বকুলতলা ১৪.

0
582

বকুলতলা

১৪.
নেতিয়ে পরা তরীর মাথা আলতো করে বুকে চেপে বসে আছে মাহাদ। অনেক্ষণ হলো, মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। সিক্ত নেত্রজোড়া যেন তখনো তরতাজা। পাঁপড়িগুচ্ছে ভেঁজা ভেঁজা ভাব। বড্ড মলিন দেখাচ্ছে মুখটা। মাহাদ আরেকটু আগলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। আশপাশে ক্ষীণ তাকালো। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। মেলা নিয়ে সবার হৈ-হুল্লোড় তখনো কমেনি। আকাশটাও সুবিধের না। মেঘ করছে খুব। কালো কালো মেঘ।
মাহাদ তরীর গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো, “তরী? উঠো। এই মেয়ে, যাবে না বাসায়?”

তরী একটুখানি নড়লো যেন। খুব সামান্য। গালের মধ্যিখানে তখনো কাঁটা দাগের মতো শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু লেগে আছে। আঙুলের চাপে সেই দাগ মুছতে চাইলো মাহাদ। উহু, হলো না। আরেকবার চেষ্টা করলো। এবারও না। তরী আবারও নড়েচড়ে উঠলো। চোখ মেললো। মাহাদকে এতটুকু কাছে দেখে চমকালো খুব। তৎক্ষণাৎ মাহাদের বুক শূণ্য করে বললো, “কয়টা বাজে?”
মোটরসাইকেল থেকে উঠে দাঁড়ালো মাহাদ,
—“৫টা ৬টা হবে। ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করছে না।”
অথচ তরী মেলা থেকে বের হয়েছিল ৪টার দিকে। এখন সন্ধ্যে প্রায়। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে? এই রাস্তায়? লোকটা ডাকেনি কেন? তটস্থ ভঙ্গিতে রাস্তার মানুষগুলোর দিকে একবার চোখ বুলালো তরী। ফুটপাতের পথচারী, টং দোকানে বসে থাকা লোকগুলো কিংবা তাদের মতোই কিছু তরুণ-তরুণী একাধারে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন তাদের আগ্রহের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু ওরাই। তরী লজ্জায় নতজানু হলো। পলক ঝাপটালো বেশ কয়েকবার। নিজ মনেই বিড়বিড়ালো, “আমি কি বেশি ঘুমিয়ে ফেলেছি?”

মাহাদ তখন কুঁচকানো দৃষ্টিতে পরখ করছিল তরীর হলদেটে মুখশ্রীর আনাচে কানাচে। অপ্রস্তুত তরীর নাকটা লাল হয়ে আছে। চোখ ফুলে একাকার। হালকা গলায় সে শুধালো, “কিছু খাবে তরী? পানি আনি? কেঁদেকেটে তো দূর্বল হয়ে গেছ।”
তরী মাথা নাড়ালো। খাবে না। মাহাদ আবার বললো,
—“বাদাম আনবো? বা অন্য কিছু?”
এবারও ডানে বামে মাথা নাড়ালো সে। আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকালো। চোখে চোখ রাখলো। ভেঁজা কণ্ঠে বললো, “আপনাকে আমার কিছু বলার আছে মাহাদ।”
—“শুনতে ইচ্ছে করছে না।”
—“কেন?”
মাহাদের শান্ত দৃষ্টি পাল্টালো। প্রচন্ড স্বাভাবিক দেখালো তা। ঢিমে যাওয়া স্বরে বললো, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে কষ্ট দিবে তরী।”

বুকের ভেতরটা ভারী হলো কি? পাহাড় সমান কিছু ডেবে গেল? নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তরী বুঝলো, মাহাদ নামের লোকটা তাকে বিষণ্ণ, উদাসীন করে দিচ্ছে। সে কথা ঘুরাবার চেষ্টা করলো, “আপনি কি কোনো কারণে আপনার বাবার প্রতি রেগে আছেন, মাহাদ?”
—“কেন মনে হলো?” মোটরসাইকেল থেকে হেলমেট নিয়ে তা আবারও তরীকে পরিয়ে দিতে লাগলো মাহাদ৷ এবারও গলার দাগটা চোখে বিঁধলো। বাজে ভাবেই। তবে কোনোরুপ প্রশ্ন করলো না।
তরী মনে করিয়ে দেওয়ার মতো করে বললো, “ওইযে, কালকে? আপনার বাবা ফোন দিয়েছিল। কিন্তু আপনি ধরেননি।”
—“আমাকে দেখে মনে হয় আমি বাবার সঙ্গে রেগে আছি?”
জবাবে তরী মাথা দুলালো ঘনঘন। হেলমেট ভালো করে লাগিয়ে মাহাদ সরে দাঁড়ালো তখন। দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিঃশব্দে। একটুও ভণিতা না রেখে বললো, “আমি ছোটবেলা থেকে বাবার হাতে মাকে মার খেতে দেখেছি তরী। এজন্যই হয়তো বাবার প্রতি আমার ভালোবাসাটা প্রকাশ পায়না।”

কথাটা বুঝতে বেশ সময় নেয় তরী। ক্ষণে ক্ষণে থমকায়, চমকায়, অবাক হয়। অবাক হয় এজন্য, কেউ কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিল যে মানুষটা সবসময় তার ভালো খারাপ নিয়ে পরে থাকে, সে-ই ভালো নেই।

আজকেও প্রণয় হাসপাতাল থেকে দ্রুত ফিরেছে। তরী জানতো না। রুমের ঢোকার আগে লাইব্রেরী ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অনেক্ষণ। দরজার ক্ষীণ ফাঁকফোঁকর দিয়ে দেখছিল অর্ধেক বইয়ের স্তুপ মাখা তাকগুলি। হঠাৎ পেছন থেকে প্রণয়ের রুক্ষ গলা শোনা গেল, “আমি কারো তাকানো জন্য আমার লাইব্রেরী ঘর বানাইনি।”
আচমকা ডাকে তরী ভয় পেয়ে যায়। হন্তদন্ত বুকটা ধরফর করে। রাগ হয় খুব। কিন্তু দোষটা যেহেতু তার, তাই কিছু বলার জো নেই।

—“আপনাকে আমার লাইব্রেরী থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম।” প্রণয় বললো। গম্ভীর চিত্তে।
তরী কোনো ধরণের অপরাধবোধ ছাড়াই বললো, “আমি কি আপনার লাইব্রেরীর কিছু করেছি? দরজাও তো ধরিনি।”
—“আপনি আমার জিনিসের আশেপাশেই না আসার চেষ্টা করুন তরী। আপনাকে ঠিক আমার পছন্দ না।”

তরীর সহ্য হলো না এই পছন্দ অপছন্দের কথাটা। তিন বছর ধরে শুনছে। এখানে এসেছিল একটু শান্তি মতো বাঁচতে। কটু কথাগুলো থেকে বাঁচতে। কই? পারলো নাতো।
কণ্ঠে দারুণ ঝাঁঝ থাকলেও কেমন করুণ সুরে আহাজারি করে উঠলো সে, “কেন পছন্দ না আপনার ভাইয়া? কি করেছি আমি? ধর্ষিতা বলে? ধর্ষিতা বলে আপনারা সবাই আমাকে অপছন্দ করেন? আমার সাথে একটু কথা বললে, একটু ছঁলে কি আপনাদের গায়ে ময়লা লেগে যাবে?”

এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড। সময় গড়ালো। প্রণয়ের থমথমে মুখটা বিদ্যুতের মতো চমকালো যেন। স্পষ্ট বিমূঢ়তায় হতভম্ব হলো। কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইলো, “তুমি– তুমি ধর্ষিতা?”
প্রশ্নটা ভীষণ আজব ঠেকলো তরীর কাছে। মনে প্রাণে অনুভূত হলো, প্রণয় অভিনয় করছে। তাচ্ছিল্য করছে তাকে।
প্রণয় নড়বড়ে গলায় আবার বললো, “তুমি কি আমার সাথে মজা করছো তরী?”
—“আপনার সঙ্গে মজা করার সম্পর্ক আদৌ আছে আমার?”

উত্তর দিতে প্রণয় সময় নেয়। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে বলে, “গলার দাগটা কি তবে অর্ণবের না?”
তরীর শক্ত গলা, “না।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
বানান ভুল থাকতে পারে। ভুল-ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here