তিমিরে_ফোটা_গোলাপ পর্ব–৯৬

0
373

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৯৬
Writer তানিয়া শেখ

অনেক খোঁজাখুজির পর ভোলইয়ার মৃত দেহ পাওয়া গেল লনের ঝোপের আড়ালে । তাশার সে কী কান্না। রেইনি হিমশিম খেল কান্না থামাতে। তাতিয়ানার বিড়াল পছন্দ না, কিন্তু মেয়ের খুশির জন্য মাতভেইর এই উপহারটাকে সে অপছন্দও করেনি। মেয়েটার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল ওটা।

“আর কেঁদো না, সোনা। বাবা তোমাকে নতুন একটা বিড়াল এনে দেবে।”
তবুও মেয়ের কান্না কোনোভাবে থামাতে পারল না। মাতভেই এগিয়ে এলো। কোলে নিলো মেয়েকে। এটা ওটা বলে সান্ত্বনা দেয়। তাতিয়ানার ভীষণ খারাপ লাগল মেয়ের জন্য। মাতভেই আর ওর চোখাচোখি হতে চোখ সরিয়ে নিলো। ঠাণ্ডা লড়াই চলছে ওদের মধ্যে। মাতভেই তাতিয়ানার বিশ্বাসে আঘাত করেছে। ইসাবেলার সম্পর্কের ব্যাপারেও জেনেও লুকিয়েছে ওর থেকে। দারুন কষ্ট পেয়েছে মনে তাতিয়ানা। মাতভেই ক্ষমা চায়। সত্যি বলতে ও জানত না ইসাবেলা এখনও নিকোলাসের সাথে সম্পর্কে আছে। ভেবেছিল আন্দ্রেইর সেই হুমকির পর ওদের মধ্যে আর যোগাযোগ নেই। থাকবেই বা কি করে, নিকোলাস তো জানতোই না ইসাবেলা বেঁচে আছে না মরে গেছে। ইসাবেলাও আর ওকে কিছু বলেনি। সন্দেহ তো হয়েছিল মাতভেইর, কিন্তু সন্দেহের কিনারা পর্যন্ত যাওয়ার অবসর হয়ে ওঠেনি।
তাতিয়ানা সব শোনার পরও গম্ভীর। মাতভেই জানে এই গম্ভীরতা কাটতে সময় লাগবে, চেষ্টা লাগবে। সব করবে মাতভেই। মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়। তবে সেই ভুল শিক্ষা হওয়া উচিত।

বিড়ালটাকে ভাগাড়ে ফেলে ওরা মহলে প্রবেশ করল। কেবল দাঁড়িয়ে রইলেন একজন, আন্না মেরিও। তাঁর দৃষ্টি গেল সোজা ইসাবেলার জানালার দিকে। মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার আগে ধরা পড়ে গেল ইসাবেলা। ওর ওই বিষন্ন, অপরাধী মুখ ওতদূরে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট দেখতে পেলেন আন্না মেরিও। ইসাবেলা চট করে নিজেকে আড়াল করে নিলো। আজ মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহসও ওর নেই। দু-হাতের মুষ্টি শক্ত হলো, দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরে আছেন। নিজেকে প্রতারিত মনে করলেন। এই মেয়ে তাঁর বিশ্বাস ভেঙেছে। তাঁর সকল শিক্ষা পায়ে পিষে আজ পিশাচিনী হওয়ার পথে৷ তবে প্রতারণার চেয়ে মাতৃত্ববোধ প্রবল। এক মা দেখছে তাঁর মেয়ে বিপথে যাচ্ছে। আজন্ম আদরের আহ্লাদে, সুশিক্ষায় মানুষ করা মেয়েটা অন্ধকার পাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ, তিনি হাত গুটিয়ে বসে আছেন। চোখের সামনে সন্তানকে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখেও চুপ করে আছেন। অভিমান, ক্রোধ, তিরস্কার ও ছোটো করা ছাড়া আর কি কিছু করার নেই? না, এভাবে চুপ করে থাকবেন না তিনি। পানি মাথার ওপর চলে যাবে নয়তো। ভ্যালেরিয়া গেল, রজার গেল, ভোলইয়া গেল, এমনি করে চুপচাপ থাকলে একদিন সব শেষ হয়ে যাবে।

“নিকোলাস ম্যাক্সওয়েলদের বংশ নির্বংশ করতে চায় আন্নে। তোমার মেয়েকে ও ব্যবহার করছে। তোমার মেয়ে!” তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন মার্কোভিক। তারপর বললেন,

“ও আর তোমার মেয়ে নেই। দেখেছো না কীভাবে ওই পিশাচের পক্ষে কথা বলে। বশীভূত করে ফেলেছে ওকে পিশাচটা। এখনও সময় আছে আন্নে। এখনও সব ঠিক হতে পারে। তুমি একটু সহযোগিতা করলে ফিরে পাবে তোমার মেয়েকে, রক্ষা পাবে ম্যাক্সওয়েল বংশ। নয়তো সব শেষ হয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে সব।”

পিতার কথা স্মরণ করতে শক্ত মুষ্টি আলগা করলেন। ভুল করেছেন পিতাকে অমান্য করে। এই ভুলের শাস্তি বেশ করে পেয়েছেন। এবার তার প্রায়শ্চিত্ত করবেন। একজন মা, একজন ম্যাক্সওয়েল হিসেবে এ তাঁর কর্তব্য।

মার্কোভিক একপ্রকার আশা ছেড়ে দিলেন। ম্যাক্সিমও তাই। কিন্তু ড্যামিয়ানের দৃঢ় বিশ্বাস নিজের পরিকল্পনার ওপর। এত বছর একটু একটু করে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ধৈর্য ধরে পরিকল্পনা করেছে। ত্যাগ কি করেনি? শিকার টোপ ফেলে ধরতে হয়। ইসাবেলাকে ও টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। রিস্ক ছিল। কিন্তু নিকোলাস যখন আস্তে আস্তে ওর প্রতি দুর্বল হলো তখন ভয়টা কেটে যায়। মনে মনে হেসেছে। লোকে বলে মেয়েলোক দুর্বল। আবেগের আতিশয্যে ভরা জীব। কিন্তু এই মেয়েলোক দিয়েই বিশ্ব জয় সম্ভব। যে পুরুষ পণ করেছে ঘর করব না, নত হব না তাকেও এই নারীদের একজন ঘরে টানে, সম্মুখে হাঁটু ভেঙে বসায়। স্বার্থপর, নিষ্ঠুর পিশাচ যার হৃদয়ে প্রেম ছিল না, মায়া ছিল না সেও প্রেমে পড়ল, তুমুলভাবে, হৃদয় নিংড়ে। নারী শক্তির উৎস। এই শক্তি দিয়ে সৃষ্টিকর্তা পৃথিবী সজীব, সৌন্দর্যমণ্ডিত ও পুন্যময় করেছেন। আর টেনেছেন পুরুষের লাগাম। শয়তান করল ঠিক উলটো। স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হওয়ার প্রতিশোধ সে নিয়েছে এই নারীকে কুমন্ত্রণা দিয়েই। যে পুরুষের লাগাম টানার শক্তি রাখে তাকে বশ করা সহজ নয়। কিন্তু যে করতে পেরেছে জয়মাল্য তারই জোটে। সুতরাং এই জয়মাল্যও ড্যামিয়ান অধিকার করবে।
সফলতার কয়েক কদম দূরে এসে হতাশ হবে না। প্রশ্নই ওঠে না। আন্না মেরিওকে ও ঠিক চেনে। আজ হোক কাল আন্না মেরিও ওর কাছে আসবে। আসতেই হবে। ওর পাতা ফাঁদে পা দেওয়া ছাড়া আর যে পথ নেই তাঁর। ড্যামিয়ান নিশ্চিন্ত মনে বিয়ারে চুমুক দেয়। মার্কোভিক ওর এই শান্ত হয়ে থাকায় বেশ বিরক্ত হচ্ছেন।

“না, আমি তোমার এই নীরবতা আর মানতে পারছি না ড্যামিয়ান। ওই পিশাচটা আমার ছেলে, মেয়েকে মারল। আমার নাতনি ওর বশে। বিনা বাধায় ও আমার মহলে আসছে যাচ্ছে। কোনদিন না আমাদের সবাইকে সমূলে শেষ করে দেয়। এমন বিপদ মাথায় করে হাত গুটিয়ে বসে থাকার মানে হয় না।”

“তুমি আমার ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছ মার্কোভিক? বলেছি তো সবুর করো। এতকাল করলে আর ক’টা দিন _” ড্যামিয়ানের কথা অসমাপ্ত থাকে দরজায় কড়া পড়তে।

“ভেতরে এসো।”

তরুণী ভৃত্যাটি দরজা খুলে নত মুখে দাঁড়ায়,

“মনিব, একজন ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তাঁকে কি বসার ঘরে অপেক্ষা করতে বলব?”

মার্কোভিকের দিকে তাকিয়ে ড্যামিয়ান হাসল। বলল,

“ক’টা দিন নয় আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাচ্ছি প্রৌঢ় ম্যাক্সওয়েল। তোমার আমার আমাদের সবার সফলতার চাবিকাঠি দুয়ারে এসে গেছে।”

তারপর ভৃত্যার দিকে তাকিয়ে আদেশ করল,

“যাও, আমার আন্নেকে সসম্মানে এখানে নিয়ে এসো।”

ভৃত্যাটি প্রস্থান করল। একটু পর আন্না মেরিওকে নিয়ে হাজির হয়। মার্কোভিক ও ম্যাক্সিমের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তে ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে আন্না মেরিওকে। বিপর্যস্ত, বিপন্ন। কিন্তু চোখ জ্বলন্ত। ড্যামিয়ান এগিয়ে আসতে আন্না মেরিও গম্ভীর গলায় বললেন,

“আমি এখানে খোশগল্প করতে আসিনি ড্যামিয়ান। তুমি আগেও যেমন ঘৃণিত ছিলে আমার চোখে, আজও আছো ভবিষ্যতেও থাকবে। অযথা তোষামোদি করতে এসো না। ওই পিশাচকে আমি আমার মেয়ের জীবন থেকে চিরতরে সরাতে চাই। আমার ভাই-বোনের মৃত্যু, পূর্বপুরুষদের অপমান, নির্যাতনের কারণ যদি ওই পিশাচই হয় তবে ওর ধ্বংস কামনা করছি আমি।”

মেয়ের প্রতি পুষে রাখা সব রাগ ভুলে গেলেন মার্কোভিক। বিড়বিড় করে বললেন,

“এই না হলে আমার রক্ত। আমার মেয়ে। ম্যাক্সওয়েলদের মেয়ে।” ম্যাক্সিম পিতার কাঁধে হাত রাখল,

“বলেছিলাম না আপনাকে রক্ত সময়মতো ঠিক জ্বলে উঠবে। দেখুন বাবা, দেখুন।”

ড্যামিয়ান কাছে এসে আন্না মেরিওর করপুটে চুম্বন করল। তারপর বলল,
“তোমার প্রার্থনা কবুল হোক আন্নে।” ম্যাক্সিম ও মার্কোভিকও সমস্বরে একই কথা বলে ওঠে।

পেটে চিনচিনে ব্যথা টের পাচ্ছে ফের ইসাবেলা। হাতের ব্যান্ডেজ খুলে কাটা জায়গাটাতে জোরে কামড়ে ধরল। চোখ খিঁচে রইল ব্যথায়। জিহ্বায় রক্তের স্বাদ না পাওয়া পর্যন্ত ওভাবে কামড়ে ধরে থাকল হাতটা। রক্ত জিহবায় পড়তে চুষে নেয়। এমন করতে বড়ো অস্বস্তি ও বমির উদ্রেক হলো। কিন্তু এমন না করেও যে উপায় নেই।
কিছুক্ষণ পরে পেটের চিনচিনে ব্যথাটা আর টের পায় না। হাঁপ ছাড়ে। পুনরায় ব্যান্ডেজ করল। হাতের ব্যথা সহনীয় কিন্তু পেটের ওই ব্যথা সহনশীলতার বাইরে। উপায়ন্তর না দেখে এই পন্থা বেছে নিয়েছে। আজ নিকোলাস এলে ঠিক বলবে সমস্যার কথাটা। ও নিশ্চয় একটা উপায় বের করবে। মুক্তি দেবে এই যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু এই যন্ত্রণার কারণ এখনও অনুসন্ধান করে পেল না।
দেওয়াল ঘড়িতে পৌনে নয়টার ঘণ্টা বাজল। ইসাবেলা বালিশে মাথা দিয়ে সিলিং এ একদৃষ্টে চেয়ে আছে। সকাল বেলা দেখা মায়ের শীতল চোখদুটো ওর রক্ত হিম করে দেয়। তিনি কি ভোলইয়ার মৃত্যুর পেছনে ইসাবেলাকে সন্দেহ করেছেন? সত্যিটা জানলে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হবে ভাবতেই মন বিষাদে ভরে যায়। মা ওকে আগের চাইতে এবার আরও ঘৃণা করবেন। সকলে ঘৃণার চোখে তাকাবে। এত ঘৃণা কী করে সহ্য করবে? শত, সহস্র মাইলের দুরত্বেও এ ঘৃণার বাণ রোজ ওর বুকে বিঁধবে, রোজ পীড়িত করবে।

গতকাল নিকোলাসের সাথে চলে গেলেই ভালো হতো। কেন গেল না? কীসের মায়ায় এখনও এই মহলে পড়ে আছে? আপনজনেরা ওকে ঘৃণা করে পর করেছে কিন্তু ও তো তাদের এখনও ভালোবাসে, এখনও আপনই ভাবে। এখান থেকে একবার গেলে আর ফেরা হবে না হয়তো। এরা কি ভুলে যাবে ইসাবেলাকে? কেউ মনে রাখবে না? এই রক্তের বাঁধন ছিঁড়ে যেতে কষ্ট পায় ও। এদের ব্যবহারে কান্না পায়, চার দেওয়ালের মাঝে সংকুচিত আর বড়ো একা হয়ে পড়ে। তবুও এদের ছাড়তে গিয়ে থমকে যায়, চোখ ফেটে কান্না আসে।
চোখ মুছে ইসাবেলা উঠে বসল। কিছু জিনিস স্মৃতি হিসেবে নিয়ে যাবে। সেগুলো ব্যাগে গোছাতে লাগল। ব্যাগ গুছিয়ে এই কক্ষটা আরেকবার একনজর দেখে। ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। শেষবার বাবা- মায়ের সঙ্গে অন্তত দেখা করা উচিত। না, চলে যাওয়ার কথা বলবে না। দরজা খুলে আজ অনেকদিন পর বাইরে পা দিলো।

রাশিয়ার নিবিড় জঙ্গলের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে ড্যামিয়ানের গাড়ি। পাশে ম্যাক্সিম, পেছনে মার্কোভিক ও আন্না মেরিও। সম্পূর্ণ রাস্তায় তিনি একটা কথাও বলেননি। এই মুহূর্তে তাঁর মনে কী চলছে তিনজনের কেউ ই জানে না। যাই ভাবুক শুধু প্লানের বিপরীত না গেলেই হলো।

“আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে আর মাত্র কয়েক কদম দূরে। সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসে গেছি।”

ড্যামিয়ান নেমে দাঁড়ায়। একে একে বাকিরা নামল। সবার শেষে আন্না মেরিও। আড়চোখে পেছনে তাকালেন। শ’খানেক সৈন্য নিয়ে এসেছে ড্যামিয়ান। শুধু মানুষ নয় নেকড়েও রয়েছে। কেমন যেন লাগে তাঁর। ড্যামিয়ান পিস্তল বের করে হাতে নেয়। ম্যাক্সিমও তাই করল। সাথে পিশাচবধের সামগ্রী শেষবার যাচাই করে। মার্কোভিক নিরস্ত্র দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এর বেশিদূর যাবেন না। গাড়িতে বসে জয়ের স্লোগানের অপেক্ষা করবেন। মেয়েকে বুঝালেন আজ তিনি গর্বিত আন্না মেরিওকে মেয়ে হিসেবে পেয়ে। ম্যাক্সওয়েলরা চিরজীবন তাঁর এই কর্মের জন্য প্রশংসা করে যাবে। আন্না মেরিও কিন্তু চুপ করে রইলেন। কঠিন প্রতিমার ন্যায় স্থির তিনি। ড্যামিয়ান সৈন্যদের আদেশ করল তাঁকে অনুসরণ করতে। এগিয়ে গেল সে। পিছু পিছু ম্যাক্সিম ও আন্না মেরিও। তাদের পেছনে সৈন্যরা। জঙ্গলে পা রাখতেই আড়াল থেকে নেকড়ের চাপা গর্জন শুনতে পায়। সৈন্যদের সতর্ক হতে ইশারা করে ড্যামিয়ান। ম্যাক্সিমের হৃদয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। রজার এখানেই কোথাও দম ছেড়েছিল।

“প্রিয় ভাইটি আমার। তোমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব আজ আমি। একেকটার গর্দান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের রক্তে গোসল করব আমি।” মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল ম্যাক্সিম। ড্যামিয়ান আন্না মেরিওর দিকে নিজের পিস্তল বাড়িয়ে দিলেন,

“এটা রাখো। তোমাকে নিরাপদ রাখতে সাহায্য করবে এটা।”

একবার পিস্তল আরেকবার ড্যামিয়ানের দিকে তাকালেন আন্না মেরিও। তারপর বললেন,

“তুমি নিরস্ত্র থাকবে?”

ড্যামিয়ানের মনে লাগল কথাটা। এখনও আন্নে ওর জন্য চিন্তা করে। একই রক্ত বইছে ওদের দেহে। এই টানেই ড্যামিয়ান এদের পর ভাবতে পারে না। রক্তসম্পর্কের এই টানে এরা এক হয়েছে আজ। আন্না মেরিও ওর মুচকি হাসি দেখে চট করে মুখ বদলে ফেললেন। ড্যামিয়ান বলল,

“চিন্তা করো না আন্নে। আমার দুটো হাত এই পিস্তল থেকেও বড়ো অস্ত্র।”

আন্না মেরিও মুখ ঘুরিয়ে নিতে ড্যামিয়ান সামনে তাকাল। কয়েক পা সামনে দিতে কোথা থেকে একটা নেকড়ে আক্রমণ করে বসল। তারপর আরেকটা, আরেকটা…. ড্যামিয়ান রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। একাই পর পর দুটোর গলা ছিঁড়ে মাথা আলাদা করে ফেললো। যত মারছে ততই যেন সংখ্যায় বাড়ছে নেকড়ের দল। মনে মনে নিকোলাসের এই নিরাপত্তা নীতিকে গালি দিলো ড্যামিয়ান। আজ এসপার ওসপার করেই যাবে। হয় শেষ করবে না হয় শেষ হবে। দুই পক্ষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চললো। তলোয়ারের ঝংকার, পিস্তলের বিকট শব্দে জঙ্গল কাঁপছে যেন। সমানে সমানে মরছে দুই পক্ষের সৈন্যরা। বাতাস ওদের আর্তগর্জনে ভারি হয়ে ওঠে। ড্যামিয়ান নেকড়েগুলোর গর্দান ছিঁড়ে, আছরে ফেলে রক্তাক্ত শরীরে আন্না মেরিওর কাছে এলো। ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন তিনি। হাতের পিস্তলটা কখন যে পড়ে গেছে জানেনও না। ম্যাক্সিম তাঁকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতর রেখেছে। ভয়ার্ত রক্তশূন্য মুখে চারিদিকে দেখছেন। এ কোন নরকে এসে পড়েছেন? মনে মনে ভাবলেন। ড্যামিয়ান তাঁর কাঁধে হাত রাখল।

“আন্নে, তোমাকে ভয় পেলে চলবে না। ইসাবেলার ভালোর জন্য, রজার ও ভ্যালেরির মৃত আত্মার শান্তির জন্য, ম্যাক্সওয়েলদের জন্য তোমাকে সাহসী হতে হবে। ওই যে সামনের দুর্গ দেখছো। ওখানেই শুয়ে আছে ওই পিশাচটা। আমাদের হাতে সময় কম আন্নে। শক্ত করো নিজেকে। ভয়কে ঠেলে সরিয়ে দাও। যাও আন্নে, ওই পিশাচকে শেষ করে এসো।”

আন্না মেরিওর ঠাণ্ডা রক্ত মুহূর্তে গরম হয়ে ওঠে। ভয় পুরোপুরি ঠেলে সরাতে সক্ষম না হলেও ড্যামিয়ানের কথাতে মাথা নাড়ান সামনে পেছনে। গভীর শ্বাস নিলেন। ড্যামিয়ান ম্যাক্সিমকে ইশারা করে দুর্গ পর্যন্ত নিরাপদে আন্নাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। দুই ভাইবোনকে সামনের বাধা সরিয়ে এগিয়ে যেতে দেখছে ড্যামিয়ান। দুর্গের চূড়ায় তাকাল। সহাস্যে সদর্পে বলল,

“আফসোস আমাদের সাক্ষাৎ এই পৃথিবীতে আর হলো না বড়ো ভাই। বড়ো ইচ্ছে ছিল তোমার মুখোমুখি হওয়ার কিন্তু তুমি সেই ইচ্ছেতে পানি ঢেলে দিয়েছ। যদি সেদিন ঈর্ষা না করতে, মাকে হত্যা না করতে তবে আজ আমাদের সম্পর্ক ভিন্ন রকম হতো। আমরা নিশ্চিত বন্ধু হতাম। ওপরে গিয়ে তোমার ম্যাক্স বাবাকে আমার কথা জানিয়ো। আমি জানি এখন তুমি সব জেনে গেছ। পিতাকে বলো আমি তাঁকে ভালোবাসি। আর আমার মা_” চোয়াল কঠিন হয় ড্যামিয়ানের। একটা নেকড়ে এলো আক্রমণ করতে। ড্যামিয়ান খানিক সরে যায়। নেকড়ে আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে ঘোৎ ঘোৎ করে। হিংস্র চাহনিতে চেয়ে আছে। ড্যামিয়ান ফের তাকায় দুর্গের দিকে। ক্রুর কুটিল হেসে বলে,

“তোমার বেলাকে আমি বড়ো আদরে আহ্লাদে রাখব বড়ো ভাই। এতটা ভালোবাসা দেবো যে ও তোমায় ভুলে যাবে, চিরতরে ভুলে যাবে। বড়ো ভাইয়ের কাছে ছোটো ভাই ওয়াদা করছে। আলবিদা বড়ো ভাই, আলবিদা।”

নেকড়েটা দাঁত খিচিয়ে ওর দিকে আক্রমণ করতে এলে ড্যামিয়ান ছুটে গেল সেদিকে। মুহূর্তে একজন মানব যুবক পরিবর্তন হয় বাদামি লোমশওয়ালা এক নেকড়েতে। কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে অপর নেকড়েটির গলা। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে গর্জন করল।

পুরো দুর্গে ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। বাইরের নেকড়ে ও মানুষের গর্জন দরজার মুখে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে। আন্না মেরিও ত্রস্ত পায়ে ভেতরে পা রাখলেন। ধুলোমলিন শ্রী ছাড়া দুর্গটির ভেতরের অংশ। কালের চাকায় পিষ্ট হয়ে একসময়ের জমকালো, ঐশ্বর্যময় সৌন্দর্যের দুর্গটির জীর্ণ দীন অবস্থা। আগাছা, মাকড়সার জালে জড়িয়ে আছে হলঘর। ধুলোর ওপর পায়ের ছাপ ফেলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ম্যাক্সিম থামাল। ম্যাপ মুখস্থ করে এসেছে সে। সিঁড়ির নিচে গোপন কক্ষে রয়েছে নিকোলাসের কফিন। কক্ষের মুখ খুঁজতে লাগল। ভালো করে খুঁজতে পেয়ে গেল মুখ। পাথরের পাটাতনে মুখটি বন্ধ করা। ম্যাক্সিমের একার পক্ষে সম্ভব নয় এটা উঠানো। আন্না মেরিওকে দাঁড় করিয়ে সে সাহায্যের জন্য গেল। সতর্ক করে পিস্তল এবং পিশাচবধের সামগ্রী রেখে গেল সেখানে। ম্যাক্সিম যেতে আন্না মেরিও পাটাতন সরাতে চেষ্টা করে। পারলেন না। অনেক্ক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও ম্যাক্সিম এলো না। আন্না মেরিও সবকিছু তুলে নিয়ে অন্য দিকে পথ খুঁজলেন। দুর্গের এদিক ওদিক ঘুরেও পথ পেলেন না। বাদুরের বিষ্ঠা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। উৎকট গন্ধে তাঁর পেট মুচরে ওঠে। কয়েকটা বাদুর ঝিম ধরে ঝুলছিল এখানে সেখানে। নিঃশব্দে তিনি ফের সিঁড়ির নিচে ফিরে এলেন। আশ্চর্য পাটাতন সরিয়েছে কেউ! আশপাশে ম্যাক্সিমকে খুঁজে পেলেন না। দরজার মুখে একটা নেকড়ে দাঁড়িয়ে। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় পেয়ে গেলেন। কাঁপা হাতে পিস্তল উঠাতে বাদামি পশমওয়ালা নেকড়টা চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল। নেকড়েটা বোধহয় তাঁকে সাহায্য করতে এসেছিল। কিন্তু কী যেন চেনা ওর মধ্যে।

“পাটাতন কে সরালো? তুমি?” ম্যাক্সিমের বিস্মিত গলা। আন্না মেরিও মাথা নাড়ালেন,

“না, একটা নেকড়ে। বাদামি পশমওয়ালা। তুমি চেনো ওটাকে? ড্যামিয়ানের পোষা কি? ওর চোখজোড়া কেমন যেন চেনা চেনা জানো!”

ম্যাক্সিম গলা ঝাড়লেন। দৃষ্টি লুকালেন। প্রসঙ্গ পালটে বললেন,

“আর দেরি করো না আন্নে। নেমে যাও নিচে। একটু পর পিশাচটা জেগে উঠলে আমরা সকলে মারা পড়ব। জলদি করো।”

সিঁড়ি বেয়ে অন্ধকার কবরে নামল দুজন। ম্যাক্সিম আলো জ্বালিয়েছে। নিচটা অস্বাভাবিক রকমের শীতল। গুমোট বাতাসে সোঁদা মাটির গন্ধে দম বন্ধ হয়ে এলো যেন আন্না মেরিওর। এদিক ওদিক তাকালেন সতর্কে। এক পা সামনে দিতে হঠাৎ ম্যাক্সিম বাহু চেপে ধরে। বা’দিকে আঙুল তুলে বলল,

“ওই যে পিশাচটার কফিন।”

আন্না মেরিও বাতির আলোয় একটু দূরে আবছা অন্ধকারের মাঝে মেরুণ রঙের কাঠের কফিনটা দেখতে পেলেন। ম্যাক্সিম তাঁর আগে এগিয়ে গেল। ঠেলে সরালো কফিনের মুখ। প্রতিশোধের নেশায় তার মগজ টগবগ করে ফুটছে। ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুণি পিশাচটার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আন্না মেরিও এসে দাঁড়ালেন কফিনের সামনে। তাকালের কফিনে শায়িত সুদর্শন পুরুষটার দিকে। এই রূপের জালে তাঁর সরলা মেয়েকে বশ করেছে, সতিত্ব কেড়েছে। এই পিশাচের জন্য মায়ের দেওয়া শিক্ষা, আপন ধর্ম সব বিসর্জন দিয়েছে তাঁর বেলা। পরিবারকে ত্যাগ করতেও রাজি আজ ও। নিকোলাস মিথ্যা ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে টেনে নিতে চাইছে অন্ধকার নরকে। মা হয়ে তা তিনি কী করে হতে দেবেন! সন্তানের মঙ্গলের জন্য মায়েরা সৃষ্টিকর্তার সাথে লড়ে যায় আর এ তো সামান্য এক পিশাচ। আন্না মেরিওর মনে হলো জীবনে তিনি কাওকে এতটা ঘৃণা করেননি এই পিশাচ যুবককে যতটা করেন।

“তাকিয়ে তাকিয়ে কী দেখছো? শেষ করে ফেলো ওকে? তাড়াতাড়ি করো।”

আন্না মেরিও ক্রুশটা হাতে নিলেন। ওপরে তুলতে চোখ মেলে তাকায় নিকোলাস। শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। চোখ রক্তজবার ন্যায়। হাত থেকে ছুরি খসে পড়ে গেল। পিছিয়ে গেলেন আন্না মেরিও। বুক কাঁপছে ভয়ে।

“ও তোমার ক্ষতি করার অবস্থায় নেই এখন। ভয় পেয়ো না আন্নে। এগিয়ে এসো। ক্রুশটা তুলে নাও। আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। জলদি করো আন্নে। ওর জেগে ওঠার সময় হয়ে গেল।”

ম্যাক্সিমের তাড়ায় আন্না মেরিও ফের ক্রুশটা তুললেন। এগিয়ে গেলেন কফিনের দিকে। নিকোলাসের মুখে তাকালেন না। সোজা ওর বুকের বা’পাশে ঢুকিয়ে দিলেন। ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল নিকোলাস দেহ। ম্যাক্সিম রসুন গুঁজে দেয় ঠোঁটের ফাঁকে। আন্না মেরিও ছুরি তুলে নিলেন। তাকাবেন না তাকাবেন না করেও নিকোলাসের মুখের দিকে তাকালেন। সেই রক্তচক্ষু, শ্বাদন্ত কিছুই নেই। অসহায় এক মুখ দেখছেন আন্না মেরিও। দৃষ্টিতে আকুতি। বাঁচার? তাঁর মাতৃহৃদয় নরম হয়।

বাঁচার আকুতি কোনোদিন দেখায়নি নিকোলাস। শেষ হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল না আগে। শূন্যতায় বাঁচা আর মরা কী! কিন্তু এখন তো শূন্য নয়। ইসাবেলা ওর আছে। এরা আজ সেটাও কেঁড়ে নিতে মরিয়া। এত আকাঙ্ক্ষায় পাওয়া ভালোবাসা কেন এদের চক্ষুশূল? নিকোলাস তো কিছু চায় না। শুধু ইসাবেলার সাথে থাকতে চায়। প্রয়োজনে ও নোভার মতো হয়ে যাবে। মানুষের রক্ত পান ত্যাগ করবে, মানুষের মতো সামাজিক হবে। যাকে কোনোদিন মানবে না বলেছিল তাঁকেও মানবে। নত হবে ওই সৃষ্টিকর্তার সামনে। তবুও এরা ওকে না মারুক। আন্না মেরিওর দয়া হোক একটু। দুপুর হতে আর কত দেরি! নিকোলাসের এই অসহায়ত্ব দূর হোক, হাতে পায়ে প্রাণ আসুক। আন্না মেরিও এত বড়ো অবিচার করতে পারেন না মেয়ের ওপর। ইসাবেলা ওর পথ চেয়ে থাকবে। নিকোলাস কী করবে এখন! সৃষ্টিকর্তা ক্ষমা করুক, দয়া করুক ওর ওপর। বাকি জীবন একনিষ্ঠমনে তাঁর গোলামি করে যাবে নিকোলাস। শুধু ইসাবেলার থেকে দূর না করুক, দূর না করুক।

এই যুবক তাঁর বেলার ভালোবাসা। যেই ভালোবাসার টানে সব ছাড়তে রাজি ও৷ এ কী নিছক মোহ বা ছল? আন্না মেরিওর হাত কাঁপল। ছুরিটা তিনি শক্ত করে ধরতে পারছেন না। নিকোলাস মরলে ইসাবেলা আগের মতো হবে তো? পিটারকে ভুলতে পারলে একেও নিশ্চয় ভুলতে পারবে, পারবে না? এ যে ওর জন্য ঠিক নয়।

“আন্নে সময় বয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি করো। ও তোমাকে ছলনায় ফেলতে চাইছে। ভুলো না ওতে।

ভাইয়ের কথা উপেক্ষা করে আন্না মেরিও বিড়বিড় করে বললেন,
“তুই আমার নিষ্পাপ মেয়ের গায়ে পাপ লাগিয়েছিস। আমাদের মাঝে এনেছিস দুরত্ব । ম্যাক্সওয়েলদের যখনই সামনে পেয়েছিস নির্মমভাবে হত্যা করেছিস। আমার ভ্যালেরিয়া, ভাই রজার কাওকে ছাড়িসনি। আজ কি দেখেছি জানিস? আমার বেলা, তাশার প্রিয় বিড়ালটিকে হত্যা করেছে। কী করে ছেড়েছিস আমার মেয়েটিকে! তোর ধ্বংস আমার মেয়ের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনবে। শান্তি ফিরে পাবে। এক মা তাঁর মেয়ের মঙ্গলের জন্য সব করতে পারে। সেটা তোর মতো পিশাচবধই হোক না কেন!”

আন্না মেরিও ক্রোধে কাঁপছেন। নিকোলাসের কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। ইসাবেলা বিড়াল হত্যা করেছে? কেন? ও কি কিছু গোপন করেছে! ওর কিছু না হোক। ধ্বংসের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়েও ইসাবেলার জন্য দুশ্চিন্তা করল। হতাশায় ডুবে যায়। পরাজিত এক প্রেমিক, যে নিজেকেই বাঁচাতে ব্যর্থ সে নিজের ভালোবাসা কী করে বাঁচাবে! ওর শেষ হয়ে যাওয়াতে যদি ইসাবেলার কল্যাণ হয়, জীবনে শান্তি আসে তবে তাই হোক। চোখ বুজল নিকোলাস। আন্না মেরিও শক্ত করে ছুরিটা ধরলেন।

ইসাবেলা পিতা-মাতার কক্ষের দরজায় নক করে। কয়েকবার নক করতেও ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না৷ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ওলেগ আধশোয়া হয়ে আছেন বিছানার কোণায়। একটা হাত তার মুখের ওপরে। বাবাকে ভীষণ মিস করবে ইসাবেলা। চোখ ভিজে এলো। ধীর পায়ে পিতার মাথার কাছে দাঁড়ায়।

“বাবা।”

ওলেগ চুপ রইলেন। একচুল নড়লেন না। ইসাবেলার গলা ধরে এলো,

“বাবা।”

ওলেগ আস্তে আস্তে মুখের ওপর থেকে হাত সরালেন। কিন্তু চোখ মেললেন না। ইসাবেলা ঠোঁট চেপে কান্না গিলে বলল,

“আমার সাথে তুমিও কথা বলবে না বাবা? এত খারাপ হয়ে গেলাম আমি? এত পর?”

“পর?” চোখ মেললেন ওলেগ। কঠোর চাহনি তাঁর। এমনভাবে বাবাকে আগে দেখেনি ইসাবেলা। ওলেগ তিরস্কারের সুরে বললেন,

“আমরা পর করেছি? আমি তোমার হাত ধরে এত অনুনয় করলাম, এত বুঝালাম তারপরেও আমাদের ছেড়ে ওই পিশাচটার সাথে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছ। এখানে কেন এসেছ বিদায় নিতে? যাও বিদায় দিলাম। দূর হও আমার সামনে থেকে। স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ মেয়ে। তোমার মা ঠিকই বলেছিল। তোমাকে গর্ব ভেবে ভুল করেছি আমরা। আসলে তুমি আমাদের লজ্জা। যে সন্তান পিতা-মাতার মান সম্মান ডুবিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে এক পাপী, অভিশপ্ত শয়তানের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে সে লজ্জা ছাড়া কী?”

ইসাবেলা ঠোঁট সজোরে কামড়ে ধরে আছে। কান্না শব্দ রোধ করতে পারলেও চোখের পানি অপ্রতিরোধ্য। নিজেকে সামলে অশ্রুরুদ্ধ গলায় বলল,

“আমি স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ তাই না বাবা? তোমরা তো পিতা-মাতা৷ গুরুজন, সন্তানের শিক্ষক। তবে তোমরা কেন উদার হতে পারলে না? আমি তো স্বীকার করেছি ভুল হয়েছে আমার। অন্যায় করেছি তোমাদের না জানিয়ে বিয়েটা করে। জানিয়ে করলে বিয়েটা হতে দিতে বলো? কোনোদিন না। আমি যে ওকে খুব ভালোবাসি বাবা। ও আমার জীবনের পরম ও শ্রেষ্ঠ পাওয়া। একবার যদি শান্তিতে কথা বলতে তবে বুঝতে তোমার মেয়ের জন্য ওর চেয়ে উপযুক্ত পাত্র পৃথিবীতে আর নেই।”

“তাই বলে একটা পিশাচ!”

“বার বার কেন এই এক শব্দে থামছ তোমরা? অন্যের কথায় কেন বিচার করেছে ওকে। একবার নিজে থেকে বুঝতে চাওনি, চেষ্টাও করোনি। কেন? ও পিশাচ বলে। পিশাচ বলে কি ওর ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার থাকবে না?” ওলেগ জবাব দিলেন না। ইসাবেলা চোখ মুছলো।

“আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো বাবা। তোমরা যদি একটু উদার হতে তবে আজ আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে বলতে হতো না, চলে যাচ্ছি আমি। বাধ্য করেছো তোমাদের ছাড়তে আমাকে। ভালো থেকো বাবা।”

ইসাবেলা দরজার দিকে পা বাড়াতে ওলেগ উঠে বসেন।

“তুমি কোথাও যাচ্ছো না, শুনেছ? জেনেশুনে তোমাকে এতবড়ো ভুল করতে দিতে পারি না আমরা।”

“আমি যাব বাবা, অবশ্যই যাব। আমি অ্যাডাল্ট হয়েছি। জোর করে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারবে না। এই মহলে বন্দি করে রাখতে পারবে না তোমরা আমাকে।”

ওলেগ কাষ্ঠ হাসলেন।

“কার সাথে যাবে শুনি? ওই পিশাচ তো আসবে না। তোমার পর্যন্ত পৌঁছানোর ওর সকল পথ বন্ধ করতে গিয়েছে আন্নে।”

ইসাবেলা চমকে তাকায়। আর্ত হয়ে ওঠে ওর মুখ,

“ভয় দেখানোর জন্য মিথ্যা বলছ, না বাবা?”

ওলেগ কঠিন মুখে বসে আছেন। ইসাবেলার বুক দুরুদুরু করছে। এদিক ওদিকে তাকায়।

“মা কোথায়, বাবা? মা, মা। বাবা প্লিজ বলো?”

মেয়ের কাতর প্রশ্নের জবাবে ওলেগের গলা দিয়ে কিছুই বের হয় না। তিনি মনকে একটাই কথায় বার বার বুঝ দিচ্ছেন, যা করছেন তাতেই ইসাবেলার মঙ্গল। ইসাবেলা শঙ্কিত হয়ে উঠল। এই কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে এলো। মা মা বলে চিৎকার করতে করতে হলঘরে নামল। ওলেগ চোখ বন্ধ করলেন। মেয়েদুটো তাঁর বড়ো আদরের। ওদের সকল দুঃখ কষ্ট দ্বিগুণ হয়ে লেগেছে তাঁর বুকে। আজ কি না নিজে ছোটো মেয়েকে দুঃখ দিলেন! কিন্তু এতেই যে মেয়েটার কল্যাণ নিহিত।

হলঘরে বসে থাকা সকলে ইসাবেলার চিৎকারে এগিয়ে এলো। পাগলের মতো মা মা করে ডাকছে। কেউ জানে না আন্না মেরিও কোথায়। মা’কে কোথাও না পেয়ে ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। বার বার বাবার কথা স্মরণ হয়। মা ওর এতবড়ো সর্বনাশ করবে? নিকোলাসকে হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত, ভীত৷ হঠাৎই পেটের বুঁজে থাকা ব্যথা রগে রগে চিলিক দিয়ে ওঠে। দুহাত চেপে ধরে বসে পড়ে ফ্লোরে। ভ্লাদিমি, মাতভেই ও তাতিয়ানা ছুটে এলো। আর্তচিৎকার করে ওঠে ব্যথায় ইসাবেলা।

“ইসাবেল, কী হলো তোমার?” তাতিয়ানা উদ্বিগ্ন হলো। বোনকে জড়িয়ে ধরেছে। ইসাবেলা ওদের প্রশ্ন উপেক্ষা করে কোনোরকমে হাতের ব্যান্ডেজ খুললো। রক্ত চুষতে থাকে। ভয়ে ছিটকে সরে যায় তাতিয়ানা। বাকিরা বিস্ময়াহত। পিছিয়ে যায় ওরা। কিন্তু মাতভেই তেমনই দাঁড়িয়ে আছে। ও যে এসবের সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। বসল এক হাঁটু ভেঙে ইসাবেলার সামনে৷

“বেল?”

সিক্ত রক্তাক্ত মুখে তাকালো ইসাবেলা।

“মাতভেই আমার নিকোলাস_” ঠোঁট কাঁপছে ইসাবেলার। ভুরু কুঁচকে তাকায় মাতভেই। নিকোলাস! আবার সেই নাম। মাতভেই কিছু বলবে তখনই সদর দরজা খুলে গেল। আন্না মেরিও নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ইসাবেলা আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মা মেয়ের দৃষ্টি এক হয়। পেটের ব্যথা ক্ষীণ হয়ে আসছে কিন্তু বুকের ব্যথা বড্ড বেশি ইসাবেলার। কী শান্ত ওর মায়ের মুখ! সারা দেহ যেন অবশ হয়ে এলো ইসাবেলার। গলা চিরে বেরোলো,

“তুমি ওকে শেষ করে এলে, মা?”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here