তোমার_আমার_প্রণয় #israt_jahan_arina #part_4

0
1449

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_4

আজ অফিসে এসে দৃশ্য একটু অবাক হলো। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ অফিসে ডিসিপ্লিনের মাত্রাটা একটু বেশি। মিস লুবনার আন্ডার এ যারা কাজ করে তারা সব সময়ই অনেক বেশি ডিসিপ্লিন মেনটেন করে। তা না হলে মিস লুবনা তো সবাইকে কাঁচা লবণ দিয়ে মিশিয়ে খেয়ে ফেলবে। তবে বাকি ডিজাইনারগুলো লুবনার তুলনায় একটু কম টর্চার করে। যার ফলে মাঝে মাঝেই তাদের আন্ডারের লোক গুলোর মধ্যে কিছুটা অলসতা দেখা যায়। তবে আজ সবাইকে ভীষণ চটপটে মনে হচ্ছে। বিষয়টা ক্লিয়ার হতে দৃশ্য তার কলিগ ঈশিতাকে জিজ্ঞাসা করলো ঘটনা কী? ঈশিতা জানানো ফ্যাশন হাউজের ওউনার আজ অনেকদিন পর আসছে।
সকাল থেকে দৃশ্য মিস লুবনার পেছনে পেছনে ঘুরছে। মিস লুবনার মাথা আজ বেশ গরম। তার বেশ কয়েকটা ড্রেস এখনো রেডি হয়নি। ড্রেস মেকারদের এতক্ষণ ভীষণ ঝেরেছে। ডিসিপ্লিন হীন মানুষ মিস লুবনা একদমই পছন্দ করেনা। তাই দৃশ্য বেচারীও ভয় আছে কখন না তাকেও বকা শুনতে হয়।

লাঞ্চ শেষে দৃশ্য করিডোরে দাঁড়িয়ে একটু রেষ্ট নিচ্ছে। পা দুটিও আজ কেমন অসাড় হয়ে আসছে। লুবনার পিছনে দৌড়ে তার পা ব্যথা হয়ে গেছে। তবে দৃশ্য মাঝে মাঝে অবাক হয়। মিস লুবনার কাজের এনার্জি কখনো কমেনা। মহিলাটার কিছু কাজ বিরক্ত লাগলেও তার অনেক হেবিট দৃশ্যর খুব ভালো লাগে।তার জীবনে এমন মানুষ সে আর একজনকে দেখছে।আর সে হলো তার স্কুলের আতিক স্যার।তিনিও দৃশ্যকে ভীষণ দৌড়ের উপর রাখতো।দৃশ্য হটাৎ পুরনো দিনে হারিয়ে যেতে লাগলো।

সেদিন ওই মানুষটাকে জব্দ করতে পেরে সে ভীষণ খুশি ছিলো।আসলে তার কাজই সারাদিন বাঁদরামি করে বেড়ানো।এতে করে তার মায়ের বকুনি কম খেতে হয়না।সন্ধায় সে বসে টিভি দেখছিল।মূলত ডরিমন তার ভীষণ পছন্দ।সোফায় বসে কার্টুন দেখছে আর হাসছে।কিছুক্ষণ পর তার মা মাগরিবের নামাজ পড়ে আসলেন।মেয়েকে এখনো টিভির সামনে দেখে ধমক দিয়ে বললেন

-“এই আযান কানে যায়না?”

-“যায় তো।”

-“তাহলে নামায না পড়ে এখনো টিভির সামনে বসে আছিস কেন? যা নামাজ শেষ করে পড়তে বস।”

দৃশ্য বিরক্ত হয়ে বলল
-“তোমাদের সব রুলস কি শুধু আমার জন্য? ভাইয়াতো এখনো বাসায় আসেনি কই তাকে তো কিছু বলো না?”

-“তুই নিজের চিন্তা কর যা রুমে যা।”

এমন সময় ফাহিম বাসায় ঢুকলো।দৃশ্যকে মন খারাপ করতে দেখে বললো

-“কিরে বুড়ি মন খারাপ?”

দৃশ্য কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো
-“কেউ আমাকে ভালোবাসে না যত বাধা আমার ক্ষেত্রে। শান্তিতে টিভিও দেখতে পারিনা।”

ফাহিম দৃশ্যর মাথায় চাপড় মেরে বললো
-“পরীক্ষা শেষ করে আরামসে টিভি দেখবি এখন যা পড়তে যা।”

দৃশ্য বিরক্ত হয়ে বললো
-“এখনি শেষ হয়ে যাবে ডরিমন শেষ করে তার পর যাবো।”

এমন সময় হঠাৎ ডোরবেল এর সাউন্ড শুনে দৃশ্য থতমত খেয়ে গেলো। সোফায় রিমোট ফেলে এক দৌড়ে রুমে চলে গেল। কারণ সে জানে এই মুহূর্তে তার বাবা বাসায় এসেছে। দৃশ্য তার বাবাকে ভীষণ ভয় পায়।

টিফিন আওয়ারে দৃশ্য আর তার বান্ধবীরা মিলে ক্যান্টিনে সিঙ্গারা সমুচা খাচ্ছে। হঠাৎই দৃশ্যের চোখ গেল সাইডের কর্নারের টেবিলের দিকে। সেদিনের সেই ছেলেটা আর তার বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। দৃশ্যর ক্লাসমেট ইভার কাছে জিজ্ঞাসা করলো

-“ওই ভাইয়াটা কে চিনিস?”

-“কোন ভাইয়ের কথা বলিস?”

-“আরে ঐ কর্নারের মাথায় ক্যাপ পরা ভাইয়া।”

-“ও ওটা মাহাদ ভাইয়া। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। জানিস উনি কি ভালো গান গায়।”

-“তুই কিভাবে জানলি উনি গান গায়,আমি তো আগে কোনদিন দেখি নাই।”

-“উনি কলেজে বেশি একটা আসে না।উনার গানের প্র্যাকটিস থাকে তাই ।আমাদের এলাকার একটা অনুষ্ঠানে গান গাইতে শুনছিলাম।”

-“ও এর জন্যই তো আমার চোখে পড়ে নাই।”

মৌ মুচকি হেসে বললো
-“কেন রে বান্ধবী ক্রাশ খাইছিস? ঐদিন এত করে বাঁশ দিয়ে এখন আবার ক্রাশ খাস?”

-“আজাইরা কথা রাখ।ক্রাশ কেমনে খায় তাই তো জানিনা।”

সায়মা এক্সাইটেড হয়ে বললো
-“তোরা খাইছিস কিনা জানিনা বাট ভাইয়াটাকে প্রথম দেখেই আমি সেই লেভেলের ক্রাশ খেয়েছি কি কিউট!”

দৃশ্য হেসে বললো
-“ওই তুই এমন লুচু কেনো?এতো দিন না বলতি ক্লাস টেনের সাব্বির ভাইকে ভালো লাগে? এখন আবার আরেক জন।”

-“আরে এই মাহাদ ভাইয়ের কাছে সাব্বির ভাই জিরো।”

সায়মার কথা শুনে তার বান্ধুবিরা হাসতে শুরু করলো।
পাশে জোরে হাসির আওয়াজ শুনে মাহাদ আর তার বন্ধুরা সে দিকে তাকালো।
মাহাদ তো কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই মুগ্ধ করা বাচ্চা মেয়েটার দিকে হারিয়ে গেলো।খিল খিল করে হাসছে দৃশ্য।
জয় বললো

-“ওই পিচ্ছিটা না?

তানিম বললো
-“যাই বলিস এই পিচ্চি কিন্তু কিউট আছে কি বলিস মাহাদ?”

তানিম মাহাদে দিকে তাকিয়ে দেখে সে ওই পিচ্চির মাঝে হারিয়ে গেছে।তাই মুচকি হেসে বললো

-“আমারতো মনে হয় শেষ পর্যন্ত না জানি এই পিচ্চিটাকে ভাবি বলতে হয়।”

তানিমের কথা শুনে মাহাদ সহ তার সব ফ্রেন্ডরা চোখ বড় বড় করে তাকালো।
তানিম বললো
-“আরে এই ভাবে আমার দিকে তাকানোর কি আছে?আমাদের মাহাদ যেই ডেব ডেব করে তাকায় ছিলো তো আমি কি করবো?”

মাহাদ বিরক্ত হয়ে বললো
-“বেশি বুঝিস তুই।”

স্কুল ছুটির পর দৃশ্য আর নাবিলা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।নাবিলা রাস্তায় টেইলার্সের দোকানে ঢুকলো।তার আম্মুর কিছু জামা বানাতে দিয়েছে।তাই আজ তাকে সেই জামাগুলো নিয়ে যেতে বলেছে।

দৃশ্য বাইরেই দাড়িয়ে রইলো।আকাশ মেঘলা তাই ঠান্ডা বাতাস বইছে।দৃশ্য তা উপভোগ করছে।হঠাৎ খেয়াল করলো রাস্তায় মানুষজন তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। দৃশ্য কিছুতে এর মানে বুঝতে পারল না। হঠাৎ পেছন থেকে ‘পিচ্চি’ নামটা ভেসে আসলো।সে পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলো মাহাদ নামের ছেলেটা দৌড়ে আসছে। মাহাদ বলতে শুরু করলো

-“তুমি শুধু দেখতেই পাচ্ছি না তোমার কাজেও তুমি পিচ্চি।”

দৃশ্য এই কথায় ততটা অবাক হলো না যতটা অবাক হলো ছেলেটার কাজ দেখে। ছেলেটার কথাগুলো বলছে আর শার্টের বোতাম খুলছে। দৃশ্য ভাবছে

-“আল্লাহ এই ছেলের মাথার তার ছেড়া নাকি? রাস্তার মাঝখানে শার্ট খুলতেছে কেনো?”

মাহাদ তার গা থেকে শার্টটা খুলে দৃশ্যের দিকে এগিয়ে আসলো। ভয়ে দৃশ্য কিছুটা পিছিয়ে গেলো। রাস্তার মাঝখানে এই ভাইয়া কি শুরু করেছে। দৃশ্যকে অবাক করে দিয়ে মাহাদ দৃশ্যের কোমরে শার্ট টা বেধে দিলো।

দৃশ্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেই দূসর চোখ জোড়ার দিকে। দৃশ্য এবার বুঝতে পারল আসল ঘটনা কি? ঘন্টাখানেক আগে থেকেই তার তলপেটে চিনচিন ব্যথা হচ্ছিল। পিরিয়েড এর ডেট সে বেমালুম ভুলে বসে আছে। এবার আর সে মাহাদের দিকে তাকাতে পারলো না। একরাশ লজ্জা তাকে ঘিরে ধরলো। ছি! কি বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হয়ে গেলো। দৃশ্য একবার আড়চোখে মাহাদের দিকে তাকালো। তার গায়ে একটা ছোট হাতার টি-শার্ট জড়ানো। আল্লাহ!এই ছেলে শার্টের নিচে টি শার্ট ও পরে?

মাহাদ বুঝতে পারল দৃশ্য ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে তাই সে কিছু না বলেই সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। যেতে যেতে সে একবার তার চুলে হাত বুলালো। কিভাবে কাজটা করল তার দৃশ্য জানে না তবে জিনিসটা তার খুব মনে ধরলো।
কিছুক্ষণ পর নাবিলা আসতেই দৃশ্যকে দেখে বললো

-“কিরে কোমরে কার শার্ট?”

দৃশ্য নাবিলাকে পুরো ঘটনাটা বর্ননা করলো। নাবিলা ভীষণ আফসোস নিয়ে বললো

-“দেখলি ছেলেটা কত ভালো আর তুই কিনা তার সাথে কত কিছু করলি।”

-“এখন সব দোষ আমার? আইসক্রিম কি সেদিন আমি একা খেয়ে ছিলাম নাকি তোরাও খেয়েছিস?”

সেদিন ভীষণ লুকিয়ে বাসায় ঢুকেতে হয়েছিল, না হলে মায়ের হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো। কোমর থেকে সাদা শার্ট বের করে দেখলো শার্টের গায়ে কিছুটা দাগ লেগে গেছে। সে দ্রুত শার্ট নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো।
আটটার দিকে ফাহিম বাসায় ঢুকলো। ঢুকে দেখল তার বাবা ড্রয়িংরূমের সোফায় বসে টিভি দেখছেন। ফাহিমকে দেখে তিনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন

-“কোনো ভদ্র বাড়ির ছেলে কি এত রাত পর্যন্ত বাসার বাইরে থাকে?”

ফাহিম কিছুটা কাচুমাচু হয়ে বলল
-“সরি বাবা আসলে আজ এক ফ্রেন্ডের বার্থডে ছিল তো তাই সেখানে গিয়েছিলাম। নেক্সট টাইম আর এমন হবে না।”
-“মনে থাকে যেন।”

ফাহিম যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে সোজা চলে গেলো দৃশ্যর রুমে। রুমে আসতেই দেখতে পেলো দৃশ্য টেবিলে বসে মোবাইল টিপছে।ফাহিম বিরক্ত হয়ে বললো

-“এই লেখাপড়া রেখে মোবাইলে কি সারাদিন?”

-“ইসস ভাইয়া তুমিও মায়ের মতো শুরু করো না তো?”

-“বাবাকে বলে তোকে মোবাইল নিয়ে দেওয়া একদম উচিত হয়নি।পরীক্ষায় লাড্ডু মারবি আর বাবা আমাকে কথা শুনাবে।”

-“বর্তমান যুগে কারো কাছে মোবাইল নেই এমন কি আছে? তুমি কি আমাকে ব্যাকডেটেড রাখতে চাও?”

-“কথা কম বলে পড়তে বস, আর তোর জন্য আইসক্রিম এনেছিলাম। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে লুকিয়ে ফ্রিজ থেকে বের করে খাবি। না হলে মা আবার আমার উপর চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করবে।”

দৃশ্য ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে বললো
-“থ্যাংক ইউ ভাইয়া আই লাভ ইউ।”

ফাহিম মুচকি হেসে বললো
-“লাভ ইউ টু বুড়ি।”

ফাহিম চলে যেতেই দৃশ্য আবার ফেসবুকে মাহাদকে সার্চ করলো।এতক্ষণ ফেসবুকে সে মাহাদকে খুঁজছিল। কিন্তু কিছুতেই তার আইডিটা খুঁজে বের করতে পারলো না। মাহাদের পুরো নামটা তার ঠিক জানা নেই। পুরো নামটা জানা থাকলে খুঁজে বের করাটা সহজ হতো। সে আবার নজর ফেরালো বারান্দার দিকে। বাতাসে এ শার্টটার দুলছে। আজ প্রথম সে নিজ হাতে কোন কাপড় পরিষ্কার করলো। সেটাও কিনা ওই ছেলেটার শার্ট?

আর যাই হোক এই শার্টটা বাসার কারো চোখে পড়ার আগেই ব্যাগের লুকিয়ে ফেলতে হবে। না হলে বাসায় লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে সে। তাই ছেলেদের সাথে খুব একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে না। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় একটা ছেলে তার সাথে কথা বলতে চাইতো। তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইতো। কোন ভাবে ফাহিম সেই খবর পেয়ে ছেলেটাকে সেই ধোলানি দিয়েছিলো। এর পর থেকে আর কোন ছেলে দৃশ্য সাথে লাগতে আসেনা। ফাহিম পাশের এলাকার একটা কলেজে পড়ে। সে এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। বাবার ক্ষমতার জন্যই এলাকায় তার পরিচিতি আছে।

হঠাৎ ঈশিতার ডাকে তার ঘোর ভাঙলো। ঈশিতা বললো
-“এই দৃশ্য কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাওনা?”

-“সরি আসলে খেয়াল করতে পারিনি, বলো কী হয়েছে?”

-“আরে লুবনা ম্যাম তোমাকে আজাদ ভাইয়ের কাছ থেকে ড্রেসগুলোও নিয়ে যেতে বলেছে। স্যার চলে এসেছে।উনার ড্রেসগুলো আজাদ ভাইয়ের কাছে আছে। লুবনা ম্যাম তোমাকে সেগুলি নিয়ে যেতে বলেছে।”

-“আচ্ছা যাচ্ছি থ্যাঙ্ক ইউ।”

দৃশ্য দ্রুত চলে গেল আজাদ ভাইয়ের কাছে। আজাদ ভাই মূলতো মিস লুবনার ডিজাইনকৃত ড্রেসগুলো মেক করে থাকে। দৃশ্য ড্রেস গুলো কালেক্ট করে ট্রায়াল রুমের দিকে এগুলো। কাপড়ের বড় বড় বক্স গুলোর জন্য দৃশ্য ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। কোনমতে ট্রায়াল রুমের টেবিলে বক্সগুলো রাখলো।কপালের ঘাম টুকু মুছে কোমরে হাত দিয়ে পিছনে ঘুরতেই সে ভীষণ শক খেলো। এই মানুষটা এখানে কি করছে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here