বকুলতলা ২০.

0
632

বকুলতলা

২০.
নূরী ভাবী প্রেগন্যান্ট। দেড় মাস চলছে। তরী জানতো না। সকালে ঘুম থেকে উঠতেও দেড়ি করে ফেলেছে সে। তাড়াহুড়ো করে হাত, মুখ ধুয়ে নিচে নামতেই দেখলো, বাড়ির পরিবেশ একদমই অচেনা হয়ে আছে। আলাদা, আলাদা ভাবসাব। নূরী উজ্জ্বল মুখে টেবিলের মধ্যিখানে বসে আছে। হাসি যেন সরছেই না ওর ঠোঁট থেকে। আয়েশা খাতুনকেও চেনা যাচ্ছে না। তিনি মোটামোটি খানিকটা অপছন্দই করতেন নূরীকে। তবে ভেতরে ভেতরে। কখনো ছেলের বউকে ডেকে এনে দুটো ভালো কথা বলেছেন কিনা, মনে নেই। সেই তিনি নূরীকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন! কোনো কিছুতে অসুবিধে হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করছেন! ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। তরীর কেন যেন হজম হলো না।
সালেহাকে রান্নাঘর থেকে উঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে। তরী সেদিকে ধীর পায়ে এগোলো। শুধালো, “কি হয়েছে সালেহা? এভাবে চোরের মতো উঁকি দিচ্ছো কেন?”

চোর বলায় সালেহা বোকা হাসলো। কিন্তু উঁকি দেওয়া বন্ধ করলো না। খাবার ঘরের ওদিকটায় দৃষ্টি স্থির রেখেই বললো, “দেখতেছো না কি আজব কান্ড ঘটতাছে? রোজ রোজ এমন সার্কাস দেখতে পামু নাকি?”
তরী বুঝলো না, “মানে?”
—“তোমার মামীর দিকে তাকাইয়া দেখো। এই মহিলা বুঝি নিজের বউরে এমন ভালাবাইসা কিছু খাওয়াইবো? কহনো দেখছো? স্বার্থপর মহিলা! নাতি আইবো দেইখাই তো দরদ উতলাই পরতাছে।”
—“নাতি আসবে না? নূরী ভাবী কি প্রেগন্যান্ট?”
—“হ! জানতা না?”
তরী বিস্মিত হলেও সেই বিস্ময় ভাব বেশিক্ষণ টিকলো না। সালেহার প্রশ্নে দমে গেল সে। মন খারাপ হলো ভীষণ। নূরী ভাবীর বাচ্চা হবে, অথচ কেউ তাকে বললোও না। অবশ্য সে এ বাড়ির কে? তাকে হাঁকডাক দিয়ে বলতেই-বা হবে কেন?

প্রণয় আসলো এর অল্পক্ষণ পরেই। বেশ পরিপাটি সাজ নিয়ে। বোঝার উপায় নেই, এ ছেলেটাই কাল পুরোটা সময় হাড় কাঁপানো জ্বরে অস্থির ছিলো। এখন সে বড্ড স্বাভাবিক, স্থির। গটগট পায়ে বাবার পাশের চেয়ারটা টেনে বসতেই রফিক প্রশ্ন করলেন, “এখন কেমন আছো? জ্বর কমেছে?”
বাবার দিকে একপলক তাকিয়ে প্রণয়ের উত্তর, “হ্যাঁ। কমেছে।”

বলতে বলতে পরোটা একটু করে ছিঁড়ে মুখে পুরলো সে। রফিক চা খেতে খেতে মাথা দুলালেন। যেন বিশাল কিছু বুঝে ফেলেছেন।
আবদুল বললো, “তোকে বলা হয়নি প্রণয়, নূরী মানে তোর ভাবী প্রেগন্যান্ট। তুই চাচা হবি।”
প্রণয় শুনলো। সেকেন্ডের জন্য তাকালো নূরীর দিকে। মুচকি হেসে বললো, “কংগ্রেস ভাবী।”
উত্তরে নূরীও হাসলো মুখ ভরে।

তরী এতক্ষণ নীরবে খাচ্ছিল। অন্যদিকে মন নেই। প্রণয় আসার পর থেকে মাথা তুলেও তাকায়নি। আচমকা শুনতে পেল, কেউ তাকে আদেশ দিয়ে বলছে, “তরী, পায়েসের বাটিটা দিন।”
তরী চমকালো। ভড়কানো দৃষ্টিতে তাকালো প্রণয়ের দিকে। প্রণয়ের চাহনি ঠান্ডা। একমনে চেয়ে আছে ওরই দিকে। তরী আড়চোখে আয়েশা খাতুনের চোখের তীক্ষ্ণটা পরখ করে নিলো। খানিকটা তোতলিয়ে বললো, “জি?”
—“পায়েসের বাটিটা.. আমাকে দিন।”

তরী সময় নিলো না। হড়বড় করে বাটিটা ঠেলে দিলো প্রণয়ের দিকে। পরপরই আবার মাথা নিচু করে খাবার খেতে লাগলো। সে টের পাচ্ছে, আয়েশা খাতুন তখনো তাকে দেখছেন। সূক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা ঝাঁঝরা করে ফেলছেন। অস্বস্তিতে মেরে ফেলতে চাইছেন বোধহয়। তরীর আর সহ্য হলো না। খাবার গলা দিয়ে নামলো না। ওই আধখাওয়া প্লেটটা হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো ও।

কালো অধ্যায়ের প্রথম পাতাটা উল্টানো হয়েছিল মাত্র। ক্ষতবিক্ষত, ন’গ্ন তরীকে পাওয়া গিয়েছিল পার্কের পাশের জঙ্গলটায়। মিছে মায়ায়, হাহাকারে কোলাহল হচ্ছিল আশপাশে। খুব দেড়িতেই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল মেয়েটাকে। তরীর বাবা টেলিভিশন, খবরের কাগজ, এসবে মেয়ের কলঙ্কের কথা তুলে ধরতে চাননি। যা একটু পুলিশের কাছে মামলা করতে চেয়েছিলেন, পুরো গ্রামবাসির কথায় আবার দু’কদম পিছনে ফিরে আসেন। বখাটে হলেও হায়’নাগুলোর ক্ষমতা অনেক। পাছে যদি ন্যায়ের বদলে আরও অন্যায় হয়? মেয়েটার যদি আবার ক্ষতি হয়?
হাসপাতাল থেকে আনার পর তরী একদম নীরব হয়ে যায়। কেমন পুতুলের মতো। ঠোঁটে হাসি নেই। কথা নেই। যা করতে বলা হবে চুপচাপ করবে। খাবার সামনে দিয়ে রাখলে একটুও ধরে দেখবে না। অথচ খাইয়ে দিলে বিনাবাক্যে খেয়ে নিবে। মাঝে মাঝে বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে চিৎকার করে কান্নার শব্দ পাওয়া যায়। একেকটা আর্তনাদ কি ভীষণ হৃদয় কাঁপানো! তরীর মা দমবন্ধ নিশ্বাসে এসব দেখতেন, শুনতেন। আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদতেন সারাক্ষণ। তরীর বাবাও মেয়ের উদাসীনতা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। সবার কথা অগ্রাহ্য করে গ্রামের মাতব্বরের কাছে হাত পাতলেন। মাতব্বর ছিলেন অনেকটা উদার মনের। তিনি আশ্বাস দিলেন, একদিন নিশ্চই অপরাধী শাস্তি পাবে।

‘একদিন’ সময়টা আসতে বহুদিন লাগলো। বহুক্ষণ গড়ালো। তরী বিছানায় নিশ্চুপ ভাবে বসেছিল। মেঝের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল গভীর মনোযোগে। তরীর বাবা আস্তে করে তার পাশে বসলেন। আদুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “নিচে কি দেখিস মা? পেটে খুদা লাগে নাই? খাবি না?”

তরী উত্তরহীন। একইভাবে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। তিনি কিছুক্ষণ নিরবে মেয়েকে দেখলেন। চাপা কষ্টে ভেতরে ভেতরে হু হু করে কাঁদলেন। একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, “তোর জন্য চিঠি এসেছে মা। নেয়, ধর।”

তরী চোখ তুলে তাকালো এবার। চিঠিটার পানে। একদম আস্তে শুধালো, “কার?”
—“রুপালীর।”
তৎক্ষণাৎ সর্বাঙ্গ ক্ষীণ কেঁপে উঠলো। চোখের পাতা কাঁপলো। অবাক নেত্রজোড়া স্থির হলো বাবার মুখশ্রীতে। যেন চুপ থেকেই হাজারটা প্রশ্ন করে ফেলছে সে। তরীর বাবা কোমল স্বরটা আরেকটু নাজুক করে বলতে রইলেন, “রুপালী আর বেঁচে নেই মা। পাশের শহরের একটা ভাড়া বাসায় ওর আর ওর প্রেমিকের ম’রদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মরার আগে তোর জন্য চিঠি লিখে গেছে মেয়েটা।”

বাহিরে বুঝি ঝড় শুরু হলো? নাকি তরীর বুকটা ঝড়ে নিঃশেষ হলো? সে কি কাঁদছে? গালজোড়া তো ভিঁজে যাচ্ছে। বিন্দু বিন্দু জল ভিঁজিয়ে দিচ্ছে। যন্ত্রণায় গলা দিয়ে কথাও বের হতে চাইছে না। তবুও রয়েসয়ে, অবিশ্বাস্য গলায় তরী উচ্চারণ করলো, “ও কি সত্যি বেঁচে নাই আব্বা?”
তিনি ‘না’ বলতেই কি যেন হলো তরীর। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো একদমই। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। চিৎকার করে কেঁদে ফেললো, “অন্ধ হয়ে ও আমার সুখ কেড়ে নিলো আব্বা। আমার ভালো থাকা কেড়ে নিয়ে চলে গেল।”

মাহাদ দারুণ ফুটবল খেলতে পারে। মোটরসাইকেল দিয়ে আসার সময় কতগুলো ছেলেকে মাঠে ফুটবল খেলতে দেখেছিল। দুপুরের বৃষ্টির পানিতে কাঁদা কাঁদা মাঠ। সুন্দর আবহাওয়া। আকাশে সূর্য নেই। মেঘেরাও নেই। নীল রঙে ভরে আছে পুরো গগন। ছেলেগুলোকে দেখে মাহাদের মন মানলো না আর। তরীকেও টেনে আনলো জোড়পূর্বক। মাঠের একপাশে মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে সেখানেই বসিয়ে রাখলো তরীকে। নিচু হয়ে জিন্স দু’হাতে বটে বটে ভাঁজ করতে করতে বললো, “তুমি এখানে বসে থাকো। আমি খেলে আসছি।”
তরী অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “আমি এখানে একা একা কি করবো?”
—“আমাকে চিয়ারআপ করবে। আমি গোল দিয়ে তোমার দিকে তাকালে তুমিও আমার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসবে, ঠিকাছে?”
তরী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো শুধু। এছাড়া তো আর উপায় নেই।

মাঠের ছেলেগুলো মাহাদের থেকে অনেক ছোট। ইন্টারে সবে উঠেছে এমন। টগবগে যুবক সবাই-ই। মাহাদের সাথে ওরা এমন ভাবে মিশেছে যে, মনে হচ্ছে মাহাদ ওদের বয়সেরই একজন।
আস্তে আস্তে খেলা জমে উঠলো। তরীও আগ্রহ পেল খুব। কাঁদায় মাখো মাখো মাহাদকে দেখতে লাগলো। মাহাদ আনন্দ করতে জানে। নিজে নিজেই নিজের আনন্দ খুঁজে বেড়াতে জানে। এই যে, কি সুন্দর হাসছে ছেলেটা। বলে একেকটা জোড়দার আঘাতে গোল দিয়ে যাচ্ছে। গোল দিয়েই বিজয়ী হাসি নিয়ে তরীর দিকে তাকাচ্ছে বারবার। তরী কিন্তু হাসছে না। মাহাদের কথামতোও কিছু করছে না। চেয়ে আছে শুধু। মুগ্ধতার রেশ কি পাওয়া যাচ্ছে? হ্যাঁ, যাচ্ছে বোধহয়।

খেলা শেষ হতে হতে বিকালের শেষ প্রায়। মাহাদ কাঁদায় গোসল হয়ে তরীর সামনে দাঁড়াতেই তরী পানির বোতল এগিয়ে দিলো। মাহাদ নিলো না। ধপ করে তরীর পাশে, মোটরসাইকেলে বসে পরলো। গায়ের কাঁদা সেখানেও লাগলো খুব করে। তরীর হাতেও লাগলো খানিকটা। তবুও মাহাদ নির্লিপ্ত। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। প্রশান্তি খেলা করছে তারা সারা মুখে। তরী বললো, “কেমন খেললেন? মজা পেয়েছেন?”
—“খুউউব!”
—“আরও খেলতে মন চাইছে?”
—“হ্যাঁ।”
—“কিন্তু আপনি তো ক্লান্ত।”

মাহাদ হঠাৎ করে তরীর দিকে তাকালো। চোখে চোখ রাখলো। বিস্তর হেসে বললো, “ছেলেগুলো দারুণ খেলে জানো? আমি খেলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি!”
—“কিন্তু বিজয়ী তো আপনার দলই হয়েছে।”

মাহাদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। চুপ করে সন্ধ্যার আগমন দেখতে লাগলো। তরী আবার বললো, “আর কতক্ষণ বসে থাকবেন? আমার কিন্তু দেড়ি হয়ে গেছে।”
মাহাদ জবাব দিতে একটু বেশিই সময় লাগালো। কিন্তু সে তরী জবাবের উত্তর দিলো না। তার মনে হলো, আকাশ তাকে একটা প্রশ্ন করেছে। খুব বিরাট প্রশ্ন। আনমনে, খুব আস্তে, গুনগুনিয়ে সে সেটারই উত্তর দিলো, “তুমি তাচ্ছিল্য করো না হে আকাশ। আমি তাকেও জিতে নেব একদিন।”

_______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here