বকুলতলা
১১.
আজকাল প্রণয়ের সঙ্গে তরীর দেখাই হয়না বলা চলে। হাসপাতাল থেকে আসতে আসতে ঘড়িতে তখন প্রায় এক’টা। ততক্ষণে ক্লান্ত তরীও ঘুমে বিভোর। ছোট্ট সালেহা একহাতে খুব সূক্ষ্ণ ভাবে সব সামলে নেয়। খাওয়া দাওয়া শেষে সুন্দর করে গুছিয়েও রাখে আবার। প্রণয় চলে যায় তার লাইব্রেরি ঘরে। বাকিটা সময় তার ওখানেই কাটে। বড়সড় জানালা দিয়ে টিমটিম করা তারাগুলির কথোপকথন যেন তাকে ঘিরেই। বাতাসের শো শো বয়ে চলা শব্দ শক্ত কাচ ভেদ করে আসতে পারে না। তবুও হাতটা আলতো করে কাচের ওপর রেখে তা স্পর্শ করার ক্ষীণ প্রচেষ্টায় নেমে পরে প্রণয়। মাসটা জুলাই। জুলাইয়ের আকাশ, নিস্তব্ধতা, ঠান্ডা হাহাকার।
আচমকা সালেহার হাঁক শোনা গেল, “ভাইজান, ঢুকমু?”
প্রণয়ের মনের আকাশে বিশাল বিষাদের কালো মেঘেরা খেলা করছিল। হতাশ নিশ্বাসগুলো পিছু ছাড়ছিল না। লাইব্রেরির শতশত তাকের একটির সামনে মাত্রই দাঁড়িয়ে ছিল সে। সালেহার হঠাৎ ডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। বললো, “আয়।”
পা দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো সালেহা। হাতে তার চায়ের কাপ। খুব সাবধানে কাপটা টেবিলে রেখে সে আবার বললো, “আর কি কিছু দিতে হইবো ভাইজান? আমি ঘুমাইতে যাই?”
বলতে বলতে কেমন দুলে উঠলো সে। তন্দ্রার দাপটে চোখ তুলে তাকানো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। প্রণয় একটু হাসলো। তার ভাইটা যদি আজ বেঁচে থাকতো, তবে হয়তো সালেহার মতোই দেখতে হতো।
পাঁচ নম্বর তাকটা থেকে একটা উপন্যাসের বই হাতে নিলো প্রণয়। বইয়ে নামটা একটু ছুঁয়ে দেখলো। এরপর পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বললো, “আর কিছু লাগবে না। যাওয়ার সময় দরজা ভিড়িয়ে দিস।”
সালেহা আস্তেধীরে চলে যায়। আড়চোখে একবার দরজাটা পরখ করে নেয় প্রণয়। তারপর ইজি চেয়ারে গিয়ে বসে। হাতে থাকা বইটা খুব পুরনো। একযুগ আগের হয়তো। কিংবা তারও বেশি। উপন্যাসটার জটিল একটা পাতার একপাশে প্রণয় অনভ্যস্ত হাতে একবার বকুলগাছ একেঁছিল। ত্যাড়াব্যাকা ভাবে। এত কাঁটাছেড়ার মাঝে বোঝার উপায় নেই, এটা আদৌ বকুলগাছ। প্রণয় বইটার একটা একটা করে পাতা উল্টালো। ৮১ নম্বর পাতায় হাত থমকালো তার। উপন্যাসের কিছু লাইন চোখে পড়লো,
—“প্রিতম, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আমি চাই আমার ভালোবাসাটা অপূর্ণ থাকুক। পাওয়া থেকে তো না পাওয়াতেই সুখ বেশি।”
প্রিতম ছেলেটা হেসে বলে, “অথচ আমি তোমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে কাছে রাখতে চেয়েছিলাম।”
প্রণয়ের কেন যেন লাইন দুটো খুব পছন্দের। বিড়বিড় করে বেশ কয়েকবার পড়লোও সে। পেন্সিলের দাগে তৈরি পাশের কৃত্রিম বকুলগাছটা আলতো করে ছুঁলো। তরীদের বাসার বকুলগাছটাও এমন। একটুও সুন্দর না। প্রণয়ের মনে পরে, ছোটবেলায় যখন তারা গ্রামে যেত, তরীদের বাসাতেই থাকা হতো ওদের। প্রণয় ছোট থেকেই খুব শান্ত, ভদ্র ছিল। সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে রাখতো। সে যে ঘরটায় থাকতো, ওখান থেকে স্পষ্ট বকুলগাছটা দেখা যেত। সময়ে অসময়ে গাছ বেয়ে ডালে বসে মনের সুখে গান ধরতো তরী,
“আমারো পরাণও যাহা চায়, বকুলফুল তুমি তাই, ওগো তুমি তাই।”
দশ বছরের তরী কি মিষ্টি করেই না গাইতো! ভেবে ভেবে প্রণয় শব্দ করে হেসে ফেললো। সেই হাসি লাইব্রেরি ঘরে ঝংকার তুললো যেন। অথচ কেউ শোনার নেই। কেউ পাশে নেই।
প্রণয়ের ক্ষণিকের হাসি হঠাৎ থেমে গেল। বইটা বন্ধ করে পাঁচ নম্বর তাকে সেটা আবারও রেখে দিলো সে। বুকে পাথর জমেছে। তরীর হয়তো কিচ্ছু মনে নেই। না থাকারই কথা। তখন তো তার বয়স কম ছিল। প্রণয়ও অত মিশতো না।
–
বাসে আজ ভীড় নেই তেমন। তবে জ্যাম খুব। বাস একটু এগোতে না এগোতেই জ্যাম লেগে বসে থাকতে হচ্ছে। মাহাদ যেন খুব উপভোগ করছে ব্যাপারটা। তরী সবসময়ের মতো উদাসীন চোখে দেখছে তাকে। মাহাদ সাহেব আজ বায়না ধরেছেন, তিনি বাসে করে যাবেন তরীর সঙ্গে। তরী মানা করেনি। আবার যেতেও বলেনি।
মাহাদের শরীরে গরম বেশি। একটু থেকে একটু হলেই গরমে হাঁপিয়ে যায় সে। এখনও ঘেমে নেয়ে এলাহি কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। শার্টের প্রথম বোতামটা সর্বদা খোলাই রাখে মাহাদ। এবার দ্বিতীয় বোতামটাও খুলে কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, “কথা বলছো না কেন তরী? ভালো লাগছে না আমার।”
কণ্ঠেই সুস্পষ্ট তেঁতো মেজাজ উপড়ে আসতে চাইছে। তরী একবার মাহাদের দিকে তাকালো। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিলো।
—“আপনি শুধু শুধু নিজের দেড়ি করছেন। আমরা এখনো বাড়ির অর্ধেক রাস্তায়ও আসিনি।”
মাহাদের বাঁকা কণ্ঠে উত্তর, “একটা ছেলেকে বিকাল বেলা উড়াধুরা মারার কথা ছিল আমার। সেটা না করে আমি তোমার সাথে চুপচাপ বসে আছি। তোমার কি ভালো লাগছে না?”
তরী তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। সরাসরি তাকিয়ে বললো,
—“আপনি এত বাজে কেন মাহাদ?”
—“তুমি এত পাষাণ কেন?”
তরী আর কিছু বললো না। মুখ মলিন করে অন্যপাশে চেয়ে রইলো। পাশে বসে থাকা মাহাদ কিন্তু থেমে নেই। একটুও স্থিরতা নেই লোকটার মাঝে। সরব তার বাহু টেনে নিজের কাঁধে মাথা চেপে ধরলো। তরীর চোখ বড়োসড়ো হয়ে গেল মুহুর্তেই। ভড়কালো খুব। হন্তদন্ত কণ্ঠে বললো, “বাসে মানুষ! মাথা গেছে আপনার?”
—“চুপ থাকো তরী।”
—“কি চুপ থাকো? দেখি, সরুন।”
চোখের চাহনি কঠোর করলো মাহাদ। তরী নড়াচড়া ক্ষীণ থামালো। ম্লান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “এমন করছেন কেন?”
—“তুমি ক্লান্ত, তাই।”
তরী তবুও শান্ত হলো না। আশেপাশে নজর ঘুরালো। কলেজ পড়ুয়া দুটো মেয়ে তাদের পাশের সীটে বসে আছে। ওরা কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। তরী তাকাতেই মুখ ভরে হাসলো।
লজ্জায় আড়ষ্ট তরী সরতে নিলেই মাহাদ বলে, “চোখ বন্ধ করো তরী।”
—“কেন?”
—“চোখ বন্ধ করো। তারপর বলছি।”
তরী সত্যি সত্যি নেত্রপল্লব একটার সঙ্গে অন্যটা মিলিয়ে নিলো। তার ধীর কণ্ঠে বললো, “করেছি।”
—“এবার চোখ বন্ধ করে রাখো। কথা বলবে না।”
তরী তাই-ই করলো। শরীর যেন আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলো। বন্ধ চোখের কালো গভীরতা বাড়লো। একটু একটু করে বেড়েই চললো।
তরীর যখন ঘুম ভেঙ্গেছে তখন আকাশে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মাহাদ স্থির চোখে সামনের দিকে চেয়ে চেয়ে কি যেন দেখছে। তরী একটু নড়েচড়ে উঠলো। প্রশ্ন করলো, “কয়টা বাজে?”
—“৭টা বাজবে একটু পর।”
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব আস্তে বললো, “আজকেও দেড়ি হয়ে গেছে। মামী বকবেন খুব।”
অথচ মাহাদ কথাটা শুনে ফেললো। শুধালো, “তোমার মামী তোমার সাথে এমন ব্যবহার করে কেন?”
—“মামীর তিন ছেলে ছিল। ছোট ছেলে তৈয়ব আমাদের বাড়ির ছাদে খেলতে গিয়ে নিচে পরে গিয়েছিল। বেঁচে ফিরেনি আর। তখন থেকে মামী আমাদের তেমন পছন্দ করেন না।”
মাহাদ শুনলো, বুঝলো। বিষয়টা এড়িয়ে বললো, “তোমাকে না মিথ্যে বলার কিছু পয়েন্ট দিয়েছিলাম? শিখেছো? দেখি, একবার মিথ্যে বলো তো।”
মাহাদের ভাবভঙ্গি নিমিষেই বুঝে ফেললো তরী। হেসে বললো, “মাহাদকে কেউ পছন্দ করে না।”
মাহাদ নাক কুঁচকে বললো তখন, “মিথ্যেটা আমার পছন্দ হয়নি। বলো, মাহাদকে কেউ ভালোবাসে না।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা