বকুলতলা
৩৪.
রাত কত হয়েছে, প্রণয়ের জানা নেই। লাইব্রেরী ঘরে সে কোনো ধরণের ঘড়ি রাখে না। তার মতে, ঘড়ি মানুষকে আকর্ষণ করার দারুণ ক্ষমতা রাখে। কোনো কিছু শান্তিতে, তাড়াহীন ভাবে করতে চাইলেই সে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে আকর্ষণের সিস্টেমটা চালু করে দেয়। বলে, ‘কাজটা বন্ধ কর তো! এখন তোর ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে। বারোটা বাজে! কাল না ডিউটি আছে?’ অথচ প্রণয় তো এ ঘরে আসে একটু শান্তিতে থাকার জন্যই। যেখানে কোনো তাড়া থাকবে না। সময়ের বিশ্রী জ্ঞানটাও কেউ দিবে না। তবে বাহিরের গভীর অন্ধকার বলে দিচ্ছে, সময়টা এক কিংবা দুইয়ের আশপাশে। টেবিলের ওপর মাত্তুল, পেরাকগুলোও ঘণ্টাখানেক ধরে একইভাবে পরে আছে। তার সবসময়কার বসার কাঠের চেয়ারটা ইদানিং সমস্যা করছে। বসতে গেলেই ‘ভটভট’ আওয়াজ হয়। পেরাক ঢিলে হয়ে গেছে হয়তো। ঠিক করবে বলেই মাত্তুর আর পেরাক এনেছিল। কিন্তু তরী এসে যাওয়ায় সেটা আর করা হয়নি। এখন আর করতেও ইচ্ছে করছে না। মাথার ভেতরটা কেমন কিলবিল করছে। অস’হ্য য’ন্ত্র’ণা! চোখ কি শুকিয়ে গেছে তার? কি হয়েছে কি? এত ব্য’থা করছে কেন?
প্রণয় হুট করেই উঠে দাঁড়ালো। পাঁচনম্বর তাক থেকে সেই বইটি নিলো। জানালার পর্দা আরেকটু সরিয়ে নড়বড়ে, ভটভট করা চেয়ারটাতেই বসে পরলো সশব্দে। উদভ্রান্তের মতো বইয়ের একটা অর্ধেক মতো খালি পৃষ্ঠায় লিখতে শুরু করলো,
‘আমার দেখা প্রিয় নিষ্ঠুরতম মেয়ে,
তুমি কি জানো আমি তোমাকে ঠিক কতটা চাই? ভালোবাসি? জানতে চাওনি বলেই হয়তো জানো না। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে আগলে রাখতে পারবো। তোমার সব আবদার পূরণে সর্বদা মুখিয়ে থাকতে পারবো। আমি চাইলে জোড় করে তোমাকে বিয়েও করতে পারি। একটু আগের সময়টাতেও আমি সেটাই ভেবেছিলাম। অসুস্থ আমার তোমাকেই চাই। কিন্তু অসম্ভব বাজে সত্য, তুমি আমাকে চাও না। তোমার মনে মাহাদ এমন ভাবে গেঁথে গেছে যে, আমার দিকে তুমি একটু তাকানোর সময়টুকুও পাওনি। বুঝতে চাওনি আমার ভেতরে কি চলছে। আমি তোমাকে দোষারোপ করছি না। ওই ছেলেটাকেও না। দোষটা আসলে আমার। নিজের অনুভূতি কিভাবে প্রকাশ করতে হয় তা আমার জানা নেই। এই একটা ব্যর্থতাই কি তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলো? নিয়েছে হয়তো। আমি স্পষ্ট সেই ব্যর্থতার পরাজয় দেখেছি।
তুমি যখন আমাকে মাহাদের কথা বলছিলে? তোমার চোখে-মুখে কি সুন্দর আনন্দ খেলা করছিল! যেন ছেলেটাকে নিয়ে কথা বলতে তুমি খুব স্বাচ্ছন্দ বোধ করো। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু তোমাকেই দেখছিলাম। আমার ভেতরটা হতাশায় ভরে গিয়েছিল। এই আনন্দ, উৎফুল্লতা আমি তৈরি করতে পারিনি কেন? এত নগন্য কেন আমি?
তুমিই হয়তো ঠিক তরী। হয়তো তোমার কথাগুলোই সঠিক। আমার সত্যিই একজন আগলে রাখার মতো মানুষ প্রয়োজন। কিন্তু সেটা তুমি কেন নও? আমরা কি একে অপরকে আগলে রাখতে পারিনা? আসলে কঠিন সত্য কি জানো? আমি, ওই ছেলে– তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসি, সেটা মূখ্য না। তুমি কাকে ভালোবাসো সেটাই মূখ্য, মূল। আর এই কঠিন সত্যের ওপরই আমার অভিযোগ। কেন তুমি আমায় ভালোবাসলে না? পছন্দ করলে না? আমাকে একটু বুঝতে চাইলে না কেন তরী? আমি তো বেশি কিছু চাইনি।’
তারিখ লেখার জায়গা নেই। প্রণয় আর লিখলো না। কলম রেখে দিলো। অনুভব করলো, তার চোখের ব্য’থাটা আরও বেড়ে গেছে। সচ্ছ পানিকণাগুলো গাল ভিঁজিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। আহ! তরীর মতোই নিষ্ঠুর ওর দেওয়া অশ্রুরাও!
–
পরের সময়গুলো যেন একটু বেশিই তাড়াতাড়ি কেটে গেল। প্রণয় সবাইকে মানা করে দিয়েছে বিয়ের জন্য। সে তরীকে বিয়ে করবে না। রফিক সাহেব এ কথা শুনে চরম রাগারাগিও করেছিলেন। কিন্তু প্রণয় ছিল নির্বিকার। কারণ জিজ্ঞেস করলেও বলছিল না। এত এত প্রশ্নের জবাব থেকে বাঁচতে দুটো রাত বাসায়ও ফিরেনি। কোথায় ছিল, কিভাবে থেকেছে, কেউ জানে না। এ নিয়ে আয়েশা খাতুনের চিন্তায় শেষ নেই! তবে অবাক বিষয়, মহিলা এই বিয়ে ভাঙ্গা নিয়ে কাউকেই কোনো ধরণের প্রশ্ন করেননি। যেন বিয়ে ভাঙ্গাতে বরং খুশিই হয়েছেন তিনি। সারাক্ষণ মুখে বিস্তর একটা হাসি নিয়ে ঘোরাফেরা করেন। তরীর সাথে দেখা হলে এই হাসির প্রস্থ আরও বেড়ে যায়। তাচ্ছিল্যের একটা ভাব নিয়ে কেমন করে যেন তাকান তিনি। তরী শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই বাড়িটা তার জন্য আস্তে আস্তে নি’ষি’দ্ধ হয়ে উঠছে। নিজেকে আজকাল জড় বস্তুই মনে হয় তার।
বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় তরীর বাবাকেও ঢাকায় আসতে সেদিনই মানা করে দিয়েছিলেন রফিক সাহেব। একবার ডেকে তরীকে কারণ জিজ্ঞেস করার চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। তরী ছিল তখন চুপচাপ। না জানার ভান করেছিল শুধু। ওদিকে আবার মাহাদকেও ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে। অনেকটা বিরক্ত হয়েই। লোকটা হাসপাতালের মানুষগুলোকেও ছাড় দেয়নি। সারাদিন নাকি এক বুলিই আওরাতে থাকে, “আমাকে ডিসচার্জ দিচ্ছে না কেন? আমি একদম সুস্থ আছি। তবুও আটকে রাখার মানে কি? এত টাকা খাওয়ার লোভ আপনাদের! আমাকে এক্ষুণি যেতে দিন বলছি! নয়তো কিন্তু উলটাপালটা খবর ছাপিয়ে দেব।”
বাধ্য হয়ে যখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রায় তৎক্ষণাৎ ডিসচার্জ দিলো, তখনো লোকটার ত্যাড়া স্বভাব গেল না। সে আবারও ডাক্তার, নার্সদের পাগল বানিয়ে ছাড়লো, “আশ্চর্য! আপনাদের এখন ডিসচার্জ দিতে কে বলেছে? আমি অসুস্থ মানুষ। একা একা বাসায় যাবো নাকি? আমার বউ বিকালে আসবে। তখন ডিসচার্জ দিবেন। এখন আমি এখান থেকে একচুলও নড়ছি না।”
তরী উদাস চোখে মাহাদের এই পাগলামিগুলো দেখলো মাত্র। দেখলো না ঠিক। শুনলো। নার্সরা প্রচুর আগ্রহ নিয়ে গল্প বানিয়ে বানিয়ে শোনালো তাকে। সাথে এও বললো, তার কপালে নাকি একটা পাগল স্বামী ছুটেছে। যেন দেখে রাখে। কিন্তু আদৌ কি দেখার উপায় আছে মাহাদকে? লোকটা তো তাকেই দেখে কূল পায় না। ইদানিং মনে হয়, তরীর তাকে পছন্দ করার সহজ স্বীকারোক্তির পরপরই লোকটা আরও বেশি ছন্নছাড়া, বে’পরো’য়া হয়ে গেছে।
রাস্তা পর্যন্ত মাহাদকে ধরে ধরে আনতে হলো। সে এখনো পুরোপুরি সুস্থ না। শুধুমাত্র জেদ করে ডিসচার্জ নিয়েছে। এত মানুষের সমাগম, কোলাহল, ফিনাইলের বিশ্রী গন্ধটা! মাহাদ আসলে সহ্য করতে পারছিল না। তরী সেটা বুঝতে পেরেছে। এজন্যই এ নিয়ে আর কিছু বলেনি।
—“সিএনজি কোথায় ঠিক করেছ?”
অসুস্থতায় চোখ মুখ কুঁচকে রাখা ক্লান্ত মাহাদ তরীর দিকে আধো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে এখনো ঠিকভাবে হাঁটতে পারেনা। খুড়িয়ে খুড়িয়ে একটু হাঁটলেই কোমড়ে জ্বালা শুরু হয়ে যায়। এখনো হচ্ছে। তরী তাকে একটু দেখে নিয়ে আস্তে করে উত্তর দিলো, “আপনার বাসার ওখানেই।”
—“এখন বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। ঠিকানা চেঞ্জ করো। অন্যকোথাও যাবো।”
—“অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় যাবেন? আপনার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন।”
মাহাদ আস্তে আস্তে মাথা হেলিয়ে দিলো তরীর কাঁধ। চোখ বুজলো। ঢিমে যাওয়া স্বরে বললো, “আমার এখন শান্তি প্রয়োজন তরী।”
_____________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা