#নিনীকা
#পর্ব_১৩_ও_১৪
#পর্ব_১৩
সকালে ঘুম ভাঙতেই নিনীকা যে কথাটা প্রথম শুনলো তা হলো,
—ও ছুডু মেডাম সর্বনাশ! দাদীমার ঘরে ভুত আইছিলো। কইয়া গেছে বিয়ার আগে দোয়া পড়াইয়া মিসকিন খাওয়াইতে হবে।
—ঠিক কতজন মিসকিন এসব কি কিছু বলে গেছে খালা?
—না। জিগাইয়া আমু?
—এই ঘটনা তোমাদের জামাইকে বলেছো?
—জামাই কেডায়?
—রওনক রাজ! দ্য কিসিং ম্যান। সেও তো এখন এ বাড়ির মানুষ হতে যাচ্ছে। ভুত সাহেবকে তো তারও চেনা দরকার।
—ও আল্লাহ! কন কি? ভুতের খবর হুনলে মাইন করবো না?
নিনীকা রওনকের নাম্বার ডায়াল করলো। মোবাইল এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
—করলে করবে। নাও খালা, কথা বলো!
নাসিদা খালা বিভ্রান্তের মতো মোবাইল হাতে নিলেন।
—ও ছুডু স্যার! দাদীমার ঘরে ভুত আইছে। আপনের দাওয়াত!
বলেই খালা মোবাইল ফেলে দৌড় দিলেন।
রওনক ফোন ধরে থতমত খেয়ে গেল। মানেটা কি? নিনীকার নাম্বার না?
—হ্যালো.. হ্যালো। ডক্টর নিনীকা…
হাই তুলতে তুলতে নিনীকা বললো,
—বলুন দুধ রাজ! কেমন আছেন?
রওনক আবার ফোন নাম্বারটা দেখলো। গলা তো নিনীকার মতোই, তাহলে?
—কে বলছেন?
—আমি ভুত মিল্ক সাহেব। আমাদের বাসায় ভুত এসেছে, দেখে যান এসে।
রওনক মাথা চুলকে বললো,
—কিছুই তো বুঝতেছি না। মানে কি?
—মানে হলো আপনি এখন গন্ধময় দুধ রূপে আছেন। ভেরি সুন আমি আপনাকে দই বানিয়ে খেয়ে ফেলবো। দই ইজ মাই ফেভারিট।
রওনক সাথে সাথে ফোন রেখে দিলো। ও মাই গড!
দুধ রাজটা কে? তাকে দই বানিয়ে খেয়ে ফেলারই বা কারণ কি? কার সাথে কথা বলছে সে?
নিনীকা হাসলো। আচ্ছা, তার হয়েছেটা কি? এসব কথা রওনককে সে কেন বলছে? রাতেই তো সে খুব রাগ করেছিলো?
পেপার খুলেই নিনীকা বিষম খেলো! ফ্রন্টপেজে ছবিসহ নিউজ। অবশেষে সিংগেল তকমা ঘুচতে যাচ্ছে বাংলার চকলেট বয়ের। কনে ডাক্তার!
সাথে নিনীকা আর রওনকের ছবি।
নিনীকা বিস্তারিত পড়লো না আর। মনে মনে বললো, রেডী হয়ে যাও নিনীকা এখন থেকে তুমিও ‘খবর’!
বের হবার সময় নিনীকা রান্নাঘরে উঁকি দিলো। করুণ কণ্ঠ করে মা’কে ডাকলো,
—মা, মিসকিন খাওয়াবে ভালো কথা। ভুত তোমাদের জামাইর কথা বলেনি বলে কি তোমরা তাকে ইনভাইট করবে না, এটা কেমন কথা?
বিস্ময়ে হা করে মাহবুবা বললেন,
—জামাইটা কে?
—বাহ্, জামাইকেই এখন চিনতে পারছো না! আমি খুব কষ্ট পেয়েছি মা। কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছি।
নিনীকা দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল। মাহবুবা অবাক হয়ে মেয়ের যাবার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
রাতে নিনীকা ফিরেই দেখলো রওনকের মা এসেছেন।
তিনি নিনীকার জন্য অপেক্ষা করছেন।
—বিয়ের কনের বুঝি এত কাজ করতে হচ্ছে এখন?বিশ্রাম নেই?
এপ্রনটা খুলতে খুলতে নিনীকা বললো,
—ভালো আছেন?
—তুমি তাড়াতাড়ি আসো আমার বাড়িতে, তাহলেই আমি ভালো থাকবো। খুব খাটতে হয় বুঝি?
—এই তো! নাম করতে গেলে তো একটু খাটাখাটনি করতেই হয়।
—তোমার এমনি নাম হয়ে যাবে, দেখো। এপ্রন গায়ে পেন্সিল হিলে কটকট করে যখন তুমি হাসপাতাল ঘুড়ে বেড়াও, কি যে আদর লাগে দেখতে! আমার তো মনে হয়, তোমায় দেখেই রোগীর অর্ধেক রোগ ভালো হয়ে যায়।
—আপনি কি একাই এসেছেন?
—রওনকের প্রোগ্রাম আছে। তুমি ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নাও আগে, তারপর কথা বলবো।
—এক কাজ করুন আপনি আমার ঘরে এসে বসুন। ফ্রেশ হতে আমার দুমিনিট লাগবে।
রেবেকা নিনীকার ঘরে এসেই বিছানায় হেলান দিয়ে বসলেন।
—গান শুনেন তো নাকি?
—হুঁ…
মিউজিক প্লেয়ারে লো ভলিউমে একটা গান চালু করতে করতে নিনীকা বললো,
—আপাতত এই শিল্পীর সাথে থাকুন, আমি চট করেই আসছি।
—তোমার রুমটা খুব সুন্দর, নিনীকা। শান্তিময়, ভালোবাসাময়! কে সাজালো?
—আর আপনার ছেলের ঘর বুঝি পঁচা? চা খাবেন?
—দুবার হয়ে গেছে এর মাঝে। হারমোনিয়াম যে ঘরে, তুমি গান গাও?
—একটু আধটু করি। বাসায় খুব বকা দেয়। শখের বশে করা হয়, সিরিয়াসলি নয়।
—যখন আমাদের সাথে থাকবে, কেউ বকবে না। তুমি ইচ্ছেমত গান গাইবে। রওনকের বাবাও চমৎকার গাইতেন!
—রওনক গান ভালোবাসে না?
—রওনক কি ভালোবাসে আর বাসেনা, সেটা জানতেই তো তোমাকে নিয়োগ করা হচ্ছে। এটা কি?
—রেডিয়াম মার্কার। যাতেই আপনি মার্ক করবেন, অন্ধকারে সেটা জ্বলবে। একটা মেডিসিন কোম্পানি দিলো আমায়। এটা নেবেন আপনি?
—মজার তো। অফ কোর্স নিবো। রওনককে ভয় দেখানো যাবে।
—এত বড় হিরোও ভয় পায়?
—রওনক তো বাইম মাছ দেখলেই সাপ সাপ করে ভয় পায়।
নিনীকা শব্দ করে হেসে ফেললো। ওয়াশরুমের দরজার দিকে যেতে যেতে নিনীকা বললো,
—আপনাকে কি বলে ডাকবো? ‘মা’ বলতে লজ্জা করছে।
গভীর মমতা ভরা চোখে রেবেকা নিনীকার দিকে তাকালেন। মনে মনে বললেন, তুমি এতো ভালো কেন নিনীকা?
হেসে বললেন,
—তুমি আমায় আন্টি বলতে পারো তো!
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে নিনীকা দেখলো রওনকের মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাঁথাটা গায়ে টেনে দিলো নিনীকা। মানুষটা এত ক্লান্ত ছিল নাকি? বাতিটা নিভিয়ে নিনীকা বারান্দায় এসে রওনককে ফোন করলো,
—হ্যালো মিল্ক মিঞা, কি করেন?
রওনক একটা প্রোগ্রামে তখন। একটু আড়ালে এলো। বিরক্তির সাথে বললো,
—এই মিল্ক ব্যাপারটা কি? সকালেও বললেন। ফোন করে ভুতের দাওয়াত দিচ্ছেন। এগুলোর মানে কি?
—বলবো না। এগুলো রহস্য।
রওনক হতাশভাবে আবার ফোনস্ক্রিনটা দেখলো। নিনীকাই তো! এমন অদ্ভূত কেন মেয়েটা?
—এখন ফোন কেন?
—আপনার মা আজ রাতে আমার সাথে থাকছেন। আপনি রাতে ভয় পেলেই ফোন করবেন কিন্তু।
—রাতে থাকছেন মানে? মা কোথায়? ফোনটা দিন তো তাকে।
—উনি ঘুমিয়ে আছেন। ভিডিও কল দিন দেখাই।
—না থাক দরকার নেই। রাখছি।
—শুনুন শুনুন… রাখবেন না।
—আর কি বাকি?
—গুড নাইট বলা বাকি।
—আচ্ছা, গুড নাইট!
—আরেকটু বাকি।
—হু বলুন…
চোখ বন্ধ করে নিনীকা দ্রুত বললো,
—আমায় মিষ্টি করে একটা গুড নাইট কিস দিন তো।
—মানে?
—মানে হলো, হে চুমু দূষিত নায়ক আমায় একটা শুভরাত্রির চুমু দিন।
রওনক কোনোমতে বললো,
—আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
—ঢং! বুঝতে পারছেন না। ফোনে একটা চুমু দিবেন; এত দাম দেখাচ্ছেন কেন?
—পারবো না।
রওনক ফোন রেখে বিস্মিতভাবে সোহেলকে ডাকলো,
—সোহেল, এক্ষুণি গাড়ি নিয়ে যাও। মা’কে নিয়ে আসো।
সোহেল এসে পড়লো মহাবিপদে! নিনীকা ম্যামের বড় ফুফু তাকে নিয়ে বিয়ের লিস্ট করতে বসেছেন। সে যেতে পারছে না। রওনক ফোন করতেই ফুফু বলে দিলেন,
—সোহেল আজ এখানেই থাকবে। তোমার সমস্যা নেই তো, জামাই?
রওনকের সব হ-য-ব-র-ল লাগছে। এই নিনীকা মেয়েটার সমস্যা কি? যেই তার বাড়ি যাচ্ছে, আটকে যাচ্ছে!
নিনীকা কি একদিন তাকেও আটকে ফেলবে?
#পর্ব_১৪
প্রতিদিনই নিনীকার পত্রিকা খুলে আৎকে উঠতে হচ্ছে। আজ এ নায়িকার বিবৃতি, কাল আবার অন্য নায়িকার। সব নায়িকাই বলছে, রওনক তাদের ভালোবেসেছে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে নিনীকা একদিন শুধু বলেছিলো,
—কত মেয়ের সাথে উনার ঢলাঢলি দেখেছো দাদীমা?
যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে দাদীমা বললেন,
—ঢলাঢলি করলে কি হয়েছে? শরীর কি ক্ষয়ে গেছে নাকি? তোর দাদাভাই আমায় বিয়ে করলেন, দ্বিতীয় তরফের বউ করে। তাই বলে কি আমি কম সুখী? আমি কি ছেলেমেয়ে পাই নাই? বরং প্রথম বিয়েটা করায় তোর দাদুভাই’র বুদ্ধি খুলে গিয়েছিলো, তিনি আরো সুন্দর করে আমার সাথে সংসার গোছাতে পেরেছিল।
—মা, যুক্তি দেখেছো দাদীমার? দাদীমার কথায় আমার তো মনে হচ্ছে প্রত্যেক মেয়েকেই এমন ছেলের কাছে বিয়ে দেয়া উচিত যে আগে আরেকটা বিয়ে করেছিলো। অভিজ্ঞ বর হবে তাহলে।
মা বিরক্ত মুখ করে চা ঢালতে ঢালতে বললেন,
—ওসব ফেইক নিনীকা। তাঁর মা ক্লিয়ারলি বলেছেন, রওনক শুধু উনার পছন্দেই বিয়ে করতে চেয়েছে আজীবন। আর এসব সত্যি হলে সে মিডিয়ার বাইরে বিয়ে করতো না নিশ্চয়! কই আমরা তো কথা বলছি না এসব নিয়ে? তুই ঘাটছিস যে বড়!
—হিংসে হয় মা! আমার তো তোমাদের জামাইকে আরো আগে বিয়ে করে নেওয়া দরকার ছিল। উফ্ কত চিন্তা লাগছে আমার জানো?
—বিয়ের কথা হবার পর থেকে সকাল বেলাগুলোতে তোর কি হয় নিনী? নাশতায় বসে এরকম বিয়ে বিয়ে করে মাথা না খেলে হয় না? তুই তো এমন ছিলি না নিনী? কি যে বিয়েপাগলী হয়ে গেছিস তুই! পড়াশোনা তো ডুবাচ্ছিস!
—তোমাদের জামাই আমাকে জাদু করেছে মা।
নিনীকা গুণগুণিয়ে উঠলো,
“দিনে ঘুড়বো পথে পথে…
রাতে খাবো হাওয়া….
বলুক সবাই এই মেয়েটা
বিয়ের বড়ি খাওয়া…..”
দাদীমা গানে তাল দিতে থাকলেন। মাহবুবা রেগে বললেন,
—চুপ কর নিনী। নাশতা কর আগে।
—মা এনগেজমেন্ট পরশু কেন? কাল করে ফেললে কি হয়? মা, গুণীরা কি বলেছেন জানো? বলেছেন যে,
“কোনো কাজ আগামীকালকের জন্য ফেলে রাখতে নেই… সব আজকেই করো। আজকে করবে তো, এক্ষুণি নয় কেন?”
—পাগলামি করিস না নিনী? অলরেডি নিউজ হয়ে গেছে সব মিডিয়াতে। ওয়েডিং প্ল্যানাররা ওভাবেই সব প্ল্যান করছেন। রওনকের ইমেজের ব্যাপার জড়িয়ে আছে এতে। রিসেপশান পর্যন্ত সব ডেট এনাউন্স হয়ে গেছে।
এপ্রন হাতে নিয়ে উঠতে উঠতে নিনীকা বললো,
—তোমাদের জামাইকে নিয়ে কেন এত নিউজ হয় মা? এত হ্যাপেনিং ম্যান কেন? হট এন্ড হ্যাপেনিং, হুহ!
মাহবুবা মুখ কুঁচকে তিরিক্ষি মেজাজ করে বললেন,
—মানে কি? একটু পরপর দশবার করে বলছো, তোমাদের জামাই, তোমাদের জামাই। ছেলেটার তো একটা নাম আছে নাকি?
দাদীমা শক্তভাবে বললেন,
—আমি মানা করছি নাম মুখে নিতে। স্বামীর নাম বারবার মুখে নিলে হায়াত কমে যায়!
—এসব কুসংস্কার তুইও মানছিস নিনী?
মা’কে চুমু খেয়ে বাই বলতে বলতে নিনীকা বললো,
—আমি হলাম পতিব্রতা নারী মা। ও’র ব্যাপারে আমি কোনো রিস্কে যাবো না মা। এক চুটকি সিন্দুর কি কিমাত তুম কেয়া জানো মাতা জি?
মা এইবার হেসে ফেললেন।
—তুই একটা পাগলি নিনী! দুষ্টুর হাড্ডি মেয়ে।
বেড়িয়ে যেতে যেতে নিনীকা মনে মনে বললো, আমি জানি মা আমার এই আহলাদী কথাগুলো তুমি খুব ভালোবাসো। শুনলেই খুশি হও। তোমাকে খুশি করতে আমি সব ভেলকি করতে রাজি মা। আমি কেন তোমার মতো হলাম না বলো? বাবার এত গুণ পেলাম! গান তো আমি চাইনি, গান গাইয়ে ছিচকাঁদুনে টাইপ মেয়ে আমি হতে চাই না মা। আমি চাই তোমার সব গুণগুলো আমার মাঝে জেগে উঠুক।তোমার সমস্ত নারীত্বের শক্তি এসে আমার মাঝে ভর করুক। লাভ ইয়ু মা!
এনগেজমেন্ট প্রোগ্রামের আগে রওনককে ফোন করেছিলো নিনীকা। কথা বললো সোহেল। রওনক ব্যস্ত। পুরো অনুষ্ঠানে রওনককে সে পেলো একজন যন্ত্রমানব রূপে! আংটি বদলের পর ফটোসেশনের সময় নিনীকা মন থেকে বারবার চেয়েছে, রওনক তার হাত ধরুক, গাঢ় হয়ে পাশে বসুক কিন্তু রওনক কিছুই করেনি এসবের। একবার তো নিনীকা ইচ্ছেই করেই রওনকের গা ঘেঁষে বসলো। পায়ে পা দিয়ে গুতো দিলো। রওনক ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। বিনীত মুখ করে বললো,
—স্যরি স্যরি আপনার লাগেনিতো, ডক্টর?
নিনীকা মনে মনে বললো, লেগেছের পাঁঠা, মনে লেগেছে। এমন ভাব করছিস যেন আমি তোর গুরুজি! নিনীকার ইচ্ছে হলো, হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলতে, নেরে ভক্ত প্রণাম কর! পা লেগেছে তো, মহাপাপ! এক কাজ কর, মাটিতে গড় করে প্রণাম কর। ছাগলা নায়ক!
কষ্টটা চেপে নিনীকা যেন টেরই পায়নি এমনভাবে বললো,
—কেন, কি হয়েছে? শুধু শুধু লাগবে কেন আমার?
রওনক ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেল।
ব্লাক স্যুটের সাথে ডার্ক মেরুন শার্টে রওনককে কি যে সুপার দেখাচ্ছিলো। একটু পরপর চুলে আঙুল ঢুকিয়ে চুল নেড়ে দিচ্ছে। শালা সে তাহলে খুব ভালো করেই জানে কি করলে তাকে আরও ভালো দেখায়। হাসি আর কথা বলবার সময় রওনকের উপরের ঠোঁটটা একপাশে একটু উঠে যায়। আহ্ ও চেহারা দেখেও কি শান্তি! ট্রয়নগরীর রূপবতী হেলেনকে নিয়ে যুদ্ধ হয়েছিলো; নিনীকার মনে হলো, রওনককে নিয়ে একটা যুদ্ধ হলে মন্দ কি?
খেতে বসতে গিয়ে নিনীকা ইচ্ছে করে চেয়ারটা কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে রওনকের হাত চেপে ধরলো। রওনক হাতটা পুরা নিস্তেজ করে ছেড়ে দিলো, যেন প্যারালাইজড! নিনীকাই হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,
—রক্ত চলাচল তো করছে না বোধহয়! রক্ত আছে তো? এত ঠান্ডা হাত! কচুশাক-টাক, আয়রন ট্যাবলেট ফেবলেট খান তো!
পার্টির শেষে ডিসাইড করা হলো, রওনক নিনীকাদের বাসা ঘুরে যাবে। পাকা কথা যেহেতু হয়েই গেছে, এখন তো আর যেতে বাঁধা নেই। নিনীকা সেঁধেই বললো,
—পাপা, আমাদের বাসায় যেহেতু যাচ্ছে আমি ড্রাইভ করে নায়ক সাহেবকে নিয়ে যাই? স্পেশাল অনার!
পাপা দারুণ আনন্দিত হয়ে বললেন,
—এতো আরো ভালো হলো মামণি। এ সুইট জার্নি যাস্ট আফটার দ্য এনগেজমেন্ট।
রওনকের পিঠ চাপড়ে পাপা বললেন,
—তোমার তো শাহী কপাল হিরোসাহেব। বিয়ের কনে স্বয়ং ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছে তোমায়। গুড লাক!
সোহেল আগ বাড়িয়ে বললো,
—আমিও যাই স্যারের সাথে?
নিনীকা কঠিন গলা করে বললো,
—তোমার হিরো স্যার কি আমার সাথে যেতে ভয় পাচ্ছেন? কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে কি আমি তাঁর কিডনি বেঁচে দিবো? আমি কি ছেলেধরা?
সোহেল আর সাহস পায়নি।
রওনকের যেন ব্যাপারটা পছন্দই হলো না। অথচ নিনীকা মনে মনে চাইছিলো, তারা দুজনে একান্তে সময় পাক একটু। একটু নিরিবিলি কাটাক। সবসময় বডিগার্ড আর ম্যানেজার!
ড্রাইভিং সিটে বসেই নিনীকা মনে মনে বললো, রেডী হয়ে যাও নায়ক! দেখে নাও তোমার বউ আরও কত কি পারে? বউ তো সবাই পায় কিন্তু এমন গুণবতী বউ ক’জনে পায়?
পাশের সিটে বসে রওনক ক্রমাগত মোবাইল স্ক্রিন স্ক্রল করে যাচ্ছে।
নিনীকা গান ধরলো,
“পদ্মদিঘীর পদ্ম আমি…
তুমি জলের ঢেউ..
বলবো দুজন মনের কথা
শুনবে না তো কেউ…”
রওনক মোবাইলে আরও মনোযোগী হলো। স্পষ্ট ইগনোর! হহ। নিনীকার ভেতরে থেকে তিন মাইল লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
আচ্ছা মানুষটা কি? নিনীকার দিকে ভালো করে তাকালে কি হয় একটু? আরো কাছে এসেও তো বসা যায় নাকি? সে কি চট করে নিনীকাকে একটু জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে নিতে পারে না? নিনীকার তো স্টিয়ারিং হুইলে হাত। সে তো বাঁধাও দিবে না একটু। এই যে নিনীকা গাল পেতে আছে। গরুটা কি বুঝে না? নিনীকা কষ্টবোধ থেকে ফিসফিস করে উচ্চারণ করলো, “রামছাগল, রামবলদ, রামভেড়া, রামমহিষ আর রামগাধা নায়ক একটা!
হতাশ হয়ে স্পিডটা তুলে দিলো আরেকটু সে। রওনক তখনি কথা বললো,
—পার্টির মাঝখানে আপনি একবার কোথায় গিয়েছিলেন ডক্টর?
উত্তর দেবার অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে নিনীকা বললো,
—গিয়েছিলাম নাকি? ওয়াশরুমে হয়তো!
—এতক্ষণ ওয়াশরুমে কি করলেন? এবাভ ফিফটিন মিনিটস হবে!
নিনীকা মনে মনে বললো, নাচতে গেছিলাম রে বোকার ডিম! হবু বউকে একা পেয়েছিস, রোমান্টিক কথা বলবি, আদর টাদর করবি একটু। তা না করে জিজ্ঞাসাবাদ করছিস, পার্টির মাঝখানে ভাগলি কেন?
মুখে বললো,
—মেকআপ ঠিক করতে হলো, তাই সময় লেগেছে। আপনি এসবও খেয়াল রাখেন নাকি?
—গেস্টরা খোঁজ করছিলো, তাই চোখে পড়লো। আংটিও তো দেখি খুলে ফেলেছেন, কেন?
হাতটা দেখে নিনীকা একটু ভাবলো। আংটিটা সে একটা বিশেষ কারণে খুলেছে। একজন বিশেষ মানুষের কষ্ট কমাতে খুলেছে। এই বিশেষ মানুষটার সাথে নিনীকার আজই প্রথম কথা হয়েছে। অথচ মানুষটা তাকে চেনে অনেক মাস আগে থেকে।
একটু হেসে জবাব দিলো,
—-ও’তে সাবান আটকে যাবে, চুলে লেগে আবার চুল ছিড়বে। আই হেইট অর্নামেন্টস। হাতের চুড়িও তো খুলেছি। দেখেন হাত চুলকে গুটি শুটি উঠে গেছে। সার্জন হতে গেলে গয়না এমনিতেই ছাড়তে হয়।আমার ভালো লাগে না।
—গয়না ভালোবাসেনা এমন মেয়েও আছে তাহলে! বাঁধিয়ে রাখা দরকার আপনাকে।
—আমার তো সাজুগুজুতেও বিরক্তি। কানের দুলও পরে ঘুমাতে পারি না, খোঁচায় খুব। গলায় তো বারমাসি পাতলা চেইনও না, শুতে গেলে গলায় উসখুস করে। এই যে ভারি কানের দুল, এর অনেক শাস্তি পেতে হবে আমায়। কান ব্যথা করছে এখনি।
—বিয়েতে খরচ বাঁচলো আমার। গয়না বিদ্বেষী কনে!
—বাঁচবে না। গয়নাগাটি আমি তো নেবোই। পরে বিক্রি করে দিয়ে লিকুইড ক্যাশ করে ফেলবো। তারপর ফাটিয়ে খরচা। হাতি, ঘোড়া আর রাজ্য কিনবো।
রওনক হাসলো। নিনীকা তাকিয়েই বললো,
—এত মিষ্টি করে কেন হাসেন আপনি? মাথা ঘুড়ঘুড় করে আমার দেখে।
গেটে পৌঁছে নামবার আগ অবধি নিনীকা অপেক্ষা করলো, রওনক অন্তত মিষ্টি করে একটা কথা বলবে।জেদে দাঁত কেটে মনে মনে বললো, একটু তাকা না শালা, দেখ কোমরের কাছে শাড়ি গুজার কাছটায় আমার পেটে কত সুন্দর একটা হালকা ভাঁজ পড়ে। দেখ না শালা! তুই তো দেখার সুযোগ পাচ্ছিস।
শুধু নিনীকা জানে, এ জীবনে এই সুযোগ নিনীকা আর কাউকে কোনোদিন দেয়নি।
রওনক একটি বারের জন্যও তাকালো না। এরকম উদাসীন হলে নিনীকা কেমন করে একটা ভালোবাসার সংসার সাজাবে?
নিনীকা গাড়িতে বসে থেকেই বললো,
—আপনি যান পাপাদের সাথে আমি একটু বাদেই আসছি। এন্ড ওয়েলকাম টু আওয়ার সুইট হোম।
রওনক নেমে গেল মোবাইল গাড়িতে ফেলে গেছে, নিনীকা পিছু ডেকে তা হাতে করেও দিলো না।
তার ভালো লাগছে না। একদম না! রওনক এমন কেনো? কিসের এত অপেক্ষা তাঁর? কিসের ভাবনা?
মনখুলে একটু নিনীকার সাথে কথা বললে কি ক্ষতি?
তাহলে কি ওই অত বছর আগে ঘটনায় কি সে এখনো আটকে আছে? না না এ হতে পারে না।
নিনীকা গাড়িতে চাবি লাগিয়েই নেমে গেল। পা চলছে না তার। সমস্ত শরীর ভারী লাগছে। পা টেনে দ্রুত হাঁটছে সে। মনে হচ্ছে, টলে পরে যাবে সে এখনি!
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা