#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৪৮
Writer তানিয়া শেখ
বারের ভিআইপি রুমে বসে আছে ড্যামিয়ান। হাতে সিগার আর সামনে ভদকার গ্লাস। কোলে বসা বাদামি চুলো এক তরুণী বার ডান্সার। ড্যামিয়ানের খালি হাত মেয়েটির শরীরের সর্ব স্থানে বিচরণ করছে। কিন্তু ওর দৃষ্টি সামনের ব্যক্তি দুজনের দিকে। তাদের কামুক চাহনি মেয়েটির ওপর। ড্যামিয়ান সিগারে টান দিতে তরুণী ঠোঁট চেপে সবটা ধোঁয়া নিজের মুখে নিলো। তারপর ঘুরে বসে সামনের ব্যক্তি দুটোর মুখের ওপর ছেড়ে মুচকি হাসে। ওর কোমরে স্থির ড্যামিয়ানের হাতটা শক্ত হয়। ব্যথায় “উহু” করে উঠল তরুণী।
“বিহেভ!” সতর্ক করল ড্যামিয়ান। তরুণীর মুখটা মলিন হলো। কোমরে ভীষণ ব্যথা দেওয়ায় অভিমান করে। কোল ছেড়ে উঠতে গেলে বাধা দেয় ড্যামিয়ান। বাজখাঁই গলায় বলল,
“রাগ করেছ? কেন? ইউ ওয়ান্ট থ্রিসাম, হুঁ?”
তরুণীর গলা চেপে ধরে এক হাতে। ভয়ে মুখের রঙ উড়ে যায় মেয়েটার। ও ড্যামিয়ানকে চেনে প্রায় এক সপ্তাহ হলো। অর্থবান বলে ড্যামিয়ানের সঙ্গী হওয়ার প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হয়েছে। দেখতেও সে সুদর্শন। কিন্তু কয়েকদিন যেতে এই সুন্দরের আড়ালের আসল রূপটা ও দেখতে পায়। লোকটা বিকৃত মানসিকতার। সব কিছু বড়ো অদ্ভুত। ওর কিছু কাজে মেয়েটা ইদানীং ভয় পেতে শুরু করেছে। এই যে এখন যেভাবে তাকিয়ে কথা বলছে তা রীতিমতো ভীতির সৃষ্টি করে।
“সরি স্যার, আ’ম সরি।”
মেয়েটা ক্ষমা চায়। ড্যামিয়ান মেয়েটার ক্ষমা প্রার্থনা এড়িয়ে সামনে বসা ব্যক্তি দুজনকে আদেশ করে,
“বের হ এখান থেকে, এক্ষুনি।”
ব্যক্তি দুজন ভীত মুখে বেরিয়ে যায়। ড্যামিয়ান তরুণীর গলায় চাপ বাড়িয়ে বিকৃত গলায় বলল,
“ওদের দেখে তোর ভেতরের বেশ্যাটা জেগে উঠেছে, হ্যাঁ?”
“স্যা_র” তরুণীর গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে এলো ড্যামিয়ানের হাতের চাপে। ড্যামিয়ানের মায়া হয় না। চোখ দুটো নির্মম, হিংস্র। তরুণীকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে আদেশ করে,
“হাঁটুর ওপর বস, কুক্কুরি।”
তরুণী তাড়াতাড়ি হাঁটুর ওপর বসে ফুপাতে লাগল। ড্যামিয়ান বেল্ট খুলে ওর গলায় বাধে। শেষ অংশ টানতে তরুনীর শ্বাসরোধ হয়ে এলো যেন। মুখ হা করল কথা বলার জন্য। ড্যামিয়ান দু আঙুল মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ায় কথাগুলো কেবল গোঙানির মতো শোনায়।
“হামাগুড়ি দে।
তরুণী ইতস্তত করে সামান্য। ড্যামিয়ান বেল্টের শেষ অংশে ফের টান দিতে তরুণীর গলার বাঁধনে চাপ পড়ে। হামাগুড়ি দিতে বাধ্য হয়। ওর দু-চোখ ফেটে জল পড়ছে এই লাঞ্ছনায়, কিন্তু ভয় পায় প্রতিবাদ করতে।
“যতক্ষণ না বলব এভাবেই থাকবি। কোনো কথা হবে না, না কোনো নড়াচড়া। বুঝাতে পেরেছি?”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় তরুণী। মেয়েটি যেন মানুষ নয় পালিত প্রভুভক্ত কুকুর ড্যামিয়ানের কাছে। যার নিয়ন্ত্রণ এখন ওর হাতে৷
কিছুক্ষণ পর বারের ভিআইপি রুমের দরজায় নক পড়ে। বিরক্ত হয় ড্যামিয়ান।
“কে?”
“আমি।”
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে মুখের ওপর থেকে বিরক্ত মুছে গেল।
“ভেতরে এসো।”
আগন্তুক ভেতরে ঢুকতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার ভান ধরে বলল,
“পার্টনার!”
আগন্তুক ফ্লোরে হামাগুড়ি দেওয়া মেয়েটিকে দেখে মুচকি হাসল। তারপর তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
“আমরা পার্টনার নই আর না হব।”
ড্যামিয়ান সামনের কাউচে বসতে ইশারা করে বলল,
“তুমি মানো আর না মানো আমি তো তোমাকে পার্টনারই ভাবি, পার্টনার। এই যে আমরা একে অপরের প্রয়োজনে পরস্পরকে সহযোগিতা করছি, এটা তো পার্টনাররাই করে, তাই না? তাছাড়া আমাদের দুজনের শত্রুও তো ওই একজনই। দুজনের গন্তব্য যখন এক পথে তখন পার্টনার হতে দোষ কোথায়?”
আগন্তুক চুপ করে রইলেন। হামাগুড়ি দেওয়া তরুণীর পশ্চাৎ আগন্তুকের দিকে। আগন্তুকের দৃষ্টি বার বার ওইদিকে যায়। ড্যামিয়ান মুচকি হেসে বলল,
“দেখার জিনিস দেখতে এত সংকোচ করছ কেন পার্টনার?”
আগন্তুক বিব্রতবোধ করে। ড্যামিয়ানের কথা অগ্রাহ্য করে বলে,
“আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।”
“সাহায্য! আমাকে? এবং কীভাবে?”
“ইসাবেলাকে পেতে সাহায্য করব।”
ড্যামিয়ান হাসল। আগন্তুক ভুরু কুঁচকায়। ড্যামিয়ান ভদকা গলায় ঢেলে বলল,
“যা আমার তা আমি সময় হলে নিজেই হাসিল করে নেবো পার্টনার। তোমাকে তার জন্য কষ্ট করতে হবে না।”
আগন্তুক বলল,
“সেটা আগে হলে পারতে, কিন্তু এখন আর পারবে না। নিকোলাস সর্বক্ষণ ওর সাথে ছায়া হয়ে থাকে। আমার তো মনে হয় ওর প্রেমে পড়েছে। ওই মেয়ের জন্য পুরো পিশাচ কমিউনিটিকে হুমকি দিয়েছে, ভেঙেছে এত বছরের নিয়ম। এখন কারো সাহস নেই ওই মেয়েকে ছোঁয়ার।”
“পিশাচ আর প্রেম? ইন্টারেস্টিং তো! আমার না বোর লাগছিল এতদিন, পার্টনার। এখন এক্সাইটেড ফিল হচ্ছে। একটি ফুলের দুজন দাবিদার। ওয়াও! দারুন জমবে এবার খেলা। প্রতিদ্বন্দ্বী যখন নিকোলাস উইলিয়াম তখন তো গেমস টোটালি জমে যাবে।”
আগন্তুক ভেবে এসেছিল ড্যামিয়ানকে ভয় পাইয়ে, রাগিয়ে কার্যোদ্ধার করবে, কিন্তু হচ্ছে উলটো। এই ড্যামিয়ান যে একটা অপ্রকৃতিস্থ ভুলেই গিয়েছিল আগন্তুক। অপ্রকৃতিস্থেরা ভয় পায় না বরং ভয় পাইয়ে ছাড়ে। আগন্তুকের হতাশ মুখে চেয়ে ক্রূর হাসল ড্যামিয়ান। বলল,
“চিন্তা করো না পার্টনার। তোমাকে আমি সাহায্য করব।”
“আমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”
শব্দ করে হাসল ড্যামিয়ান।
“মিথ্যা বলো না পার্টনার। আমি তুমি দুজনই জানি, আমরা স্বার্থ ছাড়া কাজ করি না। এখন স্বীকার করো, একে অপরের পার্টনার হবে কি না?”
আগন্তুক ভেবে বলল,
“ঠিক আছে, কিন্তু_”
ড্যামিয়ান থামিয়ে দিয়ে বলে,
“কিন্তু আমার একটি শর্ত আছে। তোমার সাহায্য আমার লাগছে না, কিন্তু আমার সাহায্য ছাড়া তুমি তোমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। এতবড় উপকার করে দেবো বিনিময়ে কিছু দেবে না পার্টনারকে?” ড্যামিয়ান বেল্টের শেষাংশ টেনে তরুণীকে দুপায়ের মাঝে আনে। আগন্তুক বলল,
“বিনিময়?”
“হ্যাঁ।” ড্যামিয়ান প্যান্টের চেইন খুলে তরুণীর মাথার পেছনে হাত রেখে ওর মুখটা কোলের ওপর চেপে ধরে। আগন্তুক চোখ সরিয়ে নেয়। মেয়েটির চাপা গোঙানি উপেক্ষা করে প্রশ্ন করে,
“কী চাও?”
“নোভালি।” বা’হাতে ডান গালের কাটা দাগটাতে হাত বুলিয়ে বলল ড্যামিয়ান। আগন্তুকের শান্ত চোখ মুহূর্তে জ্বলে ওঠে।
“কক্ষনো না।”
“তাহলে তোমার স্বপ্নও ভুলে যাও। ওই স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে না। ফিরে পাবে না হারিয়ে যাওয়া সেই সম্মান। আমি জানি, তোমার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে পার্টনার। আমি জানি, প্রতিনিয়ত কতটা কষ্টে কাটছে তোমার দিন। আমি এও জানি, তুমি ওই সামান্য ডাইনির জন্য নিজের স্বপ্নভঙ্গ হতে দেবে না।”
আগন্তুক চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ ভাবনা চিন্তার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ঠিক আছে।”
তরুণীকে ঠেলে ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন আঁটকে হাত বাড়ায়,
“পার্টনার।”
আগন্তুক হাতটার দিকে চেয়ে নাক কুঁচকায়। ড্যামিয়ান প্যান্টে হাত মুছে পুনরায় হাত বাড়াতে হ্যান্ডশেক করে জবাব দেয় ,
“পার্টনার।”
ঝিম ধরা একটা রাত। আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে মেঘের ফাঁকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে অনুজ্জ্বল চাঁদ। ইসাবেলা রাশভারী মুখে দাঁড়িয়ে আছে বেনাসের বাড়ির পেছনের বাগানে। রাতের বেলা এদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাকে সরগরম থাকে। আজ একেবারে ভূতুরে নিস্তব্ধতা। কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপছে ও। ইসাবেলা মুখ তুলল সামনে। নিকোলাস এক হাত দুরত্বে দাঁড়িয়ে। ইসাবেলার শ্বাসনালী ভেদ করে দেহের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে যায় সোঁদা মাটির গন্ধ। হৃৎস্পন্দনের গতির তীব্রতায় শ্বাস ভারী হয়। নিকোলাস এগোতেই ও বিড়বিড় করে,
“ঈশ্বর, ঈশ্বর।”
কোনো কিছুতেই আজ আর দুরত্ব তৈরি করতে পারে না নিকোলাসের থেকে। ওর ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া গালের দু’পাশে হাত রাখে নিকোলাস। ইসাবেলা তবুও চোখ তুলে তাকায় না। বিড়বিড়ানি আরো বাড়ে,
“ঈশ্বর, ঈশ্বর।”
নিকোলাস ওর গালদুটো দুহাতে হালকা ঘষে বলে,
“ঠাণ্ডায় জমে গেছো দেখছি।”
ইসাবেলা তখনো একইভাবে আছে। নিকোলাস হাঁপ ছেড়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে লাগল। ওর স্কার্ফে ঢাকা মাথার ওপর চুমু দিয়ে চুপ করে চেয়ে রইল সামনের অন্ধকারে। আজ অন্ধকারটাও কত সুন্দর লাগছে। ইসাবেলার বিড়বিড়ানি শুনে মুচকি হাসতে লাগল। দুজনে এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। ইসাবেলার বিড়বিড় শব্দ একসময় থেমে যায়। নিকোলাস ইসাবেলার মুখটা দেখল। ঘুমিয়ে পড়েছে ও। ইসাবেলার গালটা আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আমি কখনো সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করিনি। কিন্তু আজ বলতেই হচ্ছে মনোহরা তাঁর সৃষ্টি। মনোহরা তুমি, বেলা।”
ইসাবেলার কপালে চুম্বন দিয়ে আস্তে করে কোলে তুলে নিলো। তারপর হাওয়ার বেগে ছুটে গেল সামনে। মিনিট খানিক পরে এসে থামে একটি কাঠের বাড়ির সদরে। দেখলে অনুমেয় বাড়িটি পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত। হিম বাতাসে দুলছে পায়ের নিচের সবুজ ঘাস। নিকোলাস দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। ঘরের মাঝে বেশ বড়ো একটি খাট। উঁচু গদির বিছানা। তার ওপর শুইয়ে দিলো ইসাবেলাকে। শীতে কুঁকড়ে যায় ওর শরীর। নিকোলাস মোটা কম্বল টেনে দিলো গলা অব্দি। গাল ছুঁয়ে দেখল এখনো বেশ ঠাণ্ডা। সামনের ফায়ারপ্লেসটা জ্বালিয়ে এসে ইসাবেলার শিওরের পাশে বসল। বিছানায় থুতনি রেখে বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল। ইসাবেলা পাশ ফিরে শুতে নিকোলাস আবার একইভাবে বসল সেদিকে। রাত গভীর হয়, কিন্তু নিকোলাসের পলক পড়ে না। সামনের জানালার অন্ধকারে একপলক চেয়ে বলে,
“আজ রাত না ফুরাক, এমনই থাক, এমনই থাক। আমি দেখি তোমায়, তুমি তুমি নও, তুমি যেন
মৃত্যুর অমানিশায় জীবনের গান।
আমার আঁধারে আলোর স্ফুরণ।
মৃতসঞ্জীবনী, তুমি আমার মৃতসঞ্জীবনী।”
চলবে,,