বকুলতলা শেষ পর্ব.

0
973

বকুলতলা

শেষ পর্ব.
বুকের ধুকপুক ধ্বনি আস্তে আস্তে কমে এসেছে। ঘোর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে আশপাশে। সেই নিস্তব্ধতায় একটুখানি ফ্যানের ভটভট শব্দ কি যে তীব্র শোনাচ্ছে! ফোনটা রাখার পর থেকেই চুপচাপ বসে আছে তরী। তার ভেতরে কোনো অ’স্থিরতা কাজ করছে না। উত্তে’জনায় দু’ম’ড়েমুচ’ড়ে নিঃশে’ষ হচ্ছে না কিছু। শুধু অনুভব করছে, নিশ্বাস নিতে বড্ড ক’ষ্ট হচ্ছে তার। ভীষণ কষ্ট। জ্ব’লজ্ব’লে ফোনের স্ক্রীনে হাসপাতালের নামটা ভেসে বেড়াচ্ছে। একটু আগেই আরিফ নামের ছেলেটা মেসেজ করে ঠিকানা পাঠিয়েছে তাকে। তরীর ইচ্ছে করছে, একছুটে মাহাদের বুকে মাথা রেখে নিজেকে এই পৃথিবী থেকে, এই হঠাৎ আসা য ন্ত্র ণাগুলো থেকে লুকিয়ে নিতে। কিন্তু সে পারছে না। নি’ষ্ঠুর হাত-পাগুলি ঠান্ডা হয়ে ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। হেঁটে চলার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই।
সময় গড়িয়ে চললো। প্রায় আধঘণ্টা ওভাবেই নিশ্চুপ, ব্য’থাতুর, জড় কন্যার মতো বসে রইলো তরী। তারপর আস্তে আস্তে মোবাইল আর কিছু টাকা নিয়ে বেড়িয়ে পরলো ঘর থেকে। প্রণয় তখন বসারঘরে টিভি দেখছে। ঘুম আসছে না বিধায় একটা পুরোনো ইংলিশ মুভি দেখতে বসেছে সেই বারোটার দিকে। বস্তুত, তরীকে এমন বি’ধস্ত অবস্থায় দেখে অবাক হলো প্রণয়। তৎক্ষণাৎ ডাকলো, “তরী?”

ব্যস্ত তরী শুনতে পেল না সেই ডাক। তার মস্তিষ্কে একটা কথাই ঘুরঘুর করছে ‘মাহাদের কাছে যেতে হবে। যে করেই হোক, যেতেই হবে।’ সদর দরজা খুলতে উদ্যোগী হওয়া মাত্রই দ্রুত পা ফেলে সামনে এসে হাজির হলো প্রণয়। শক্ত হাতে বাহু টেনে প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে তরী? এত রাতে কোথায় যাচ্ছো?”

গোছালো, স্নিগ্ধ তরী যেন হঠাৎ করেই এলোমেলো হয়ে গেছে। অস্বাভাবিক আচরণ বিস্মিত করছে খুব। টকটকে লাল চোখ দুটোয় কি ভ’য়ং’ক’র বেদ’না! যেন এক্ষুণি কেঁ’দেকে’টে পৃথিবী ভাসিয়ে ফেলবে। উত্তর না পেয়ে প্রণয় আবার শুধালো, “কিছু বলছো না কেন? কি হয়েছে?”
—“হাত ছাড়ুন। আমার যেতে হবে।”
অস্পষ্ট কণ্ঠ। কথা বলতে গিয়েও কেমন নেতিয়ে পরছে মেয়েটা। নিশ্বাস নিচ্ছে জোড়ে জোড়ে।
—“কোথায় যাবে? এখন রাত একটা বাজছে তরী।”
—“বাজুক। আমি তবুও যাবো। আমার হাত ছাড়ুন।”

কঠিন রমণীর করুণ তেজ দেখে প্রণয় নিঃশব্দে বাহু ছেড়ে দিলো। নরম সুরে বললো, “কি হয়েছে না বললে আমি তোমাকে এভাবে, এত রাতে বের হতে দিতে পারি না তরী।”
বিন্দু অশ্রুকণা আচমকা গাল গড়িয়ে পরলো। নিজেকে শক্ত প্রমাণ করা তরীর খোলস ভে’ঙে গুঁড়িয়ে গেল মুহুর্তেই। কাঁদলো হু হু করে। ভেতরকার দা’বা’নল উপচে দিয়ে বললো, “আমার দেড়ি হচ্ছে। কেন বুঝতে পারছেন না? মাহাদ ভালো নেই। আমার ওর কাছে যেতে হবে।”

প্রণয় একদম শান্ত হয়ে গেল। তরীর কান্নায় হতবিহ্বল হওয়া চোখদুটো স্থির হলো আজীবনের জন্য। বললো, “কি হয়েছে মাহাদের?”
—“আমি জানি না। কিচ্ছু জানি না।”
প্রণয় সামান্য চুপ থেকে বললো,
—“আমি তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি। একটু ওয়েট করো। রুম থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে আসছি।”
তরীর ঘোর আপত্তি, “আমি একা যেতে পারবো।”
—“অলরেডি একটা বেজে বিশ মিনিট! এত রাতে সহজে গাড়ি পাবে না। আমার সাথে চলো। তাড়াতাড়ি যেতে পারবে।”

প্রণয় চাবি নিয়ে এলো। গ্যারাজ থেকে বেগুনী রঙের গাড়িটা বের করে তরীকে বসতে ইশারা করলো। তরী কোনো ধরণের উচ্চবাচ্য করেনি। সারা রাস্তা মৃ তমানুষের মতো বসে ছিল শুধু। মাঝে মাঝে একটা দুইটা পানির কণা বি’ষা’দময় মুখটার একাংশ ভিঁজিয়ে দিচ্ছিল। প্রণয় আড়চোখে সবই খেয়াল করেছে। মনের খুব গভীর কোথাও আগলে রাখা ব্য’থাটাও চিনচিন করে আফসোস জানাচ্ছিল, “তরীর এই বে’দ’না, কান্না, চিন্তা— তার জন্যেও তো হতে পারতো!”

হাসপাতালে অনেক ভীড়। আ’ গু’নে পু’ ড়ে নি হত- আ হত প্রায় সবাইকে এই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। গাড়ি থেকে নেমেই তরী লম্বা করিডোরের দিকে ছুটলো। হাতের ফোনের লক খুলে কল লাগালো কাঙ্ক্ষিত মানুষটার নম্বরে। রিং হলো, একবার, দুবার, তিনবার। পরপরই কেটে গেল কল। তরী আবার কল লাগালো। এবারও রিং হয়ে কেটে গেছে। নিচের ঠোঁটের পাতা কামড়ে এদিক-ওদিক অসহায়ের মতো তাকাতে লাগালো তরী। কান্না আটকানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালালো। চারিদিকের প্রিয়জন হারানোর তীব্র হা’হাকার কানে স্পষ্ট বাজছে। সেই সাথে হৃদযন্ত্রের অ স হনীয় য ন্ত্রণা কাতরে তুলছে তরীকে। সে এখন মাহাদকে কোথায় খুঁজবে? কোথায় পাবে?
প্রণয় এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, “দাঁড়িয়ে আছো কেন? মাহাদ কোথায়?”
ভেঁজা কণ্ঠে তরী কেমন বাচ্চাদের মতো অভিযোগ করলো, “খুঁজে পাচ্ছি না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রণয় বললো, “এই হাসপাতালেই যে ছেলেটা আছে, তুমি সিওর?”
তরী মাথা দুলালো। মেসেজে তো এই হাসপাতালের ঠিকানাটাই ছিল।
—“তাহলে এখানেই থাকবে। দাঁড়িয়ে না থেকে খুঁজো।”

তারা যখন হাসপাতালের একতলা তন্নতন্ন করে মাহাদকে খুঁজছিল, সেসময় তরীর ফোনটা এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় বেজে উঠলো। তাকে নিরাশ না করে মাহাদের নম্বর থেকেই কল এসেছে। রিসিভ করার সাথে সাথেই আরিফের কণ্ঠ শোনা গেল, “ক্ষমা করবেন ভাবী। ব্যস্ত ছিলাম। কলের আওয়াজ শুনিনি। আপনি কি হাসপাতালে চলে এসেছেন?”
তরীর দ্রুত উত্তর,
—“জি। মাহাদ কোথায়?”
—“তিনতলায়। আপনি আসুন। আমি সিঁড়ির কাছেই আছি।”

উপরের তলার হা’হাকারটা যেন একটু বেশিই। যতই উপরে উঠছিল ততই যেন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ধরা দিচ্ছিল তা। মহিলা, পুরুষ সমানতালে চিৎ’কার করে গলা ফাঁ’টিয়ে যাচ্ছে। কিছু করুণ কান্নার সুর ভেতরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে অনায়াসে। অজানা, কাঙ্ক্ষিত কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কথা ভেবে তরীর শরীর শিরশির করছে। এত কষ্ট হচ্ছে কেন? অসহ্য লাগছে। চোখ ফেঁটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে একটুখানি কান্নার আবদারে।
সিঁড়ির কাছেই আরিফ দাঁড়িয়ে ছিল। তরীকে দেখে হাঁক ছেড়ে বললো, “ভাবী? আমি আরিফ। আমার সাথে আসুন।”

লম্বা, কালো মতো ছেলে। হালকা আকাশী শার্টে শুকিয়ে যাওয়া র’ক্তের ছড়াছড়ি। তরীর বুক কেঁপে উঠলো। যন্ত্রের মতো অনুসরণ করলো ছেলেটাকে। আরিফ কখন যে দাঁড়িয়ে গিয়ে কিছু বললো, খেয়াল নেই। সে এক অন্য ঘোরেই ছিল। সম্বিৎ ফিরতেই অবুজের মতো তাকালো। আরিফ আবার বললো, “সামনের সাত নাম্বার বেডেই মাহাদ আছে ভাবী। আপনি এগোন। আমার একটু কাজ আছে।”

তরী এবারও আনমনেই মাথা দুলালো। আশপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো একবার। পু’ড়ে চামড়া ঝ ল সে গেছে একেকজন রো’গীর। কারো মুখ চেনা যাচ্ছে না, কারো হাত-পা পু’ড়ে গেছে। কারো সারা পিঠ, শরীর। সেই বহুক্ষণ আগের দারুণ ভ’য়া’বহ ভী’তিটা আবারও এসে হানা দিলো যেন। আনমনা ভাব চলে গেল পুরোপুরি। পাথরে পরিণত হলো পাদুটোর ওজন। সামনে টেনে নিতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। আস্তে ধীরে, গুটিগুটি পায়ে সাত নম্বর বেডটার কাছাকাছি আসতেই এবার যেন সত্যি সত্যি দম ফুরিয়ে এলো তরীর। সাদা চাদরে আচ্ছাদিত বেড। মাহাদের সুন্দর মুখটা ব্যথায় নীল হয়ে পরে আছে। গাল, কপাল, ঠোঁট, নাক ক্ষ’ত’বি’ক্ষ’ত। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। শরীরটা সাদা চাদর দিয়ে একটু আলগা করে ঢাকা। গায়ে কাপড় নেই হয়তো। চাদরের একফাঁকে লাল লাল চামড়ার অল্পাংশ দেখা যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীন তরী বিছানার একপাশে শরীর ছেড়ে দিলো। কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে দেখলো লোকটাকে। একমনে, অনিমেষ। চোখের পানি ততক্ষণে বাঁধ ভেঙ্গে ফেলেছে। চিৎকার করে কান্নাটাই অবশিষ্ট মাত্র। কিন্তু তরী তো শক্ত মেয়ে। সে তো সহজে কাঁদে না। আসলেই কি কাঁদে না? তার ফোঁপানোর শব্দ শুনে যে মাহাদ জেগে গেল! পিটপিট করে তাকিয়ে তরীকে দেখে কেমন করে যে হাসলো! ক্ষীণ হাসি। হাসতে গিয়ে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলেছে ব্যথায়। তরী সঙ্গে সঙ্গে আ’র্ত’নাদ করে উঠলো, “এমন করছেন কেন?”

সচল হাতটা দিয়ে আস্তে করে অক্সিজেন মাস্ক খুলে থুতনিতে ঠেকালো মাহাদ। ভাঙ্গা কণ্ঠে উত্তর দিলো, “তোমাকে দেখছি।”
একথার পিঠে তরীর আর কিছু বলা হলো না। সেই চিৎকার করে না কাঁদার ফাঁকফোঁকরটুকু ঘুচে গেল। সশব্দে মেয়েলি কা’ন্নাটা হৃদয় কাঁ’পালো সবার। অথচ মাহাদ হেসেই শুধালো, “চারিদিকে তাকিয়ে দেখো তরী। সবাই মৃ ত্যু দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। য ন্ত্র’ণা সহ্য করতে না পেরে মৃ ত্যুর জন্য প্রার্থনা করছে। কিন্তু এইযে আমি, তোমার সামনে শুয়ে আছি, কথা বলছি, নিশ্চিন্তে নিশ্বাস নিতে পারছি, তোমার কি শান্তি লাগছে না? কাঁদছো কেন?”

এই অবুজ মাহাদকে কে বোঝাবে? এটা দুঃখের কা’ন্না মোটেও না। কা’ন্নাটা কিছু হারিয়ে ফেলতে ফেলতে হঠাৎ পেয়ে যাওয়ার কা’ন্না। সুখের কা’ন্না। তৃপ্তির কা’ন্না।

—“একটু কাছে আসবে, তরী?”
তরী আসলো না। ঠায় বসে রইলো। কাঁদলো খুব করে। সেভাবেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “এসব কিভাবে হয়েছে?”
ত্যাড়া মাহাদ এই অসুস্থ অবস্থাতেও প্রচন্ড বিরক্তির সঙ্গে তাকালো। বললো, “তোমাকে কি বলেছি মেয়ে? মিথ্যুকের পাশাপাশি দেখছি চরম অবাধ্যও হয়ে গেছ! এদিকে আসো তো। কাছে আসো।”

তরী একটু এগিয়ে বসলো। মাহাদের ব্যান্ডেজে আবৃত হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে দিলো। কিন্তু লোকটার তাতেও হলো না। আবার আওড়ালো, “এটা আমার জন্য কাছে হয়নি তরী। আরো কাছে আসো। আমার দিকে ঝুঁকে কপালে কপাল ছোঁয়াও। নাকে নাক ছোঁয়াও।”
তরী অধৈর্য হলো খুব,
—“আপনার কষ্ট হবে মাহাদ। মাক্স পরুন।”
—“হবে না। যা বলছি করো।”

সিক্ত নেত্রপল্লব বার কয়েক ঝাপটে নিলো তরী। আশপাশের কারো ধার ধারলো না। ঝুঁকে গিয়ে ক্ষ ত বিক্ষ ত কপালের ওপর কপাল ঠেকালো। নাকে নাক ছোঁয়ালো। ঠিক যেমনটা মাহাদ বলেছে। মাহাদের ঠোঁটে তখন উজ্বল হাসিরা খেলা করছিল। চোখ বুজে রেখেছিল সে। বন্ধ চোখের কোণ ঘেঁষে একফোঁটা পানির চিহ্ন উদ্ধার করতেই কেঁপে উঠলো তরী। মানুষটা কাঁদছে কেন? বেশি কষ্ট হচ্ছে?
তরী সরে যেতে নিলেই মাহাদের দূর্বল আওয়াজ, “যেও না তরী। এভাবে, তোমার সাথে আমি সবসময় থাকতে চাই।”

তরী সত্যি সত্যি গেল না। থাকলো। খুবক্ষণ চুপ থেকে সময়টা অনুভব করলো গভীর আবেগ দিয়ে। বস্তুত, মাহাদ বলতে লাগলো, “সব কিছু… একেবারে সবকিছু পু’ড়ে যাচ্ছিল তরী। শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক, সবাই বাঁচার জন্য কাঁ’দছিল। আমি আর আমার ক্যামেরা ম্যান কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার এক সহকর্মী নি হ ত হয়ে পরে ছিল আমারই সামনে। বেঁচে ফেরার কোনো পথ নেই। আ’গু’নে দাউদাউ করছিল চারপাশ। একটু এগোলেই আ’গুন লেগে শরীর ঝ ল সে যাচ্ছে। নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। ধোঁয়ায় চোখ জ্ব’লছিল। আমি… আমি বাঁচতে চাইছিলাম তরী। বাঁচার পথ খুঁজছিলাম। কিন্তু কোথাও কিচ্ছু নেই। শুধু আগু’ন আর আগু’ন! মায়ের মৃ’ ত্যুর পর এই দিনটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। আমি তোমাকে মনে মনে অনেক ডাকছিলাম। ভেবেছিলাম, তোমাকে বুঝি আমার আর পাওয়া হলো না। তোমার সাথে বুঝি আমার বুড়োকাল কাটানো হলো না। আমার কান্না আসছিল তরী। মৃ ত্যুযাত্রীর মতো আমার বুকটাও বাঁচার জন্য হা’হা’কারে দু’মড়ে যাচ্ছিল। ঝাপসা চোখে তোমাকে, নূপুরকে আমার সামনে বসে থাকতে দেখে নিজেকে এত অসহায় লাগছিল! তারপর বুঝলাম, এটা আমার ভ্রম। যেই ভ্রম আমাকে আমার শরীর পোঁ’ড়ার জ্বা’লাটুকু অনুভব করতে দেয়নি। বরং আশপাশের অনেকের মৃ ত্যু কা’ন্নায় আমার কান নিস্তেজ করে দিয়েছে। শেষ মুহুর্তে আমি কিচ্ছু শুনতে পাইনি, দেখতে পাইনি। অনুভব শক্তি হারিয়ে আমি বুঝি তখন সত্যি সত্যিই মা রা গিয়েছিলাম!”

মাহাদ ক্ষীণ থামলো। নিশ্বাসের আদান-প্রদান ঘটালো বেশ সময় নিয়ে। তার হৃদয়, ফুসফুস কিচ্ছু ভালো নেই। ধোঁয়ায় মাখোমাখো বাতাসে যখন নিশ্বাস নিতে পারছিল না, শ্বাস’ক’ষ্ট হচ্ছিল, তখনের মতো ঠিক তেমনটাই এখন হচ্ছে। নিজেকে একটু জিড়িয়ে কেমন বিম’র্ষ, ঝিমানো আকুলতা নিয়ে মাহাদ বলা শুরু করলো, “তোমার প্রিয় আমার বুকটা আগের মতো নেই তরী। পু’ড়ে থেতলে গেছে। তুমি কি আমার পো’ড়া বুক দেখে ঘৃ’ণা করবে? করলেও কখনো মুখ ফুটে বলো না। তোমার জন্য এই বুকে আমি অনেক কিছু আগলে রেখেছি। ঘৃ’ণার বদলে নাহয় সবটুকু নিয়ে নিও। তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না মেয়ে। নি’ষ্ঠুর হইও না। এই সুখটা আমার দরকার। আমার তোমাকে দরকার। দয়া করো। দয়া করো আমার ওপর। তোমাকে ছাড়া আমার বুক শূণ্য হয়ে যাবে তরী। পৃথিবীতে আমার সব অনুভূতি মৃ ত হয়ে যাবে। আকাশের দিকে আমি আর কখনো চোখ মেলে তাকাতে পারবো না। তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা খুব কষ্টের মেয়ে। আমাকে এভাবে হারতে দিও না। আকাশকে তাচ্ছিল্য করার সুযোগ দিও না। আমাকে জিতিয়ে দাও। আমার পাশে থাকো। অনতত আমার ম র ণ পর্যন্ত। আমি আর কিচ্ছু চাইবো না। কিচ্ছু চাইবো না।”

দুহাতে মাহাদের অমসৃণ গালদুটো আঁকড়ে ধরলো তরী। হাত বুলালো আস্তে আস্তে। চোখ বন্ধ করে ভীষণ কা’ন্নায় মিইয়ে গেল। তরীর চোখের পানি টুপটাপ করে সিক্ত করে তুললো মাহাদের গাল, নাক। জোড়ে জোড়ে মাথা নাড়িয়ে তরী স্বীকারোক্তি দিলো, “আমি কোত্থাও যাবো না মাহাদ। নিজের তীড় ছেড়ে নৌকা কোথাও যেতে পারে না।”

বিষণ্ণ মুহুর্তে এই বাক্যগুলো যেন চিরপ্রশান্তির শুরু। মাহাদের খুব ইচ্ছে হলো, তরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। নিজের মাঝে লুকিয়ে নিতে। সচল হাতটা দিয়ে ধরলোও। কিন্তু ভালোভাবে পারলো না। হাতে টান লাগছে। পু’ড়ে যাওয়া অংশগুলোয় কেউ যেন লবণ মাখিয়ে জ্বা’লাপো’ড়ন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই জ্বা’লার ঔষধ চাইতে বুকের কম্প’নটুকু ঠোঁটে এঁটে মাহাদ ফিসফিসিয়ে বললো, “আমাকে একটু চুমু খাবে তরী? শুধু একবার?”

অন্যদিন কিংবা অন্যসময় হলে তরী হয়তো লজ্জা পেত। খুব রেগে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতো। অথচ এই মুহুর্তে সামান্য চমকের ভাবও দেখা গেল না মেয়েটির মাঝে। বরং কোমল অধরজোড়া উঁচিয়ে কপালের মাঝ বরাবর দ্বিধা ছাড়াই ছুঁয়ে দিলো। অনেক্ষণ ছুঁইয়ে রাখলো। তারপর একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ওর মতো করেই ফিসফিসালো, “আমি আপনাকে ভালোবাসি, মাহাদ আয়মান।”

বসার ঘরের টিভিটা এখনো চলছে। নিস্তব্ধ, নিস্তেজ পরিবেশ রমরমা হয়ে আছে টিভির পর্দায় চলমান রোমান্টিক দৃশ্যের মাধ্যমে। প্রণয়ের মনে হলো, এটা নিয়তির কোনো কঠিন ছ’ল। সে ইচ্ছে করেই এসব দেখিয়ে প্রণয়ের ভেতরকার দ’হন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভীষণ আ’ক্রোশ নিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিলো প্রণয়। ক্ষুধায় পেটের ইঁদুরগুলো ডাকাডাকি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে সেই বহু আগে। এখন ক্ষিদেটা আর নেই। ধীরে ধীরে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। সিলিংয়ের পানে চেয়ে চেয়ে ভাবলো, হাসপাতালে তরী এখন কি করছে? নিশ্চই ভীষণ যত্নে আগলে রেখেছে মাহাদকে? রাখারই কথা। তরী তো নিজের মুখে স্বীকার করেছে, সে মাহাদকে ভালোবাসে। এখন আর মিছে আশা রেখে লাভ কি? লাভ নেই তো! শুধু শুধু হিং’সে-বিদ্বে’ষ বাড়বে। হিং’সা পরায়ণ হয়ে সে তো কিছু করেও ফেলতে পারে! তারপর… তারপর হয়তো তরীর চোখে আরও ছোট হয়ে যাবে। অপ’রাধী হয়ে যাবে।
লম্বা, দীর্ঘ নিশ্বাসটা আস্তে আস্তে ছেড়ে চোখ মুদলো প্রণয়। গলায় একটা বিদ’ঘুটে ঝাঁঝ মন বি’ষিয়ে দিচ্ছে। শরীর মেচমেচ করছে খুব। গোসল প্রয়োজন। প্রণয় আর দেড়ি করলো না। বরাবর দশ মিনিটের মাথায় গোসল সেরে সরাসরি চলে গেল লাইব্রেরী ঘরে।

লাইব্রেরীর একদম নিচের তাকে প্রণয়ের একটা গোপন জিনিস আছে। খুব মূল্যবান, ছোটখাটো একটা এ্যালবাম। কাঠের সুন্দর কারুকাজের ভেতরে তরীর অহরহ ছবি সযত্নে রাখা আছে সাজানো গুছানো ভাবে। পৃষ্ঠা উল্টালেই সেগুলোর দেখা পাওয়া যায়। কোনোটায় তরী প্রাণখুলে হাসছে। কোনোটায় কাঁদছে। কোনোটায়-বা অভিমানে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কৃত্রিম তরীর অভিমানী গালদুটো ছুঁয়ে দিলো প্রণয়। হাসলো অল্প। কিছুক্ষণ চেয়েই রইলো একাধারে। মুখে নেমে এলো কালো ঘুটঘুটে মেঘের আধার। মস্তিষ্কে তখন ভীষণ বি’শ্রী এক ক’র্কশ আ’ন্দো’লন চলছিল। মনে চলছিল বড় কষ্টের সংঘ’র্ষ। তৎক্ষণাৎ তরীর গাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো প্রণয়। এক এক করে ছবিগুলো এ্যালবাম থেকে বের করে ছিঁড়ে ফেললো এক ঝটকায়। তারপর এ্যালবামসহ কাগজের টুকরো গুলো পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো।

এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। ফোনের গ্যালারিটাও তো তরীর ছবিতে ভর্তি। সেগুলোও তো ডিলিট করতে হবে! টেবিল থেকে ফোন নিয়ে তরীর সব স্মৃতি নিমিষেই ডিলিট বাটন চেপে মুছে ফেলল প্রণয়। অথচ অসহায় ছেলেটা জানে, তাকে আজীবন এই নির্ম’ম, পা’ষাণ, পাথর হৃদয়ের মেয়েটির স্মৃতি নিয়েই বাঁচতে হবে। এত সহজে তো ভোলা সম্ভব নয়। ভুলতে পারাটা হলো একটা আর্ট। প্রণয় তো কোনো চিত্রশিল্পী না। সে এই বাজে আর্টটা পারে না। আর্টিস্ট হওয়ার চেষ্টাও অবশ্য করেনি কখনো। স্বার্থ’পরের মতো ঠিকই পুরোনো মানিব্যাগে তরীর ছবিটা অক্ষত রেখেছে। হয়তো এই ভেবে, কোনো এক মন খারাপের দিনে, যখন তরী নামক অন্যঘাটের নৌকাকে ভীষণ মনে পরবে, তখন যেন সে কৃত্রিমভাবে হলেও মেয়েটাকে একটু ছঁতে পারে! মন ভরে দেখতে পারে!

ভেতরের সকল অভিযোগ, অভিমান, সুখ, দুঃ’খ দূরে ঠেলে দিলো প্রণয়। ক্লান্ত গলায় বললো, “ভালোবাসার সুখটা আমি তোমায় না পেয়েই খুঁজে নিলাম প্রিয়। তুমি আমার না হলে, আমি সব মেনে নিলাম।”

মাহাদের জ্ঞান নেই। একটু আগেই প্রবল উ’ত্তে’জনায় শ্বাসক’ষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছিল লোকটার। ডাক্তার এসে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে গেছেন। সাথে এও বলেছেন, এ যাত্রায় মাহাদ ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে। তার বলতে গেলে অনেক কিছু হয়েও কিছু হয়নি। শরীরে মাত্র আ গুন লাগা শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই ফায়ার সার্ভিসের দুজন লোক উদ্ধার করতে পেরেছিল তাকে। হাত, পা, গলা যেটুকু পো’ড়া গেছে, তা সময়ের সাথে সাথে চলে যাওয়ার সম্ভবনা আছে। একটু নিয়ম মেনে চললেই হবে। কিন্তু বুকের দিকটা বা’জে ভাবে ঝ ল সে গেছে। পো’ড়া কাঠ জাতীয় কি যেন বুকের ওপর পরেছিল। তাই আর রক্ষে হয়নি। তরী প্রবল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মাহাদ থেকে চোখ সরালো। দরজা দিয়ে নতুন এক রোগীকে কেবিনে নিয়ে আসা হয়েছে। পুরো শরীর ব্যান্ডিজে আবৃতি। তরীদের দুই বেড পরেই লোকটার থাকার স্থান হয়েছে।

তরী আবার মাহাদের পানে ফিরে তাকালো। লোকটাকে দেখে ক্ষণে ক্ষণে অ’মাব’স্যা নেমে আসছে তার চোখ মুখে। সাংবাদিকতা বুঝি এত কঠিন? নাকি লোকটার ভাগ্যটাই ম’ন্দ? একের পর এক বিপ’দ আসছেই! তারা কি আসলেই ভালো থাকার কপাল নিয়ে জন্মেনি? তরী জানে না। জানতে চাইলেও সেই সুযোগ নেই।
মাহাদের দিকে অল্প ঝুঁকে কপালে তপ্ত স্পর্শ এঁকে দিলো সে। বিড়বিড়ালো, “আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি ত্যাড়া মাহাদ। ত্যাড়াদেরকে বুঝি এত ভালোবাসা যায়?”

সকাল বেলাটা ছিল অকল্পিত। রশিদ সাহেব, নূপুর হঠাৎ করেই হাসপাতালে এসে হাজির হয়েছেন। তরী তখন মাহাদের পাশে বসে ঝিমুচ্ছে। সারা রাত না ঘুমানোর ফল এই ঝিমুনি। তার সামনে শুয়ে থাকা মাহাদ নিষ্পলক তার এই বি’ধ্বং’সী রুপ দেখে মুগ্ধ হচ্ছে শুধু। তার তরীটা এত সুন্দর কেন? এত মায়াময় কেন? তার যে খারাপ ধরণের ঘোর লেগে যাচ্ছে!

পরক্ষণেই হুড়মুড় করে নূপুরকে হুইলচেয়ারের হাতল চেপে ঢুকতে দেখে চমকে উঠলো মাহাদ। মুখে অক্সিজেন মাক্স থাকায় কণ্ঠস্বর গলিয়ে শব্দ বের করতে পারলো না। বড় বড় চোখে চেয়ে রইলো মাত্র। নূপুর যারপরনাই ঠোঁট ভেঙ্গে চেঁ’চিয়ে উঠলো, “ভাইয়া, এ কি হাল হয়ে গেল তোর! এমন অবস্থা কেমনে হলো?”

পরপরই কেঁদে উঠলো নূপুর। আকস্মিক চেঁ’চানোতে তরী ভ’য় পেয়ে গেল। ঘুম-টুম উবে গেল সেকেন্ডেই। কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে চেয়ে থেকে নিজেকে ধাতস্ত করে বললো, “তোমার ভাইয়া ঠিক আছে। কেঁদো না।”
নূপুর যেন এক্ষুণি খেয়াল করলো তরীকে। কান্না ভুলে চোখজোড়া গোল গোল করে বললো, “তুমি তরী ভাবী না? তুমি এখানে কিভাবে? তোমাদের কি প্রেম হয়ে গেছে?”

অদ্ভুত, উদ্ভ’ট প্রশ্ন! হকচকিয়ে তরী কি উত্তর দিবে বুঝে পেল না। নূপুর এবার মাহাদকে উদ্দেশ্য করে আরেকদফা প্রশ্নের বান ছুঁড়লো, “তুই না বললি ভাবী নাকি পটছে না? কিন্তু এখানে তো দেখি অন্য কেস!”

মাহাদ সেই থেকে চোখ রাঙ্গাচ্ছে। ইশারায় তরীকে মাক্স খুলতে বললেই তরী দ্বিধাদ্বন্দে খুলে দিলো। মাহাদ এখনো পুরোপুরি সুস্থ না। সময়ে সময়ে শ্বাসক’ষ্ট হচ্ছে। অথচ এই লোক কি-না কিছু থেকে কিছু হলেই অক্সিকেন মাক্স খুলতে উঠে পরে লাগে!

—“তুই এখানে কেমনে? আব্বা কই?”
—“আছে। তোর বন্ধুর সাথে কথা বলে।”
বিরক্তি সূচক শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। এই আরিফ ছেলেটা কি তার অসুস্থতার কথা জনে জনে কল করে বলছে নাকি? আশ্চর্য! ভাবনার মাঝেই হন্তদন্ত পায়ে রশিদ সাহেব দৌঁড়ে এলেন। কাল রাতে ছেলের এই দূ’র্ঘটনার কথা শুনে খুব কেঁদেছেন তিনি। ভোরের বাসেই রওনা হয়েছেন ছেলের কাছে আসতে। প্রাণপ্রিয় ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে তার কলিজায় টান পরছে। অতি আবেগ সামলাতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদেই ফেললেন। কণ্ঠে অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে বললেন, “তুই আমার লগে গ্রামে চইলা আয় বাপধন। তর আর এইহানে কষ্ট করন লাগবো না। বাপের লগে থাকবি। আর গুসসা কইরা থাকিস না বাপ। এই অভাগা বাপরে ক্ষমা কইরা দেয়। তোরে ছাড়া আমরা কেউ ভালা নাই।”

মাহাদের ক’ষ্ট লাগলো ঠিক। তবে আশেপাশের রোগীরা এই ম’রা কান্নায় বিরক্ত হচ্ছে। সে নিজেও কিঞ্চিত হচ্ছে। মুখের ভঙ্গিমায় বিরক্তি ভাব এঁটেই মাহাদ বললো, “কান্না বন্ধ করো আব্বা। এটা হাসপাতাল।”

রশিদ সাহেব থামাতে পারলেন না। অসহায় মুখ করে কাঁদতেই রইলেন। মাহাদের মায়াটা তরতর করে বাড়ছে। শত হোক, এটা তারই বাবা। সে না চাইতেও এই বাবাকেই ভালোবাসে। উপরে যত কঠিন হয়ে থাকুক!
—“আমি ঠিক আছি আব্বা। সুস্থ হয়ে যাবো কয়েকদিনের মাঝে। কান্না থামাও তুমি।”
—“সত্যি কইতাছোস? বেশি ব্যাথা পাস নাই?”
—“না।”
—“সুস্থ হওয়ার পর আমি কিন্তু তোরে আমার লগে নিয়া যামু।”
—“এত দরদ দেখাচ্ছো কেন আব্বা? ছোটবেলায় তো দেখানো ভালোবাসাটাও বাসোনি। নাটক করছো না তো?”

কিছু তিক্ত স্মৃতি থাকে। যা মানুষকে ভালো থাকতে দেয়না। ওইযে, বাবাকে দেখলে তার মায়ের মুখটা চোখে ভেসে উঠে! মাহাদ ক’ড়া কথা বলে থাকতে পারে না তাই। এখন অবশ্য বলতে চায়নি। মুখ ফুসকে বেড়িয়ে গেছে। বলার পর তার খারাপও লাগছে। আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলো, রশিদ সাহেব মুখে মলিন হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন কথাটা অত গায়ে মাখেন নি তিনি। ছেলে তার আগের থেকে ভালো ব্যবহার করছে। একটু হলেও কথা বলছে। তার আর কি দরকার? আস্তে আস্তে নাহয় একদিন স্বাভাবিক হয়ে যাবে সম্পর্ক।
হাসি মুখেই বললেন, “নাটক করতেছি না বাপধন। এইহানে থাইকা তুই কি করবি? কে আছে তোর?”

মাহাদ একবার তরীকে দেখে নিলো। বাবার সাথে এভাবে কথা বলা যে মেয়েটার বিশেষ পছন্দ হয়নি, তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বাবার আদরের দুলালি কিনা! গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো, “চাকরিটা আমার শখের। ছাড়তে পারবো না। তাছাড়া তোমার বউমার পড়ালেখাও চলছে।”
—“বউমা কে?” ভ্রু কুঁচকে শুধালেন রফিক সাহেব।
নূপুর বিরক্তি নিয়ে বললো, “তুমি কি বলোতো আব্বা! সামনেই ভাবী বইসা আছে, দেখতাছো না?”
রশিদ সাহেব তখন চোখ মেলে তাকালেন তরীর দিকে। মুগ্ধ কণ্ঠে সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, “কি মিষ্টি দেখতে মাইয়াটা! নূপুরের পাশাপাশি তাইলে আমার আরেকটা মা আইতাছে? কি নাম তোমার মা?”

তরী ততক্ষণে লজ্জায় মুখ নুইয়ে রেখেছে।

বিকালের দিকে একটু বিশ্রাম নিতে বাড়িতে ফেরে তরী। সে আসলে আসতে চায়নি। মাহাদ জোড় করে পাঠিয়েছে তাকে। একরাত না ঘুমানোতেই চেহারা বিধ্ব’স্ত হয়ে গেছে। কা’ন্নার দরুণ চোখ মুখ ফুলানো। কালকে থেকে এক কাপড়ই পরে আছে তরী। কামিজটা পালটানো দরকার। ঘুমানো প্রয়োজন। যদিও তরী জানে, কালকের আগে মাহাদের সাথে আর দেখা হবে না ওর। রোজ রোজ তো আর রাতে থাকা সম্ভব না। সে অন্যজনের বাড়িতে থাকে। তারা তার রাতবিরেতে বাহিরে থাকা পছন্দ নাও করতে পারেন। করতে পারেন কি! আয়েশা খাতুন তো মোটেও এসব সহ্য করবেন না। তবে মনে মনে একটু চিন্তা মুক্ত হতে পারছে সে। অনতত মাহাদের সাথে মাহাদের পরিবারের কেউ তো থাকবে! রশিদ সাহেব, নূপুর এখানে না এলে তরীর বাস্তবিকই অনেক ক’ষ্ট হয়ে যেত।

—“এত সকাল সকাল কই গিয়েছিলে শুনি? ঘুম থেকে উঠে তোমাকে দেখলাম না যে! আর এসব কি জামা? ঘরের জামা পরে এদিক সেদিক চলে যাওয়ার বেরাম আছে নাকি তোমার? আমাদের যে একটা রেপুটেশন আছে ভুলে গেছ?”

আয়েশা খাতুনের কথাগুলো তীরের মতো আঘা’ত করে তরীকে। আজও করলো। মন খারাপে আশাহ’ত হলো মেজাজ। ভীষণ ঠান্ডা গলায় বললো, “আমার সাথে তো একটু ভালো ব্যবহারও করতে পারেন মামী।”
আয়েশা খাতুন ভেঙ্গালেন যেন, “তোমাদের সাথে আবার কিসের ভালো ব্যবহার শুনি? আমার ছেলেগুলোকে তো খেয়েদেয়ে বাকি রাখো নি।”
তরীর ভীষণ রেগে কাঠকাঠ গলায় বললো, “আপনার সমস্যাটা আসলে কোথায় মামী? ছোটভাইয়ার মৃ ত্যুটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। এটা আপনিও জানেন। তবুও কেন বারবার আমাদের দো’ষারোপ করছেন?”

একথার জবাব দিলেন না আয়েশা খাতুন। চোখ মুখ কুঁচকে অন্যদিকে চলে গেলেন। তরীকে তার আসলে তিন বছর আগের অতীতটার জন্যই বিশেষ একটা পছন্দ নয়। সেই আদি যুগের ধারণা থেকে তিনি মনে করেন, তরী অ’ল’ক্ষী। তার সাথে যে থাকবে তার কখনো ভালো হবে না।

দিনটা সুখময় এক দিন। চারিদিকে সুখ সুখ একটা আবহাওয়ার তীব্র ঘ্রাণ নাক ঝাঁ’ঝিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে বহিছে প্রেমের ঘোর আবেদন। স্নিগ্ধ এক পরশ মন ভালো করে দিচ্ছে ক্ষণেই। তবে আকাশটা আজ বেজার খুব। তার ভীষণ মন খারাপ। সেই রাত থেকে ঝড় বৃষ্টির অদলে পুরো শহরটার চেহারা পালটে দিয়েছে। কিন্তু তাতে কি? শ্রাবণ প্রেমী মানুষেরা যে এটাকেই সুখের নৌকা বানিয়ে ভাসছে। কপোত-কপোতীদের রাস্তায় হাতে হাত ধরে ভিঁজতে দেখা যাচ্ছে।

আজকে মাহাদের রিলিজডেট। ঠান্ডা ঠান্ডা এই বৃষ্টির মৌসুমে লোকটার জন্য গরম গরম খিচুড়ি বানিয়ে এনেছে তরী। সাথে কড়া করে ইলিশ ভাঁজা, পিয়াজু! মাহাদ তৃপ্তির সঙ্গে তরীর হাতে একটু একটু করে খাচ্ছে। আঠারোদিনের এই চিকিৎসা জার্নিতে সে মোটামোটি প্রায় সুস্থ। ডাক্তাররা অবশ্য বলেছিল আরও কয়েকদিন থাকতে, কিন্তু মাহাদের স্বভাব তো আর ভদ্রসভ্য না। তার মনে হয়েছে সে আর হাসপাতালে থাকবে না, অর্থাৎ, কোনো ভাবেই থাকবে না।

—“পো’ড়া দাগে এমন কি দেখছো মেয়ে? পলক ফেলো!”
আদুরে ধমক শুনে তরী পিটপিট করে তাকালো। হাসপাতালের পোশাক পালটে মাহাদ একটা ঢিলাঢালা গেঞ্জি পরে আছে। গলায় সাত, আটটা গুটিগুটি ফো’সকার দাগ। তার পাশেই লম্বাটে একটা পো’ড়া দাগ। এখনো তেমন শুকায়নি। গভীর, লালচে রঙ। তরীর মনে পরে গেল, কিছুদিন আগের ঘটনাগুলো। মাহাদ এই পো’ড়া চামড়ার য ন্ত্রণায় ঘুমাতে পারতো না। সারারাত ছটপট করতো। তার সেই ছটপট ভিডিও কলে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাতো নূপুর। ব্য’থায় লোকটা কেঁ’দে ফেলতো নিশব্দে। ঔষধ লাগাতে চাইতো না। পাগলামি করতো। অথচ সকালে যখন তরী মাহাদকে দেখতে যেত? লোকটা যেন তখন পুরোপুরি সুস্থ! বোঝাই যেত না এটা তার অভিনয়। স্বাভাবিক ভাবে সব করছে। ঔষধ খাচ্ছে। তরী জিজ্ঞেস করলে মাছি তাড়ানোর মতো করে বলছে, “আরেহ্! আমি একদম সুস্থ। তোমাকে এসব ভুলভাল খবর কে দেয়?”

ভাবনার অকূল পাথারেই মাহাদের কণ্ঠ শোনা গেল। তাকে মুখ মলিন করতে দেখে সে বললো, “কি হয়েছে তরী? চেহারা এমন করেছো কেন? বোকা মেয়ে! আমি তো সত্যি সত্যি তোমায় বকা দেইনি।”
—“আপনাকে আমার সবভাবে ভালো লাগে মাহাদ। আপনার পুরো শরীর পু’ড়ে গেলেও আমি আপনাকে কখনোই ছাড়তাম না।”

আকস্মিক এহেন কথায় মাহাদ ঘাব’ড়ালো না। চমকালো না। আজকাল মেয়েটা প্রায় প্রায়ই এমন কথা বলে। বিশেষ করে তখন, যখন মাহাদ তার এই পো’ড়া দাগগুলোর জন্য হতাশ হয়। আফসোস করে। মুখে না বললেও তরী যে কিভাবে বুঝে যায়! মুচকি হাসতে হাসত মাহাদ বললো, “জানি তো! আমি যে তোমার আমার আকাশ জোড়া লাগিয়ে নতুন এক আকাশ গড়েছি। সেই খবর তো আমারই আগে পাওয়ার কথা।”

বলার মাঝেই একলোকমা খিচুড়ি মুখে পুরে দিলো তরী। মাহাদ চিবুতে চিবুতে তার কথার খেলায় লেগে গেল। জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, প্রণয় ছেলেটার সাথে কি তোমার যোগাযোগ এখনো আছে? ছেলেটা কি করছে এখন?”

তড়িৎ গতিতে চোখ তুলে তাকালো তরী। ফিচেল গলায় বললো, “আপনি প্রণয় ভাইয়াকে চিনেন?”
—“চিনবো না কেন? তোমার কোনো খোঁজখবর রাখি না মনে করো?”
বরাবরের মতো ত্যাড়া, নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর। কিন্তু তরী নির্লিপ্ত হতে পারলো না। মাহাদের প্রশ্নের উত্তরও দিলো না। এক সপ্তাহ হচ্ছে, প্রণয়দের বাসা ছেড়েছে সে। ভার্সিটির পাঁচ মিনিট দূরত্বেই একটা ছোটখাটো, কম ভাড়ার বাসা আছে। সেখানের দু’তলায় উঠেছে। তার সাথে আরও দুটো মেয়েও আছে।
সেদিনের পর প্রণয়ের সাথে তার দেখা হয়নি। আসার সময়ও না। একরকম গা ঢাকা দিয়ে আছে লোকটা। তবে সালেহার থেকে শুনেছে, প্রণয় নাকি আবারও ভিনদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখানে আর বেশিদিন থাকবে না।

মাহাদকে খাইয়ে হাতটা ধুঁয়ে নিলো তরী। গ্লাসে পানি ঢেলে বললো, “নিন। তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে। একটু পরেই আঙ্কেল আসবেন।”
পানিটা একঢোকে পান করে নিলো মাহাদ।
—“আব্বা আসলেই কি চলে যাবো?”
—“আপনি কি আরও থাকতে চাচ্ছেন?” ভীষণ ভাবে ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো তরী। লোকটাকে তার সুবিধার লাগছে না।এতক্ষণ ‘বাসায় যাবো’ ‘বাসায় যাবো’ বলে হাসপাতাল মাথায় তুলে ফেলছিল। এখন দেখো, কেমন করে হাসছে!

—“আব্বাকে বলো না আসতে। আমি এখন বাসায় যাবো না।”
—“তাহলে কোথায় যাবেন? বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে মাহাদ। দয়া করে এখন আর পাগলামি করবেন না।”
—“বকুলতলার রাজ্যে সুখ বাটতে যাবো, চলো।’

তরী চোখ পাকালো। থমথমে গলায় বললো, “মাথা কি পুরোপুরি গেছে?”
মাহাদ জবাব দিলো না। আস্তে করে উঠে দাঁড়ালো। আবারও বললো, “চলো তো।”

অগত্যা তরীরও আর উপায় রইলো না। হাসপাতালের ফর্মালিটি পূরণ করে পা রাখলো চৌরাস্তার ভেঁজা, সেঁতসেঁতে বুকে। আকাশ দেখলো, পুরো পৃথিবী সাক্ষী হলো, এক উম্মা’দ প্রেমিক আর তার ক’ঠিন হৃদয়া প্রেমিকাকে এক ছাতার নিচে উচ্ছল প্রেম নিয়ে পথ চলা শুরু করতে।
মাহাদ তখন তার প্রতিটা কদমে, ভীষণ নিশ্চুপ ভাবে আকাশকে জানিয়ে দিচ্ছিল, “এবার আমি তাচ্ছিল্য করবো হে আকাশ। তোমার এবার দুঃখী হওয়ার পালা।”

_____________

সমাপ্ত~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

[বকুলতলা গল্পটি এক ব্য’র্থ প্রেমিকের, যে কিনা একপাক্ষিক ভালোবেসে পাঠকদের মনে জায়গা করেছে। গল্পটা এক উম্মা’দ প্রেমিকের, যে কিনা তার উ’ম্মাদনায় একটা মেয়েকে আবারও জীবন্ত করে তুলেছে। গল্পটা এক ক’ঠিন মেয়ের, যে কিনা সূঁ’চালো অতীত নিয়েও বেঁচে ছিল। পরিশেষে পেয়েছে এক সুন্দর জীবন! কতটুকু তুলেছি জানিনা, তবে শেষটা তাড়াহুড়ো করেছি বলে স্বীকার করছি। এই তাড়াহুড়ো সময়টাতে আমার প্রচন্ড মনে পরবে আপনাদের। আমার সকল পাঠকদের মন থেকে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা।❤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here