তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব—৮৯,৯০

0
467

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব—৮৯,৯০
Writer তানিয়া শেখ
৮৯

আগাথা হাঁটু ভেঙে বসেছেন চন্দ্রদেবীর সামনে। দুহাত জোড় করে প্রার্থনা করে বললেন,
“দেবী, দয়া করুন। আজ আপনার দয়ার বড়ো প্রয়োজন আমার। আমার সন্তানদের সামনে ঘোর বিপদ। ওদের আপনি বিপদ থেকে উদ্ধার করুন দেবী।”

দেবী হতাশ মুখে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললেন,

“না, বাছা, এ আমার পক্ষে অসম্ভব। নিয়তিকে আমি সংস্কার করতে পারব না। কর্মের ফল ওদের পেতেই হবে।”

“আর শাপমোচন?”

“সেই জন্যই তোমাকে পাঠিয়েছিলাম। খারাপ লাগলেও বলতে হচ্ছে তুমি ব্যর্থ হলে। এখন সব আমার সাধ্যের বাইরে বাছা।”

আগাথা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নুয়ে রইলেন। দুই সন্তানের শাপমোচনের জন্য মরেও যে শান্তি হলো না তাঁর। দেবীর করুণায় কত চেষ্টায় তো করলেন, তবুও ওদের ভাগ্য বদলাতে অসফল হলেন। মনে পড়ল নোভার চিৎকার। মাথা ফের তুললেন।

“দেবী, আমার নোভাকে অন্তত মুক্ত করুণ ওই শয়তানের হাত থেকে। ও বেচারী বিনা পাপে শাস্তি ভোগ করছে।”

দেবী উঠে দাঁড়ালেন সিংহাসন ছেড়ে। একটু পায়চারি করে বললেন,

“ঠিক আছে কিন্তু একটি শর্তে।”

“শর্ত?”

“এরপর তুমি আর পৃথিবীতে যেতে পারবে না।”

“দেবী!”

“তোমাকে মানতেই হবে এই শর্ত আগাথা। হ্যাঁ, না বলার অধিকার নেই। আমার হুকুম এটা। তুমি আর জীবিত মানুষ নও যে পৃথিবীর আলো বাতাস গ্রহণ করতেই হবে। মৃত্যুর পর ওই পৃথিবী এবং ওতে বসবাসরত মানুষের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে তোমার। তোমার সততা, ধর্মনিষ্ঠার কারণে সুযোগ পেয়েছিলে সন্তানদের শাপমোচন করার। তোমাকে বহুবার বলেছিলাম ভাগ্য বদলানোর ক্ষমতা কোনো মানুষের নেই। কর্মে যা ঘটে কর্মেই তা বদলায়। তোমার সন্তানেরা কর্ম বদলায়নি। নিজেদেরও না। মেনে নাও এই ওদের ভাগ্য। এ তুমি বদলাতে পারবে না। অনেক সুযোগ দিয়েছি তোমাকে আমি। আমারও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে আগাথা। এর বেশি সত্যি আমার পক্ষে অসম্ভব।”

দেবীর গলা কঠিন শোনালো। আগাথা বিমর্ষ হয়ে গেলেন। তাঁর সন্তানেরা এভাবেই অভিশপ্ত হয়ে থাকবে? মুক্তি মিলবে না কোনোদিন? মাতৃহৃদয় হাহাকার করে। মৃত্যু মুহূর্তের সেই পীড়া আবার যেন উপলব্ধি করছেন আজ। হঠাৎ মনে এলো ইসাবেলাকে তিনি বলেছিলেন এসব কথা। ও কথা দিয়েছিল তাঁর সন্তানদের শাপমোচনে সাহায্য করবে। এইজন্যই তো তিনি ছলে-বলে ওকে নিকোলাসের কাছে ঠেলেছেন। সেই উদ্দেশ্য তাঁর সফল হয়েছে। আজ তাঁর ছেলে ইসাবেলার প্রেমে পাগল। এখন কি কথা রাখবে না ইসাবেলা?

পল মোসেল নদীর অববাহিকায় একটি বড়ো ছায়াবৃক্ষের নিচে বসল। কাঁধের ব্যাগটা রাখল কোলের ওপর। ট্রিয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে। এত পথ কেবল প্রার্থনা করেছে নোভাকে যেন ওখানেই পায়। এর বিপরীত চিন্তা ওর চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, বিশ্রাম থেকে টেনে রাস্তায় নামিয়েছে। অদূরে ফায়ারিং এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে সাঁইসাঁই করে উড়ে গেল কয়েকটি যুদ্ধ বিমান। খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে পলকে। জঙ্গল হলে সুবিধা হয়। ফাঁকা স্থান যত পারছে এড়িয়ে যাচ্ছে। সামনে ফাঁকা স্থান। তারপর মোসেল নদী। নদীটি পাড় হয়ে কিছু পথ হাঁটলে ট্রিয়ের সেই জঙ্গল যেখানে আন্দ্রেই নির্বাসিত, আর ওর নোভা রয়েছে। সম্ভবত!
শীতের প্রকোপ কমে এসেছে। বৃষ্টি হচ্ছে হুটহাট। বর্ষাকালে এই পথ চলা আরও কঠিন। এক হাঁটু কাঁদা, কীট মাড়িয়ে যেতে সময় ব্যয় হয়। অপরাহ্ণের এই সময় সামনের সমতলের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেমন সময় লাগবে তেমন বিপদও। একটু পর পর যুদ্ধ বিমান যাচ্ছে। সৈন্যদের নজরদারিও এদিকে খুব। পলকে ভিন্ন পথ দেখতে হবে। বৃষ্টি কমতে ও উঠে দাঁড়ায়। পেছনে পাহাড়ি অরণ্য। এখানে ওঠে চারিদিক দেখে নিলে কেমন হয়! সাবধানে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের শিখর সমতলে উঠল। সেখানে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল আরেক বিপদ। দশ বারোজন পিশাচ ও নেকড়ে অতর্কিতে আক্রমণ করে বসল ওপর। লড়াই করতে গিয়ে ঘায়েল হলো পল। মানুষ রূপে এদের সাথে পেরে উঠবে না। প্রচন্ড চিৎকারের সাথে নেকড়ে রূপে পরিবর্তন হয়। ওইদিন রাতে নিকোলাস নিজের রক্ত ওকে পান করিয়েছিল। পিশাচের রক্তে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। সেই ক্ষমতা বলেই জন্মগত ত্রুটি সেরেছে। এখন পল ইচ্ছেমতো যখন তখন পুরোপুরি নেকড়ে রূপে পরিবর্তন হতে পারে। পলের ধারণা পথের এ সকল বিপদ অনুমান করেই এতকাল পর ওর মনিব সদয় হয়েছে। কৃতজ্ঞ তার কাছে পল।
উপস্থিত পিশাচ ও নেকড়ে তো বিস্মিত হয় প্রথমে। তাদের বলা হয়েছিল এ সামান্য মানুষ। এখন দেখছে বাদামি লোমওয়ালা এক হিংস্র নেকড়ে। দুই পক্ষে রক্তক্ষয়ী লড়াই চললো। একে একে প্রায় সবগুলোকেই ধরাশায়ী করেছে পল। জয়ের খুব কাছে। তখনই কেউ ওর পিঠে গুলি ছোড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ও। যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। উঠতে গেলে আবার একটা গুলি এসে বিঁধল ওর পায়ে। পড়ে গেল মাটিতে। আহত কয়েকটি নেকড়ে উঠে এলো ওর ওপর। কামড়ে ছিঁড়ে তুলে নেয় দেহের এখান ওখান থেকে খাবলা খাবলা লোমসহ মাংস। ব্যথায় গর্জন করে পল।

“থাম।” একটা পরিচিত গলার স্বর। আদেশ পেয়ে নেকড়েগুলো সরে গেল ওর ওপর থেকে। এখনও দাঁত খিঁচিয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে দেখছে ওরা। পলের নেকড়ে শরীর রক্তে মাখামাখি। মানুষ রূপে পরিবর্তন হওয়ার শক্তি নেই। সিক্ত ব্যথাতুর চোখে তাকালো গলার স্বর অনুসরণ করে।

“আমার পুত্রের বিশ্বস্ত কুকুরটা দেখি নেকড়ে হতে পেরেছে শেষ অব্দি।” রিচার্ড সামনে দাঁড়িয়ে ঠাট্টার সুরে বললেন। হাতে পিস্তল। পল মনে মনে বলল,

“আমার ধারণা তা হলে সত্য ছিল।”

“শতভাগ৷” রিচার্ড শব্দ করে হাসলেন। যেন তিনি বুঝতে পারলেন ওর অনুক্ত কথা। তারপর এগিয়ে এলেন কয়েক কদম।

“কিন্তু আফসোস এখন ধারণা ফারণা করে লাভ হবে না। মরবে কি না।”

পল গর্জন করে ওর ওপর আক্রমণ করতে গেলে ফের ফায়ার করলেন রিচার্ড। পরপর চারটে গুলি ওর পেটে ও বুকে ঢুকিয়ে দিলেন। নিস্তেজ হয়ে মাটিতে আছরে পড়ল পল। নিঃশ্বাস দুর্বল। বুক খুব দ্রুত ওঠানামা করছে। রিচার্ড ওর অশ্রুসিক্ত চোখে চেয়ে দুঃখী হওয়ার ভান করে বললেন,

“বেচারা, শুধু শুধু মরলি। কী দরকার ছিল আমার পথে কাঁটা হওয়ার তোর? নোভা, নোভা করে মাথা খেয়ে ফেলেছিস আমার। আবার ওকে খুঁজে বের করতে বেরিয়েছেন উনি। এত দরদ কেন? ওহ! দরদ নয় এ তো ভালোবাসা।” তারপরে অশ্লীল ভাষায় গালি দিলেন। পলের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। ঝাপসা দৃষ্টিতে নোভার মুখটা দেখতে পায়। এই মুখ আর বুঝি দেখা হবে! চোখের জলে মাটি ভিজে গেছে। পশুসুলভ ভাষায় গোঙায়,

“নোওওআও, নোওওআওও।”

রিচার্ড ঝুঁকে চাপা গলায় বললেন,

“নোভা! সে যেন কোথায়, কোথায়? আহ! মনে পড়েছে। সে তো ওই ট্রিয়ের জঙ্গলে আন্দ্রেইর কাছে, না?”

পলের দৃষ্টিতে অন্ধকার নামে। তীব্র যন্ত্রণা ক্রমশ ভোঁতা হতে লাগল। ভীষণ হালকা অনুভব করছে। এই কি মৃত্যুর লক্ষণ? মরবে এখন ও? তাহলে নোভার কি হবে? টের পাচ্ছে ওকে টেনে হিঁচড়ে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে এরা। রিচার্ডের গলা আবার শুনতে পেল।

“নোভাকে বেজায় ভালোবাসিস? কিন্তু আফসোস, তোর মতো চাকরের ভাগ্যে নেই ও। ওর রাজকপাল। ড্যামিয়ানের সঙ্গিনী হবে যে নোভালি।”

ড্যামিয়ান! নোভা ওই শয়তানের সঙ্গিনী হবে? না, না। গতবার নোভার ওপর ড্যামিয়ানের অত্যাচারের স্মৃতি স্মরণ করতে শিউরে উঠল।

“প্রভু, আমার প্রানভিক্ষা দাও। চিরজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকব। অতীত ভুলের জন্য তোমার দুয়ারে মাথা ঠুকব। বাঁচাও আমায় প্রভু। আমার নোভার জন্য আমাকে যে বাঁচতে হবে। হে প্রভু, হে জীবনমৃত্যুর মালিক আমায় রক্ষা করো।”

পলের মনের সকল প্রার্থনা থমকে যায় রিচার্ডের আদেশ শুনে,

“ছুঁড়ে ফেল এই পাহাড় থেকে ওকে। ওর চিহ্ন যেন না থাকে আর।”

পরক্ষণেই নিজেকে শূন্যে অনুভব করল পল। ও এখন সত্যি মরবে। নোভাকে আর দেখা হবে না। আর বলা হবে না, “ভালোবাসি তোমায় জংলী ফুল। হা! প্রভু, একটু করুণা হলো না আমার ওপর তোমার? নোভা, নোভা…….ওকেই না হয় বাঁচাও প্রভু। নোভা, নোভা…..”

পলের নেকড়ে শরীর নিচের ঘন অরণ্যে ঘেরা খাদে হারিয়ে যেতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন রিচার্ড। রাস্তা পরিস্কার এখন। ঘুরে দাঁড়াতে পলের ব্যাগটা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিলেন হাতে। একটা জার্নাল, কিছু খাদ্য, পানীয়, অর্থ আর ছুরি। পলের শরীর যেদিকে হারিয়ে গেছে সেদিকেই ছুঁড়ে ফেললেন।

“বেচারা চাকরের আত্মা মুক্তি পাক, আমিন।”

চলবে,,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯০
Writer তানিয়া শেখ

জেদ আর ঘোর এক নয়। কিন্তু এ দুটো তীব্র অনুভূতির শব্দ মাঝে মাঝে এক হয়ে যায়। পানিতে মিশে যাওয়া চিনির মতো পরস্পরে এমনই মিশে থাকে যে আলাদা করা যায় না। নোভার প্রতি ড্যামিয়ানের যে আকর্ষণ তা জেদ। আর ইসাবেলার প্রতি ঘোর। তাই কি? না, হয়তো উলটোটা। ইসাবেলা ওর জেদ আর নোভা ঘোর। আবার ভাবে দুটোই জেদ কিংবা ঘোর। যাই হোক না কেন এই দুজনকেই ওর চায়। এক পুরুষ কি একসাথে দুজন নারীকে চাইতে পারে না? ওদের সমাজ, ধর্মে নিষিদ্ধ হলেই মনে নিষিদ্ধ হবে কেন? তাছাড়া সমাজ, ধর্ম কবে মেনেছে ড্যামিয়ান? সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে চাওয়া এই দুই নারী ওকে ঘৃণা ছাড়া কিছু দেয়নি। জীবন ফের ওকে ঠকিয়েছে। শূন্য হাত শূন্যই রেখেছে। মাতৃগর্ভ থেকে ঠকছে ও। এবার যে আর ঠকবে না। দুহাতে লুটে নেবে। যারা ঠকিয়েছে তাদের পালা ঠকবার।

নিঝুম রাত। নির্ঘুম জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। আকাশে রুপোলী থালার মতো চাঁদ। কী অপূর্ব জ্যোৎস্না! তার মাঝে সেই তারাটা। ওটার নাম ইসাবেলা রেখেছে ড্যামিয়ান। জ্যোতিষী মহাশয় ইসাবেলার জন্মকুণ্ডলী ঘেঁটে দেখে ওই নক্ষত্র ইশারা করে বলেছিলেন,

“ওই তো সেই সমৃদ্ধি আর ক্ষমতার আশীর্বাদের চিহ্ন। ওকে হাসিল করো ড্যামিয়ান, হাসিল করো। ও তোমার ভাগ্য বদলে দেবে। তোমায় মহাক্ষমতাবান করবে। তোমার বংশে আগত সৌভাগ্য, তোমার পিতার প্রার্থনার ফল ও মেয়ে। ওকে পেলে সব পাবে, এমন কী পিতৃ স্বীকৃতি ও মাতৃহত্যার প্রতিশোধও।”

ড্যামিয়ানে এখন ইসাবেলাকে চায়। যে কোনোভাবে। প্রতিশোধের পালাটা শেষ হলে একান্ত নিজের করে নেবে। তারাটা নিবিষ্ট মনে দেখছিল। আচমকা সেটা হারিয়ে গেল! বিচলিত হয়ে পড়ে ড্যামিয়ান।

“ইসাবেলা, ইসাবেলা!”

যতদূর আকাশ দেখা যায় ও ওই উজ্জ্বল তারাটা খোঁজে। সব তারার মাঝে যেন এক হয়ে গেছে। আলাদা করা যাচ্ছে না। আশ্চর্য! এতদিন কিন্তু আলাদাভাবে চিনতে পারা যেত। এখন পারছে না কেন?

“কে কোথায় আছিস? জ্যোতিষীকে খবর দে। তাড়াতাড়ি ডেকে আন তাঁকে।”

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন জ্যোতিষী মহাশয়। বুক সমান দাড়ি, ঠোঁটের ওপর পুরু গোঁফ। মাথা টাক। চোখ দুটো তীক্ষ্ণ। মুখভাবে ধূর্ততা ও বিচক্ষণতা প্রকাশিত। পরনে ধূসর আলখেল্লা। কুর্নিশের ঢঙে বললেন,

“আমাকে ডেকেছেন জনাব?”

ড্যামিয়ান কম্পিত হাত আকাশের দিকে ইশারা করে বলল,
“ও নেই। আমার বেবিগার্ল ওখানে নেই মহাশয়।”

জ্যোতিষী বাইনোকুলার আনালেন। ধীরে ধীরে তাঁর মুখ বদলে যেতে লাগল। খানিক আশ্চর্য, খানিক ভয় আর হতবুদ্ধিভাবের মিশ্রণ দেখা যায়।
ড্যামিয়ান তাঁর রক্তশূন্য মুখে চেয়ে বলল,

“কী হয়েছে মহাশয়?”

শুকনো ঢোক গিললেন জ্যোতিষী। ভাবিত মুখে বিড়বিড় করে বললেন,

“ও সত্যি আর নেই। কিন্তু এ তো অসম্ভব!”

“কী অসম্ভব?”

রজার বলল। ম্যাক্সিম তার পেছন পেছন ড্যামিয়ানের কক্ষে প্রবেশ করে। তারাটা পূর্বে যেখানে ছিল সেখানে তাকিয়ে রইলেন জ্যোতিষী। তিনি যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। হঠাৎ কী দেখে তার মুখে আষাঢ়ে মেঘ জমে। থমথমে গলায় বলেন,

“হা প্রভু! এ কী অনাসৃষ্টি!”

“নিজে নিজে কী বক বক করছেন, মহাশয়? আপনাকে এখানে নিজ মনে বকবকানির জন্য আনা হয়নি। পরিস্কার করে বলুন হয়েছে কী?”

ধমকের সুরে বলল রজার। ম্যাক্সিম দেখছে ড্যামিয়ানকে। অস্বাভাবিক রকমের শান্ত এই মুহূর্তে ও। চোখ দুটো স্থির আকাশের সেই তারাটির দিকে। একটু আগে অদৃশ্য হয়ে গেলেও এখন আবার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পাশে নতুন আরেকটি কি জ্বলজ্বল করছে? ড্যামিয়ান জ্যোতিষীর দিকে গভীর চোখে তাকালো। তার মুখ পড়ে নিচ্ছে যেন। জ্যোতিষী কিছু বলার আগে এগিয়ে এলো। থমথমে গলায় বলল,

“ও আমার হবে তো?”

জ্যোতিষী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

“সহজে না। ওই যে ওর পাশের নতুন উদিত নক্ষত্রটি ওর রক্ষাকবচ হয়েছে এখন। কিন্তু হঠাৎ করে ওটা এলো কেন? কারণটা আমাকে অনুসন্ধান করতে হবে।”

ড্যামিয়ান অপ্রকৃতস্থ মতো হয়ে বলল,

“ওকে আমার চাই কিন্তু মহাশয়। যেকোনো ভাবে।”

“আমি জানি জনাব। চিন্তা করবেন না। এই বাধা দূর করার একটা উপায় ঠিক বের করব আমি। একটু সময় দিন।”

ড্যামিয়ান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জামাতে জ্যোতিষী প্রস্থান করলেন। রজার ও ম্যাক্সিম রয়ে গেল। ম্যাক্সিম বলল,

“চিন্তা করো না ড্যামিয়ান। ইসাবেলা তোমারই হবে।”

সায় দিলো রজার তাতে,

“আলবাত।”

ড্যামিয়ান কেবল মাথা নাড়ায়। ওর দৃষ্টি ইসাবেলার নক্ষত্রের পাশে উদিত নতুন তারাটির দিকে। তীক্ষ্ণ ক্রুর চোখে ওটাকে দেখছে।

“তোমরা ঠিকঠাক খোঁজ রাখছো তো ভাগ্নির?” নীরবতা ভেঙে বলল ইসাবেলার মামাদের। দুজনেই একসাথে জবাব দিলো,

“খুব ভালোভাবে।”

“তবে আজ আমার কেন মনে হচ্ছে নিকোলাস আর ওর সম্পর্ক এখন আর হৃদয়ে হৃদয়ে নেই। আরও গভীরে গিয়েছে।”

“তোমার মনের ভয় ওটা। আমরা বেশ করে নজরদারিতে রেখেছি। তেমন কিছু ঘটলে অবশ্যই জানতাম। চিন্তার কারণ নেই।”

“হুঁ! চিন্তার কারণ নেই তবে ওই নক্ষত্রের উদয় হলো কী করে হঠাৎ, কুত্তার বাচ্চারা?”

চেঁচিয়ে উঠল ড্যামিয়ান। রজার ও ম্যাক্সিমের দিকে হুঙ্কার ছাড়ে।

“আমার সিক্স সেন্স বলছে তোদের কোথাও ভুল হয়েছে। যা আমার থাকার কথা তা এখন অন্য কারো দখলে গেছে। কসম করে বলছি যদি তাই হয় তবে তোদের ক্ষমা নেই। আপন রক্ত বলে ছেড়ে দেবো না। রক্তমাংস এক করে খাব। দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে অপদার্থের দল।”

ভয় পেল দুই ভাই। দুজনে দ্রুত প্রস্থান করল সেখান থেকে।

কয়েক গ্লাস ভদকা পান করার পরও নেশা হয়নি ড্যামিয়ানের। রাতটা আজ যেন ফুরাচ্ছেই না। ওই নক্ষত্রের দিকে তাকাবে না তাকাবে না করেও তাকাচ্ছে। এত বছরের অভ্যাস একরাতে পরিবর্তন হয়? রাগটা আগাগোড়াই একটু বেশি। এই কারণে তা যে আরও বাড়ল। এতটা বাড়ল যে অন্ধকার কক্ষে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। কিছুর ওপর তো রাগটা খাটানো চায়। এমনি এমনি যাবে না। মাথাটা ঘুরছে। সর্ব শরীর মনে হচ্ছে জ্বলছে। মাথার ভেতর নিষ্ঠুর সব ভাবনা চিন্তা। না, আর চুপচাপ থাকতে পারছে না। ঝড়ের মতো সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। প্রহরীরা এতকাল দেখে আসছে মনিবকে। মনিবের রাগী মুখ ভালোভাবেই টের পায়। রাগলে এই লোক কী ঘটাতে সক্ষম তা কি ওরা জানে না? ভয়ে গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনিবকে গর্ভগৃহের দিকে যেতে দেখল।

গর্ভগৃহের ঘুটঘুটে অন্ধকার ম্লান হয় ড্যামিয়ানের হাতের মশালের আলোতে। অন্ধকারে পা পড়ে কয়েকটি ইঁদুর ও সাপের ওপর। ইঁদুরগুলো চিঁচিঁ করে উঠল। সাপগুলো অবশ্য পালটা আঘাত করেছে। মাতৃগর্ভ থেকেই যে বিষাক্ত এই সাপের বিষে তার আর কী হয়! রাত নামলে এই স্যাঁতসেঁতে পাতাল আঁধারে সাপ বিচ্ছুতে গিজগিজ করে। নোভার কাঁচের সেলের কাছাকাছি যেতে থেমে যায়। সামনে সাপ বিচ্ছুসহ বিষাক্ত প্রাণীরা শায়িত এক মানুষের আকৃতি নিয়েছে। আকৃতি নিয়েছে! শক্ত করে মশালের হাতল ধরল ড্যামিয়ান। কাউকে ছিঁড়ে কামড়ে,শুষে খাচ্ছে সরীসৃপগুলো। মশালের আগুনের তাপ লাগতে ছিটকে সরে গেল। ড্যামিয়ানের সেই চল্লিশোর্ধ্ব চাকরটির বিভৎস দেহ পড়ে আছে। কী হয়েছে বুঝতে যেন আর কষ্ট হলো না ড্যামিয়ানের। মৃত চাকরটির বোকামিকে গালি দিয়ে ছুটল সামনে। যা ভেবেছিল তাই। নোভা ফের একবার চালাকি করে পালিয়েছে। রাগে লাল হয়ে ওঠে ড্যামিয়ানের চোখ। উন্মাদের মতো হাসছে। রাগের আগুন মশালে আগুন এক হয়ে সমস্ত গর্ভগৃহে ছড়িয়ে পড়ে। মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে ড্যামিয়ান।

গতবার পালানো সহজ ছিল। কিন্তু এবার যে সহজ হবে না সে ও জানতো। ওই পাতাল বন্দিদশা ছেড়ে জঙ্গলে পথ খুঁজছে নোভা। কিন্তু বার বার ঘুরেফিরে একই স্থানে এসে দাঁড়াচ্ছে যেন। ঠিক যেন গোলকধাঁধা। এত সহজে হার মানবে না নোভা। এখান থেকে বেরোবেই। নতুন একটি রাস্তা ধরলো। কিন্তু হতাশ হলো। এই রাস্তাও ওকে আগের স্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে। আশপাশে অস্থিরভাবে পায়চারি করল। একটা গাছ দেখতে থামে। তিন পাপড়ির ছোটো ছোটো নীল ফুলে ভরে আছে গাছটি। ফুলগুলো এখনো কুঁড়ি। এই গাছের বিশেষত্ব হলো কুঁড়িতে বিষ, ফুটলে নির্বিষ। কিন্তু নির্বিষ ওই কুঁড়ির বিষকে কাটে না। কুঁড়ি অবস্থায় সম্মোহনীয় ঘ্রাণে আশপাশের প্রাণীদের আকৃষ্ট করে। একবার এর মায়াজালে পড়লে তার আর রক্ষা নেই। ফুটলে কিন্তু এই ফুলে কোনো সুবাস থাকে না। তখন পৃথিবীর আর পাঁচটা সাধারণ ফুলের মতো। নোভা মানুষ নয়। ওকে ততখানি মায়াজালে ফেলতে সক্ষম নয় এই কুঁড়ি ও কুঁড়ির সুবাস। তবুও ছুঁয়ে দেখার লোভ আর সামলাতে পারল না নোভা।

“ভেবেছিলি এবারও পালিয়ে যাবি?”

পেছনে ড্যামিয়ানের বিকৃত হাসি শুনলো নোভা। ঘুরে তাকালো না। শয়তানটার মুখ দেখার চেয়ে এই ফুল দেখা ভালো। মনে শান্তি আসে। ড্যামিয়ানকে ও মনপ্রাণে ঘৃণা করে। ওর স্পর্শের কথা ভাবতে গা গুলিয়ে এলো। লড়ে যদি মুক্তির পথ দেখত তবে এই মুহূর্তে তাই করত। ড্যামিয়ান সে সুযোগ ওকে দেবে না। চোখ বন্ধ করল। প্রিয়জনদের মুখটা দেখতে পায়। দেখতে পায় তাকে যার ছবিটি হৃদয়ে অঙ্কিত৷ যাকে বলা হয়নি মনের কথা। হয়তো আর কোনোদিন বলা হবে না। তবুও শান্তি সে ওর হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে। ড্যামিয়ানের নোংরা হাত ওই পর্যন্ত ছুঁতে পারবে না। কোনোদিন না।

ড্যামিয়ান এগিয়ে যায় ওর দিকে।

“অনেক সময় দিয়েছি তোকে। মধুর মধুর কথা বলেছি। এবার ভয় দেখাইনি, অত্যাচারও আর করিনি। কিছুতেই তোর মন পেলাম না। বেশ। তোর মন আর চাই না। শুধু শরীরটা এখন চাই। প্রয়োজনে জোর করে হলেও তা আজ আমার চাই।”

ড্যামিয়ান ক্ষিপ্র হাতে বাহু ধরে ঘুরাতেই নোভার নিথর দেহখানি পায়ের কাছে উবু হয়ে পড়ল। কী ঘটল বুঝতে সময় লাগে। ধাতস্থ হতে নিচে তাকায়। হাঁটু ভেঙে বসল ওর শরীরের পাশে। পরাজয়ের আভাস পাচ্ছে ড্যামিয়ান। না, না। ফের পরাজয় চায় না ও।

“দ্যাখ, একদম নাটক করবি না নোভালি। ওঠ, ওঠ বলছি। এসব নাটক করে আমায় বোকা বানাতে পারবি না। ভালোই ভালোই বলছি ওঠ।”

নোভালি তেমনি পড়ে আছে। ধীরে ধীরে ওর দেহটাকে সোজা করল ড্যামিয়ান। দু-চোখ বিস্ফোরিত হয় নোভার নীলবর্ণ মুখ দেখে। এতক্ষণ পরে বিষাক্ত ফুলের সুবাস বুঝতে পারে। তাকায় সেদিকে। কুঁড়ি ছেঁড়া বৃন্তটি সহজে চোখে পড়ে। দুহাতে খামচে ধরে নোভার নিথর দেহখানির দুবাহু। সজোরে ঝাঁকায়।

“না, না। চোখ খোল। এই..এই নোভালি, এত সহজে আমাকে তোরা হারাতে পারবি না। বার বার কেন হারব আমি? তোর মুক্তি নেই। আমার স্বপ্ন পূরণ না করে তোর মুক্তি হবে না।”

ড্যামিয়ান ওর বিষাক্ত নীল ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দেয়। শুষে নিতে চায় সব বিষ। কিন্তু ব্যর্থ হয়। কারণ নোভা ওর জেদ, ভালোবাসা নয়। এই বিষ কেবল ভালোবাসাময় চুম্বনে শরীর ত্যাগ করবে।

চলবে,,,,

একটুসখানি স্নো হোয়াইট বা স্লিপিং বিউটি থেকে অনুপ্রাণিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here