#তনয়া
#পর্ব -১৩
“আমি চেয়েছিলাম এক ফোঁটা জল,
তুমি দিয়েছ বিশাল এক সমুদ্র।
অথচ আমি ভাসতে চাইলেই,
তুমি যত্ন করে দিচ্ছো ডুবিয়ে।”
ব্যাগের ভেতর ছোট চিরকুট টা পেয়ে অবাক হলো তনু।কে রেখেছে এটা? কখনই বা রাখলো?দুদিন থেকে তো সে ভার্সিটিতে যায় না।আজ তৈরী হয়ে ব্যাগ গোছানোর সময় দেখতে পেল চিরকুটটা।কে লিখতে পারে এটা ভাবতে ভাবতেই বের হলো সে।রিকশা থেকে নেমে ভীড়ের মাঝখানে পরে গেল।ভার্সিটির সামনের রাস্তায় অনেক ভীড়। ধীরে ধীরে এগোচ্ছো সে।লোকজনের থেকে গা বাঁচিয়ে হাঁটছে।ঠিক সে সময় সে খেয়াল করলো তার পাশ ঘেঁষে কেউ হাঁটছে!পাশ ফিরে তাকিয়ে মিশকাত কে দেখে চমকালো না।বরং একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আজকাল তোমায় একটু বেশি দেখা যাচ্ছে!”
মিশকাত জবাবও দিলো না এমনকি তনুর দিকে তাকালো না।কিন্ত হাঁটছে তনুর ঠিক পাশ ঘেঁষে।তনু মিশকাতের নতুন ধরনের হাবভাব বুঝে উঠতে পারছে না। হুট করেই কেমন যেন হয়ে গেছে?আচ্ছা, চিরকুটটা মিশকাত রাখে নি তো?সেদিন যে ব্যাগটা টেনে নিলো!
“তুমি আমার ব্যাগে চিরকুট রেখেছিলে মিশকাত ভাই?”রাস্তা পার হয়ে এসে দুজনেই দাঁড়াল।
“সবসময় তোর উল্টা পাল্টা কথা বলাই লাগবে, তাই না?এখনও ভদ্রতা শিখতে পারলি না আবার আমায় বলিস স্কুলে ভর্তি হতে?”
“মোটেও উল্টো পাল্টা কথা বলি না আমি। তোমার সাথে কথা বলাই ভুল।”
“আমার বড় ভুল তোর সাথে দেখা হওয়া।শোন,তোর সাথে দেখা না করতে না পারলে কেউ মরে যাচ্ছে না!”
“আশ্চর্য তো!আমি কখন বলেছি কেউ আমায় দেখার আশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে?”
“তোর মুখে বলতে হবে কেন?ভাবখানা তো তাই দেখাস!”
“মিশকাত ভাই তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মহিলাদের মতো ঝগড়া করছো কেন? ”
“চুপ থাক।” মিশকাত ধমক দিলো।তনুর চোখ মুখ আরও কঠিন হয়ে উঠল।
তনু মনে মনে বলল,
“আমার সাথে একটু সুন্দর করে কথা বললে কি হয় মিশকাত ভাই?আমি যে খুব হাপিয়ে উঠেছি।তোমায় কিছুতেই মন থেকে সরানো যায় না।এত কঠিন অনুভূতি নিয়ে কেন গেড়ে বসেছ আমার মনে?”
মিশকাত তার হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা তনুর হাতে দিয়ে বলল,
“ধর তো একটু?”
“কি এটা?”
“এই জন্যই তোর সাথে সুন্দর ভাবে কথা বলা যায় না।সবকিছুতেই তোর হাজারটা প্রশ্ন? ”
তনু দীর্ঘশ্বাস চেপে ব্যাগটা হাতে নিলো।
“তুই একটু দাঁড়া আমি আসছি।”
তনু এবার প্রশ্ন করল না, কোথায় যাবে?কিছু বললেই তো আবার ঝাড়ি খেতে হবে।কি দরকার যেচে পড়ে ঝাঁজ সহ্য করার?হাতে থাকা ফোনে সময় দেখলো।প্রথম ক্লাসটা বোধহয় আর করা হবে না।মিশকাত না চাইতেও তনুকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে অজানা কোনো বাঁধনে।এমন কেন হচ্ছে? যত দূরে থাকতে চায় ততই যেন কাছে আসা হয়!
দাঁড়িয়ে থেকে পা ধরে গেল অথচ মিশকাতের দেখা মিললো না।তনু যা বোঝার বুঝে গেল।মিশকাতের সাথে দেখা হওয়ার আসল কারণ এই ব্যাগটা!এটা তনুকে দেয়ার জন্যই এসেছে?কিন্তু কি আছে এতে?
তনু আর ভার্সিটিতে গেল না। ফিরে এলে বাড়িতে।
ব্যাগটা খুলে একটু চমকালো।অনেক সুন্দর একটা শাড়ি।শুধু শাড়ি নয় সাথে চুড়ি গাজরা সবকিছু।সাদা রংয়ের শাড়িটার সাথে একটা চিরকুট আটকানো!
“শোন,তোর কাছে ব্যাগটা ভালো ভাবে রাখিস।হলে থাকি এসব মেয়েদের জিনিসপত্র কিভাবে রাখি বলতো?একজনকে দেয়ার জন্য কিনেছি কিন্তু দিতে পারছি না কিছু কারণে। সেই একজনটা কে তোকে বলব সময় করে, খুব বিশেষ কেউ।বাড়িতেও রাখা যাবে না মা দেখে ফেলবে।তাই তোর কাছে রাখলাম।দেখিস আবার নিজের মনে করে পড়ে ফেলিস না যেন?একদম হাত দিবি না, যেমন ব্যাগটা দিয়েছি ঠিক সেভাবেই রাখবি, কেমন?এর জন্য তোকে বকশিসও দেব ভাবিস না।তুই শুধু যত্ন করে রাখিস।”
শাড়িটা হাতে নিয়ে তনু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো।বুকের ভেতর কি হচ্ছে সেটা শুধু সেই জানে।মানুষটা এত অন্যরকম কেন? তনুকে দিয়েছে সেটা সোজা ভাবে বলতেও পারল না?বলবেই বা কি করে সেই সম্পর্ক কি আছে দুজনের মধ্যে?
ইশ!এখনও তনুতেই বিভোর হয়ে আছে মিশকাত ভাই।খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে তনুর,খুব।যে কান্না গুলো তাকে শান্তনা দেবে!বুকের ভেতর ওঠা ঝড়টাকে সামলে দেবে!
***
আরাফ গত এক সপ্তাহ ধরে মায়ের সাথে রীতিমতো যুদ্ধ করে চলেছে।তনুকে তার পক্ষে কিছুতেই ভুলে থাকা সম্ভব নয়।অন্যদিকে আরাফের মা ছেলের জেদের কাছে হার মানবেন না।এই নিয়ে অশান্তির শেষ নেই।আরাফের বাবা তো বলেই দিয়েছেন তার একমাত্র ছেলের জন্য তনুকে বউ করে আনবেন না।আরাফের বোন দুলাভাই অনেক বুঝিয়েছে।যেখানে মেয়ে নিজেই রাজি নয় সেখানে আরাফের এমন জেদ সত্যি অমূলক।কি দরকার আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করার?তনুর পরিবার সত্যি ভালো শুধু মেয়েটার যদি সমস্যা টা না থাকতো তাহলে এতকিছু ভাবতে হতো না।অনেক আগেই বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যেত। লজ্জায় তো আরাফের বাবা মা পরেছেন।নিজেদের ছেলেকেই সামলাতে পারছেন না।এত আবেগ দিয়ে কি জীবন চলে?রাফাত তো আরাফের সাথে ঠিকমতো কথাই বলে না।
আজ আরাফ এসেছে তনুর বাবার অফিসে।অনেক ভেবে তানভীর সাহেবের সাথে কথা বলতে এসেছে।তানভীর সাহেবের পিয়ন এসে জানিয়ে গেছে কিছুক্ষণ বসতে হবে। তাই আরাফ অপেক্ষা করছে। ঠিক সেসময় মিশকাত এসে হাজির হলো।আরাফকে দেখে অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে সৌজন্য বজায় রেখে কথা বলল।
“আপনি এখানে?”
“একটু আংকেলের সাথে কথা বলতে এসেছি।”
“কেনো কাজের ব্যাপারে নাকি?”
“নাহ্ সেরকম কিছু নয় একটু কথা বলতে এসেছি শুধু। ”
“ওহহ,তাহলে বাসায় চলে যেতেন?”
“না বাসায় যাওয়ার সময় নেই।আমি অফিস থেকে সোজা এখানে এসেছি। তা আপনি এইদিকে?”
“আমাকে বাবা পাঠিয়েছে ফুপার কাছে আমাদের কিছু কাগজপত্র থাকে তাই নিতে।”
“আংকেল বোধহয় খুব ব্যস্ত।আমায় ওনার পিয়ন এসে একটু অপেক্ষা করতে বলল।আপনিও বসেন?”
“সমস্যা নেই আপনি বসেন।আমাকে প্রায় আসতে হয়।”
তানভীর সাহেবের সাথে আলাদা ভাবে দেখা করতে আসা বিষয়টা মিশকাতকে ভাবিয়ে তুললো।সবটাই শুনেছিল মারুফের কাছে।তনুর পেছনে এই ছেলে এত দৌড়াচ্ছে কেন বুঝতে পারছে না।তনুর জন্য গভীর ভালোবাসা কি আছে আরাফের মনে?ক্ষনিকের দেখায় ভালো লেগে গেছে তনু তো ভালো লাগারই মতো।সাধারণের ভীড়ে অসাধারণ। মিশকাত মনে মনে হাসলো,তার ছয় বছরের ভালোবাসা পুড়তে পুড়তে খাঁটি হয়েছে।এত সহজে তা অন্যকারও হয়ে যাবে?তনুর থেকে সবসময় দূরে ছিল তবু তারা যেন কত কাছে!একজন অন্যজনকে খুব করে অনুভব করতে পারে।মনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা ইচ্ছে গুলো মুখে বলতে হয় না।দূরত্ব কখনও তাদের ভালোবাসায় ধুলো জমতে দেয় নি।সবসময় সজীবতা বিরাজমান!
মিশকাতের পিয়নের পরিচয় অনেক আগে থেকেই।তানভীর সাহেবের মিটিং শেষ হয়েছে। ব্যবসা নিয়ে প্রায় সময়ই ব্যস্ত থাকতে হয়।কিন্তু মিশকাতকে কখনও অপেক্ষা করতে হয় না।সে সোজা রুমের ভেতর ঢুকে বলল,
“খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে? আফসার সাহেব ফেরেন নি কানাডা থেকে?”
“না রে ও ফিরলেই আমার ব্যস্ততা কমে যায়।আরও দুসপ্তাহ ওকে থাকতে হবে বাইরে।তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“বসবো না আজ।কাগজ গুলো দাও।তোমার সাথে কথা বলার জন্য বাইরে আরেকজন খুব আগ্রহ নিয়ে বসে আছে দেখছি!”
“হ্যাঁ,আয়রার খালা শ্বাশুড়ির ছেলে। ওকে ওভাবে বসিয়ে রাখতে খারাপ লাগছে।কিন্তু কিছু করার নেই।কেবল মিটিং শেষ হলো।”তানভীর টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফাইলটা বের করে দিলো।
মিশকাত সেটা নিয়ে বলল,
“ওকে বসিয়ে রাখায় খারাপ লাগছে সেটা পর্যন্ত ঠিকিই আছে কিন্তু ওকে তোমার আমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা দিতে না পারায় যেন মোটেও খারাপ না লাগে তোমার।”
মিশকাত বেরিয়ে গেল।তানভীর সাহেব একরাশ বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। তবে বুঝতে পারলেন বুকে থাকা কষ্টের ভারী পাথরটা হঠাৎ সরে গেছে।আনন্দে চোখে পানি চলে আসার আগেই সেটা মুছে নিলেন।পিয়নকে বললেন,আরাফকে আসতে বলতে।ছেলেটাকে আজ ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে।
***
বিয়ের পর আয়রার হানিমুন হয় নি।তাই রাফাত ভাবছে গরমের ছুটিতে কোথা থেকে ঘুরে আসা যায়?আয়রা একা গেলে তো শান্তি পাবে না তাই সবাই মিলে একটা ছোট খাটো ট্যুরের প্লানিং করাই যায়।আয়রার কাজিন তো অনেক।তনু তো আছেই।আয়রা শুনে তো মহাখুশি। তবে বেশি কাউকে নেয়া যাবে না। বেশি গ্যাদারিং হবে যাবে।আয়রার কথা মতো রাফাত ঠিক করলো তনু, শান্তা, মারুফ আর মিশকাতকে।এদের সবাইকে বলাও হয়ে গেল।মিশকাত শোনার সঙ্গে সঙ্গে বলে হ্যাঁ বলে দিয়েছে।যদিও সামনে তার ফাইনাল পরিক্ষা তার ওপর ইন্টারভিউয়ে টিকে গেলে ডাক আসতে পারে এসব নিয়ে না ভেবে সে রাজি হয়ে গেছে।তনু যাবে আর সে যাবে না সেটা তো হতে পারে না?তাছাড়া আরাফের যাওয়ার একটা চান্স আছে!তিনদিনের জন্য সিলেট ঘুরে আসলে মন্দ হয় না।সেই সাথে প্রকৃতির বুকে তনুর কাছাকাছি থাকা!এমন একটা সুযোগ ভবিষ্যতে নাও হতে পারে।আগে হলে মিশকাত দূরেই থাকতো। কারণ সবটা তো জানতো না।এখন তো দূরে থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না।
শুধু রাফাতকে বলে রাখলো তার যাওয়ার ব্যপারটা যেন তনুকে না জানানো হয়।রাফাত কারণ জানতে চাইলে বলেছে,দেখা হলে সবটা খুলে বলবে।তবে রাফাত যা বোঝার বুঝে গেছে।তাই সহজেই ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে।
তনুর ব্যাগপ্যাক করা শেষ।শায়লা বেগম মেয়ে জামাইর এমন সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন। তনুর এই সময় একটু বাইরে ঘুরে আসার দরকার ছিলো।তিনি বুঝতে পারেন মেয়েটার মাঝে মাঝে দমবন্ধ আসে।
শান্তা মারুফ বিকেলে চলে আসলো তনুদের বাড়িতে।আগামিকাল সকালে ওরা রওনা দেবে সিলেটের উদ্দেশ্যে।তনুর মনটা সত্যি খুব ফুরফুরে লাগছে।একটু ভেবে মিশকাতের দেয়া শাড়িটাও সাথে নিয়ে নিলো। হঠাৎ মুক্ত হাওয়ায় উড়তে ইচ্ছে করছে।প্রিয় মানুষকে বা নাই পেল সাথী হিসেবে তার দেয়া শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে তো প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে পারবে!
চলবে..
(মিশকাত তনুর কাহিনি কেমন লাগছে সবার?)