বকুলতলা ৩৭.

0
713

বকুলতলা

৩৭.
মাহাদের স্পষ্ট মনে আছে, এই উঠোন জুড়েই সে ছোটবেলায় দৌঁড়ে বেড়াতো। তার পিছু পিছু ভাতের থালা নিয়ে ছুটতেন তার মা। রডের তৈরি গেটটার ঠিক ডান পাশের মাটির রান্নাঘরে মাকে সবসময় পাওয়া যেত। রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে ভীষণ পাজি মাহাদকে পাটিতে বসিয়ে পড়ালেখা করাতেন তিনি। মাঝে মাঝে সুতীর শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘর্মাক্ত ঘাড়, গলা, কপাল মুছতেন। আবার যখন মাহাদ পড়া বাদ দিয়ে দুষ্টুমীতে লেগে যেত, উঠে এসে শক্ত হাতের একদু’টো চড় দিয়ে অনায়াসে পিঠ জ্বালিয়ে দিতেন। সে কি ব্য’থা! ভাবলেই মাহাদের হাসি পায়। বাঁধাহীন ভাবে প্রাণখোলা হাসিটা জায়গা করে নেয় পুরো ঠোঁট জুড়ে। চওড়া, বিস্তর হাসি। অথচ এই হাসিতে কোনো উল্লাস নেই। আনন্দ নেই। চোখের পাতা কেঁপে উঠে শুধু। এই বুঝি একটুখানি জল বাম চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরলো! ইশ! তার মা যে এই উঠোনেই মৃ’ত্যু’যন্ত্র’ণায় কাতরেছে। ছটপট করেছে। সেই করুণ দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। হাঁসফাঁস করতে থাকা মন বি’ষি’য়ে উঠে। বুক ভারী হয় প্রবল বিতৃষ্ণায়। চারিদিকে এত ক’ষ্ট! যেন সেই ক’ষ্টের মাঝেই মায়ের বকুনি, খিলখিলানো হাসি স্পষ্ট শুনতে পারছে সে।
মাহাদ বেশি কিছু ভাবতে পারলো না। উদাস মনটায় হঠাৎ লাগাম টেনে নূপুর প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে ভাইয়া? কি ভাবছিস?”

মাহাদ সেকথার উত্তর দেয় না। সময় নেয় অল্পক্ষণ। মাটির রান্নাঘরটার দিকে একাধারে তাকিয়ে থেকে বলে, “মা এখানে সবসময় বসে থাকতো, জানিস? পাটি বিছিয়ে আমাকে পড়াতো, তোর সাথে খেলতো, রান্না করতো। তোর মনে আছে?”
—“মনে নেই ভাইয়া।”
আনমনেই উত্তর দিলো নূপুর। তবে তার সত্যিই মনে নেই। মাটির রান্নাঘরটাকে এখন আসলে আর রান্নাঘর বলা যায় না। বড়োজোর ভাঙ্গাচোরা একটা স্টোররুম বলা যেতে পারে। লাড়কি, কিছু মরিচিকায় ভরপুর পুরানো টিনের স্তুপ পরে আছে সেখানটায়। এ বাড়িটায় আগের মতো কিচ্ছু নেই। রশিদ সাহেব সব নতুন করে তৈরি করেছেন। একতলা বাড়িটা দু’তলা করেছেন। টাইলস করা মেঝে, এটাচ্ বাথরুম! মাহাদের কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে হয়, কোনো অচেনা পরিবেশে চলে এসেছে সে। যেখানে তার মায়ের হাতের স্পর্শ নেই। কোনো স্মৃতি নেই।
ভাইয়ের মন খারাপের কারণ নূপুর সহজেই বুঝলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইয়ের হাতটা আলতো করে ধরলো সে। আস্তে করে শুধালো, “ভাত খাবি না? আমি নিজে আজকে রান্না করেছি। আয়।”
মাহাদ আস্তে করে জবাব দিলো তখন, “আসছি।”

রশিদ সাহেবকে দেখে মাহাদ মুচকি মুচকি হাসছে। কারণটা অদ্ভুত! মায়ের মৃ’ত্যুর একদিনেই তার হাল বেহাল হয়ে গেছে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরা জলকণা গুলো সেকেন্ডে সেকেন্ডে গাল ঘঁষে মুছছেন তিনি। কিন্তু অশ্রুরা যেন ফুরাতেই চাইছে না! ফ্যাকাশে, মলিন হয়ে আছে শ্যামলা মুখ। মাহাদ হাসতে হাসতেই বললো, “কেমন লাগছে আব্বা?”
প্রশ্ন শুনে ভীষণ চমকালেন রশিদ। গলায় ভাত আটকে খুকখুক করে কাশতে লাগলেন। মাহাদ বেশ শান্ত ভাবেই ভরাট পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। আবার বললো, “দাদী তো তাও স্বাভাবিক ভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আব্বা। বয়স হয়েছে। একদিন না একদিন ম’রতোই। অথচ আমার মাকে তুমি মে’রে ফেলেছিলে। আমার সামনে। নূপুরের সামনে। এক মাকে সন্তানের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে আবার সেই মায়ের জন্যই কান্না করাটা বেমানান। কেমন বিশ্রী দেখায়। তুমি আর কেঁদো না তো!”

সত্যি সত্যি রশিদের কান্না থেমে গেল। ছেলের দিকে কিছুক্ষণ অসহায় নয়নে চেয়ে রইলেন তিনি। ভেতরকার আর্ত’নাদটা বের হওয়ার আগেই নূপুর বললো, “আব্বাকে আর এসব বলে কষ্ট দিস না ভাইয়া। আব্বা শুধরে গেছে। তার কাজের জন্য সে অনুতপ্ত।”
—“তার অনুতপ্ত হওয়া কি আমাদের কাছে আমাদের মাকে ফিরিয়ে আনবে?”
—“এটা কিভাবে সম্ভব?”
ভাত খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে বহু আগেই। প্লেটেই হাতটা ধুঁয়ে উঠে দাঁড়ালো মাহাদ। চলে যেতে যেতে বললো, “তাহলে আমার দ্বারাও ভালো ব্যবহার করা সম্ভব না। সরি।”

রশিদও আর ভাত খেতে পারলেন না। তার বুকটা খা খা করছে। অনেকদিন পর সাহানার জন্য দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ তুলে নূপুরের দিকে তাকালেন তিনি। বিবশ গলায় বললেন, “মাহাদ না কোন মাইয়ারে পছন্দ করে বললি? মাইয়ার নাম কি? বিয়ার প্রস্তাব পাঠাইলে কেমন অয়?”
নূপুর আধখাওয়া প্লেটগুলো একটার ওপর একটা রাখতে রাখতে বললো, “ভাইয়াকে না বলে আগেই কিচ্ছু করতে যাইও না। পরে হিতে বিপরীত হবে।”

সকাল থেকেই বরকত সাহেব খুশিখুশি আমেজ নিয়ে ঘোরাফেরা করছেন। বাজার থেকে কারণ ছাড়াই দু’প্যাকেট মিস্টিও এনেছেন তিনি। তরী প্রথমে বাবার এসব কান্ডে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। পরে জানতে পারে, অর্ণবকে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে সকালেই। আপাতত রিমান্ডে আছে সে। তরীর সাথে ডিভো’র্সের পর অর্ণব যে ভালো ছেলে হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। চুপিসারে, আড়ালে আবডালে বিভিন্ন কু’নৈ’তিক কাজ করে গেছে। কয়েকটা মেয়ের জীবনও নষ্ট করেছে ধ’র্ষ’ণের মাধ্যমে। এতদিন ক্ষমতার জোড়ে অসহায় মানুষেরা কিছু করতে পারেনি। সয়ে গেছে শুধু। এবার পালা তাদের রুখে দাঁড়ানোর।
টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র, সোশ্যালমিডিয়াসহ সব জায়গাতেই অর্ণবকে ধিক্কার জানিয়ে পোস্ট করা হচ্ছে অহরহ। তরী জানে, এসব মাহাদের করা। সে ছাড়া এসব করবেই বা কে? মনে মনে ভীষণ শান্তিতে সিক্ত হয়ে উঠলো তরী। যাক, সে যা ভেবেছিল অনতত তা হয়নি। মাহাদ মা’রপিট করেনি ভেবেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো বেশ কয়েকবার। কিন্তু তার এই স্বস্তি বেশিক্ষণ টিকলো না। বিকাল হতে না হতেই মাহাদের মেসেজ এলো,
—“তোমার বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার বাপ কি এখানের এই জঙ্গলগুলো পরিষ্কার করে না? এত মশা কেন? তাড়াতাড়ি আসো তো। কিছু নিয়েও এসো। ক্ষুধা লেগেছে।”

তরী ঠিক ঠিক তা-ই করলো। তখনো বিকাল হয়নি। ঘড়িতে তিনটা বেজে ত্রিশ মিনিট। চো’রের মতো গা ঢাকা দিয়ে তরী বরকত সাহেবের আনা কয়েকটা মিস্টি আর দুটো পরোটা প্লেটে করে নিয়ে নিলো। পেছনের দরজা দিয়ে বের হতেই দেখলো, মহাবিরক্ত মাহাদ সাহেব সবসময়ের মতো চোখ-মুখ কুঁচকে, বিরক্ত হয়েই দাঁড়িয়ে আছেন। নাক এমন ভাবে কুঁচকে রেখেছে যে, দেখতে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে। তরী ধীর পায়ে আরেকটু কাছাকাছি হতেই খেয়াল করলো, মাহাদ ভালো নেই। তার কপাল জুড়ে সাদা ব্যান্ডেজ উঁকি দিচ্ছে। গালের একপাশ ফুলে আছে। ঠোঁটের কোণে র’ক্ত জমাট বাঁধা। তরী তার পায়ের গতি বাড়ালো। দ্রুত এগিয়ে আসতে আসতে মৃদু গলায় শুধালো, “আপনার এই অবস্থা কেন?”
হাতের ছোট ছোট লাল দাগগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে মাহাদ প্রবল অসন্তুষ্টি নিয়ে বললো, “জানো না কেন? তোমার বাবার গাফলতির জন্যই মশারা আজ আমাকে পেয়ে বসেছে। উফ!”
—“আমি মোটেও মশার কামড়ের কথা বলছি না। আপনার শরীরে এমন কাঁটাছেড়া কেন? কার সাথে মা’রপিট করে এসেছেন?”

মাহাদ যেন শুনলোই না। তরীর হাতের প্লেটের দিকে চেয়ে চেয়ে বললো, “কি এনেছো? আমার কিন্তু অনেক ক্ষুধা লেগেছে! আসো, খাইয়ে দেবে।”
তরী দমলো না। ক্ষীণ রাগী কণ্ঠে বললো,
—“আপনি আগে আমার কথার উত্তর দিন।”
মাহাদের একরোখা উত্তর, “এ গ্রামের মাতব্বরের সাথে হা-ডু-ডু খেলতে গিয়েছিলাম কাল রাতে। খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি। সামান্য ব্যাপার।”

তরী ক্লান্ত শ্বাস ফেললো। মলিন নেত্রে মাহাদের কুঁচকানো মুখটা আরেকদফা দেখে নিয়ে বললো, “কি দারকার ছিল এসবের? পুলিশে তো দিয়েছেনই।”
—“পুলিশে দিয়েছি তো কি? মনের একটা শান্তি আছে না? ওকে মেরে যে কি শান্তি পেয়েছি! একেকটা ঘু’ষি দেওয়ার সময় বেয়াদ’বটা যেভাবে চেঁচা’চ্ছিল! উফ! আমার কানটা ধন্য হয়ে গেছে!”

আবার ত্যাড়া কথা! তরী ভীষণ হতাশ হলো। এ বিষয়ে আর একটাও কথা বললো না। ওড়নার ভেতর থেকে প্লেট বের করে বললো, “অর্ণব জেলে যাওয়ায় বাবা খুশি হয়ে মিস্টি এনেছেন। নিন। এগুলো খেয়ে জিভও ধন্য করুন।”
মাহাদ সাথে সাথে খুশি হয়ে কিছু বলতে নিচ্ছিলো। তরী থামিয়ে দিলো। ধমকের মতো করে বললো, “আগে খেয়ে শেষ করুন। তারপর কথা।”
—“কিন্তু আমি তো তোমার হাতে খাবো।”
—“এটা কি খাওয়ার পরিবেশ? আমি কিভাবে খাওয়াবো? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?”
—“আমি সেটা বলেছি? একটু দূরেই গাড়ি পার্ক করা আছে। চলো।”

তরী অবাক হয়ে শুধালো, “গাড়ি কোথায় পেলেন?”
মাহাদ ততক্ষণে তরীর হাত নিজের হাতের ভাঁজে টেনে নিয়েছে। এদিক-ওদিক পরখ করে বললো, “ফ্রেন্ড থেকে ধার নিয়েছি। বলেছি, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরবো। সেও দিয়ে দিয়েছে।”
—“আপনি কি কখনো শুধরাবেন না?”

মাহাদ ঘাড় ঘুরিয়ে তরীর দিকে তাকালো তখন। ফিসফিসিয়ে বললো, “শোকর করো মেয়ে। আমার মতো প্রেমিকপুরুষ তুমি এই পৃথিবীতে আর পাবে না। তোমার উচিত পৃথিবীকে ধন্যবাদ জানানো।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here