তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব–৬৯

0
369

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৬৯
Writer তানিয়া শেখ

কাউকে বিশ্বাস করা নিকোলাসের পক্ষে সহজ ছিল না। তবুও আন্দ্রেইকে বিশ্বাস করেছিল। ইসাবেলাকে নিয়ে যা বলেছিল ছেলেমানুষী ভেবে গুরুত্ব দেয়নি তখন। কে জানত ওই জায়গাতেই ভুল করেছে নিকোলাস। আন্দ্রেই নিজেকে ঠিক দেখাতে এতটা নীচে নামতে পারল! ক্রোধের তীব্রতায় নিকোলাসের মস্তিষ্ক টগবগ করে ফুটছে। বহুবছর পরে আবার সেই প্রতারিত হওয়ার অনুভূতি ফিরে এলো। আপনজনের প্রতারণা বড্ড দুঃসহ। বিশ্বাস হারিয়ে গেলে সেখানে সকল সম্পর্ক অর্থহীন। নোভার অপরাধ আন্দ্রেইর চেয়ে নগন্য হলেও নিকোলাস বোনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। রাগই ওর বড়ো শত্রু। রাগ ওকে বিধ্বংসী করে তোলে। আপন পরের হিসেব তখন আর থাকে না। চিৎকার করে জানিয়েছে আর কোনোদিন আন্দ্রেইর মুখ দেখবে না। আন্দ্রেইকে ও ক্ষমা করবে না। কমিউনিটির নিয়ম অনুযায়ী প্রতারণার শাস্তি মৃত্যুদন্ড অথবা নির্বাসন। রাজা ছাড়া কেউ এই শাস্তির উর্ধ্বে নয়। সুতরাং নোভা এবং আন্দ্রেইকে শাস্তি দেওয়ার জন্য মিটিং বসল। যেহেতু নিকোলাস আন্দ্রেইর মুখ দেখবে না বলে জানিয়েছে তাই ওকে পাশের কক্ষে বসতে হয়েছে।

ভাই ওর মুখ দেখবে না। এ সেই ভাই যার কারণে আন্দ্রেই পিশাচ হতে দু’বার ভাবেনি। যাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে। নিজের সর্বস্ব দিয়ে যার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছিল। ইসাবেলাকে নিকোলাসের থেকে দূর করতে চেয়েছে নিকোলাসের ভালোর জন্য। এই ভালো করতে গিয়ে খারাপ বনে গেছে ও। বিশ্বাস ভেঙেছে ভাইয়ের। মানুষ আর পিশাচে মাঝে কি কোনো সম্পর্ক হয়? হয়, শত্রু শত্রু সম্পর্ক হয়। ইসাবেলা শত্রু বংশের কন্যা। কী করে বিশ্বাস করবে ওকে আন্দ্রেই? সেই শত্রুর বংশের মেয়ের জন্য আজ কি না ভাইকে ত্যাগ করতে দু’বার ভাবল না নিকোলাস! পাগলের মতো নিঃশব্দে হাসল আন্দ্রেই।

“ঠিক হয়েছে। খুব ভাই ভাই করেছিলি না? দ্যাখ, এবার। দ্যাখ, তোর সেই ভাই আজ তোকে কত সহজে ত্যাগ করল। ওই শয়তানটার জন্য কত কী করেছিস! বিনিময়ে কিছু পেয়েছিস তুই? ওর ভালো করতে গিয়ে আজ শেষ হতে যাচ্ছিস আন্দ্রেই।” পাশে বসে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন সোফিয়া। মানুষ হলে এখন তিনি কেঁদেকেটে অস্থির হতেন। কাঁদতে পারছেন না বলেই রাগটা আরও বাড়ছে। আন্দ্রেই বিরক্ত হয়ে বলল,

“কানের কাছে ঘ্যানঘ্যানানি বন্ধ করো।”

“আমি কিছু বললেই ঘ্যানঘ্যানানি, না? মায়ের কষ্ট তুই কি বুঝবি?”

আন্দ্রেই শব্দ করে হেসে ওঠে।

“মায়ের কষ্ট! বাহ! শুনতে ভালোই লাগল।” হাসি থামিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

“এই কষ্ট কোথায় ছিল যখন দুধের শিশুকে দিনের পর দিন দাসীর কাছে ছেড়ে দিয়েছিলে? তুমি জানো ক্ষুধা- তৃষ্ণায় আমি যখন মা মা করে চিৎকার করতাম ওই দাসিগুলো কী করত? জানো না। কী করে জানবে? কখনো তো বলিইনি তোমাকে। আজ বলব কারণ তুমি আমাকে মায়ের কষ্ট বুঝাতে চাইছ না? আজ তোমাকে আমি সন্তানের কষ্ট বুঝাব। দাসীরা আমার কান্না থামাতে ব্যর্থ হয়ে মুখে কাপড় গুঁজে দিতো। তাতেও না থামলে মুখের ওপর বালিশ চেপে ধরেছে। শ্বাস নেওয়ার জন্য হাত পা ছুঁড়তাম আমি। ওই দৃশ্য ওদের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠল। অবুঝ আমি। তোমাকে দেখে চোখের পানিতে সেসবই বলতে চাইতাম। মায়েরা না কি সন্তান না বলতেই সব বোঝে। আমি তোমায় কত ইঙ্গিত দিলাম তুমি তবুও বুঝলে না। দাসীদের কড়া সুরে আদেশ দিলে তোমার ছেলে যেন এক মুহূর্তের জন্যও না কাঁদে৷ ওরা সত্যি এবার আমার কান্না বন্ধ করল। কীভাবে শুনবে? আফিম খাইয়ে। এবার তুমি খুশি হলে। তোমার ছিঁচকাঁদুনে ছেলেটা হঠাৎ ঝিম মেরে গেল বলে খানিক অবাকও হলে। কিন্তু এর বেশি বুঝতে যাওয়ার সময় কোথায় তোমার? স্বামীকে দখল করতে হবে তো! তাঁর মন আবার প্রথম স্ত্রীর প্রতি দুর্বল। পাছে তোমাকে ছেড়ে দেয়! সেই ভয়ে সারাক্ষণ স্বামীর সাথে ছায়ার মতো থাকো। তাঁর মনকে বশ করার চেষ্টায় তুমি আমাকে একেবারে ভুলে গেলে। মায়ের একটু ভালোবাসা, একটু মমতার পরশের জন্য ছটফট করে কেটেছে আমার শৈশব। কোথায় ছিলে তখন তুমি মা? মা! হ্যাঁ, এই শব্দে আমি সেদিনও ভীত কণ্ঠে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি, যেদিন ওই দাসীদের একজন আমায় শরীরের নিচে দলিতমথিত করেছে। তুমি আসোনি মা। কতরাত সেই কষ্ট থেকে বাঁচতে তোমায় ডেকেছি। তুমি শুনতে পাওনি। আমার কষ্ট দূর করতেও আসোনি। আর তুমি কি না বলছ আমি তোমার কষ্ট বুঝি না।”

“চুপ করো। চুপ করো।” সোফিয়া কানে হাত দিয়ে বলে ওঠেন। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সোফিয়া ভালো প্রেমিকা হয়েছেন, স্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু ভালো মা হয়ে ওঠা হয়নি তাঁর। সন্তান জন্ম দিলেই মেয়েলোক মা হয়ে ওঠে না। মা হতে মমতা লাগে, টান লাগে। সোফিয়ার তা ছিল না তখন। অল্প বয়সে মা হয়েছেন নিতান্ত অনিচ্ছায়।আন্দ্রেইকে তিনি পেটে ধরেছিলেন রিচার্ডের সাথে সম্পর্ক শক্ত করতে। করেওছেন সেটা। বাবা হিসেবে রিচার্ড মোটেও দায়িত্বশীল, যত্নশীল নন। আন্দ্রেইর প্রতি তেমন টান তাঁর ছিল না। ওর কারণেই সোফিয়াকে না চাইতেও বিয়ে করতে হয়েছে। মনে মনে বিরাগ ছিল তাই আন্দ্রেইর প্রতি। এই বিরাগে ছেলেকে কাছে টানেননি। সোফিয়ার সেদিকে কোনো খেয়াল ছিল না। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে ধরে রাখতে গিয়ে পৃথিবীর সব উপেক্ষা করেছেন। একমাত্র সন্তানকেও। এই উপেক্ষার পরিণাম এত ভয়াবহ হবে সোফিয়ার কল্পনাতীত ছিল। নিজেকে এখন পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মা মনে হচ্ছে। মায়েরা নিঃস্বার্থ হয়, তিনি স্বার্থপর। মায়েরা মমতাময়ী হয়, তিনি পাষাণ। তবুও আন্দ্রেই তাঁকে মা ডাকে৷ তবুও তিনি মা। মা হয়ে তিনি সন্তানকে আগলে রাখতে পারেননি। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়।
আন্দ্রেই চুপ করে হয়ে গেল। দুচোখ বন্ধ করে। চোখের সামনে বাল্যকালের দুঃসহ স্মৃতি ভেসে ওঠে। শক্ত হয়ে আসে দেহটা।

নিকোলাসের রাজদরবারে পিশাচ কমিউনিটির উচ্চপর্যায়ের সকল সদস্য উপস্থিত। গম্ভীর মুখে আন্দ্রেই ও নোভার শাস্তি নির্ধারণ নিয়ে কয়েকজন আলাপ করছেন। রিচার্ড এককোণে বসে চুপচাপ দেখছেন, শুনছেন। মৃত্যু অথবা নির্বাসন। শব্দ দুটো তাঁকে পৈশাচিক আনন্দ এনে দিচ্ছে। বাবা হিসেবে এমন আনন্দিত হওয়া ঠিক না। ভেতরের পৈশাচিক আনন্দ একটু যেন ফিকে হলো। ভালো-মন্দের পার্থক্যবোধ এখনও একেবারে ধুয়েমুছে যায়নি। কিন্তু যখনই সামনের সিংহাসনের দিকে তাকান ওই পার্থক্যবোধটুকু লাথি মেরে সরিয়ে দেন। লোভে চকচক করে ওঠে চোখদুটো। অতীত সোনালি দিন স্মরণ হয়। কত প্রতাপ, প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। এতদিন সিংহাসনে থাকলে অর্ধেক পৃথিবীর শাসন হাতের মুঠোয় চলে আসতো। এই অপ্রাপ্তি, ক্ষমতাশূনতার কারণ ওই নিকোলাস আর আন্দ্রেই। নোভাও ভাইদের দলেই ছিল। বহু বছর ওরা তাঁকে বন্দি করে রেখেছিল। সেই সব কষ্টের দিনগুলো আরও প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। বাবা নন তিনি। এরা বাবা বলে মেনেইছে বা কবে! এরা কেবল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী। একে একে যাদের পরাজিত করবেন।ক্ষমতারলোভ তাঁকে বিবেকহীন, বিকারগ্রস্ত করে। রিচার্ডের দৃষ্টি স্থির নিকোলাসের দিকে। থমথমে মুখে অন্যমনস্ক হয়ে সিংহাসনে বসে আছে ও। আপনজনের কাছে ফের একবার প্রতারিত হয়েছে। এবারও এর পেছনে কলকাঠি রিচার্ডই নেড়েছেন৷ একমাত্র তাঁরই তো জানা ওর দুর্বলতা।
সিংহাসনে সিংহের মতো বসে থাকলেও আজ ওর মনটা বিষণ্ণ, ভগ্ন। ভাই-বোন ওর সবচেয়ে কাছের। সেই কাছের দুজনকে হারাবে আজ ও। ওরা সরলে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহজ হবে রিচার্ডের। আর এই জন্য আন্দ্রেইর মৃত্যু অথবা নির্বাসন যে কোনো একটি ভীষণ দরকার। সিদ্ধান্ত নিতে এরা এত দেরি করছে কেন? রিচার্ড অধৈর্য হয়ে ওঠেন। সেই সময়ই সামনে বসা একজন মধ্য বয়সী দীর্ঘ বলিষ্ঠদেহি লোক দাঁড়িয়ে গেলেন। জাতিতে কৃষ্ণবর্ণের আফ্রিকান। হিংস্র ও কপট তাঁর চাহনি। নিকোলাসকে অভিবাদন জানিয়ে নির্মম কণ্ঠে বললেন,

“বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ক্ষমা নেই। আজ আপনার সাথে করেছে কাল কমিউনিটির সাথে করবে। আমরা সকলে নিজেদের কসম খেয়ে ওয়াদা করেছিলাম রাজার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব। এর অন্যথা হলে মৃত্যু মাথা পেতে নেবো। যে ভাবেই হোক আন্দ্রেই ও নোভালি ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। এর শাস্তিও ওদের পাওনা। তাই সবদিক বিবেচনা করে আমি এবং কমিউনিটির আরও বিশজন আন্দ্রেইর মৃত্যুদন্ড কামনা করছি। আর নোভার নির্বাসন। বাকিটা মহামান্য রাজার যা ইচ্ছে হয়।”

লোকটা আড়চোখে রিচার্ডকে দেখলেন। ক্ষীণ হাসি দেখা গেল তাঁর ঠোঁটে। কারও চোখে পড়ার আগেই মাথা নুয়ে অভিবাদনের ভঙ্গি করে বসলেন নিজ আসনে। দরবারে ফিসফাস শুরু হলো। আরও অনেকে সম্মতি জানায় লোকটার কথাতে। নিকোলাসের দমবন্ধ হয়ে আসছে এদের মাঝে। এই সিংহাসন কাঁটার মতো বিঁধছে সারা দেহে।

দরবারে ফিসফাস বন্ধ হয় একজন বয়োজ্যেষ্ঠের গলা ঝাড়ার শব্দে। কাঁচা পাকা চুল, ঠোঁটের ওপর পুরু গোঁফ, বুকসমান কাঁচা পাকা দাড়ি ও পরনে লম্বা কোট তাঁর। লোকটির চোখ-মুখে বিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। কোনো এক কারণে আন্দ্রেইকে তিনি বিশেষ স্নেহ করেন। সেই স্নেহের টানে চুপ করে থাকতে পারলেন না। নিকোলাসকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন,

“একপাক্ষিকভাবে শাস্তি দেওয়াটা এই কমিউনিটির নিয়ম বহির্ভূত। অপরাধীর আসনে যে বসে আছে তার কথাও আমাদের শুনতে হবে। তার দিক_”

বয়োজ্যেষ্ঠকে থামিয়ে দেয় আন্দ্রেই,

“পিয়েতর গুসেভ, আমি আমার অপরাধ অকপটে স্বীকার করছি। কিন্তু নোভাকে শাস্তি না দেওয়া হোক। ওই বেচারি নির্দোষ। ও যখন সত্যিটা জেনেছে তখন ভাই রাশিয়া ভ্রমণে রওয়ানা হয়েছিল। নয়তো ও বলত। সুতরাং যা মিথ্যা আমি বলেছি। দোষ একা আমার।”

“আন্দ্রেই!” পিয়তর গুসেভ ও নোভা ওকে বাধা দিতে গেলে আন্দ্রেই বলে,

“আমাকে বলতে দিন। আমি স্বীকার করছি ভাইকে আমি মিথ্যা বলেছি, ধোঁকা দিয়েছি, আঘাতও করেছি।” বড়সড় ঢোক গিললো আন্দ্রেই। তারপর বলল,

“এর জন্য যে শাস্তি প্রাপ্য আমি মাথা পেতে নেবো। কিন্তু এই কথাও সেই সাথে বলব, ওই মেয়ের সাথে যা করেছি তাতে আমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই। আমি এখনও বলছি, ইসাবেলাকে আমি আমার ভাইয়ের সঙ্গী হিসেবে মানি না, মানবো না।”

“হু দ্য হেল আর ইউ?” গর্জে ওঠে নিকোলাস,

“ইসাবেলাকে আমার সঙ্গী হিসেবে মানা না মানার তুই কে? কেউ না তুই আমার আন্দ্রেই, কেউ না।”

“ভাই বলে অস্বীকার করছ তবে?”

“হ্যাঁ, করছি।”

আন্দ্রেইর গলায় যেন ভীষণভাবে কিছু বিঁধে গেল। তড়িৎ গতিতে এসে দাঁড়ায় নিকোলাসের সিংহাসনের সামনে। ইসাবেলা ওকে বলেছিল, “আমার সাথে যা করছ সেটা প্রকাশ পেলে ভাইয়ের মুখোমুখি হতে পারবে?” আন্দ্রেই সামনে তো এসে দাঁড়িয়েছে কিন্তু চোখে চোখ রাখতে পারছে না। ওই চোখে আন্দ্রেইর জন্য কোনো মায়া নেই, আছে শুধু অসন্তোষ। কতটা অপ্রিয় হলে কেউ সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারে!
নিকোলাস লড়ছে নিজের ক্রোধের নিজে। ক্ষমা মহৎ গুন। কিন্তু আফসোস নিকোলাস মহৎ নয়। আন্দ্রেইর মুখ না দেখে যে কথাটা বলেছে। সেই একই কথা এখন আর বলতে পারবে না। জিজ্ঞেস করুক কেউ ওকে? নিকোলাস অন্যদিকে তাকিয়ে রাগত গলায় বলল,

“আমি তোর মুখ দেখতে চাই না আন্দ্রেই। সরে যা আমার দৃষ্টির সামনে থেকে।”

আন্দ্রেই সরে না। বজ্রহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। ভাইকে ও ভীষণ ভালোবাসে। আর সেই ভাই মুখ ফিরিয়ে নিলো। অস্বীকার করল। ভালোবাসা! আবার সেই শব্দ। এই শব্দের কারণে আজ ওর এত কষ্ট, এত দুর্গতি। যে ভালোবাসে সে সেই মানুষটিকে আগলে রাখতে চায় সকল বিপদ থেকে। আন্দ্রেইও তাই চেয়েছিল। ভাই ওকে ভুল বুঝল। পর করে দিলো ওই মেয়েটার কারণে। ঘৃণা করে ইসাবেলাকে আন্দ্রেই। প্রচন্ড ঘৃণা করে।

“আমি মৃত্যু চাই।”

আন্দ্রেই নিস্পৃহ গলায় বলল। নিকোলাস চকিতে তাকায়। জ্বলন্ত চোখে বলল,

“অপরাধীর শাস্তি নির্ধারণ করার ক্ষমতা অপরাধী রাখে না।”

“কিন্তু শেষ ইচ্ছে তো রাখা হয়। এটাই আমার শেষ ইচ্ছা। আমি মৃত্যু চাই। শেষ করে দেওয়া হোক আমাকে।” চিৎকার করে বলল আন্দ্রেই। নিকোলাস শক্ত করে সিংহাসন ধরে আছে। গর্জন করে বলল,

“কমিউনিটির বিচারবিভাগকে অবমাননা করছিস তুই আন্দ্রেই।”

“তাহলে আরেকটা শাস্তি পাওনা হলো। আরও শাস্তি দাও। কিন্তু মৃত্যুর চেয়ে বড়ো শাস্তি আর কী হতে পারে ভাই। ওহ! তুমি তো এখন আর আমার ভাই নও। রাজা নিকোলাস। আপনাকে কুর্নিশ রাজা নিকোলাস।”
নতমাথায় শ্লেষোক্তি করতে নিকোলাস হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,

“প্রহরী নিয়ে যাও এই বেয়াদবটাকে আমার চোখের সামনে থেকে।”

প্রহরীরা এগোতে এলেই রক্তচক্ষু নিয়ে ওদের দিকে তাকায় আন্দ্রেই। ঠোঁটের দু’পাশে শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছে।

“তুমি আমার সামনে ওদের ভয় দেখাতে পারো না আন্দ্রেই।”

“এখন আমি সব পারি রাজা নিকোলাস।”

একজন প্রহরী এগিয়ে আসতে আন্দ্রেই ওকে মেরে হাঁটুর ওপর বসিয়ে পেছন থেকে একটানে শিরশ্ছেদ করে।

“আন্দ্রেই!” নিষেধ করে নোভা, সোফিয়া ও পিয়েতর। আন্দ্রেই সেদিকে কর্ণপাতও করে না। প্রহরীরা ঘিরে ধরল ওকে। উপস্থির সদস্যদের কয়েকজন সমস্বরে বলে ওঠে।

“রাজদ্রোহ, ঘোর রাজদ্রোহ।”

হট্টগোল লেগে যায় দরবারে। নিকোলাস সিংহাসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। গলা চড়িয়ে আদেশ করল,

“আত্মসমর্পণ করো আন্দ্রেই। এটা আমার আদেশ।”

আন্দ্রেই ভাইয়ের আদেশ অমান্য করে কী করে! আত্মসমর্পণ করল। প্রহরীরা জোর করে হাঁটুর ওপর বসায়। আন্দ্রেইকে জোর করা এই মুহূর্তে খুব সহজ। রিচার্ডের উস্কানিতে পিশাচ সদস্যেরা আন্দ্রেইর এহেন আচরণকে রাজদ্রোহ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে। শাস্তি চায় ওর। এই প্রথম দিশেহারা হয়ে পড়ল সিংহাসনে বসে নিকোলাস। সদস্যরা চাপ দিতে লাগল আন্দ্রেইর মৃত্যুদন্ডের। একজন দুইজন এমন করে পঞ্চাশজন।

“রাজদ্রোহী, প্রতারকের শাস্তি চাই। মৃত্যুদন্ড, মৃত্যুদন্ড।” একসাথে চেঁচিয়ে ওঠে পিশাচেরা। আন্দ্রেইর পক্ষে যারা তারা আজ নিতান্ত কম। কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। রা নেই ওদের মুখে। আন্দ্রেইর বিপক্ষ শক্তির চাপ বাড়তে লাগল ক্রমশ নিকোলাসের ওপর। ক্ষিপ্ত, ক্রোধিত নিকোলাস বজ্র কণ্ঠে বলে ওঠে,

“থামো সবাই।”

মুহূর্তে নিস্তব্ধ দরবারে। নিকোলাস গভীর শ্বাস নিয়ে আন্দ্রেইর দিকে তাকায়। ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে আছে আন্দ্রেই। নিকোলাস ওর দিকে দৃষ্টি অনড় রেখে বলল,

“আন্দ্রেইকে নির্বাসিত করার হুকুম জারি করলাম আমি। ট্রিয়েরের দুর্গম জঙ্গলের গুহাতে ফেলে আসা হোক ওকে।”

বলামাত্রই উঠে দাঁড়াল নিকোলাস। দরবারের সবার দিকে চেয়ে বলল,

“আমার হুকুমের বিপক্ষে কে আছে এখানে?”

উপস্থিত সকলে মাথা নত করে জানিয়ে দেয় নিকোলাসের হুকুমের পক্ষে তারা। ট্রিয়ের দুর্গম জঙ্গল মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। রিচার্ড যেন মনে মনে দারুন খুশি হলেন। সোফিয়া ও নোভা করুণ চোখে আন্দ্রেইর দিকে চেয়ে রইল। আন্দ্রেই নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে আছে ভাইয়ের দিকে। বিদায়কালে একবার ফিরে দেখুক ওকে ভাই! একবার! নিকোলাস ফিরেও ওকে আর দেখল না। হনহন করে বেরিয়ে গেল দরবার ছেড়ে। পেছনে দাঁড়িয়ে সেই পথে চেয়ে আন্দ্রেই হাসল। বড়ো কষ্টের সেই হাসি। বিড়বিড় করে বলল,

“বিদায় ভাই, বিদায়।”

চলবে,,,,

গত দুই বছর আরামসে দিন কাটিয়েছি ঘরে বসে। খুব একটা ব্যস্ততা ছিল না। রিসেন্টলি আবার কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি লেখার ফুরসত পাই না। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর এত ক্লান্ত হয়ে পড়ি যে সবসময়ই লেখার মতো মন-মানসিকতা থাকে না। উপন্যাসটা চলমান না থাকলে লেখালেখি আপাতত বন্ধ করে দিতাম।কিন্তু হাজার কষ্টের পরও এখন সেটা পারছি না। গত কয়েক পর্ব এবং এটিও লিখতে মধ্যরাত পর্যন্ত জাগতে হয়েছে আমাকে। কথাগুলো বললাম কারণ আগের চাইতে গ্যাপটা বেশি পড়ছে বলে। এত গ্যাপে চলমান গল্প পড়া সত্যি কষ্টের। কিন্তু আমি নিরুপায়। আশা করি এইটুকু মানিয়ে নেবেন। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তাড়াতাড়ি দেওয়ার। ভালো থাকবেন❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here