বকুলতলা
২৩.
ঘরটায় কেমন ভ্যাপসা গরম, ফাপা গন্ধ। জানালার ওপারটা গাছগাছালিতে জঙ্গল হয়ে আছে। সূর্যের আলো ঢুকছে কম। তরী ভেঁজা চুলগুলো ভালো ভাবে মুছে নিলো। গামছাটা রাখলো পুরোনো কাঠের চেয়ারটাতে। তিতির গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে বিছানার মাঝখানটায়। তরী নিঃশব্দে বোনের মাথার কাছে এসে বসলো। চুলে হাত বুলাতে লাগলো আলতো করে। বোনটা তার অনেক আদরের। মা মারা যাওয়ার পর থেকে তরীই যেন ওর সব। অথচ সে শহরে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটা কেমন অযত্নে নেতিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পরেছে, শরীর-মুখ শুকিয়ে কাঠ, মাথার চুল যত্নের অভাবে উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। এসবে আসলে বরকত সাহেবকে তেমন একটা দোষ দেওয়া যায় না। তিনি আর কত করবেন? সারাদিন দোকানের কাজ, রান্নাবান্না, ঘরদর পরিচ্ছন্ন রাখা- এসব করতে করতে তো নিজেরই খেয়াল রাখা হয়না। তিতিরকে কিভাবে সামলাবেন? মেয়েটা এমনিতেও বড্ড চঞ্চল। বড্ড অভিমানী।
তরী খানিকটা মাথা ঝুঁকালো। তিতিরের কপালে দীর্ঘ চুমু এঁকে সরে এলো তৎক্ষণাৎ। খাবার ঘর থেকে বাবার হাঁক শোনা যাচ্ছে। ভাত খেতে ডাকছেন তিনি। গায়ে ওড়না জড়াতে জড়াতে তরী উঁচু গলায় জবাব দিলো, “আসছি, আব্বা।”
তরীর বড় ফুপি এসেছেন। আমেনা খাইরুন। মহিলা বেশ ঠোঁটকাটা স্বভাবের। মুখে যা আসে সরাসরি বলে দেন। কে কি মনে করলো, খারাপ লাগলো কিনা, এতে তার কিচ্ছু যায় আসে না। তরীদের দশঘর পরেই উনার টিনের ছোটখাটো বাড়ি। এলাকার সবাই আমেনাকে এক নামেই ডাকে, ‘পাশের বাসার আন্টি।’
তরী একটু জোড়সড়ো হয়ে চেয়ারে বসলো। প্লেটে দু’চামচ ভাত আর পটল ভাঁজা নিলো। আড়চোখে সামনের মানুষটাকেও দেখে নিলো একবার। আমেনা জহুরি চোখে চেয়ে আছেন সেই প্রথম থেকে। মুখশ্রী ভীষণ ভাবে কুঁচকানো। বিশেষ করে কপালের দিকটা। কয়েক মিনিটের পর্যবেক্ষণ শেষে খসখসে কণ্ঠে বললেন, “তোর খানাদানার এই ছিরি ক্যান? কিছু কি খাস না?”
তরীর মৃদু স্বরের উত্তর, “খাই।”
—“দেইখা তো তেমনডা মনে অয় না। চোখের নিচে কালি বইয়া গেছে। রাত জাইগা থাকোস নাকি? নতুন নাগর জুটাইছোস?”
তরী মাত্র ভাতের এক লোকমা মুখে দিয়েছিল। চাবাতে পারলো না আর। থমকালো। চোখের দৃষ্টি স্থির হলো ভাতের দানার ওপর। বরকত সাহেব কৃত্রিম হেসে বললেন, “ওসব কিছু না বুবু। তরী সারারাত জেগে পড়াশোনা করে তো!”
আমেনা বিশ্রী ভাবে মুখ বাঁকালেন। স্বাচ্ছন্দে ভাত চিবুতে চিবুতে তাচ্ছিল্য করলেন, “কি পড়ালেহা করে, আমার জানা আছে। আমারে শিখাইতে আসিস না। এক পড়ালেহা, পড়ালেহা কইরা অসতী হইলো। আবার বিয়াটাও টিকলো না। এত পড়ালেহা করাইয়া কি করবি বরকত? আবার বিয়া দেওনের চেষ্টা কর। আমার কাছে একখান ভালা সম্বন্ধ আছে।”
ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে বুঝি? তরী বুঝতে পারলো না। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুখের ভাতটুকু গলা দিয়ে নামতেই চাইছে না। দৃঢ় কিছু কথা শুনিয়ে দিতে গিয়েও পারলো না। বরকত সাহেব বারবার চোখের ইশারায় অনুরোধ করছেন কিছু না বলার জন্য। তরী সশব্দে উঠে দাঁড়ালো। একপলক বাবার দিকে অভিমান ভরা দৃষ্টে তাকিয়ে, চলে গেল ডানপাশের ঘরটায়।
আমেনা কিন্তু তখনো ক্ষান্ত হননি। খসখসে কণ্ঠটা ক্যাসেটের মতো চালাতেই রইলেন, “অর্ণব ছেলেডার সাথে কালকা দেখা হইছিল। কি ভদ্র,সভ্য হইছে! আগের কুনু বদকাম করে না। তোর মাইয়ার মইধ্যেই দোষ আছিলো। ভালা পোলাটারে ধইরা রাইখতে পারলো না!” কণ্ঠস্বর চুইয়ে চুইয়ে একরাশ আফসোস।
এবার আর না রেগে পারলেন না বরকত সাহেব। বিরক্তিতে মুখ তিতা করে রাখলেন।
—“তোমাকে আমার মেয়ের ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে না বুবু। খাইতে আসছো, খেয়ে চলে যাবা। এত বার্তি ঝামেলা পছন্দ না আমার।”
কথাটা কি গায়ে লাগলো আমেনার? লাগেনি বোধহয়। আগের মতোই তৃপ্তির সাথে খাবার খাচ্ছেন তিনি। মাঝখান দিয়ে আবার কি যেন বিড়বিড় করে বলছিলেনও! বরকত সাহেব শুনতে পাননি।
–
তিতির অনেকদিন ধরেই অসুস্থ। এই জ্বর, এই ঠান্ডা-কাশি। এবার খানিকটা মাত্রা ছাড়ানো জ্বরই হয়েছে ওর। প্রতিবার ঘুমের ঘোরে নাকি তরীকেই একটু জড়িয়ে ধরার আবদার করছিল। একটুখানি কথা বলার অফুরান আবদার জাহির করছিল। বাবার কাছে সবকিছু শুনে তরী আর দেড়ি করতে চায়নি। সকালেই চলে এসেছে। তারও আর শহরের যান্ত্রিকতা ভালো লাগে না। দমবন্ধ হয়ে আসে। এই প্রকৃতি, ঠান্ডা বাতাস, বিশ হাত দূরে মায়ের কবর, ওইতো ওই বকুল গাছটা! তরী নামক নৌকা নিজের তির ছাড়া বাঁচবে কিভাবে?
ঘড়িতে তখন পৌনে দুইটা। তিতির শক্ত বাঁধনে তরীকে জড়িয়ে ধরে আছে। তরীর চোখে ঘুম নেই। শুয়ে শুয়ে গ্যালারি দেখছিল ও। একদম শেষের সারিতে কয়েকটা ছবি দেখতে পেল বন্ধুদের নিয়ে। রুপালীও আছে। তরী আর রুপালী একই শাড়ি পরেছিল সেদিন। মুখে কি আনন্দের বিস্তর হাসি! একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসছিল ওরা। মুহুর্তেই তরীর মনে একটা প্রশ্ন এলো, রুপালীকে কবর কোথায় দেওয়া হয়েছে? ওর বাবা মা তো রাগ করে মেয়ের লা’শটাও দেখতে যায়নি।
তরীর ফোনে কল এসেছে। অচেনা নম্বর। তরী স্বাভাবিকভাবে অচেনা নম্বর ধরে না। কিন্তু এ ফোনটা নতুন। শহরে যাওয়ার আগে বাবা কিনে দিয়েছিলেন। অনেকের নম্বরই ফোনে সেভ নেই। খানিক্ষণ ভেবে চিন্তে তরী ফোনটা ধরলো, “হ্যালো, কে বলছেন?”
ওপাশ নিশ্চুপ। কথা নেই। তরী আবার বললো, “কথা বলছেন না কেন? হ্যালো?”
সেকেন্ড লাগিয়ে ওপাশের ব্যক্তি উত্তর দিলো, “আমি বলছি।”
গলাটা প্রণয়ের। গম্ভীর গলা। তরী ভড়কালো খুব। কথা বলতে পারলো না। প্রণয়ই শুধালো,
—“আপনি কি ঘুমাচ্ছিলেন?”
—“না।”
যথা সম্ভব শান্ত গলায় জবাব দিলো তরী। প্রণয় শুনলো। কিন্তু কথা বললো না। ওপাশ থেকে নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তিতির নড়েচড়ে শুয়েছে। আরও শক্ত করে ধরেছে তরীকে। সেও পালটা ভাবে তিতিরের কপালে চুমু খেল। তারপর অনেকটা বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি আমি কি করছি সেটা জানার জন্যই কল করেছেন? কিছু বলার থাকলে দ্রুত বলুন। আমি ঘুমাবো।”
প্রণয় বেশক্ষণ চুপ থেকে ধীর গলায় শুধালো, “কবে আসবেন?”
—“কেন?”
—“আমার আপনাকে মনে পরছে তরী। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা