বকুলতলা
১৩.
নিশ্চল চোখজোড়া তুখর করে চেয়ে আছে প্রণয়। গম্ভীর মুখটা ভীষণ বিষণ্ণতায় জড়িয়ে। দেখছে, তরীকে। শান্ত মেয়েটার হঠাৎ রেগে যাওয়াকে। তরীর ওড়না অবাধ্য ভাবে কুঁচকে আছে। দৃষ্টিতে কি মারাত্বক তেজ! প্রণয় নিঃশব্দে নিশ্বাস ফেললো। দহনে দহনে কাটাকাটি হয়ে দমবন্ধ হয়ে আসছে। কি বিশ্রী ব্যাপার!
প্রণয় আস্তে ধীরে বললো, “ঘরে যান। দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন নেই।”
তরী কি মানলো সেই কথা? একদম না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো আরও কিছুক্ষণ। চোখ টলমল করলো। খুব, খুব, খুব কষ্ট হলো। সিমেন্টের ধূলোবালিতে মাখোমাখো জমিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকালো। সিক্ত অথচ কঠিন কণ্ঠস্বরে বললো, “আপনারা যে কখনোই আমাদের আপন ছিলেন না, সেটা প্রমাণ করে দিলেন ভাইয়া। ধন্যবাদ।”
বলে আর দাঁড়ায়নি সে। হনহনিয়ে চলে গেছে। পেছনে ফেলে যাওয়া প্রণয় তখনো স্থির, শান্ত। সব বিষয়ে সে এত শান্ত থাকে কেন? আর ভালো লাগছে না। প্রণয় একটু প্রাণখুলে হাসতে চায়, কাঁদতে চায়, রাগ করতে চায়। কিন্তু হচ্ছে নাতো। কিচ্ছু হচ্ছে না।
বসার ঘরে জমজমাট পরিস্থিতি। সবার সাথে আয়েশা খাতুনও আছেন। অল্পসল্প মুখ কুঁচকে টিভির পর্দায় কি যেন দেখছেন। মাঝে মাঝে নিজের বৌমার কথায় সায় দিয়ে মাথা দোলাচ্ছেন। তরী ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকলো। এতগুলো মানুষের সামনে আয়েশা খাতুন না আবার তাকে ধমকে উঠেন!
তরী এক কদম এগোতে না এগোতেই প্রণয়ের ভাবী নূরী গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
—“তরী, এত দেড়ি হলো যে? তোমার ক্লাস না সাড়ে চারটায় শেষ?”
—“রাস্তায় জ্যাম ছিল ভাবী। তাই দেড়ি হয়ে গেছে।” আড়ষ্টতা নিয়ে কথাটা বলেই আড়চোখে আয়েশা খাতুনের দিকে তাকালো তরী। তিনি মুখশ্রী শক্ত করে চুপ করে আছেন।
নূরী ফোন ঘেটেঘেটে কি যেন বের করতে লাগলো। বললো, “আমার পাশে বসো তো তরী। তোমাকে একটা কিছু দেখাবো।”
তরী দ্বিধাদ্বন্দে বসলো। সময় নিলো একটু আধটু।
—“এই মেয়েটাকে চিনেছো? চেনার কথা তো! ভালো করে দেখো।”
ফোনের স্ক্রীনে একটা ভীষণ সুন্দরী মেয়ের প্রতিচ্ছবি। তরী খেয়াল করে দেখলো। মনে পরলো, কয়েকদিন আগেই এ বাড়িতেই মেয়েটাকে দেখেছে সে। প্রণয়ের বান্ধবী। নিভু নিভু স্বরে বললো, “উনি প্রণয় ভাইয়ার বান্ধবী না?”
তরীর উত্তর শুনে যেন ভীষণ খুশি নূরী। প্রবল উৎফুল্লতায় চোখে মুখে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠছে। বিস্তর হাসি ঠোঁটে আঠার মতো লেগে গেছে যেন, “হ্যাঁ, ঠিক চিনেছো। মেয়েটা অনেক সুন্দরী, তাই না?”
তরী মাথা দুলালো শুধু। নূরী আবার বললো, “আমি ভাবছি আমার ভাইয়ের জন্য মেয়েটাকে দেখবো। আমার ভাইয়ের সাথে মানাবে, বলো?”
তরী আমতা আমতা করলো, “মানাবে, হয়তো—”
আয়েশা খাতুন এতক্ষণ টিভিতে ধ্যান ধরে তাকিয়ে ছিলেন। অথচ তার কানটা ছিল এদিকেই। এমতাবস্থায় তিনি সরু গলায় হঠাৎ বললেন, “ও কি বুঝবে ভালো খারাপের নূরী? কাকে জিজ্ঞেস করছো? আর কাউকে পেলে না?”
তরী শুনলো। অপমানে মুখ থমথমে করে বসে রইলো। শ্বাশুড়ির কথাটা নূরীর কাছেও ক্ষীণ খারাপ ঠেকেছে। তবে সে এসবের মধ্যে বরাবরই নিজেকে জড়ায় না। এবারও জড়ালো না। চুপ থেকে আবারও ফোন ঘাটাঘাটি করতে লেগে পরলো।
লাইব্রেরি ঘরের দরজাটা আজকে হাঁট করে খোলা। তরী আসার সময় দেখেছে। কিন্তু ঢোকার সাহস হয়নি। একটু সময় লাগিয়ে দেখারও উপায় নেই। পাছে যদি প্রণয় এসে যায়? তরী খুব সাহিত্য প্রেমী। তাদের বাসার পেছনে ছোট্ট একটা টিনের ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন তরীর বাবা। তরীর জন্য। পুরাতন কাঠ দিয়ে থাক থাক করে অনেকগুলো তাকও বানিয়ে দিয়েছিলেন। ঘরের মাঝে একটা ছোট্ট টেবিল। দু’পাশে দুটো চেয়ার। আধভাঙ্গা জানালায় দঁড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা সাদা জবা ফুলের টব। খারাপ না। বরং তরীর জন্য সুখের জায়গা ছিল ঘরটা। টাকা জমিয়ে জমিয়ে বই কিনে তাকগুলোয় গুছিয়ে রাখতো তরী। সময়ে অসময়ে টেবিলটায় বসে বইয়ের পাতা উল্টাতো। কতদিন হয়ে গেল, পড়ার বইয়ের বাইরে উপন্যাসের বই ছোঁয়া হয় না। কারো করুণ কিংবা ভালোবাসাময় গল্প পড়া হয়না।
তরী ঘরের ভেতর ঢুকতেই সালেহা ভীষণ ভাবে চমকে উঠলো। শরীরের দৃঢ় কাঁপন নজর এড়ালো না মোটেও। সে উবু হয়ে বিছানায় কি যেন করছিল। তরী আসা মাত্রই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বিছানার এলোমেলো পাশটার দিকে একবার চেয়ে তরী জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে সালেহা? ভয় পেলে কেন?”
কাঁদো কাঁদো নয়নে তাকালো সালেহা। তটস্থ গলায় বললো, “আমি বিছানায় বইয়া বইয়া আচার খাইতেছিলাম আপা। ভুলেভালে হাত থেইকা আচার বিছানায় পইরা গেছে। সুরি আপা, ক্ষমা কইরা দাও। আমি ইচ্ছা কইরা করি নাই।”
সালেহার বলার ভঙ্গিমা দেখে তরীর হাসি পেল খুব। হাসলোও। বললো, “আমি তো বিছানায় কোনো দাগ দেখছিনা।”
—“বিছানার চাদর উঠাইয়া ফেলছি তো! বাথরুমে রাখছি। পরে ধুইয়া দিবোনি। এহন নতুন চাদর বিছাইতে ছিলাম।”
তরী এগিয়ে এসে মেঝেতে তার ব্যাগটা রাখলো। পা দুটোয় বিশ্রাম দিতে চট করে বসে পরলো বিছানায়। ক্লান্ত স্বরে বললো, “তোমাকে ধুতে হবে না। আমিই সকালে ধুয়ে দিবো। তুমি কি আমার জন্য একটু পানি আনতে পারবে?”
সালেহা দ্রুত মাথা দুলালো। বললো, “আনতাছি আপা।”
সে চলে যেতেই ভারী শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলো তরী। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেললো। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো বেশক্ষণ। ফ্যান চালু করা নেই। ফ্যানের তিনটের তিনটা পাখাতেই ময়লা জমে আছে। পরিষ্কার করতে হবে। এজন্যই হয়তো রাতে গায়ে বাতাসও লাগে না।
–
কিছুক্ষণ আগের মেঘলাটে আকাশ আর নেই। বাতাসে কেমন গরম গরম ভাব বিরাজ করছে। কলরবমূখর ক্লান্ত বিকেলবেলা। গাছের ডালে ডালে পাখিদের কূজন। ঘর্মাক্ত তরী ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। মেলায় এত ভীড় ছিল যে, ঠিকঠাক শ্বাস ফেলারও জো নেই। একটা রিকশাও খালি পাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাত ধরে তরী আরেকটু সামনে এগোলো। যদি রিকশা পাওয়া যায়!
পেছন থেকে হঠাৎ ডাক শুনতে পেল, “তরী? দাঁড়াও।”
তরী হকচকায়। চমকিত হয় খুব। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখে, মাহাদ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুহুর্তেই কাছাকাছি এসে প্রশ্ন করলো, “তুমি এখানে কি করছো?”
সেকথার উত্তর দেয় না তরী। পালটা প্রশ্ন করে, “আপনি– এখানে কি করছেন?”
—“আগে আমার উত্তর দাও।”
এটুকু সময়ে চেহারার বিস্ময়ভাব কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। ভ্রু দুটো ভীষণ করে কুঁচকে ফেলেছে মাহাদ। তরী মিনমিনিয়ে বললো,
—“কাজ ছিল।”
—“কি কাজ? ভার্সিটি আসোনি কেন?”
তরী চোখ ঘুরিতে চারিদিকে তাকালো। হালকা নিশ্বাস ফেলে বললো, “ক্লাস করতে ইচ্ছে করছিল না।”
—“মিথ্যা বলছো।”
—“আমার শরীর খারাপ করছিল আসলে।”
—“এবারও মিথ্যা।”
—“আমার ভালো লাগছিল না।”
—“মিথ্যা।”
—“মিথ্যা বলছি না আমি। মেলা থেকে কিছু কেনাকাটা করার ছিল। তাই যাইনি।”
—“কতগুলো মিথ্যা বলবে তরী?”
—“আমি মিথ্যা বলছি না তো!” অসহ্য কণ্ঠে বলে উঠলো তরী। কণ্ঠে তীব্র জোর। মাহাদ শান্ত চোখে তাকিয়ে কোমলসুরে বললো, “এবারও মিথ্যা বলছো, তরী।”
তরী বিরক্ত হলো। মারাত্বক বিরক্ত! বিরক্তিতে গোলগাল মুখশ্রী বিকৃত হলো। খানিকটা আর্তনাদের মতো করে বললো, “আপনি বুঝে ফেলছেন কেন বারবার? মিছেমিছি বিশ্বাস করতে পারছেন না?”
মাহাদ ঠোঁট কামড়ে চেয়ে থাকলো। নির্লিপ্ততার সঙ্গে ক্ষীণ গলায় বললো, “আচ্ছা, মিথ্যা বলো। আমি এবার বিশ্বাস করবো।”
তরী সন্তুষ্ট হলো না তবুও। হতাশ নিশ্বাস ফেললো কয়েকবার। সত্যি কথাটাই বলে দিলো, “আমি আসলে এখানে চাকরি নিয়েছি। স্যালসম্যান এর।”
বাতাস আচমকা ঝাপটা গিয়ে গেল। ঘোমটা পরে গেল মাথা থেকে। হাত উঁচিয়ে তরী ওড়না সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। মাহাদের দৃষ্টি ততক্ষণে পালটে গেছে। স্বাভাবিক নেই। গম্ভীর স্বরে শুধালো, “হঠাৎ?”
—“টাকার প্রয়োজন ছিল একটু।”
—“আগে জানাওনি কেন?”
তরী এবার চুপ। কথা বলছে না। মাহাদ রেগে গেছে কি? আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নিলো একবার। চোয়াল শক্ত করে রেখেছে। নেত্রজোড়া তীক্ষ্ণ। কিন্তু এসব নিয়ে আর কিছু বললো না।
—“আমি বাইক ওদিকে পার্ক করে এসেছি। চলো।”
তরীর বলছে ইচ্ছে হয়, “আমি রিকশায় করে যাবো। আপনার সাথে যাবো না।”
কিন্তু মাহাদের কঠিন মুখপানে চেয়ে নিজেকে দমিয়ে ফেলে সে। কোনোরুপ দিরুক্তি ছাড়া মাহাদ বলা মাত্রই বাইকে উঠে বসে। মাহাদ তখন বাইক থেকে হ্যালমেট নিয়ে তরীকে পরিয়ে দিচ্ছিলো। মাথা থেকে ঘোমটা ফেলে সুন্দর করে চুলগুলো গুছিয়ে। তরী মানা করলো না। শুধু একটু হাঁসফাঁস করলো,
—“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
মাহাদ বলতে চাইলো, “এদিক দিয়েই কাজে যাচ্ছিলাম।”
বলতে বলতে থমকালো সে। নেত্রজোড়া জড়ো হয়ে আটকে গেল গলার কামড়ের দাগটার ওপর। গভীর দাগ! মাহাদ স্থির হয়ে গেল। হাত কাঁপলো,
—“তোমার গলায় এটা কিসের দাগ, তরী?”
তৎক্ষণাৎ গলার পাশটা চেপে ধরলো তরী। মাহাদকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো। মাহাদের চোখমুখ তখনো বিমূঢ়তায় জর্জরিত।
—“আমি, আমি ব্যথা পেয়েছিলাম।”
কণ্ঠ নড়বড়ে খুব। যে কেউ অবিশ্বাস করবে কথাটা। মাহাদেরও করা উচিত। মাহাদের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে তরী আবার বললো, “এভাবে তাকাবেন না মাহাদ। বলছি তো ব্যথা পেয়েছি।”
—“তরী।”
নরম গলায় ডাকলো মাহাদ। তরী তাকালো। ভীতু চোখে। কেমন করে যেন বললো, “আপনি আমাকে ঘৃণা করবেন মাহাদ। জানলে আর পছন্দ করবেন না।”
আবহাওয়া পালটে গেল। ভেতরকার দাবানল উপচে পরলো। পাথরে চাপা পরলো, জ্বললো। তরীর কানে বাজলো সেই পুরনো কথা, “তুই ধর্ষিতা।”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা