তনয়া #পর্ব -১২

0
317

#তনয়া
#পর্ব -১২

“তোমার জন্যই মারুফ ভাইয়া আমায় কিছু না বলে এখানে নিয়ে এসেছে, তাই না?”

“চ্যাটাং চ্যাটাং কথা না বলে চুপচাপ বসে থাক।তোর মতন নবাবজাদীকে এভাবেই আনতে হয়।”

তনু মিশকাতের কথার পিঠে কথা না বলে চুপ করেই বসে থাকলো।হঠাৎ মিশকাত কই থেকে উদয় হলো কে জানে?এখন মিশকাতের সাথে ঠিক মতন কথা বলাই যায় না।সব কথা ত্যাড়া ভাবে বলবে।বিশেষ করে তার সাথে।আজ মিশকাতের সাথে দেখা হবে জানলে চিঠিটা সাথে করে আনতো।এখন মনে হচ্ছে ইহজনমে মিশকাতকে জানানো হবে না। অবশ্য ধীরে ধীরে অনেকেই জানতে পারবে এখন।মিশকাত ভাই ঠিক এক সময় জানবে।দেখা যাবে মামি বলে বসবে।তার আর কষ্ট করতে হবে না।মা বাবা দুজনেই খুব সুন্দর ভাবে তাকে সামলাচ্ছে। তানভীর সাহেব খুব কষ্ট পেয়েছেন।তনুর একদিক থেকে কপাল খুব ভালো সে তানভীর সাহেবের মতো বাবা শায়লা বেগমের মতো মা পেয়েছে।পরিবারকে খুব প্রয়োজন হয় এমন পরিস্থিতিতে।পরিবার পাশে থাকলে সব সীমাবদ্ধতা জয় করা যায়।

“তোর সাথে এনআইডি কার্ড আছে নিশ্চয়ই? একটু দে তো।”

“কেন? ”

মিশকাত নিজেই ব্যাগটা টেনে নিলো।কাগজটা খুঁজে নিয়ে আবার চলে গেল।তনু কিছুই বুঝতে পারছে না।ভার্সিটি থেকে একটু দূরের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে মারুফ। এখানে এসে দেখলো মিশকাত বসে আছে।তনুকে দেখে মিশকাত একটা লম্বা হাই তুলে বলল,

“মহারানীকে কোথায় খুঁজে পেলি মারুফ?তা মহারানী আপনি কি এখানে রাজভোগ খেতে এসেছেন?এসেছেন যখন বসে পরেন।আপনার সাথে আমরা গরীব প্রজারাও একটু খেতে পারবো।”

এরপর তনুকে বসিয়ে রেখে মারুফ কে নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।এবার এসে এনআইডি কার্ড নিয়ে আবার চলে গেল।কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠছে না। ইতিমধ্যে ওয়েটার ফ্রাইড রাইস চিলি চিকেন দিয়ে গেছে।তনুর বিরক্ত লাগছে।দিন দিন মিশকাত খুব বিরক্তিকর হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষটার অনুপস্থিতিও তাকে বিরক্ত করে।ভালোই হয়েছে সম্পর্কটা হয়নি।এমন মাথা পাগলা ছেলের সাথে কেনো সম্পর্ক না হওয়াই উচিত ,হু।

দশ মিনিটের মধ্যে দুজনেই ফিরে এলো।মিশকাত বসতে বসতে বলল,

“খাচ্ছিস না কেন?সারাদিন এখানে বসে থাকার ইচ্ছে আছে?এরপর একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বলল খেয়ে দেয়ে এখানে একটা সই দিয়ে চলে যা।”

“কিসের কাগজ?আমি কি এখানে বসে আছি নাকি বসিয়ে রাখা হয়েছে?”

মিশকাত কথা বলল না।সে খাওয়ায় মনযোগী হয়ে গেছে।এমন ভাব তার সামনে খাবার ছাড়া কিছু নেই।সামনের নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত মেয়েটার কোনো অস্তিত্বই নেই।

তনু মিশকাতের এমন ভাব দেখে জ্বলে উঠল।

“মারুফ ভাই তুমি আমায় বলবে কি হচ্ছে এসব?তুমি আমায় কেন নিয়ে এলে।”

মারুফ পরলো বিপদে।এদের দুজনের ঝাঁঝে এসির বাতাসও তার কাছে গরম লাগছে।

“তুই শুধু সিগনেচার করে দে।আমি তোকে রেখে আসব বাড়িতে।”

আমি বাড়ির রাস্তা জানি।তোমরা আমায় বলো কি হচ্ছে এসব?

“মারুফ এত কথা না বলে কাগজটা পড়ে দেখতে বল।এইজন্যই মেয়ে মানুষের সাহায্য নিতে নেই?” মিশকাত খেতে খেতে বলল।তার মনোযোগ এখনও খাবারে।আশেপাশে তাকানোর প্রয়োজন মনে করছে না।

তনু কাগজটা পড়ে কিছুই বুঝল না।কিসব জায়গা কেনার কথা লেখা।এই কাগজে তনুর কেন সিগনেচার লাগবে সেটাই বুঝল না।

মিশকাত ইশারায় মারুফকে বলতে বলল।

“মিশকাতের এনআইডি হারিয়ে গেছে।এই কাজটা না হলে সমস্যা হয়ে যাবে।আজকেই করতে হবে তাই তোকে ভার্সিটিতে পেয়ে নিয়ে এসেছি আমি।মিশকাত জানত না।ও তো আমার এনআইডি কার্ড নেয়ার জন্য এসেছে।আমি আনতে ভুলে গেছি।এত না ভেবে সিগনেচারটা করে দে।”

তনুর এবার সবটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কি সব কথা? এনআইডি কার্ড হারিয়ে ফেলেছে তাই তনুকে লাগবে।কেমন জোড়াতালি কথাবার্তা!
সে আবার পরলো ভালো ভাবে কাগজটা।তাই দেখে মিশকাত বলল,

“কি ভাবছিস তোর থেকে সম্পত্তির দলিলের সই করিয়ে নিচ্ছি?”

“আজব তো ,কখন বললাম সে কথা?মিশকাত ভাই তুমি একটু সুন্দর করে কথা বলতে শেখো তা না পারলে আবার স্কুলে ভর্তি হও।”

তনু রেগে ব্যাগ থেকে কলম বের করে দ্রুত সাইন করে দিলো।মিশকাত মারুফ দুজনেই লুকিয়ে হাসলো।তনু টেবিলে কাগজটা রেখে কড়া চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। মারুফ খাবার রেখে দৌড়ে পিছু নিলো।

***
“আয়রা তনয়ার বিষয়ে যা শুনলাম সেটা সত্যি? ”

“আমরা মিথ্যা বলব কেন?”

“আরে বাবা,রেগে যাচ্ছ কেন?আমি শুধু জানতে চাইলাম।আমার তনয়ারর জন্য খুব খারাপ লাগছে।বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ”

আয়রা চুপ করে রইলো।তনুর জন্য সবসময় খারাপ লাগে।তার বিয়ের পর থেকে একবারই যা এসেছে তনু।এখন নিশ্চয়ই আসতে চাইবে না?
রাফাত আয়রাকে দুহাত মেলে আগলে ধরে বলল,

“পাগলি,মন খারাপ কেন করছো?এই সাধারণ ব্যপারটা তোমরা এতো অস্বাভাবিক করে কেন তুলছো বলতো?”

“মানে? ”

“দেখ ,এটা খুব সাধারণ বিষয়।মানুষের হাতে তো কিছু নেই।সৃষ্টিকর্তা কখন কাকে সন্তান দান করেন সেটা কি কেউ বলতে পারে?তাই আমার কাছে এটা খুব সাধারণ বিষয় মনে হয়।”মা” হতে পারবে না এভাবে কথাটা বলা ঠিক না।জন্ম দিলেই কি মা হওয়া যায়, বলো?আমরা শুধু বুঝি সন্তান জন্ম দিলাম তো মা হলাম।এমনটা নয়,এটা শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যপার।আমরা গভীর ভাবে ভেবে দেখি না।যা আমাদের সমাজে প্রচলিত তাই আমরা নির্দ্বিধায় মেনে চলি।সেটা কতটুকু সঠিক এটা ভাবতে চাই না।ধরো,হসপিটালে তোমার জন্ম দেয়া সন্তানটা কোনো ভাবে পাল্টে গেল!তুমি বুঝতেই পারলে না।অন্যের সন্তানকে তোমার নিজের সন্তান ভেবে অজান্তেই তাকে লালন পালন করলে,মমতা দিলে,ভালোবাসলে।তুমি ভেবেছ সেটা তোমার নিজের সন্তান অথচ সে তোমার রক্তের নয়!”

রাফাত থামলো।আয়রার দিকে তাকিয়ে দেখলো আয়রা উৎসুক হয়ে শুনছে।সে আবার বলল,

“কখনো যদি জানতে পারো তোমার সে সন্তান ছিল না তাহলে কি তুমি সেই সন্তানকে ভুলে যাবে, ভালোবাসবে না?”

“সেটা সম্ভব নয়।এতদিন ধরে যাকে নিজের সন্তান ভেবে মানুষ করেছি তাকে কি করে ভুলব?”

“ঠিক এটাই হলো কথা।সেটা যদি হয় তবেই তুমি “মা”।আমাদের মানসিকতাই এমন হয়ে গেছে যে নিজের বলতে আমরা শুধু আপনজনদের বুঝি?অথচ সেই সন্তান একসময় বৃদ্ধ বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। তবু আমরা নিজেদের পরিবর্তন করতে পারি না।নিজের ঔরসজাত সন্তানই চাই।অথচ কত এতিম বাচ্চাদের কি নির্মম পরিনতি রাস্তাঘাটে কত টোকাই!এসব কি থাকতো?পৃথিবীর সব সন্তানই যার কাছে সন্তান সেই তো”মা”।

আয়রার চোখে পানি এসে গেছে।সবটাই সত্যি কথা কিন্তু সমাজ তো পরিবর্তন হতে চায় না?কখনো কি কেউ দেখেছে একজন মা তার ধর্ষক ছেলেকে নিজে আইনের হাতে তুলে দিয়েছে?সে মা হবার আগে একজন নারী এটা নিজের সন্তানের জন্য ভুলে যায়।মাতৃস্নেহ হবে নির্মল কোমল পবিত্র! সেটা অন্ধস্নেহ কেন হবে?

আয়রা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাফাতকে।এই মানুষটা এত ভালো কেন?

বিকেল বেলা আয়রাকে অবাক করে দিয়ে তনু এসেছে। সাথে মায়ের বানিয়ে দেয়া কয়েক ধরণের পিঠে নিয়ে।আয়রার খুশি দেখে কে?সন্ধ্যায় রাফাত অফিস থেকে ফিরে ওদের নিয়ে ডিনারে গেল।রাতে খেয়ে একটু ঘোরাঘুরি করে ফিরে এসে দেখল আরাফ এসেছে।তনু এসেছে জানতে পেরেছে আয়রার শ্বাশুড়ির থেকে।

তনু আরাফকে দেখে খুব বিরক্ত হলেও হাসি মুখে বলল,কেমন আছেন আপনি?

“ভালো আর রাখলে কই?”

“আরাফ ভাইয়া আমি আপার শ্বশুর বাড়ি এসেছি।নিজের কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে আসিনি।প্লিজ ওসব বিষয়ে কথা বলতে আসবেন না?আপনি আমার বোনের আত্মীয় তাই আমি সৌজন্যতার খাতিরে জানতে চাইলাম কেমন আছেন।আর আপনি কি উত্তর দিলেন?”

আরাফ লজ্জা পেল সত্যি সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে নাই।হুটহাট কি বলে ফেলল।নিজেকে শান্ত রেখে বলল,

আ’ম স্যরি, তনয়া।আমি তোমার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই?

তনয়া একবার রাফাতের দিকে তাকালো।রাফাত ইশরায় তনুকে আশ্বস্ত করে বলল,

“আরাফ তনুর বাবা স্পষ্ট সবকিছু বলেছেন।খালাও তার মতামত জানিয়ে দিয়েছে।এ নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো।তোর যদি কথা বলতে হয় সেটা তনয়াদের বাড়িতে গিয়ে বলিস।ও বোনের কাছে এসেছে এসব কথা বলে ওর মনটা নষ্ট করে দিস না।”

রাফাতের কথা শুনে অবাক হলো আরাফ।রাফাত এভাবে বলতে পারলো?সে ভেবেছিল সবার সাহায্য নিয়ে তনুকে বোঝাবে তাই তো এখানে আসা।উল্টো রাফাত খালা সবাই মানা করছে!তনয়াকে যে সে কতটা ভালোবেসেছে তা কেউ বুঝতেই চাইছে না?

আরাফ উঠে দাঁড়ালো। এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।কিন্ত তনু বাঁধা দিয়ে বলল,আপনি চলে গেলে আমার সত্যি আরও বেশি খারাপ লাগবে।মনে হবে আমার জন্যই আপনি চলে গেলেন। এসেছেন যখন সাবই মিলেই থাকি।গল্প করবো আড্ডা দেয়া যাবে রাতে।

আরাফ তো অবাক।খুশিতে পারলে লাফিয়ে উঠে।রাফাত শুধু হাসলো।তনয়াকে এই জন্যই খুব ভালো লাগে।তনয়া অন্য রকম।এদের দুবোনই যেন দুটো কোহিনূর!

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here