রোদ্দুরের_বৃষ্টি #পর্ব_৯_ও_১০ #পর্ব_৯

0
537

#রোদ্দুরের_বৃষ্টি
#পর্ব_৯_ও_১০

#পর্ব_৯

রিমি প্যাকেট খুলেই হতভম্ব! এরকম উপহার কেউ কাউকে দিতে পারে? এটা উপহার? মিনি সাইজের ৩০টা গামছা! গামছা দিয়ে রিমি করবে কি? বড় ভারী প্যাকেট দেখে রিমি ভেবেছিল, দামী পোশাক। আচ্ছা, প্যাকেট বদলে যায়নি তো? সে কি রেহানা ম্যামকে বলবে ফোন করে? ফোন করে বলার কি দরকার আছে? রেহেনা ম্যাম তো প্যাকেটটা হাতে দেবার সময় বললেনই,
-এতে তোমার জন্য জামা আছে, শোয়েব আজ কিনে দিলো সবাইকে। এটা তোমার….
আগামীদিন পড়াতে গেলে প্যাকেটটা নিয়ে গেলেই হবে! নাকি ছোটলোকি হবে? শোয়েব গামছা কেন কিনবে? রিমির ভাগ্যই খারাপ! উপহারের ব্যাগ বদলে গামছা চলে এসেছে, হুহ!

রিমি প্যাকেট সড়িয়ে পরতে বসলো। নাসিমা এসে চমকে বললেন,
-এগুলো কিরে রিমি? এত গামছা কেন?
হাই তুলতে তুলতে রিমি বললো,
-দোকানদার কম দামে দিলো, নিয়ে ফেললাম। দেখো তো, আশেপাশে কারো কাছে বেচা যায় নাকি?
নাসিমা অবাক ও আশাহত গলায় বললেন,
-কমদামে দিলো বলে নিয়ে ফেলবি? আর আমি গামছা বেচবো?
-হু বেঁচবে… যদি বেচাকেনা ভালো হয়, আরো কিনে আনবো। গামছার ব্যবসা একবার যদি দাঁড়িয়ে যায়, একটানে কোটিপতি….. বুঝলে মা!
নাসিমা বুঝতে পারছেন না রিমি ঠাট্টা করছে নাকি সত্যিই সত্যিই বলছে। কনফার্ম হতে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-তুই কি সত্যিই আমায় গামছা বেচতে বলছিস?
-বেচার না হলে আনতাম নাকি মা? তোমার লজ্জা লাগলে ছেড়ে দাও; আমিই বিক্রি করবো….
নাসিমা জবাব দিলেন না, রিমির পাশেই চুপ করে বসে রইলেন। অভাব অনটন টানতে টানতে মেয়েটার মাথাটাই গেছে। এখন ভাবছে, গামছার ব্যবসা করবে। নাসিমার দুচোখ ছলছল করে উঠলো। ব্যবসা কি অত সোজা নাকি? গামছা কে কিনবে?
রিমি পড়তে বসেছে। নাসিমা মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই এতটুকু ফুটফুটে মেয়ে। একমনে লিখছে খাতায়, পিঠময় লম্বা চুল ছড়িয়ে আছে। খাড়া নাকটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। নাক ঘামলে মেয়েরা নাকি স্বামী সোহাগী হয়, কি জানি হবে নাকি? বড়বড় চোখদুটোর কাজল লেপ্টে আরো বড় দেখাচ্ছে। রোদেজলে ছুটাছুটি করে গায়ের রঙটা মরে যাচ্ছে দিনদিন। আহারে! একটু ক্রিম পাউডার যদি মাখতো মেয়েটা। ছোটবেলায় তো পুরো ঘরের বাল্ব মনে হতো। যেখানে বসতো, সেখানটাই আলো। শরীরটাও ভাঙছে দিনদিন। তিনবেলা পেটপুরে ভালো করে খেতে পারলে, তেলতেলে হতো শরীরটা। নাসিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে মনে বললেন, এত সুন্দর হয়ে কেন জন্মেছিস আমার ঘরে বলতো মা? ভালো কাপড় জামা দিতে পারিনা। যত্ন-আত্তি করতে পারিনা। খালি অভাব আর অভাব। অত সুন্দর বর কই পাবো তোর জন্য বলতো? টাকা ছাড়া সুন্দরের কোনো দাম নাই।
রিমি চুলটা খোঁপা করতে করতে বললো,
-তাকিয়ে আছো কেন মা? লজ্জা লাগছে……
নাসিমা হাসলেন।
-তুই কত মন দিয়ে পড়ালেখা করছিস, দেখতে ভালো লাগছে। আমার যদি এই পড়াশোনার বয়সটা থাকতো….
-পড়তে ভালো লাগেনা মা। কাজ করতেও ভালো লাগে না।খালি শুয়ে বসে খেয়ে ঘুমিয়ে দিন কাটাতে মন চায়!
-এই যে এত টানাহেঁচড়া, ভালো লাগেনা মা। ক্লান্ত লাগে খুব।
তারপর কাছে এসে মায়ের গলা ধরে বললো,
-জানো মা, কিছু মানুষ বেবি পেটে এলেই গাড়ি ছাড়া চলতে পারেনা। আপার দেখো, ঠিক করে খাবারই যোগাড় দিতে পারছিনা। কিছু কিছু মানুষের মা ভালো থাকার জন্যই কোনো টাকা নেই; অথচ কিছু মানুষের টাকা মা দিনদিন হুরহুর করে বাড়তেই থাকে; এমন কেন হয় মা?
নাসিমা অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন! এ জবাব তাঁর কাছে নেই……

চায়ের কাপটা শোয়েব একবারে ঘরের মাঝখানে ছুঁড়ে ফেললো। রেহেনা চোখ কপালে তুলে বললেন,
-তুই এমন রেগে আছিস কেন? এত কেন মেজাজ দেখাচ্ছিস বলতো?
-কাকে দিয়ে চা বানাও যে খেতে এমন লাগে?
-কেন? আমিও তো খেলাম। ভালো ছিল….
-টিচার টিচারের মত পড়াবে, তা না বুয়ার মত চা বানাচ্ছে, রান্নাবান্না করছে, ডিসগাস্টিং….. আমার তো মনে হয় মাথাখারাপ টিচারের…. মান-সম্মানবোধ নেই;
রেহেনা ভাঙ্গা কাপপ্লেটের টুকরোগুলো মেঝে থেকে কুড়িয়ে তুলতে তুলতে বললেন,
-মেয়েটাকে দেখেই ক্ষেপে গেলি, ব্যাপারটা কি?
শোয়েব জবাব দিলো না। রেহেনা বলতেই থাকলেন,
-রান্নাবান্না করলেই কি কেউ ছোট হয়ে গেল নাকি? এই যে আমি তো সারাজীবন তোদের রেঁধে খাওয়াচ্ছি, আমি কি ছোট হয়ে গেছি? আর তাছাড়া রিমি ভালো মেয়ে, তোদের মত নবাব না!
-প্লিজ মা! ব্যাখ্যা করবে না। একজন কেউ রেঁধে দিলেই ভালো মেয়ে হয়ে গেল না!
-তোরা তো নবাবের দল। সব রেডী চাস অথচ রান্নাঘরে যাসনা কেউ-ই…. মেয়েটা কত স্ট্রাগল করে জানিস? আজ দেখি সাথে করে গামছা নিয়ে এসেছে। জিজ্ঞেস করতেই বললো, পার্টটাইম বিজনেস শুরু করেছে। আমিই তো একডজন নিলাম ঘরের জন্য; সস্তায় দিলো বেশ… ডাস্টিং ক্লিনিং এ লাগে।
শোয়েব দিশেহারা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-তুমি কিনেছো একডজন?
রেহেনা স্বাভাবিক ভাবে মাথা নাড়লেন।
শোয়েব বিছানার বালিশ চাদর ছুঁড়ে ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেল। সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারলে তার ভালো লাগতো।

রিমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। কনফার্ম হবার জন্য আবার শিউলিকে জিজ্ঞাসা করলো,
-থ্রি-পিছও?
-হ্যাঁ। দেখ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেলিভারি করে ব্যবসা একটা পপুলার ওয়ে। দেখ ৩০টা গামছা বিক্রি করতে তোর একদিনও লাগনি, তাহলে? আমরা ২জনে মিলে শুরু করবো।
রিমি গভীর চিন্তায় পড়েছে। মজা করার গামছা বিক্রি শিউলির কাছে অতি চমৎকার বিজনেস আইডিয়া মনে হচ্ছে।
-এত ভাবভাবির তো কিছু নেই রিমি। চেষ্টা করে দেখি, লসে পড়লে বাদ…….
রিমি বিড়বিড় করে বললো,
-গামছাগুলো তো এমনি পেয়েছিলাম। এখন তো পুঁজি লাগবে…….
-তুই শুধু রাজি হ, বাকি সব আমি দেখবো……

#পর্ব_১০

শিউলি আরো শক্ত হয়ে বললো,
-আমরা আসলে ডিএমসির ছাত্রী। শুধু অভাবের তাড়নায় এই উদ্যোগটা নিয়েছি।
রিমির গলা শুকিয়ে আসছে। ডিএমসির ছাত্রী বলার কি দরকার ছিল শুধু শুধু? ব্যবসা শুরু করার জন্য শিউলি রিমিকে নিয়ে ব্যাংকে এসেছে, লোনের প্রপোজাল নিয়ে কথা বলতে! ব্যাংকের যেই কর্মকর্তার সাথে ওরা কথা বলছে, তাঁর নাম রিজওয়ান। বয়স বড়জোর ২৮-২৯! ছেলেটা খুবই নরম স্বভাবের এবং ভদ্র! রিমি ও শিউলি যা-ই বলছে বিশ্বাস করছে। তবে বেশি বলা হয়ে গেছে; রিজওয়ান নিশ্চিত হতে সরাসরি রিমির দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্নটা করলো,
-ডিএমসি মানে?
রিমি জবাব দিলো না। শিউলি রিমির মুখের কথা কেড়ে নেবার মত করে বললো,
-ঢাকা মেডিকেল কলেজ! কাউকে বলতে চাই না, আসলে ব্যাপারটা গোপন রেখে ব্যাবসাটা করতে চাই। বুঝেনই তো নানা অবস্টাকলস আসবে, নিউজ ফিউজ হবে; এই জন্য আর কি…
-ঢাকা মেডিকেল কলেজ! আপনারা আসলে, এভাবে… আই এম সারপ্রাইজড এন্ড শকড…..
এই একটা কথা রিজওয়ানকে পুরোপুরিভাবে কনভিন্সড করে দিলো।
রিজওয়ানের মনটা এবার আরো খারাপ হয়ে গেল। ইশ্শিরে, তাঁর নিজের ছোটবোনকে এই তো গেল বছর, ১৭লাখ টাকা খরচ করে প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি করা হলো। হোস্টেলে থাকতে পারে না বলে, রিজওয়ানের গাড়িটা সে বোনকে দিয়ে দিয়েছে। ডাক্তার হওয়া নিয়ে কথা। টাইমলি গাড়ি করে যাওয়াআসা করছে। আর এখানে দেখো, ঢাকা মেডিকেলে পড়া ২টি মেয়ে অভাবের সাথে কেমন লড়ছে? ছোট একটা কাপড়ের ব্যবসা করতে চাচ্ছে!
এতদিন সে অভাবি ভালো ছাত্রের গল্প শুনেছে, আজ চোখের সামনে দেখতে পেলো!
এর মধ্যে রিমি মেয়েটা অপূর্ব দেখতে। কোনো বড়লোকের মেয়ে হলে তো… মন্ত্রী এমপির ছেলেরা লাইন ধরতো পিছনে। তাও এই মেয়ে ডাক্তার হলে তো সারা দুনিয়ার পোলাপান ইচ্ছে করে রোগী হয়ে যাবে। রিজওয়ানের তো দেখেই সেই কখন থেকে বুকের ভেতরটা কেমন করছে।জীবনে এমন কাউকে পেলে তো ধন্য! না পাওয়া যাক, এমন মানুষের হেল্প করতে পারাও ভাগ্য। ফাইলটা একপাশে রাখতে রাখতে, রিজওয়ান বললো,
-দেখুন, একজন গ্যারান্টার না হয় আমি মেনেজ করে দিলাম। কিন্তু ফ্যামিলি গ্যারান্টার একজন লাগবেই।সরকারী জব হোল্ডার হলে বেশি ভালো হয়।
রিমি তড়িঘড়ি করে জবাব দিলো,
-আছে আছে, শুধু কি করতে হবে বলে দিন ডিটেইলে।
শিউলি রিমির হাত শক্ত করে চেপে ধরলো,
-আমরা তাহলে কবে আসবো স্যার?
-নেক্সট উইকে আসুন। কি কি লাগবে, তার আমি একটা নোট দিয়ে দিচ্ছি। আসলে এমাউন্ট যেহেতু অল্প, পেপারসগুলো ঠিকঠাক জমা দিতে পারলে, আশা করি হয়ে যাবে। আপনারা চা খাবেন তো?
রিমি সাথে সাথেই বললো
-জি হ্যাঁ।
শিউলি দাঁড়িয়ে পড়লো,
-না মানে, আমাদের একটু তাড়া আছে। থ্যাংকস!
-আপনাদের নাম ও কন্টাক্ট নাম্বারস রেখে যান ওই ডেস্কে; কতটুকু কি আগালো, আমি ফোন করে জানাবো।
-থ্যাংক ইউ স্যার। একটু তাড়াতাড়ি যেন হয় দেখবেন।
ব্যাংক থেকে বেড়িয়েই শিউলি রিমিকে প্রথমেই যে কথাটা বললো তা হলো,
-তুই একটা গাধী! চা খেতে বললেই, রাজি হয়ে যাবি?
-কেন সমস্যাটা কি?
-সমস্যা আছে, ছেলেটা তোতে পটে গেছে! এই যে লোনটা স্যাংশান করে দিবে বললো, তাতো তোকে দেখেই। বারবার ক্যাবলাকান্তের মত তোর দিকে তাকাচ্ছিলো। ব্যংকে চাকরি করা সুদর্শন ছেলে, তোর তো কপাল খুলে গেল রে রিমি…
-তুই না, ছিঃ শিউলি!
-ছিঃ ছিঃ করিস না রিমি। একটা সহজ সূত্র। সবসময় মনে রাখবি। অবিবাহিত যেই ছেলে দেখতে যত গুছানো অর্থাৎ পরিপাটি হবে; সেই ছেলের গুছানো যোগ্যতার মেয়ে তত পছন্দ। ধর, ভালো ছাত্রী শুনলে এরা কুপোকাত। বিয়ের পর বেকার থাকবে এমন মেয়ে এরা পছন্দ করেনা। গৃহিণী বৌ এদের ভালো লাগে না। এরা চায়, বৌও টিপটপ হয়ে, গুছিয়ে বাইরে চলবে, স্ট্যাটাস মেইনটেইন করবে। রিজওয়ান সাহেবের টেবিল দেখলি আর শার্টটা, জুতোটা দেখলি। ফিট এন্ড ফাট। এর তো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বৌ চাই-ই- চাই। শুধুমাত্র নিজে অগোছালো ছেলেরা; বৌ চায় বা মেয়ে পছন্দ করে ঘরোয়া টাইপ। যত নিজে গুছাতে পারে কম, তত বেশি গুছিয়ে দেবার মত মানুষ চাই…
রিমি শিউলির কথা অগ্রাহ্যের ভঙ্গিতে হাসলো।
-আনম্যারেড বুঝলি কি করে?
-এটারও একটা সূত্র আছে! এরা খরুচে হয়, বা ভাবে কম।মেয়েদের প্রতি উপকারী মেন্টালিটিতে ভরপুর। এই যেমন নিজে থেকেই একজন গ্যারান্টার যুগিয়ে দিবে বললো।
আবার, চা অফার করে বসলো।
-তোর যতসব আজগুবি ব্যাখ্যা। বাদ দে…. প্লিজ…
-আচ্ছা ফট করে বলে দিলি যে, সরকারি জব হোল্ডার পাবো কই এখন?
-আছে একজন, বলে দেখি আগে!
-একজনটা কে? তুই চিনিস কিভাবে?
রিমি শিউলির কথার কোনো জবাব দিলো না। আজ তার হাঁটতে ভালো লাগছে। নতুন কিছু করবে সে, নতুন দোকান গড়বে, নতুন বিজনেস, নতুন জীবন হবে… যে জীবনে কোনো অভাব থাকবে না… রিমি মনে মনে বললো, হে অচেনা গামছাদাতা, তোমায় আমার মন থেকে ধন্যবাদ।আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ!

ফোন নাম্বারটা বারবার ডায়াল করেও রিমি কেটে দিচ্ছে। এখন কি ফ্রি আছে? নাকি আরো পরে কল দিবে? রিমির ভাবাভাবির মাঝখানেই অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো,
-হ্যালো আমি কি রিমি সুলতানার সাথে কথা বলছি?
-জি, আপনি?
-আমি রিজওয়ান, পূবালী ব্যাংক থেকে…
-ওহ, জি জি বলুন!
-আসলে আপনাদের ব্যাপারটা আমি খুব সিনসিয়ারলি দেখছি, হয়ে যাবে আশাকরি।
রিমি নিঃশব্দে হাসলো।
-জি স্যার হলে খুব ভালো হয়। আমরা আসলে খুবই ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। মেডিকেলে পড়া, সরকারী হলেও কত এক্সপেনসিভ আসলে।
-জি ম্যাম বুঝতে পারছি। আপনারা কোন ব্যাচ? কোন ইয়ার? আসলে আমি দেখতাম, আমি কিছু করতে পারি কিনা? আমার মেজো খালুর ফ্রেন্ড একজন আছেন ডিএমসিতে, ডাঃ হাসনাত..
-দেখুন আমরা কোনোরকম সাহায্য নেবো না বলেই কিন্তু, নিজেরা কিছু করতে চাইছি, আপনি বরং লোনের ব্যাপারটা…..
বলেই রিমি সাথে সাথে ফোন কেটে দিলো। ও মাই গড! আর একটু হলেই ধরা পড়ে যাচ্ছিলো। রিমি ফোন কেটে দেওয়ায় রিজওয়ান বেশ অস্বস্তিতে পড়লো। মেয়েটার কি আত্মসম্মানে ঘা লাগলো। কেন যে সেঁধে পড়ে ফোন করতে গেল, রেগে যায় নি তো? রিজওয়ান হাতজোড় করে উপরের দিকে তাকিয়ে বললো,
আল্লাহ্ মেয়েটা যাতে কষ্ট না পায়। মেয়েটা রাগ করলে আমি মরে যাবো। মাকে এক্ষুণি বলতে হবে, পাত্রী পাওয়া গেছে; কথা বলে দেখুক না মা। মেয়েটা যদি রাজী হয়। আর রাজী হবেই বা না কেন? স্বনামধন্য এডভোকেট বাবার একমাত্র ছেলে রিজওয়ান, ঢাকায় তাদের তিন তিনটা বাড়ি। তাছাড়া নিজেও ভালো চাকরি করছে, দেখতে ভালো। দুদিন পরই প্রমোশন হবে, অফিসে তাঁর খুব প্রশংসা। চাল চরিত্রও ভালো। মেয়েপক্ষ দরিদ্র! হোকনা দরিদ্র। তার তো টাকাকড়ি চাইনা। ডাক্তারি পড়া সুন্দরী এই মেয়েটাকে চাই শুধু। বৃষ্টির দু-এক ফোঁটা ছিটেতে, রিজওয়ানের যখনি জ্বর হবে, রিজওয়ান বিছানায় বেঁহুশের মত শুয়ে থেকে বলবে, হে সুন্দরী চিকিৎসক….. আমার ভীষণ জ্বর। কমাও আমার জ্বর…..

রিমি আবার সময়টা দেখলো। দশটা বেজে গেছে, এখন নিশ্চয় ফ্রি। তাছাড়া রেহেনা ম্যাডাম তো বলেই দিয়েছেন, তিনি আগে বলে রাখবেন। রিমি চিন্তা ও ভয় দুটো নিয়ে ফোন ডায়াল করলো।
শোয়েব ডিনারে বসেছে সবে তখন!
-হ্যালো, হ্যালো…
রিমি কথা বলল না। শোয়েব কতক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে ফোন রেখে দিলো। যত্তসব! ফাজলামোর ফোন। সিলেটের এই মফস্বল উপজেলায় চাকরি করতে এসে তাঁর হয়েছে, মহাযন্ত্রণা। বেশিরভাগ লোকের কথাই সে বুঝে না। তাঁর কথাও বেশিরভাগ সময়ে লোকজন কম বুঝে। নিশ্চয়! এখন এমন কেউ ফোন করেছে; যে হয়তো শোয়েবের হ্যলোটাই হয়তো বুঝছে না। শোয়েব খাবারে মন দিলো আবার। মায়ের রান্না খেয়ে এমন হয়েছে, কোনো রান্নাই এখন রুচে না মুখে। উফ্! মাকে নিয়ে আসা দরকার।অথবা মায়ের মত রান্না করতে পারে, এমন কাউকে দরকার! মাকে ফটোকপি করে ফেলা যেতো যদি..
অর্ধেক খাবার প্লেটেই শোয়েবকে হাত ধুয়ে উঠে পড়তে হলো। ফুলকপির তরকারিটা বিশ্রী রকম বাজে হয়েছে। রান্নার মত বিশাল একটা ব্যাপারকে কেন যে সরকারি প্রফেশনগুলোর অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। কে জানে? মাছ চাষ শেখাবার জন্য যদি, উপজেলা মৎস্য অফিসার থাকে, হাঁস-মুরগীর জন্য, ক্ষেত করবার জন্য যদি উপজেলা কৃষি অফিসার থাকতে পারে তাহলে, মজাদারও গুণগত মান ঠিক করে রান্নার জন্য উপজেলা রান্না অফিসারও থাকা উচিত ছিলো। এটাই তো সবথেকে জরুরী। ডিসি এসপিরা তো এই রান্না করা খাবার খেয়েই চাকরি করবে নাকি? সব ফালতু ডিপার্টমেন্ট আছে অথচ রান্নার মত জরুরি ব্যপারটার কোনো সরকারি ডিপার্টমেন্ট নেই….. এটা কোনো কথা হলো?

রেহেনা শোয়েবকে ফোন করলেন রাত ১১টায়।
-কিরে শুয়ে পড়েছিস?
-না মা। দেরি হবে শুতে! মুভি দেখছি। এতরাতে কেন মা?
-আরে দরকারে একটা। ওই যে রিংকু ঝিংকুর টিচার মেয়েটা আছে না; রিমি? ওই যে জামা কিনে দিয়েছিলি যাকে! ওর বিজনেসে কি একটা লোন দরকার, একজন সরকারী জব হোল্ডার গ্যারান্টার লাগে, বলেছিলো অামাকে। একটু হেল্প কর মেয়েটাকে, বড় দুখী মেয়ে…… বেচারি খুব রিকোয়েস্ট করে বললো…. তাছাড়া আমায় ক…..
শোয়েব ফোন রেখে দিলো। তার মানে একটু আগে……
কথা বলেনি কেন তবে? থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দেয়া উচিত মেয়েটার। শোয়েব টিভির দিকে তাকালো, মুভির নায়িকা ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। সামনের দিকে একগুচ্ছ ভেজা চুল উড়ে এসে নায়িকার নাকে মুখে পড়ছে। নায়িকা সেগুলো হাত দিয়ে সরাচ্ছে না…. শোয়েব টিভির রিমোটটা টিভিস্ক্রিনের মাঝ বরাবর ছুঁড়ে মারলো। স্ক্রিনটা ফেটে গেল সাথে সাথেই….

পরের দু-দিন রিমি আর শোয়েবকে ফোন করার চেষ্টাই করেনি। রেহেনা ম্যাম তো, বলেছেনই। শোয়েবভাইয়া গ্যারান্টার হবেনই। শুধু শুধু ফোন করবার কি দরকার? সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়, রিজওয়ান ছেলেটা রিমির পিছু নিয়েছে, এই বাহানায়, ঐ বাহানায় ফোন করছে, দু-লাখ টাকার লোন, এখন বলছে চার লাখ স্যংশান করে দিবে। শোয়েবভাইয়াকে কি বলবে রিমি? দু-লাখের গ্যারান্টার এক কথা, আর চার লাখ? যদি বলে, এত বড় লোনের ঝুঁকি আমি কেন নিবো? রাজি করাবার জন্য রিমির কাছে অন্য অস্ত্রও আছে অবশ্য। রিমি বলবে, সে যে রিমির সাথে একরাতে হাসপাতালে ছিল, পৃথিলা ম্যামকে নাহলে সেটা বলে দিবে, ব্যস কাজ হয়ে যাবে। হবু বৌ বলে কথা।তাও আবার বড়লোক মানুষ। মানইজ্জতের বড় ভয় এদের। গরীবের এই এক শান্তি, মান-ইজ্জত নেই, তাই যাবারও ভয় নেই! ব্যাপরাটা মনে করেই রিমি প্রশান্তির হাসি হাসলো।চারলাখ টাকা! ব্যবসা একবার দা্ড়িয়ে গেলেই সে আপাকে সবথেকে দামী ভালো খাবারগুলো কিনে দিবে সে, নে আপা, কত খাবি খা….. দামী খাবারের বড় শখ তোর…..
(চলবে)

#তৃধা_আনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here