে! রুমের মাঝামাঝি লম্বা স্টাডি টেবিলটা। তার সাথে লাগোয়া তিনটে চেয়ার। একটা মার্কোভিক ম্যাক্সওয়েল পেট্রবের এবং বিপরীতের দুটো অতিথিদের জন্য। বাতিদান খুঁজে আলো জ্বেলে নিলো ইসাবেলা। তারপর যে কাজে এসেছিল তাই শুরু করে। ড্রয়ার, টেবিলের কাগজ খুঁজে হতাশ হতে হলো ওকে। শেষ আশা সামনের বিশাল বড়ো বুক সেলফ। এত বইয়ের মাঝে কাঙ্ক্ষিত বইটি খুঁজে পাওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ইসাবেলার হাতে সময় কম। কী করবে তাই যখন ভাবছিল তখনই সোঁদা মাটির সেই হৃদয় ব্যাকুল করা গন্ধটা নাকে এলো। চকিতে ঘুরে তাকাল বাম দিকে। বাতিদানের মৃদু আলোয় নিকোলাসের মুখটা অপার্থিব লাগছে। ঠোঁটের কোণে সেই হৃদয় কাঁপানো হাসি। দু’হাত মেলে দিতে ওর বুকে আছরে পড়ল ইসাবেলা।

“নিকোলাস, আমার নিকোলাস।” কাঁধ জড়িয়ে মিশে যেতে চাইল ওর ভেতর ইসাবেলা। আনন্দের আতিশয্যে কাঁদল। নিকোলাস বাহুবন্ধন শক্ত করে। ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দেয়। ইসাবেলা তাতে সাড়া দিয়ে স্বাগত জানায় প্রিয়তমকে। এক সপ্তাহের বিরহ যেন পরস্পরকে এভাবে আঁকড়ে ভুলতে চায় ওরা। কিছু সময় পর দুজনই শান্ত হয়। ইসাবেলার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দই তখন কেবল প্রতিধ্বনিত হয় দেওয়ালে দেওয়ালে। নিকোলাস বাহুবন্ধন সামান্য ঢিলে করতে মেঝেতে পা রাখে ইসাবেলা। ওর ফ্রকের ভেতর থেকে এক টুকরো সাদা কাগজ মেঝেতে পড়ে৷ কালো মেঝেতে সহজে সেটা নিকোলাসের নজরে এলো।

“ওটা কী?” জিজ্ঞেস করল ইসাবেলাকে। জবাবের অপেক্ষা না করেই ঝুঁকে হাতে তুলে নিলো। ঘাবড়ে যায় ইসাবেলা। পাছে কাগজটা দেখে ভুল বোঝে ওকে! কাগজটা হাতে নিয়ে মুখ তুলে আবার ইসাবেলাকে দেখল নিকোলাস। ওর ঘাবড়ে যাওয়াটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে মুখে। কী লুকাচ্ছে আবার ও?

“বেলা!” কড়া সুরে ডাকল নিকোলাস। ইসাবেলা ভীত চোখে কাগজটার দিকে চেয়ে বলল,

“কথা দাও অবিশ্বাস করবে না।”

“কোনোদিন না।”

ইসাবেলা চোখ তুললো। নিকোলাসের স্থির চোখজোড়া ওর কথার সত্যতা নিশ্চিত করে। কিছু বলবে তখনই দরজার ওপাশে জুতার খটাখট শব্দ শুনে ভীত হয়ে ওঠে। নিকোলাস হাত চেপে ধরে আতঙ্কিত গলায় বলে,

“এখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো আমায়। তাড়াতাড়ি।”

নিকোলাসের প্রশ্নাত্মক চাহনি দেখে বলল,

“সব বলব আমি। এই মুহূর্তে এখান থেকে নিয়ে চলো আমাকে। প্লিজ!” কাতর শোনাল এবার ওর গলা। আর কোনো প্রশ্ন করল না নিকোলাস। দরজার খোলা আগ মুহূর্তে ওকে জড়িয়ে ধরে হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই হাওয়ার দাপটে নিভে গেল বাতিদানের আলো। মার্কোভিক খোলা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে সামনের অন্ধকারে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন।

“মঁসিয়ে, কোনো সমস্যা?” পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তিখন। মার্কোভিকের গম্ভীর মুখটার একাংশ দেখতে পাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ পর শুনতে পেল,

“না।”

পার্শ্ববর্তী একটি পার্কের নির্জন লেকের পাড়ে এসে বসল ইসাবেলা ও নিকোলাস। কাগজটি এখনও নিকোলাসের হাতে, কিন্তু খোলা। ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে ইসাবেলা। বুঝতে চাইছে প্রতিক্রিয়া। শক্ত ঠোঁট দুটোর এককোণা বেঁকে গেল। হাসছে! ভুরু কুঁচকে যায় ইসাবেলার৷ কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছে। কাগজটির লেখা পড়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে নিকোলাস। দম্ভ কতটা অন্ধ করেছিল ওকে! ভেবেছিল ওকে শেষ করার সাধ্য কারো নেই। ফাদার জালোনভ সেই দম্ভ চুর্ণ করেছেন। আজ তিনি বেঁচে থাকলে নিকোলাস অস্তিত্ব মিটে যেত হয়তো। আন্দ্রেইর কারণে লক্ষ্যের দোরগোড়ায় গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন ফাদার জালোনভ। আন্দ্রেই! নিকোলাসের বুকের ভেতরটা মুচরে ওঠে। দুচোখ বন্ধ করে মনে মনে জপে,

“শক্ত করতে হবে মনটাকে নিকোলাস। আরও কঠিন হতে হবে৷ ভুলে যা ওই প্রতারককে, ভুলে যা।”

“নিকোলাস!” ধৈর্যের বাধ ভাঙে ইসাবেলার। নিকোলাস চোখ মেলে তাকায় প্রেয়সীর দিকে। উৎকণ্ঠা ইসাবেলার চোখে-মুখে। জানতে উদগ্রীব কাগজে লেখা রহস্য।

“কাছে এসো বেলা।” ইসাবেলা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাছ ঘেঁষে বসে। নিকোলাসের তবুও মন ভরে না। টেনে কোলে বসিয়ে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজলো।

“এর ভেতরে কী লেখা তা জানতে মার্কোভিকের স্টাডি রুমে গিয়েছিলে?”

নিকোলাস আলতো করে নাক ঘষে ইসাবেলার গলায়। শিহরণে জড়সড় হয়ে গেল ইসাবেলা। নিকোলাসের শীতবস্ত্র এখন ওর পরনে। তবুও কাঁপছে। শীতে নয় শিহরণে।

“হুম?” নিকোলাস ফের প্রশ্ন করতে ধাতস্থ হয় ইসাবেলা।

“হুম।” কোনোমতে জবাব দিলো ও। সরে বসতে চায়। নিকোলাস ছাড়ে না। এমন করলে মনোযোগ কীভাবে দেবে ইসাবেলা?

“ওখানে এর জবাব পাবে কী করে বুঝলে?”

“গতকাল দুজন আগন্তুক এসেছিল নানার কাছে। বসার ঘরে কথা বলছিল তাঁরা। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ওদের হাতে একধরনের সাংকেতিক চিহ্ন সংবলিত কাগজ দেখতে পাই। নানার কাছে এর অর্থ জানতে এসেছিলেন ওঁরা। তিখনকে জিজ্ঞেস করলে ও বলল নানা কাছে এসব সাংকেতিক চিহ্ন বুঝার বই আছে। আমাদের কোনো এক পূর্ব পুরুষ বইটা লিখেছিলেন। সেটাই খুঁজতে গিয়েছিলাম।” থামল ইসাবেলা। নিকোলাস নীরবতা ভেঙে বলল,

“আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারতে। তোমার কাছে কিছু গোপন করতাম না আমি।”

অপরাধীর মতো মুখ করে ইসাবেলা বলল,

“ক্ষমা করো আমাকে। আমি তোমায় অবিশ্বাস করি না। কাগজটা আমাকে খুব বেশি কৌতূহলী করে তুলেছিল।”

একটু চুপ করে নিকোলাস বলল,

“কাগজটা আমাকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট বেলা। আমার প্রাসাদের ম্যাপ রয়েছে এতে। আমাকে খুব সহজে শেষ করা যেত এই কাগজের সূত্র ধরে।”

ইসাবেলা খামচে ধরেছে নিকোলাসের কাঁধের শার্ট। এমন কিছুই আশঙ্কা করেছিল ও। তাই তো এত রিস্ক নিয়ে স্টাডি রুমে যাওয়া। নিকোলাসের বিপদ আশঙ্কা ওর নিদ্রা কেড়ে নিয়েছিল। নিকোলাস আবার বলল,

“অহংকার মানুষকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়। কথাটা এতদিন শুনেছি। আজ মর্মে মর্মে অনুধাবন করলাম। আন্দ্রেইর না থাকলে এই অহংকার আমাকে কবেই শেষ করে দিতো। তোমার ভালোবাসা আমার আর পাওয়া হতো না। কতটা আফসোস আর শূন্যতা নিয়েই না সমাপ্তি ঘটত এই আমার! আন্দ্রেই কেন তোমার সাথে এমন করল বেলা? কেন বুঝল না আমাদের ভালোবাসা? এতটা জেদ না করলেই কী হতো না ওর?” নিকোলাসের বিমর্ষ গলা ইসাবেলাকে চিন্তায় ফেলে। ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল। নিকোলাস কি সব জেনে গেছে তবে?

“তু..তুমি সব জেনে গেছো!” আমতা আমতা করে ইসাবেলা। নিকোলাস মাথা নাড়ায়।

“কেন সত্যি বলোনি বেলা?” অভিযোগ তোলে নিকোলাস। ইসাবেলা নিচু গলায় বলে,

“তোমাদের সম্পর্ক আমার কারণে নষ্ট হোক তা আমি চাইনি নিকোলাস। কী করে জানলে তুমি?”

নিকোলাস এড়িয়ে গেল সে প্রশ্ন। দু’হাতে ওর কটিদেশ জড়িয়ে ধরে আরও নিকটে এনে বলল,

“কথা দাও এরপর আমাদের মাঝে আর কোনো গোপনীয়তা থাকবে না। কিছু লুকাবে না কোনোদিন।”

“কথা দিলাম।”

দ্বিধাহীন ওয়াদা ইসাবেলার। ঝুঁকে নিকোলাসের কপালে কপাল রাখল। দুজনে একে অপরের চোখে হারিয়ে গেল সেই মুহূর্তে। এই অন্ধকার চাদর হয়ে জড়িয়ে নিলো ওদেরকে৷ দু’জোড়া ঠোঁট কাছাকাছি এসে আলতো করে ছুঁয়ে যায়। নিকোলাস নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মন্ত্র জপতে থাকে। কনকনে হাওয়ায় বয়ে এলো রোমাঞ্চকর তপ্ততা। ইসাবেলার ওষ্ঠজোড়া থরথর করে কাঁপছে। চোখ বন্ধ। নিকোলাস একবার ওর কম্পিত ঠোঁটে তারপর মুদিত নেত্রপল্লব দেখল। চাপা গলায় বলল,

“কতটা ভালোবাসো আমায় তুমি বেলা?”

ধীরে ধীরে চোখ মেলে ইসাবেলা। স্থির ওর চাহনি। অবিচলিত কণ্ঠে বলল,

“ভালোবাসা নিক্তিতে মাপতে জানি না আমি নিকোলাস। যদি জানতাম তবে পরিমাপটা বলে দিতে পারতাম। তবে এইটুকু জেনে রেখো, প্রেমের রেজিস্ট্রার অফিসে আমার সবটা এখন তোমার নামে দলিল হয়ে গেছে। তুমি চাইলেই আমি বাঁচি, আবার মরতেও পারি।”

নিকোলাস দুহাতে ওর মুখটা ধরে ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিলো। একফাঁকে বলল,

“তুমি আমার আত্মসংযমের জন্য বড্ড হানিকর বেলা, বড্ড হানিকর।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here