নিনীকা #পর্ব_১১_ও_১২

0
290

#নিনীকা
#পর্ব_১১_ও_১২

#পর্ব_১১

এত আলোতে নিনীকার বেশ অস্বস্তি লাগছে। চোখের আলগা পাপড়িতে চোখ জ্বালা করছে। চোখ করকর করে বারবার পানি চলে আসছে। এই দুঘন্টায় রওনকের সাথে তার কথা হয়েছে খুব অল্প। আর সে রওনকের পাশে দাঁড়াতে পেরেছে মাত্র পাঁচমিনিট, তাও ফটোশুটের জন্য। ভালো করে তাকিয়ে দেখাও হলো না! রওনক শুধু একবার জিজ্ঞেস করলো,
—-হেই ডক্টর, আপনার আর কোনো বন্ধু কি বাকি আছে? খুশি তো? সব আপনার মনমতো হয়েছে তো?
স্পষ্ট খোঁচা! অথচ রওনক এত নম্রভাবে বলল যে নিনীকাকে হেসে বলতে হলো, না না সব ঠিকাছে।
রওনকের একটা জিনিস বেশ সুন্দর। কথা বলার সময় সে হাত নেড়ে নেড়ে কথার সাথে ম্যাচ করে।এসময় তাঁর ফর্সা রক্তলাল হাতের তালু দুটো কি যে চমৎকার দেখায়! ইচ্ছে করে টুপ করে ধরে গালে ছুঁইয়ে দিতে। নিনীকা মনে মনে ভেবে ফেললো, বিয়ের পর বৃষ্টির রাতগুলোতে যখনি তারা গল্প করবে, রওনকের হাত দুটো তার গালে চেপে ধরে রাখবে।

এত এত ক্যামেরার ফ্লাশের আলো, চোখের সাথে সাথে এখন বুঝি নিনীকার শরীরও পুড়িয়ে দিচ্ছে।রওনকের সাথে দুমিনিট বসবার সুযোগও হচ্ছে না।
আর রওনক? সে তো বাকিদের সামলাতেই ব্যস্ত। তবে এসবের মাঝে একটা জিনিস খুব চোখে পড়ার মতো, রওনকের একটুও বিরক্তি নেই, ক্লান্তি নেই! সবাইকে হেসে ফেইস করছে। যেন তাঁর কত ভালো লাগছে এসব! এদিকে বিরাট গন্ডগোল। গেস্ট দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নিনীকাদের জন্য বুকড টেবিলও দখল।
ফুফু এক কোণায় দাঁড়িয়ে সোহেলের সাথে সমানে ঝগড়া করে যাচ্ছেন।
—তোমার কি আক্কেল বুদ্ধি একেবারেই নেই নাকি?একেক টেবিলে পদ রেখেছো ১২টা করে। কত বিল আসবে ভেবেছো? আমাদের জামাইকে তো ভিখিরি বানানোর তাল করছো।
—আমরা তো আসলে আপনাদের কথা ভাবলাম।আপনাদের দিকের গেস্ট, কোনো কমতি থাকলে তো চলবে না।
—আমরা কি বলেছি আমাদের গেস্ট হলেই হাতি ঘোড়া খাইয়ে দিতে হবে? আইটেম তো ৪-৫ টে হলেই চলে। পরের টাকা পেয়েছো তো! আমার সাথে বুদ্ধি ফলাও? বুদ্ধির কি বাহার? দই রেখেছো ভালো কথা, আবার বোরহানি কেন? খাওয়ার বিলই তো আসবে, তিন-চার লাখ টাকা!
—এতো আসবে না ম্যাম।
—আমাকে বুঝাতে আসবে না ছেলে। দাঁড়াও বিয়েটা হতে দাও আগে, জামাইকে বলে তোমার ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সোহেল মনে মনে বললো, ব্যবস্থা লাগবে না, আপনি এরকমভাবে বকলে, আমিই চাকরি ছেড়ে দিবো।

নিনীকা অধৈর্য্য হয়ে পড়লো। তার নিজের বন্ধুদের কান্ডে বিরক্তিতে তার কপাল চাপড়াতে মন চাচ্ছে!
নিজে প্রেস এলাউ করতে বলে ফেঁসে গেছে। এর মধ্যে জার্নালিস্টদের স্ট্রেঞ্জ সব প্রশ্ন তো আছেই।
—ম্যাম, স্যারের সাথে আপনার প্রথম দেখা কোথায়?
নিনীকা কি বলবে? আরে ও বলদের দল, এটাই তো আমাদের প্রথম দেখা ছিল। তোরাই তো মাটি করছিস!
নিনীকা হেসে জবাব দিচ্ছে,
—পরে ইন ডিটেইলে সব বলবো। ধন্যবাদ।
এই থেকে বেরোবার পথ কি? পার্টি তো রাত দুটোতেও শেষ হবে না। এখন মাত্র ন’টা! উফ্। রওনক এসবের মধ্যে সারাবছর কিভাবে কাটায়? এটা কোনো লাইফ হলো? সবসময় হাসতে হচ্ছে! নিনীকা কি পালিয়ে যাবে? পালানোর কি সুযোগ হবে? রওনককে একটু ভয় দেখালে মন্দ কি?
নিনীকা ফুফুকে ডাকলো,
—আমি ওয়াশরুম যাচ্ছি। প্লিজ ম্যানেজ করো এদিকটা।
—তা যা না। ওয়াশরুম যে যাচ্ছিস আমাকে কি সাংবাদিক ভাইদের ডেকে বলতে হবে, হে সাংবাদিক ভাইগণ… মিস নিনীকা রওনক রাজের উড বি…
—প্লিজ স্টপ ফুফু। তোমাকে বলে গেলাম। কেউ খুঁজলে বলবে।
নিনীকা খুব সাবধানে হ্যান্ডপার্সটা হাতে নিলো, এক্সকিউজ মি ফর টু মিনিটস… বলে দ্রুত সড়ে এলো। রওনক হেসে হেসে সেলফি এটেন্ড করছে সবার সাথে তখনো। দেখেনি তাহলে।

নিনীকা লিফট পর্যন্ত যেতেও পারলো না রওনকের ফোন। ফোনটা কি ধরবে? না।
লিফটে ঢোকে নিনীকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।ইশ্! হিরোদের কি এবনরমাল লাইফ। নিনীকার তো ভয়ই লাগছে বিয়ের ফাংশানগুলোর কথা ভেবে।
পার্কিং ফ্লোরে নেমে গাড়ির কাছে যেতেই নিনীকা একটা ছোটোখাটো ধাক্কা খেলো। সোহেল দাঁড়িয়ে আছে।
—ম্যাম, প্রোগ্রামের নাইসলি একটা ফিনিশিং লাইন টেনে যেতে হবে। হুট করে চলে যাওয়া মানে বোঝেনই তো, নাহলে প্রেসে অন্যরকম নিউজ চলে আসবে।
নিনীকা কথা বাড়ালো না। ফিরে এলো। তার নিজেকে এই প্রথম খুব বন্দী মনে হলো। সে কি বন্দী হয়ে যাচ্ছে একজন নামীদামী হিরোর লাইফস্টাইলের হাতে?

পার্টির শেষে এত ফরমালি নিনীকাকে গাড়িতে উঠতে হলো যে ঠিক করে রওনককে বাই পর্যন্ত বলা হলো না। অথচ সে কত কি ভেবে রেখেছিলো! আজ সে প্রথম শাড়ি পরেছে। এই শাড়িটা, একদম তার নিজের টাকায় কেনা। কত আশা করে ছিল রওনক হয়তো তাকে দেখে আগ্রহের সাথে বলবে, বাহ্ কি সুন্দর শাড়ি? হালকা বেগুণির সাথে রুপোলী পাড় এত চমৎকার যায়! দেখি দেখি আঁচলটা, কি ফুল এটা? মাধবীলতা আঁকা নাকি?
এই বলে হয়তো নিনীকার হাতটা একটু ছুঁয়ে দিবে। একটু সময় নিয়ে তাকাবে। নিনীকা লজ্জা পাবে, তবু তাকিয়ে থাকতে মানা করবে না।
অথচ সব উল্টো হলো।পার্টিতে গিয়েই নিনীকাকে শুনতে হলো,
—ম্যাম আজকের জন্য তো গ্রিন গাউন ডিজাইন করা হয়েছিলো। শাড়ি কেন? অর্নামেন্টস কই? মেকআপ নেই কেন? এবং বিউটিশিয়ান এনে নিনীকাকে লেপে পুছে ডল বানিয়ে দেয়া হলো।নিনীকার ঠোঁটের লিপস্টিক খেয়ে ফেলার অভ্যাস আছে। আজ সে যতবার লিপস্টিক খেয়েছে, ততবার রিপিট দেয়া হয়েছে একটা পুরো লিপস্টিক হয়তো এ অবধি তার পেটে চলে গেছে। ইয়াক থু!
—কিরে বমি করবি নিনী?
ফুফুর কথায় নিনীকা চমকে উঠলো!
—না। পানির বোতলটা দাও তো ফুফু। আমার তো খাওয়া হয়নি, খিদে পেয়েছে খুব! সামনে কোনো টঙ দেখে থামাতে বলো, চা খাবো বনরুটি দিয়ে।
—বলিস কিরে? রওনক রাজের হবু বউ টঙে বসে চা খাবে? এটা তোর মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট লাইফ নেই এখন। সোহেল বারবার এলার্ট করে দিয়েছে, ম্যামের স্ট্যাটাস, এখন স্যারের স্ট্যাটাস! খুব সাবধানে।
জুতোর বেল্ট খুলে নিনীকা জুতোটা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো।
—জুতোটা ফেলে দিলি যে? কি সুন্দর ছিল। তুই তো পছন্দ করে কত দাম দিয়ে কিনলি। কি হয়েছে? এই নিনী…
—কিছু হয়নি ফুফু। জুতোটা আমায় খুব কষ্ট দিয়েছে ফুফু। পা ব্যথা করছে তাই ফেলে দিলাম।
—নতুন বলে এমন হলো। দুদিন পরলেই পায়ে ছাড়তো! তোর বড্ড হুরোহুরি নিনী। কদিন পরে দেখতি! একদম সাথে সাথেই ফেলে দিলি। জুতোটা কি ভালো ছিল!
নিনীকা ক্লান্ত ভঙ্গিতে সিটে হেলান দিতে দিতে বললো,
—যা আমাদের কষ্ট দেয়, তা সাথে সাথেই ফেলে দেয়া উচিত ফুফু। গা-পেতে কষ্ট নেবার কি দরকার?
একটু টিস্যু দাও তো।
টিস্যু চেপে কপাল মুছতে মুছতে নিনীকা পাপাকে ফোন করলো,
—হ্যালো পাপা..পাপা..
—আমি বাসায় এসে কথা বলি, মামণি? একটু বিজি যে…
—ওকে পাপা। তাড়াতাড়ি ফিরো, এতগুলো কথা জমে আছে। আমি কিন্তু ওয়েট করে থাকবো।

জানালার কাচটা নামিয়ে নিনীকা বাইরে তাকালো।
বিষন্ন কণ্ঠে গান ধরলো,

“যে ফুল ঝরিলো প্রাতে পিড়িতিভারে…
ভুলেও ভ্রমর তুলে লয় না তারে…”

ফুফু নিনীকার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলেন। মমতা আর ভালোবাসা জড়ানো কণ্ঠে বললেন,
—নিনী, কেন তুই এত ভালো গান গাস?

এদিকে রওনকের মা ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছেন। নিনীকা ফোন ধরলো না। তার ইচ্ছে করছে না এখন।

#পর্ব_১২

নিনীকা ফ্লোরে বসে বিছানায় ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল। পাপা মাথায় হাত রাখতেই চমকে গেল।
—কখন এলে?
—মাত্রই। তুমি ফ্রেশ হওনি কেন মামণি? নিউজে দেখলাম তো… বেশ মানিয়েছে তোমাদের। আমার কলিগরা তো ফোন করে করে আমার মাথা খেয়ে নিচ্ছে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে আমি এমন সারপ্রাইজ দিলাম বলে!
—তোমায় আমি খুব ভালোবাসি পাপা।
বলতে বলতে নিনীকা পাপার হাঁটুতে মাথা রাখলো।
—রওনককে ভালো লাগলো তো মামণি?
—আমি এত কনফিউজড কেন পাপা? বিয়ের কথা শুনতেই এত আনন্দিত হলাম, আর কারণে অকারণে এখন মন খারাপ লাগছে।
নিনীকার পাপা প্রসঙ্গ পাল্টালেন,
—ডিনার করেছো?
নিনীকা আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালো।
—না পাপা, চলো খেতে বসি। প্রচন্ড খিদে পেটে।
নিনীকা উঠে দাঁড়াতেই পাপা বললেন,
—-শাড়িতে তোমায় খুব প্রিটি দেখাচ্ছে। চমৎকার শাড়ি! প্রোগ্রামের জন্য কিনেছিলে? নিজেই পরেছো?
নিনীকা হাসতে হাসতে বললো,
—ইটস অল মাই ম্যাজিক পাপা।
ডিনারে বসে চুপচাপ নিনীকা শুধু পাতের ভাত ঘেটেই গেল। খেলো না কিছু।
—খেতে ইচ্ছে না করলে উঠে যাও মামণি। বরং আমাদের দুজনের জন্য দুটো দুধকফি বানাও। আমরা ছাদে বসবো।
নিনীকা কফি হাতে ছাদে উঠতে গিয়ে দেখলো শাড়িতে পা বেঁধে যাচ্ছে। দুহাত বন্ধ। কুচিতে পা পড়ছে।
—কোনটা ফেলবো বলতো পাপা? শাড়ি না কফি?
—কেন?
—কুচি না ধরলে হচ্ছে না। কফিমগ ধরো, আমি চেঞ্জ করে আসি।
পাপা নিনীকার হাত থকে একটা কফিমগ নিয়ে নিলেন,
—কোনটাই ফেলতে হবে না। এবার একহাতে কুচি ধরে উঠো।
—-থ্যাংক ইউ পাপা।
ছাদের রেলিং এ বসতে বসতে পাপা বললেন,
—তোমার শাড়িটাও চমৎকার, কফিও। দুটোর একটাকে বাদ দিয়ে আসলে ভালো লাগতো না। এই যে আমি একটা কফিমগ নিয়ে নিলাম, দুটোই ব্যালেন্স করতে পারলে তো! সবসময় আগে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করবে, ক্যানসেল নয়।
—আমি খুব বোকা, তাই না পাপা?
—এত তাড়াতাড়ি বুঝা যাচ্ছে না। যখন থুরথুরে বুড়ি হবে তখন ডিসাইড করা যাবে।
নিনীকা হাসলো।
—নিনী তুমি দুধ খেতে পারো না। ছোটবেলা থেকেই পারো না। তাই না মামণি?
নিনীকা উত্তর দিলো না।
—এই যে আমি দুধকফি বললাম তাও কিন্তু তুমি নিজের কফিটা উইথাউট মিল্ক নিলে। ডিরেক্ট দুধ মিশিয়ে যাই করা হোক না কেন তুমি খেতে পারো না।
—দুধে আমার প্রচন্ড গন্ধ লাগে পাপা।
—জানি। কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কি জানো? এই দুধটাকে যখন ছাঁচে ফেলে দই বানানো হয়, তুমি সেটা আগ্রহ করে খাও। ইফ আই এম নট রং, তুমি দই খুব পছন্দও করো।
—হু, দই তো ভিন্ন স্বাদের, কত্ত মজার।
—ক্লুটা ধরতে পেরেছো? দুটো একই জিনিস। দুধ তোমার পছন্দ না কিন্তু সেটাই দই হলে পছন্দ। আমাদের জীবনেও এমন মামণি। কিছু জিনিস একরকম দেখে আমরা বাদ দিতে চাই কিন্তু একটু গড়েপিঠে নিলে তাও কিন্তু অসাম হয়। বিরক্তিকর দুধ যেমন তোমার দইয়ে প্রিয়, তেমনি সেই ভালো না লাগার জিনিসটাও একটু যত্ন করলেই প্রিয় হয়ে যেতে পারে।
—তুমি যুক্তিবিদ্যা কেন পড়োনি পাপা? শাইন করতে খুব।
—এখন কি শাইন করিনি বলছো?
নিনীকা হাসলো।
—যাও তর্কবিদ্যাতেও এ প্লাস দিলাম।
—তোমার সবসময় ছেঁটে আর কেটে ফেলে দেয়ার অভ্যাস। জীবনে অনেক জিনিস তুমি হুট করে ফেলে দিয়েছো। বাদ দিবার আগে কখনোই ভাবো না।
—এজন্যই তো সার্জারিতে আমার বেশি আগ্রহ পাপা। অকেজোটাকে কেটে ফেলো।
—তোমাদের সার্জারিতে কিন্তু সব কেটে ফেলা নয়, জুড়ে দেওয়াও আছে। জীবনের সম্পর্কগুলোকে এমন জড় পদার্থ ভাবা কিন্তু অপরাধ; কঠিন অপরাধ। সম্পর্ক হলো চুলাতে রান্না করবার মতো, অমনোযোগী হলেই পুড়ে ছাই। সময়ে সময়ে এর তদারকি করতে হয়, নাড়তে হয়, নুন, মশলা দিতে হয়; আগুনের আঁচ কমানো বাড়ানো লাগে।
—রান্নার প্রসেসটা কিন্তু একটা স্পেসিফিক টাইমে এসে শেষ হয়!
—-সম্পর্কটাও কিন্তু! এটারও সময় বাঁধা। ঠিক যতদিন তুমি বেঁচে আছো, তোমায় ঘিরে থাকা সম্পর্কগুলোও বেঁচে থাকবে।
—তুমি খুব চালাক পাপা। একেক সময়ের জন্য তোমার একেক ব্যাখ্যা রেডী থাকে। যখন স্টুডেন্ট ছিলাম তখন বলতে পড়াশোনা হলো প্রার্থনার মতো, ওতে হৃদয় আর ভক্তি জুড়ে দিতে হয়। প্রার্থনা আর পড়শোনা দুটোই একনিষ্ঠ ধ্যানের কাজ। এখন যখন নতুন সম্পর্কে যাচ্ছি, তুমি অন্য ব্যাখ্যা দিচ্ছো।
—মামণি তুমি একজনকে দেখলে, সে তোমাকে দেখলো। আই লাভ ইয়ু বললে আর প্রেম হয়ে গেল; ব্যাপারটা খুব হাস্যকর, ছোট আর সামান্য হয়ে গেল না?প্ রেম কি অত ছোট আর সামান্য বলো? প্রেমের মত হেভেনলি একটা ব্যাপার হবে অনেক সাধনার।দুটো জীবন জীবনের সাথে মিলবে।
—যেমন?
—দুজন মানুষ দুজনকে জানবে, বুঝবে, কথা বলবে। একজন আরেকজনের পেছনে শ্রম দিবে, যত্ন করবে, অপেক্ষা করবে, সাধনা করবে। টোটালি এ লংটাইম ওয়ার্কিং প্রসেস। তারপর যদি সে সম্পর্কের নাম প্রেম হয়, তাহলে ঠিক আছে। এজীবনে তুমি যা পেয়েছো, তা তুমি তোমার কাজ দিয়ে পেয়েছো, ‘তুমি’ হয়েই পেয়েছো। পড়াশোনা, প্রফেশন কোথাও তুমি আমার ফেবার নাওনি। আট দশটা সাধারণ মানুষের মতো সব অর্জন করেছো। আর জীবনের সব থকে বড় পাওয়া ‘ভালোবাসা’; তা যদি রওনক তোমায় এমনি দিয়ে দেয়, সস্তা হয়ে গেল না বেশ? তুমি কি যোগ্যতাগুণে পেয়ে নেবে তা? তোমার কি পাপার কথা বিরক্ত লাগছে মামণি?
—খুব বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে তোমায় এখনি জড়িয়ে ধরি। কথা দাও তো পাপা, তুমি আমার আগে মরবে না। আমার জীবনের সব কনফিউশন তুমি এরকম ব্যাখ্যা করে শুধরে দিবে।
—মারা গেলে যে আলোচনা করা যায় না সেটা তোমায় কে বলল নিনী? তুমি শুধু চোখ বন্ধ করে বলবে, আমি কনফিউজড পাপা। দেখবে বান্দা হাজির।
কফিমগটা দু-হাতে চেপে ধরে নিনীকা একটু হেটে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একটু শীত শীত লাগছে তার।
পাপা ডাকলেন,
—হেই দ্য মোস্ট বিউটিফুল লেডী ইন শাড়ি, তুমি কি বিয়ের জন্য রেডী এখন? রওনকের মা খুব তাড়া দিচ্ছেন। উনার এক ভাগ্নি দেড় মাসের জন্য দেশে আছে। বিয়েটা এটেন্ড করেই ফিরে যাবে। নেক্সট মান্থের শুরুতে ডেট বলে দিই? তুমি ছুটি টুটি পাবে তো?
ফিরে তাকিয়ে নিনীকা বললো,
—ইয়েস পাপা, আই এম রেডী। দরকার হলে স্যারের পা ধরে বসে থাকবো, তবু ছুটি নিবো।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিনীকা ঘরে এলো। রওনকের মা অনেকবার ফোন করেছেন। কল ব্যাক করতে হবে এখনি।
ফোন হাতে নিয়েই নিনীকা দেখলো, রওনকও ফোন করেছে। রাত দেড়টা। ওহো এত রাত! ব্যাক করা কি ঠিক হবে?
নিনীকা ওয়াশরুমে গেল। দীর্ঘসময় নিয়ে সে একটা শাওয়ার নিবে এখন।
শাওয়ার শেষে টাওয়াল পেঁচিয়ে বেরিয়ে দেখে, ফোন বেজে যাচ্ছে। রওনকের কল।
—হ্যালো, আমি তখনি ব্যাক করতে চাইলাম। করিনি। হিরোদের রুটিনড লাইফ, ঘুমে যদি ব্যাঘাত ঘটে আবার!
—হিরোদের রুটিনড লাইফ নাকি? কে বললো?
—ইন্টারভিউস দেখলাম তো অনেকগুলো।
—আর বিশ্বাস করে ফেললেন?
নিনীকা জবাব দিলো না।
একটু চুপ থেকে রওনকই বললো,
—আমার সারাবছর শিডিউল দেয়া থাকে। নিজের কোনো সময় নেই আমার! বিয়েটা হুট করে তো তাই এক সপ্তাহের ব্রেক নিচ্ছি। যাস্ট বিয়েটা পর্যন্তই। এরপর কিছু আউটডোর আছে। আমি পরে সময় বের করবো আমাদের জন্য। আসলে প্রডিউসারদের কমিট করা তো!
—আপনি এত কৈফিয়ত কেন দিচ্ছেন? এত অপরাধী হয়ে বলবার তো কিছু নেই। জানি তো ব্যস্ততা খুব।
—আমি আগেভাগেই ক্ষমাপ্রার্থী। আমার ম্যানেজার, ডিজাইনার সবাইকে বলা আছে, শপিং থেক ভেন্যু সব আপনি পছন্দ করে বলে দিলেই হবে। আর ফোন যদি কখনো সাথে সাথে না ধরতে পারি, টেক্সট করে রাখবেন।
—এত অফিশিয়ালি কথাবার্তা বলছেন কেন আপনি? আমি কি আপনার অফিশিয়াল কেউ?
রওনক থামলো একটু। সত্যিই তো, যন্ত্রের মতো কথা বলছে সে।
—শুনুন, ওসব আমি কিচ্ছু পছন্দ করতে পারবো না। আপনি সব করে নিন।
—ও আচ্ছা। বাই তাহলে!
—ওয়েট এ মিনিট, কথা বাকি আছে তো আমার।
—বলুন।
গভীর আকুলতা আর আবেগভরা গলায় নিনীকা বললো,
—আপনি কেমন আছেন?
—এটা বাকি ছিল?
—হু।
—ভালো আছি। খুব ভালো আছি।
—একদিন সময় করে আসুন না এর মাঝে, আমার হাসপাতাল দেখে যান। দেখে যান, রাতের ক্লিনিকে ডাক্তাররা কত কষ্ট করে ঘুমোয়!
—ডাক্তার, হাসপাতাল এসব আমার ভয়ের কারণ। পালিয়ে বাঁচি। রাখছি ডক্টর!
—খালি রাখি রাখি! ফোন রেখে কি রাজকার্যটা করবেন শুনি? কোনো কথাই কি আপনার বলার নেই?

রওনক চুপ করে থাকলো। নিনীকা ফোন রেখে দিলো। টাওয়াল পেঁচানো ভেজা শরীরেই সে শুয়ে পড়লো। ভেজা চুলের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে, যাক! চুল শুকোবে না সে। অভিমান হয়েছে তার। খুব অভিমান। নায়ক পাঁঠা, ঘোড়ার ডিম!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here