বকুলতলা
১৬.
বিকেলের তেজটা আজ কিছুটা কম। মেলায় সেলসগার্লের কাজ করতে তরীর ভালোই লাগছে। শপটাতে প্রায় সবাই-ই বন্ধুত্বপূর্ণ। মিলেমিশে কাজ এগিয়ে দেয়। তরী তো আগে কখনো এসব কাজ করেনি। ভুল হলে বুঝিয়ে দেয়। ফাঁকে ফাঁকে এসে গল্প করে যায়। তরী এমনিতেও কারো সাথে কথা বলেনা। অচেনা, চেনা সবার সাথেই মিশতে কেমন ভয় ভয় লাগে। বরাবরের মতোই সল্পভাষী হয়ে উত্তর দিলেও আশেপাশের মেয়েগুলো যেন আরও আগ্রহী হয়ে উঠে ওকে জানার জন্য, বুঝার জন্য। সময়টা খারাপ যাচ্ছে না। ভালোই চলছে, চলুক।
মাহাদ দুপুর থেকেই তরীর সাথে মেলায় বসে আছে। তরীর শপটার ঠিক সামনের ক্যাফেতেই বসে বসে নজর রাখছে সে। এ পর্যন্ত পাঁচ-ছটা কফি খাওয়া বোধহয় এমনিতেই শেষ! অথচ মুখশ্রী বড্ড শুকনো, ক্লান্ত। সকাল থেকে এ পর্যন্ত পেটে আবিজাবি ছাড়া যে কিছু পরেনি, বোঝা যাচ্ছে। তরী তবুও আশ্বস্ত হওয়ার জন্য ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। মেসেজ অপশনে গিয়ে টাইপ করলো, “আপনি কি খেয়ে এসেছেন বাসা থেকে?”
মাহাদ কুঁচকানো চোখে শপটা পর্যবেক্ষণ করছিল। তার মতে মেলার সবচে’ ফালতু দোকান বোধহয় এটাই। কিসব রুলস, ফালতু নিয়ম-নীতি। তরী যেটাই পরে আসুক না কেন, গায়ের জামার ওপর আলাদা করে দোকানের লোগো লাগানো গেঞ্জি পরতেই হবে। কাজের বাহিরে কথা তো বলাই যাবে না! দেখা করাও নিষিদ্ধ। তারওপর ছেলে কাস্টমারগুলোর এত এত আদিখ্যেতা আর ভালো লাগছে না। বিরক্ত লাগছে। ভীষণ, ভীষণ বিরক্ত।
মাহাদ চোখমুখ কুঁচকে সঙ্গে সঙ্গেই লিখলো, “তুমি আর কতক্ষণ থাকবে এখানে?”
—“৫টা সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। আপনি খেয়ে এসেছেন?”
—“তোমার সাথে খাবো। তোমাদের কি লাঞ্চের জন্য ছুটিটুটি দেয় না কিছু?”
তরী মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে কি-বোর্ডে হাত চালালো, “উহু। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু খেতে পারি। তাছাড়া বেশি সময় তো এখানে থাকছি না। মাত্র চার ঘন্টা।”
প্রবল অসন্তুষ্টিতে মাহাদের মেজাজ আরেকটু বিগড়ালো। অনেক্ষণ ওপাশ থেকে কিছুই লিখে পাঠালো না সে। তরী ঠিকই টের পেল, তার মেজাজের তীক্ষ্ণটা। রেগে যাওয়া। লিখলো,
—“কিছু খেয়ে আসুন, যান। এখানে বসে থাকতে হবে না। কাজের খালা আসেনি আজকে?”
মাহাদ উত্তর দিলো, “মানা করে দিয়েছি আসতে। আর, খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমার সাথে খাবো।”
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে দিলো। ভাবলো, আর কিছু লিখবে না। পরক্ষণেই ভুলোমনার মতো কাঁচের গ্লাস ভেদ করে আকস্মিক তাকালো মাহাদের দিকে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, লোকটা কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। হাতের ফোনের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ। কপাল, ভ্রু, চোখ– সবকিছুতে বাজে ভাবে ভাঁজ ফেলে স্ক্রীনে দৃষ্টি ফেলে রেখেছে। শপে এখন মানুষজন কম। ব্যস্ততাও কম। আরেকবার চারপাশটা দেখে সে আবারও ফোন হাতে নিলো। মাহাদকে কঠিন থেকেও কঠিন বার্তা পাঠালো, “আপনি যদি এক্ষুণি কফি খাওয়া বাদ না দিন, তবে আমি আর আপনার সাথে কথা বলবো। এক্ষুণি খেতে যাবেন। এক্ষুণি মানে এক্ষুণি!”
ফোনটা এবার ব্যাগেই পুরে রাখলো তরী। মাহাদের ওদিকটায় ভুলেও তাকালো না। সে নিশ্চিত! লোকটা এখন মারাত্বক ধ্বং’সপূর্ণ চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। সেই চোখে চোখ রাখতে চায় না তরী। একদমই চায় না।
সেকেন্ড, মিনিট গড়ালো। একটা লম্বা মতো মেয়েকে শপের ভালো ভালো জিনিসগুলো বর্ণনা করে মাত্রই একটু চেয়ারে বসেছিল তরী। দেখতে সহজ মনে হলেও কাজটা কিন্তু ভীষণ কঠিন। কাস্টমারদের সাথে খুব বুঝেশুনে কথা বলতে হয়। কিছু কিছু জিনিসের ব্যবহার তো তরী নিজেও জানে না। অন্যজন থেকে শুনে হুবহু একাধারে কপি করে বলে দিয়ে এসেছে। লম্বা মেয়েটাও খুতখুতে কম না! এতগুলো জিনিস দেখে, এত এত ইনফরমেশন নিয়ে মাত্র দুটো জিনিস কিনেছে। তাও অনেক দরদাম করে। তরী হাঁপিয়ে উঠলো এটুকুতেই! আরও তো এক, দু ঘণ্টা বাকি!
হঠাৎ কাঁচের দরজা খুলে মাহাদ শপের ভেতর ঢুকলো। কোনোদিকে না তাকিয়ে ফুড আইটেমের দিকটায় গিয়ে থামলো সে। একটা মেয়ে কর্মী এগিয়ে এসে তখন বিনম্র কণ্ঠে জানতে চাইলো, “শুভ মধ্যাহ্ন স্যার। আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
মাহাদ গম্ভীর চিত্তে বললো, “পটেটো চিপস, চানাচুর, পানির বোতল আর যা যা খেলে পেট ভরে যায়, সব দিন। সবগুলোই ডাবল করে দুটো প্যাকেটে দিবেন।”
মেয়ে কর্মীটি মাথা দুলিয়ে সায় দিলো। অল্পক্ষণ অপেক্ষার পর জিনিসগুলো নিয়ে ক্যাসকাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালো মাহাদ। প্যান্টের পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করলো। বিল মিটালো। পরপরই তরীর সামনাসামনি এসে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো, “কাজ শেষ হওয়ার আগে এসব শেষ হওয়া চাই। নাও।”
নিদারুণ গম্ভীর কণ্ঠ। রুক্ষ। তরী মানা করার জো পেল না। হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো প্যাকেটটা। মাহাদ আর দাঁড়ায়নি। তখনই দ্রুত পায়ে চলে যায়।
রুমা নামে এক সহকর্মী সাথে সাথে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, “ওই ছেলেটা কে তরী? তোমাকে এভাবে খাবার দিয়ে গেল। তোমার প্রেমিক বুঝি?”
রুমার চোখে মুখে জানার তীব্র উৎকণ্ঠা। তরী বিব্রতবোধ করলো। কৃত্রিম মুচকি হেসে জবাব দিলো, “নাহ্।”
–
জোরে জোরে বাতাস বইছে। তরী বিধস্তের ন্যায় ওড়না সামলালো। বারবার মাথার ঘোমটা পরে যাচ্ছে। বের হতেও বেগ পেতে হয়েছে খুব। এত এত ভীড়! মানুষে মানুষে ঠেলাঠেলির মতো অবস্থা! কোনোমতে রাস্তার কাছে পৌঁছাতেই দেখলো, মাহাদ আগে থেকেই মোটরসাইকেলের ওপর বসে আছে। সে লোকটার কাছাকাছি আসতেই কেমন সূক্ষ্ণস্বরে প্রশ্ন করলো, “প্যাকেটের সবকিছু খেয়েছিলে?”
তরী মাথা নাড়ালো। খায়নি। মাহাদ ভ্রু বাঁকিয়ে আবার শুধালো, “কেন খাও নি?”
—“অতকিছু একসাথে খাওয়া যায় নাকি? পরে খাবো। আপনি খেয়েছেন কিছু?” হালকা কণ্ঠে শেষ প্রশ্নটা করলো তরী।
মাহাদ উত্তরে বললো, “তখন দুটো প্যাকেট নিয়েছিলাম না? একটা তোমার ছিল, আরেকটা আমার।”
আবহাওয়া হঠাৎ করেই ক্ষীণ গুমোটে ছেয়ে গেছে। আধো আধো রোদের ছোঁয়া পেতে মন্দ লাগছে না। সূর্যমামার দিকে একবার চেয়ে পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিলো তরী। সে জানে, মাহাদ এখন তাকে তার সাথে মোটরসাইকেলে করে যেতে বলবে। কিন্তু তরী চাইছে না। বাসে করেই যাবে। ইদানিং লোকটার প্রতি সে একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্রয় দিচ্ছে।
তরী আগেভাগেই বললো, “আমি কিন্তু আজকে আপনার সাথে যেতে পারবো না৷ বাসেই যাবো।”
জবাবে মাহাদ কিছুপলক চেয়ে ছিল। শান্ত, শীতল নেত্রে। দিরুক্তি করেনি। শুধু বলেছে, “আচ্ছা।”
জবাব শুনে তরী মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও পরপরই তা এক নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। চালাক মাহাদ মোটরসাইকেল থেকে চাবি পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো, “চলো, একসাথে যাই।”
বাসে উঠেও তরী মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো। মাহাদকে কিচ্ছু বলেনি। বলেও লাভ আছে? এই লোক শুনবে আদৌ?
অভিমানীর অভিমান দেখে মাহাদ অদৃশ্য হাসলো। বললো, “তুমি রাগলে কার মতো লাগে, জানো?”
তরী জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। মাহাদের দিকে ফিরলো না। কথাও বললো না। মাহাদই বললো, “তুমি একদম আমার মায়ের মতো তরী। অল্প কিছুতেই রেগে বসো।”
তরী এবারও নিশ্চুপ। মুখশ্রী ক্ষীণ মলিন দেখালো। নিজে নিজে কি যেন ভাবলো সে। এক মুহুর্তের জন্য প্রচন্ড ভাবুক হয়ে উঠলো। তারপর নিভু নিভু স্বরে আচমকা জিজ্ঞেস করলো, “আপনার মায়ের কি হয়েছিল, মাহাদ?”
মাহাদ চমকালো না সেই প্রশ্নে। হাসলো একটু। নিঃশব্দে, খোলাখুলি ভাবে। স্বাভাবিক স্বরেই বললো, “আমি আমার সতেরো বছর বয়সে নিজের মাকে হারিয়েছি তরী। নূপুর তখন ছোট। বাবা এমনিতে ভালো হলেও জুয়া খেলা, নেশা করার অভ্যাস ছিল। পরকীয়াও করেছিল একসময়। রোজরাতে বাবার মার খাওয়া, পরকীয়ার মতো কঠিন সত্য, মা সহ্য করতে পারেনি আসলে। ব্রেনস্টোক করে ফেলেছিল।”
আশ্চর্য! কথাগুলো বলতে বলতে মাহাদ হাসছে। লোকটার কি খারাপ লাগছে না?
—“আপনি হাসছেন কিভাবে মাহাদ?” একরাশ বিহ্বলতা তরীর কণ্ঠ জিড়ে।
—“তাহলে? কাঁদতে বলছো?”
তরী উত্তর দিলো না। অবাক, বিমূঢ় চোখে চেয়ে থাকলো মাত্র। মাহাদ আবারও হাসলো। লহু কণ্ঠে বললো, “আমি কাঁদতে পারিনা তরী। কান্না আসেনা।”
________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা