বকুলতলা
১২.
হুইলচেয়ারে চিন্তিত মুখে বসে আছে নূপুর। হাতে থাকা মোবাইলের ডায়াল লিস্টে গিয়ে বারবার মাহাদকে কল লাগাচ্ছে। কিন্তু ওপাশ থেকে আশানুরূপ সারা পাওয়া যাচ্ছে না। হতাশ নূপুর একহাতে হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক পায়চারি করছে। মাঝে মাঝে চিন্তিত নজরখানা স্থির হয়ে আটকে যাচ্ছে ফোনের স্ক্রীনের ওপর।
রশিদ মুখটা ভীষণ বেজার করে বললেন, “তুই তহন ওরে বিয়ার কথা কইলি ক্যান? বিয়ার কতা হুইনাই তো ফোন তুলতাছে না পোলাডা।”
রিং হতে হতে কল কেটে গেল আরও একবার। নূপুর এবার আর কল দিলো না। চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো বাবার দিকে। বললো, “আমি না কইলে কি ভাইয়া জানতো না? ভালো করছি বইলা দিসি।”
বিরক্ত হওয়ার ধাপ যেন একটু বাড়লো। ফ্যাকাশে নয়নে মায়ের দিকে তাকালেন রশিদ। খড়খড়ে কণ্ঠে বললেন, “আম্মা? তোমার নাতির কতা হুনছো? পোলায় ফোন না ধরলে, ওর মতামত না জানলে, আমি কুহুর লগে মাহাদের বিয়ার কতা আগামু কেমনে?”
নুরুন্নেসা ভীষণ শান্ত মেজাজে সাজানো পান মুখে পুরলেন। পান চিবুতে চিবুতে অস্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, “তোর মনে অয় দাদুভাইরে ওই মাইয়া বিয়া কইরবো?”
—“ক্যান করতো না? আমার ছেলে কি কোনো অংশে কম নাকি?”
—“আগে নিজের ছেলেরে চাকরিবাকরি কইরতে ক। বেকার ছেলেরে কি তুই মাইয়া দিবি?”
রশিদ ক্ষণিকের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। তবে দমলেন না। জোড় গলায় উত্তর দিলেন, “ও একটু সময় চাইতেছে। পরে দেইখো, কিছু একটা কইরবো।”
জবাবে নুরুন্নেসা সবজান্তার মতো মাথা দুলালেন শুধু। মুখ তার কুঁচকে রাখা। মাহাদ যে কি করবে, তিনি সেটা ভালোই জানেন। রশিদ নুরুন্নেসার তাচ্ছিল্য ভরা মুখশ্রী সহ্য করতে পারলেন না। আফসোসের সুরে বললেন, “আজ যদি সাহান বেঁচে থাকতো!”
নূপুর মিটিমিটি মুখে মা-ছেলের নীরব যুদ্ধ দেখছে। মাঝে মাঝে নিঃশব্দে দম আটকানো হাসি হাসছে। সে ইচ্ছে করেই মাহাদকে কুহুর কথা বলে দিয়েছিল। কুহু মেয়েটাকে তার পছন্দ না। বেশি সুন্দর হওয়ায় অহংকার খুব। নূপুরের বাসায় এসে নূপুরকেই কতগুলো কথা শুনিয়ে গেল ওদিন! ওর পা নেই বলে নাকি কেউ ওকে বিয়ে করবে না, ভালোবাসবে না। নূপুর এসব কথায় কিন্তু মন খারাপ করে না। দিব্যি থাকে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রেগে আগুন হয়ে যায়৷ পারলে কুহু মেয়েটার নাকে মুখে দু’ঘা লাগিয়ে দিতো!
–
বিস্তর আকাশটা কালো চাদরে ঢেকে আছে। বাসের গতিপথ ধরে শা শা বাতাস জানালা গলিয়ে ঢুকছে। সহসা ঠিকমতো চোখ তুলে তাকাতে পারছে না তরী। পলক ঝাপটাচ্ছে বারবার। মাহাদ একবার তরীর দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে জানালা বন্ধ করে দিতেই মেয়েটা জানতে চাইলো, “জানালা বন্ধ করলেন কেন?”
মাহাদের কণ্ঠে নির্লিপ্ততা, “বাতাস বেশি।”
—“তো কি হয়েছে? গরম লাগছে তো।”
—“একটু পর নেমে যাবো আমরা।”
তরী হতাশ নিশ্বাস ফেললো। দুনিয়া এদিক-ওদিক উলটে গেলেও বোধহয় এই লোকের ত্যাড়া কথা বলা বন্ধ হবে না।
হঠাৎ অল্প শব্দে ফোন বেজে উঠলো। তরী ভাবলো, হয়তো তার কল এসেছে। ব্যাগ ঘেটে ফোন বেরও করলো সে। কিন্তু নাহ্! মাহাদের ফোন বাজছে। লোকটা কপালে কতগুলো বলিরেখা ফেলে পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কয়েক সেকেন্ডের মতো। তারপর ফোনটা সাইলেন্ট করে পকেটে রেখে দিলো।
তরী জিজ্ঞেস করলো, “কে কল করেছে?”
—“বাবা।”
—“তাহলে ধরছেন না কেন?”
মাহাদ রয়েসয়ে উত্তর দিলো, “ইচ্ছে করছে না।”
বাসের চাকা আস্তে আস্তে থেমে গেছে। তরী আর দেড়ি করলো না। ওড়না গুছিয়ে নেমে পরলো। মাহাদও নামলো। রাস্তার চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে বললো, “রিকশা নিবে?”
তরী প্রশ্নটা শুনে তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারলো না। তার ব্যাগে আর মাত্র আটশত টাকা আছে। মাসের আরও পনেরো দিন বাকি। দুটো বই এখনো কেনা হয়নি। এ সপ্তাহে একটা কিনতেই হবে। বাবার থেকে এ মাসে আর টাকাও নেওয়া সম্ভব না। মনে মনে সব হিসাব কষে নিলো তরী। রিকশায় চড়াটা এখন বিলাসিতা হয়ে যাবে। এটুকুই তো পথ!
—“হেঁটে হেঁটে যাবো। রিকশায় চড়তে ইচ্ছে করছে না।”
তৎক্ষণাৎ মাহাদের শান্ত, স্থির চাহনি পরলো তরীর ওপর। মিথ্যেটা ধরে ফেললো কি? বোঝা গেল না। ধীর গলায় বললো, “আচ্ছা, চলো।”
তরী বিস্ময় নিয়ে বললো, “আপনিও যাবেন আমার সাথে?”
—“আমার ওদিকে কাজ আছে। নয়তো তোমার সাথে আসতাম নাকি?”
তরীর জানামতে মাহাদের তো ওদিকে কোনো আত্নীয় নেই। সে এ পথে আসেও তরীর জন্য। কপাল কুঁচকে সে কিছু বলতে নেওয়ার আগেই মাহাদ তার হাত ধরে রাস্তার বামপাশের অভিজাত এলাকাটার ভেতর ঢুকে পরলো। কথা বলার সুযোগ দিলো না একদমই। কিন্তু তরী চুপ রইলো না। মাঝপথে উচুনিচু গলায় ধমকালো, “হাত ধরেছেন কেন? এটা আমার নিজের এলাকা। লোকে দেখলে কি বলবে?”
মাহাদ হাত ছাড়লো না। শক্তি বাড়ালো। বড়োসড়ো চোখে চেয়ে বললো, “তরী! কাকে ধমকাচ্ছো? আমি তোমার বড় না?”
সঙ্গে সঙ্গে তরী অল্প মিইয়ে গেল, “আপনি শুধু শুধু এত কষ্ট করছেন। আমার মানা শুনছেন না।”
মাহাদ শুনলো। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। তরী আবার বললো, “আমি আপনাকে ভালোবাসি না। পছন্দ করি না। এটা কেন মেনে নেন না? আপনার পরে অনেক কষ্ট হবে।”
—“আমি কষ্ট পেতে পেতে বড় হয়েছি। এখন পাথরের চামড়া হয়ে গেছে। কিছু গায়ে লাগে না। আর কিছু?”
বুকের ভেতর থেকে আস্তে আস্তে করে কি যেন বের হলো। ভালো কিছু না। খুব খারাপ কিছু। আর্তনাদ, যন্ত্রণা, হাহাকারের মতো কিছু। তরী চাপিয়ে রাখতে পারেনি।
মাহাদের হাসোজ্জল মুখটা কেমন গুরুগম্ভীর হয়ে আছে। তরীর সাথে কথা বলছে না। প্রণয়ের বাড়ির কাছাকাছি আসতে তরী আমতা আমতা সুরে প্রশ্ন করলো, “আপনি এ এলাকায় না কি কাজে এসেছেন? কি কাজ?”
মাহাদের উত্তরটাও ছিল এমন, “তোমার জানা উচিত, মাহাদ প্রচুর মিথ্যা বলে।”
–
তরীর মামার ছোট্ট উঠানটায় একটা বেঞ্চ আছে। সিমেন্টের তৈরি। দু’জন বসতে পারে এমন। তরী গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে সেদিকে তাকালো। প্রণয় বসে আছে। তাকে দেখে কেমন রুক্ষ কণ্ঠে বলে উঠলো, “আপনাকে ছেলেদের থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম।”
তরীর চোখ সরু হয়ে এলো। অসহ্য লাগলো কথাটা। কঠিন স্বরে বললো,
—“আপনার কথা আমি শুনবো কেন?”
—“আবারও অর্ণবের মতো পরিণতি চাচ্ছেন আপনি?”
তরী রেগে গেল এবার। এলোকের সমস্যা কি? সবসময় অতীত নিয়ে পরে থাকে কেন? রাগ সামলানো দুষ্কর হয়ে গেল। ঠোঁট কাঁপলো অনেক কিছু বলতে। তবে এটুকুই বলতে পারলো, “আপনার মতো জঘণ্য লোক আমি দুটো দেখিনি। আপনি কি মনে করেন? অর্ণব আমার দূর্বলতা?”
প্রণয় জবাব দিতে সময় নিলো। অচেনা কণ্ঠে বললো, “আপনার শরীরের দাগগুলো আপনাকে পোড়ায় না তরী?”
তরী আর সহ্য করতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলো, “আপনি এত কিছু কিভাবে জানেন? কে বলেছে? আপনি তো ছিলেন না তখন।”
প্রণয় ক্ষীণ গলায় বললো, “মা বলেছে।”
_____________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
সারাদিন বাহিরে থাকার পর লিখতে ইচ্ছে করছিল না। জোড়জবরদস্তি করে লিখেছি। পর্ব ভালো নাও হতে পারে। দুঃখীত।