বকুলতলা ৪.

0
697

বকুলতলা

৪.
মেঘেদের কড়া যুদ্ধের পর পরাজিত পক্ষ কান্না করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই হয়তো আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে নামবে তারা। তরী শুধু উদাস নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখছে মাহাদকে। লোকটার সুন্দর কপালের একপাশে লম্বালম্বি একটা গভীর ক্ষত। বাম গালটা একটু ফুলে গেছে। মুখশ্রী ব্যথায় নীলচে রঙে আচ্ছাদিত। অথচ মানুষটা ভীষণ নির্লিপ্ত। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে কি? তরী তো ছুঁয়ে দেখেনি আর।
মাহাদ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তরী। হতাশ সুরে বললো, “আপনি এমন কেন মাহাদ? কথা কেন শুনেন না?”

ব্যাথার স্থানগুলো টনটন করছে। হাত উঁচিয়ে মাথার চুলগুলো একবার ঝেড়ে নিলো মাহাদ। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তরীর জন্য পারছে না। মেয়েটার আবার সিগারেটের ধোঁয়ায় এলার্জি আছে। শান্ত স্বরে সে শুধালো,
—“কোন কথা শুনিনি?”
—“তখন মারপিট করতে গেলেন কেন? কোনো দরকার ছিল শুধু শুধু ওসবে নিজেকে জড়ানোর?”
—“ছিল। হিরো সাজার জন্য মারপিট করতে গিয়েছিলাম।”

আজকাল যেন মাহাদের ত্যাড়া কথায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে তরী। তবুও একটা ভারি নিশ্বাস ভেতরটা অশান্ত করে দিলো।
—“হিরো সেজে কি লাভ হলো? সেই তো মার খেয়েই এসেছেন।”
মাহাদের মুখটা এবার একটু গম্ভীর দেখালো। তরীর দিকে তাকিয়ে বোঝানোর সুরে বললো, “এটাও খেতাম না। কালো বেটে করে একটা ছেলে দেখেছো না? ওর শরীরে বাকিদের চেয়ে শক্তি বেশি ছিল। হঠাৎ করে মারতে আসায় বুঝতে পারিনি।”

বলে অল্প থামলো মাহাদ। আকাশের গুড়ুম গুড়ুম গর্জন বেড়ে গেছে। কালো মেঘগুলো একজোট হতেই দৈবাৎ বৃষ্টির আগমন ঘটে গেল। বাতাসের ঝাপটায় তরীর ঘোমটা পরে গেছে সেই কখন! মেয়েটা চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। জ্বরের ঘোরের পাশাপাশি এক অন্যরকম ঘোর যেন তক্ষুণি শিরায় শিরায় বয়ে চললো। ধীরে ধীরে নিশ্বাসের আনাগোনা তীব্র হলো। তীর্থের ন্যায় মাহাদ শুধালো, “আমি তোমাকে নিজের কাছে রেখে দেই তরী?”
তরী এতক্ষণ আশেপাশের ব্যস্ত শহরটাকে দেখছিল। বাসস্টপের ভেতরেও বৃষ্টির অল্প সল্প ছিঁটে মুখে পরতেই ক্ষণে ক্ষণে ভালো লাগায় সিক্ত হচ্ছিল। কিন্তু মাহাদের হঠাৎ এমন কথায় মারাত্বক ভড়কে যায়। চমকিত হয় সব অনুভূতি। আকুল কণ্ঠে মাহাদ আবার জানতে চায়,
—“রেখে দেই?”

তরী জবাব দিতে সময় নেয়। অনেকটা সময়। অনেকটা মুহুর্ত। এরপর লহু স্বরটাকে কঠিন করে উত্তর দেয়, “আপনি অন্যায় আবদার করছেন। আমি, আপনি একসাথে— কখনো সম্ভব না।”
শান্ত, স্বাভাবিক মাহাদ অধৈর্য হয়ে উঠলো মুহুর্তেই,
—“কেন সম্ভব না? তুমি আমাকে কেন এত অপেক্ষা করাচ্ছো তরী?”
কথা বলার সময় মাহাদের কণ্ঠ নড়বড়ে হয়ে উঠছিল বারবার! শরীরের প্রচন্ড কাঁপাকাঁপি যেন তরী অতটুকু দূরে থেকেও টের পাচ্ছিল। মাহাদের জ্বর বেড়ে যাচ্ছে। বাহিরের ঠান্ডা আবহাওয়া সুস্থ হতে দিচ্ছে না।
মাহাদ আবারও কিছু বলতে নেওয়ার আগেই তরী প্রশ্ন এড়িয়ে বললো,
—“বাসায় যাবো। খারাপ লাগছে।”

উত্তরে মাহাদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইলো। হয়তো প্রগাঢ় চোখে তরীর দিকেই তাকিয়ে ছিল চুপচাপ। তরী তাকায় নি। মাথা নুইয়ে ছিল। তাই জানে না।
মাহাদ বললো, “রিকশায় যেতে পারবে না। বৃষ্টি হচ্ছে। ভিঁজে যাবে। বাস আসবে একটু পর। তখন যেও।”
তরী বলতে চেয়েছিল, তার কাছে ছাতা আছে। সমস্যা হবে না। কিন্তু মাহাদের দৃপ্ত ব্যক্তিত্বের পিঠে তা বলা হয়ে উঠে না। পাছে যদি মানুষটা রেগে যায়? তার তো আবার অনেক রাগ!

বাস আসার সাথে সাথেই বাসে উঠে পরলো তরী। মাহাদ আসেনি তার সাথে। সে জোর করে আসতে দেয়নি। এ বাস যাবে মিরপুর এগারোতে। সেখান থেকে মাহাদের বাসা অনেকদূর। লোকটার কষ্ট বাড়িয়ে দিতে সে অবশ্যই চায় না।

খুঁজে খুঁজে জানালার সীট-টায় বসার পর তরী এক ঝলক তাকিয়ে ছিল বিধস্ত মাহাদের পানে। সে তার গাঢ় নেত্রজোড়ার দৃঢ় আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল করে তুলছিল তাকে। যেন ইশারায় বলছিল, “তরী, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”

রাতে প্রণয় বেশ দেড়ি করে ফিরলো। ঘড়িতে তখন রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। ঘুমে ঢুলুঢুলু সালেহা দরজা খুলতেই প্রণয় ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে টেনে সোফার কাছে নিয়ে গেল। এরপরই ধপ করে বসে পরলো সোফায়। সারা শরীর ব্যথা করছে তার। আজ অনেক খাটতে হয়েছে হাসপাতালে। হেঁটে হেঁটে অতদূর রুমেও যেতে ইচ্ছে করছে না। তারওপর পেটের ভেতর ক্ষুধারা তীব্র আন্দোলন জারি করে দিয়েছে। প্রণয় ভাবলো, একেবারে খেয়ে দেয়েই রুমে যাবে। সেই ভেবে হাঁকও ছাড়লো, “সালেহা, খাবার বাড়।”

বাসার সবাই এগারোটা বাজতে বাজতেই ঘুমিয়ে যায়। তরীর ঘুম আসছিল না। তাই রান্নাঘরে নিজের জন্য হালকা-পাতলা কিছু বানাচ্ছিল সে। আর তাকে সঙ্গ দিতেই সালেহাও এতক্ষণ জেগে ছিল। কিন্তু বেচারি এখন আর চোখ মেলে থাকতে পারছে না। প্রণয়ের কথায় সে যেন একটু বিরক্তই হলো। মাছের পাতিলটা চুলায় বসাতে বসাতে তিক্ত মনে বিড়বিড়ালো, “বেটাইমে আইয়া এহন খাইতে চায়! আক্কল ছাড়া মানুষগুলা যে ক্যান আমার মগজ খাইতেই বইয়া থাকে!”

সালেহা আস্তে করে বললেও পাশে দাঁড়ানো তরী সেটা শুনে ফেলে। ফিঁক করে হেসেও দেয়। তবে শব্দ নেই সেই হাসিতে। হাসতে হাসতে বলে, “তুমি যাও, ঘুমাও। আমি করে নিবো।”
—“নাহ্! আমি করতে পারমু আপা।”
—“আরে, যাও! চোখ মেলে তাকাতে পারছো না তুমি। পরে তরকারি পুড়াবে!”
সালেহা মনে মনে খুশিই হলো। সে সত্যিই আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না।

সবকিছু গরম করা শেষে ডাইনিংটেবিলে গুছিয়ে রাখলো তরী। প্রণয় তখন টেলিভিশন দেখছিল। খবর-টবরের কোনো একটা চ্যানেল। তরী মৃদু কণ্ঠে ডাকলো, “খাবার হয়ে গেছে। টেবিলে দিয়েছি। আসুন।”
তরীকে এখন এখানে আশা করেনি প্রণয়। একটু অবাকই হয়েছিল সে তরীর ডাক শুনে। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য। খুব একটা বেশি সময় নেয়নি নিজেকে ধাতস্ত করতে। ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে টেবিলে গিয়ে বসলো। নিজে নিজে খাবার বাড়লো। খেতেও শুরু করলো। তারপর রান্নাঘর থেকে তখনো খুটখাট শব্দ শুনতেই ভ্রু কুঁচকালো সে। উঁচু কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
—“তরী? তুমি কি এখনো যাও নি?”
প্রণয় কি এ প্রথম তরীর নাম ধরে ডাকলো? হয়তো। তরী কিছু মনে করলো না। ডাকতেই পারে। সে তো তরীর বড়।

তরী গুটিগুটি পায়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো। জবাব দিলো, “যাইনি। আপনার কিছু লাগবে?”
—“না। এমনি, জানতে চাইছিলাম।”

কথাটা আবার গম্ভীর শোনালো। তরী আবারও ভাবতে বসলো প্রণয়কে নিয়ে। এ লোক আসলে কি? কি চায়? একেক সময় একেক রুপ দেখায় কেন? তার এমন অদ্ভুদ আচরণের জন্যই তরী প্রণয়ের সামনে আসতে অস্বস্তি বোধ করে। এখনো করছে। অস্বস্তি নিয়েই চলে যেতে নিলে প্রণয় হঠাৎ জিজ্ঞেস করে উঠে, “তোমাদের বাড়ির উঠানে একটা বকুল গাছ আছে, তাই না?”
—“হ্যাঁ। আপনি জানলেন কিভাবে?”

একটুখানি চমকেই বললো তরী। খাবার চিবুতে চিবুতে প্রণয় নির্বিকার স্বরে উত্তর দিলো, “দেখেছিলাম ছোটবেলায়। তোমাদের বাসায় যে সবসময় ছোট ছোট দুটো বেণি করে ঘুরতো, সেটা তুমি ছিলে না?”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here