বকুলতলা ৭.

0
633

বকুলতলা

৭.
প্রণয় চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে তরীকে। তরীর অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু তা আমলে নেওয়ার সময় নেই। যত দ্রুত সম্ভব টেবিলে খাবার গুছাতে হবে। প্রণয় ইদানিং বেশ দেড়ি করে ফেরে। সবাই ততক্ষণে খাবার-দাবার শেষ করে ঘুমের দেশে পারি দিয়েছে। অগত্যা সালেহা আর তরীকেই প্রণয়ের খাবারের ব্যাপারটা সামলাতে হয়।
প্রণয় ভেঁজা চুলগুলো একহাতে ঝেঁড়ে হঠাৎ বললো, “বরফ পাওয়া যাবে একটু?”

সেসময় সালেহা গ্লাসে পানি ভরছিল। প্রণয়ের কথা শুনে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। টেবিলে লবণ নেই। কৌটা-টাও উধাও। সালেহা কি সাথে করে নিয়ে গেছে? তরী আড়চোখে একবার প্রণয়ের দিকে তাকালো। মাত্র গোসল করে এসেছে সে। পরনে পাতলা সুতীর ফতুয়া। গাঢ় সবুজ রঙের। মাথার চুলগুলো ভালো করে মুছেছে। বৈদ্যুতিক পাখার কৃত্রিম বাতাসে দুলছে সেগুলো। তরী নজর ফেরালো। লবণ আনতে এক কদম এগোতে না এগোতেই প্রণয়ের দৃপ্ত প্রশ্ন, “অর্ণবকে মনে আছে তরী?”

মনে হলো, ধুকধুক হৃদযন্ত্রের চলা থেমে গেছে। যেন হঠাৎ করেই বিদ্যুতের ঝলকানি ধ্বংস করে দিয়েছে সব। চোখের পাতা একত্রে মিলছে না। ক্ষীণ কাঁপছে৷ ঠোঁটযুগল নড়েচড়ে কি যেন বলতে চাইছে। কিন্তু নড়া ছাড়া যে আর কিছুই করার সামর্থ্য নেই। প্রণয় সবই খেয়াল করলো। পরখ করে নিলো ভীষণ সূক্ষ্ণতার সঙ্গে। আবার শুধালো,
—“মনে আছে, অর্ণবকে?”
শক্ত হয়ে জমে থাকা তরী এবার কথা বললো। কঠিন, গম্ভীর, থমথমে গলায়,
—“কি চাচ্ছেন আপনি?”
—“আমি কি চাইবো?”
—“জ্বালাচ্ছেন কেন তাহলে?”
—“আপনাকে তিন বছর আগের ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম। আর কিছু না।”
তিন বছর আগের ঘটনা! তিন বছর আগের তরী! ওই অর্ণব নামের লোকটা! সবটা যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথায় রেকর্ডারের মতো রিপিট হলো। তরীর নিশ্বাস ভারি, ঘনঘন। চোখে কি পানি জমেছে? জমেছে হয়তো।
তরীর হালকা ভেঁজা স্বরের তেজি ভাব ভীষণ মিষ্টি শোনালো প্রণয়ের কাছে, “আমি জানি আমার অতীত। আপনাকে বলতে হবে না। দয়া করে, এত দয়া করবেন না আমার ওপর। আমার স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট ভালো আছে।”
ডালে ভাত মাখালো প্রণয়। একলোকমা খেল। কি তৃপ্তি এই সাধারণ বাঙালি খাবারে! রোজ রোজ মাংস, বিরিয়ানি খেতে প্রণয়ের সত্যিই আর ভালো লাগে না। খেতে খেতে প্রণয় বললো,
—“আমার তো মনে হচ্ছে না আপনার আগের কথা মনে আছে। মনে থাকলে তো আর অন্য ছেলেদের সাথে ঘুরতেন না।”

তরীর সর্বাঙ্গ দারুণ চমকে হতবাক হলো। বিমূঢ়তা চোখে-মুখে স্পষ্ট। জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমার বিষয়ে এত কিছু জানেন কিভাবে?”
প্রণয়ের নির্লিপ্ত উত্তর, “আপনাকে একটা ছেলের সঙ্গে দেখেছিলাম কয়েকদিন আগে।”
—“আর তিন বছর আগের ঘটনা? ওগুলো কিভাবে জেনেছেন? মামা-মামী বলেছে?”

প্রণয়ের উত্তর আর শোনা হলো না৷ সালেহা চলে এসেছে। বাম হাতের বাটিতে অনেকগুলো বরফের কিউব আর ডান হাতে লবণের কৌটা। তরী আস্তে আস্তে সরে এলো সেখান থেকে। রান্নাঘরে যায়নি। একেবারে নিজের ঘরের দরজা আটকে বিছানায় শুয়ে পরেছে।

সময় গড়িয়ে গেছে। রাতের কালো আচ্ছন্নতা শেষে সূর্যের আলোকিত স্নিগ্ধতা মন ভুলিয়ে দিতে চলে এসেছে। তরী কাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি। ফলসরূপ সকাল থেকে ভীষণ মাথাব্যথা। কাজ করতে গিয়েও যে কি আলসেমী লাগছে! ভার্সিটির জন্য তৈরি হতে গিয়ে খুব সময় লাগালো তরী। সাহেলার জোরাজোরিতে অল্প একটু পরোটা আর চা খেল।
মাহাদ তরীর জন্যই অপেক্ষা করছিল। তবে এবার ম্যানরোডের কাছে নয়, তরীর মামার বাড়ির সামছে দাঁড়িয়েছে। গেটের অনেকখানি দূরত্বে। দু’আঙুলের ভাঁজে সিগারেট রেখে একেকটা সুখটান দিচ্ছে। তরী তখন বেড়িয়েছে মাত্র। মাহাদকে প্রথমে খেয়াল করেনি। কিন্তু পরপরই যখন লোকটা ওকে ডাকলো, তরী থমকালো। মাহাদ সিগারেট ফেলে দিয়েছে। একেকটা দৃঢ় কদমে এগিয়ে আসছে ওরই পানে। কাছাকাছি হতেই পূর্ণ দৃষ্টে চাইলো। শান্ত, শীতল, ঠান্ডা দৃষ্টি।

—“তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ঠিকঠাক খাওনি?” সন্তপর্ণে লুকিয়ে থাকা তীব্র যত্ন প্রশ্নটায়।
তরী মৃদু গলায় উত্তর দিলো,
—“খেয়েছি।”
তারপর একটু থেমে আবার বললো, “আপনি হঠাৎ এ এলাকায় এসেছেন কেন? বাড়ির সামনে এভাবে আর দাঁড়াবেন না।”
তরীর কথায় কি কখনো গ্রাহ্য করেছে মাহাদ? মনে পরছে না। সে বরাবরই নির্বিকার। দৃঢ়, একরোখা, জেদী। কারো কথায় যার কিছুই যায় আসে না।
আশপাশে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে মাহাদ গাঢ় গলায় শুধালো,
—“বড়োলোকি রাস্তায় হাঁটতে এসেছিলাম। হেঁটে মজা পাইনি। হাঁটতে হাঁটতে যদি একটু ইট-পাথরে উসঠাই না খাই, তাহলে কি আর ভালো লাগে?”

তরী সরল চোখে তাকালো। তপ্ত নিশ্বাস ফেললো আস্তে আস্তে। উগ্র মাহাদকে হঠাৎই গভীর ভাবে অনুভব করলো। সেই অনুভব গভীরে গিয়েও যেন মন ছুঁলো না। মাঝপথে আটকালো, ক্ষতবিক্ষত হলো, ভাঙ্গলো, এরপর ফিরে এলো। ভেতরকার অতি গোপন কষ্ট যেন একটু একটু করে বাড়ছে। ডান চোখ থেকে একটুখানি পানি গড়িয়ে পরছে। একদম সামান্য। সেই সামান্য পানি আলতো হাতে মুছে দিলো মাহাদ। প্রথমবার! প্রথমবার তরীকে আদরমাখা হাতে স্পর্শ করলো। কপালের এলোমেলো চুল পেছনে ঠেলে ঠিকঠাক ঘোমটা আরও ঠিকঠাক করে দিলো। ঢিমে যাওয়া গলার স্বর উৎকণ্ঠা হয়ে উঠলো, “তরী? কি হয়েছে? বেশি খারাপ লাগছে? কিছু কিনে দেই? খাবে? এই মেয়ে! কথা বলছো না কেন?”
তরী সিক্ত নেত্রজোড়া নুইয়ে নিলো। থেকে থেকে বললো, “আমার– আমার কষ্ট লাগে।”
—“কেন লাগে এত কষ্ট? কেউ কিছু বলেছে? আমি কিছু করেছি?”

তরী ছোট্ট শিশুর মতো মাথা এদিক-ওদিক নাড়ালো। কেউ কিছু বলেনি। মাহাদও কিছু করেনি। মাহাদ এবার কোমলস্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তাহলে?”
—“এখানে থাকতে ভালো লাগেনা।”
—“তবে চলো বিয়ে করে ফেলি। অন্য জায়গায় গিয়ে থাকবো। অনেক দূরে। সবার থেকে দূরে।”

তরী কান্না ভুলে বড় বড় চোখে তাকালো। ওর তাকানো দেখে মাহাদ হেসে ফেললো। বিস্তর অথচ নিঃশব্দে। বললো, “মজা করছিলাম। কোথায় থাকবে না? তোমার মামা বাড়িতে? হোস্টেলের ব্যবস্থা করবো?”
—“হোস্টেলে সীট খালি নেই তো। আমি খুঁজেছিলাম।”

গালের লবণ পানিগুলো আবারও মুছে দিলো মাহাদ, “এভাবে কাঁদবে না তরী। চোখ ফুলে তোমাকে ভয়ংকর দেখায়। আমি ভয় না পেলেও রাস্তার মানুষ কিন্তু তোমার নামে মামলা ঠুকে দিবে।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here