ছত্রিশ_ঝামেলা #পর্ব_৩

0
311

#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_৩

বাড়ি এসেই নিশাতের মন ভালো হয়ে গেল। বাড়িতে একগাদা বাজার এসেছে। দুটো মুরগী আনা হয়েছে। জ্যান্ত শিং মাছ আনা হয়েছে। সোহেল বসে বসে শিং মাছের লাফালাফি দেখছে।
নিশাতের সাথে সাথে জিভে পানি এসে গেল। আজ ঠিক একমাস আটাশদিন পর বাড়িতে মুরগী আনা হয়েছে। সোহেল নিশাতকে দেখেই উঠে এলো।
-“আপা আজ কিন্তু তুই রান্না করবি।”
-“মা কি সব মশলা এনেছে? আদা ছাড়া মুরগী কিন্তু একদম মজা হবে না। গতবার কী বিচ্ছিরি হয়েছিল খেতে!”
রাবেয়া কড়া গলায় জবাব দিলেন।
-“আদা রসুন সব এনেছি। এই নে।”
-“দাদী কোথায়?”
-“একটু আগেই জ্বর নেমেছে। এখন ঘুমুচ্ছেন।”
রাবেয়া হেসে বললেন,
-“পোলাওর চালও এনেছি। কাজু, কিশমিশ দিয়ে একটু পায়েসও করবি।”
নিশাত মাকে জড়িয়ে ধরলো।
-“আমি এই মুহূর্তে ঘোষণা দিলাম, তুমি এই পৃথিবীর সেরা মা। সোহেল আমার ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে এই কথাটা এক্ষুনি লিখে দে তো।”

নিশাত ব্যাগটা বারান্দায় রেখেই মাছ কাটতে বসে গেল।
শিং মাছ দিয়ে সে পাতলা ঝোল করবে। শিং মাছের পাতলা ঝোল দাদীর খুব পছন্দ। মুরগী করবে দু’রকমের। সাদা কোরমা আর ঝাল ভুনা। টক দই সে নিজের টাকায় কিনে আনবে। কক্সবাজার যেহেতু যাওয়াই হচ্ছে না, সেই টাকা খরচ করতে অসুবিধা কোথায়?
-“মা, আজ কি দুটো মুরগীই রান্না করে ফেলবো?”
-“হু।”
নিশাতের ইচ্ছে করলো সে মাকে কোলে নিয়ে ফেলে।
সোহেল মোড়া পেতে নিশাতের পাশেই বসলো।
রাবেয়া ঘরে চলে যেতেই ফিসফিস করে বললো,
-“আপা, মা তোকে একটা ভয়ংকর দুঃসংবাদ দেবে।”
নিশাত মিষ্টি করে হাসলো। মুখটা সোহেলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“চুলটা কানের পেছনে গুঁজে দে তো ভালো করে। গালে চুলকাচ্ছে খুব।”
-“দুঃসংবাদটা শুনবি না আপা?”
-“উঁহু, খাওয়া দাওয়ার পর শুনবো। এখন শুনলে যদি খাবার ইচ্ছে নষ্ট হয়ে যায়! সুসংবাদ থাকলে বল্।”
-“সুসংবাদ হলো, মা আগামী পরশু থেকে পাঁচদিন বাড়ি থাকবেন না। মায়ের ম্যাম অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন।”
-“এটা তো দুঃসংবাদের কাছাকাছি সুসংবাদ।”
সোহেল দাঁত বের করে হাসলো।
-“আপা তোর কক্সবাজার যাবার কী হলো?”
-“যাবো না। তোকে ছাড়া ওখানে গিয়ে মজা পাবো না।”
সোহেল মন খারাপ করে বললো,
-“টাকায় হয়নি, তাই না আপা?”
নিশাত জবাব দিলো না। আজ অনেকদিন পর ভালো খাবার খাবে সে। শুধু শুধু অন্য কথা ভেবে একদম মন খারাপ করতে চায় না সে।

শিং মাছ কাটবার সময় নিশাতের হাতে কাঁটা ফুটে গেল। রাবেয়া গরম পানি নিয়ে এলেন হাত ভেজাবার জন্য। সোহেল যত্ন করে হাত ধুইয়ে দিতে থাকলো নিশাতের।
-“আপা, শিং মাছেও কিন্তু বিষাক্ত জীবাণু থাকে। বেশি ব্যথা করলে ডাক্তার দেখাতে হবে।”
নিশাত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শিংয়ের কাঁটার ব্যথা তো নিশাতের লাগছেই না। আজ মনের ভেতর এর থেকে অনেক বড় কাঁটার ব্যথা নিয়ে সে বাড়ি ফিরেছে। আজও বাসে তার সাথে একটা কুৎসিত ঘটনা ঘটেছে। একটা লোক ইচ্ছে করে তার সাথে দু-বার ধাক্কা খেয়েছে। লোকটার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। নিশাত নিশ্চিত, লোকটার ছেলেমেয়ের বয়সও নিশাতের থেকে বেশি হবে। অথচ বাসের পুরোটা সময় নিশাতের দিকে এমন করে তাকিয়েছিল ঘেন্নায় নিশাতের গা গুলিয়ে এসেছে। বারবার গায়ের ওড়নাটা টেনে নিশাত কুঁকড়ে গিয়েছে ভয়ে আর ব্যথায়। উহ!

***
লায়লার শাকিবের সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে৷ শাকিব এখনো ফেরেনি কেন? এত দেরি করছে কেন?
লায়লার সাথে শাকিবের সম্পর্কটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। শাকিব, লায়লার একমাত্র দেবর। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন লেকচারার। তবে তাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমি একজন ফটোগ্রাফার। সে কলেজ লাইফ থেকে ফটোগ্রাফি করছে। তার ছবি তোলার হাত অসাধারণ।এই বিষয়ে বাজারে তার দুটি বই অত্যন্ত জনপ্রিয়। ফটোগ্রাফিতে তার বেশ কয়েকটি পুরষ্কারও আছে। বাসার সবথেকে লম্বা রুমটা শাকিবের স্টুডিও। পরিচিত সবাই যারা যারা শাকিবকে চেনে সবাই তাকে বলে বর্ন ফটোগ্রাফার। একটা কুকুরের লেজকেও নাকি শাকিব তার ফটোগ্রাফিতে অন্যরকম করে ফেলে। লায়লার বেশ কয়েকটা অদ্ভুতরকম ছবি শাকিবের তুলে দেওয়া।
লায়লা শাকিবের ফটোগ্রাফি ব্যাপারটা না বুঝলেও একটা জিনিস মনে মনে বিশ্বাস করে- পৃথিবীতে ফটোগ্রাফারদের একটা বুদ্ধির কনটেস্ট হলে শাকিব হতো পৃথিবীর সবথেকে বুদ্ধিমান ফটোগ্রাফার। বোকা সেজে কী করে সবথেকে বেশি বুদ্ধির খেলা খেলা যায়, সেটা এই পৃথিবীতে একমাত্র শাকিবই জানে।
শাকিবের বড় ভাই হাসিব লায়লার স্বামী। তার ভালো নাম হাসিবুল চৌধুরী। সে ইউনিভার্সিটি অফ সিডনিতে একজন রিসার্চ এনালিস্ট হিসেবে কাজ করছে। তার কাজের সময় প্রায় পাঁচ বছর। সামনের মাসেই হাসিবের জন্মদিন। হাসিবের জন্মদিনে কী উপহার পাঠানো যায়, লায়লার সেটা নিয়েই শাকিবের সাথে কথা বলা দরকার। লায়লা দারোয়ান রফিককে ডেকে বলে রাখলো,
-“শাকিব এলেই আমায় খবর দেবেন। যত রাতেই আসুক।”

বাড়ির গেটে এসে শাকিবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বাড়ির ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। ড্রয়িংরুমে লাইট জ্বলছে। নিশ্চয়ই মা অপেক্ষা করছেন। এখন গেলেই শাকিবকে জেঁকে ধরবেন। আরও কিছুক্ষণ বাইক নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ঘুরাঘুরি করা যাক তাহলে। শাকিবের ঘুরাঘুরির ইচ্ছেটা তেমন মনে জোর পেলো না। দু-বার হর্ণ বাজালো সে। দারোয়ান রফিক গেট খুলে দিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। শাকিবের আসার জন্য একদম তক্কে তক্কে ছিল সে।
-“স্যার বাইক কি তালা দিয়া ফেলবো? না রাইতে আবার বাইর হবেন?”
-“বের হবো না। লক করে ফেলো।”
-“স্যার আপনার নামে পার্সেল আসছে একটা।”
-“খুলে দেখেছো কী এসেছে?”
-“জি না স্যার।”
কথাটা বলেই রফিক মাথা নিচু করে ফেললো। সে পার্সেল খুলে দেখে নিয়েছে। পার্সেলে চমৎকার একটা দেয়াল ঘড়ি। এখন ছোট স্যারের চোখের দিকে তাকালেই তার মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাবে। তবে এমনভাবে সে আবার প্যাকেটটা করেছে, এটা যে আগে থেকেই খোলা বুঝার কোনো উপায় নেই।
-“খুলে দেখোনি কেন?”
-“কী বলেন স্যার! আমি দেখবো! আমার এই অভ্যাস নাই স্যার।”
-“অভ্যাস লাগবে না। আজ একটু খুলে দেখো।”
রফিক পার্সেলটা নিয়ে এগিয়ে এলো।
-“আপনের সামনে খুলবো স্যার?”
-“এক কাজ করো রফিক, পার্সেলটা তুমি বরং তোমার মেয়ের সামনেই খুলো।”
-“মেয়ের সামনে মানে? আপনার পার্সেল আমার মেয়ে কেন দেখবে? এত বড় ঘড়ি দেখার তার দরকার কী? হাতঘড়ি আছে। সে হাতঘড়ি দেখবে। বড় ঘড়িতে যেই সময় ছোট ঘড়িতেও একই সময়। বড় ঘড়ির টাইম তো আর আলাদা কিছু না।”
শাকিব হাসলো।
-“ঘড়িটা আমি দুলির জন্যই অর্ডার করেছি রফিক। এটা চোখের সামনে টাঙানো থাকলে বেচারির আর স্কুলে যাবার সময়ে দেরি হবে না।
রফিকের আনন্দে চোখে পানি এসে গেল। মেয়েটার বড্ড ঘড়ির শখ। ঘন্টায় ঘন্টায় ঢং ঢং আওয়াজ দেয় এমন ঘড়ি। এই ঘড়িও নিশ্চয়ই আওয়াজ দেয়!

শাকিব বাড়ির ভেতর ঢুকতেই সুলতানার সামনে পড়লো। মা আজ বেশ প্রস্তুতি নিয়ে বসেছেন।
শাকিব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অপরাধীর মতো হাসলো।
-“হ্যালো মা। তুমি ভালো আছো?”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো না। সুলতানার কপাল আরও কুঁচকে গেল।
-“ক’টা বাজে? কোথায় ছিলি তুই? হু?”
-“মা তুমি জানো, আমার কাজ আছে। কনটেস্টের ডেডলাইন দিয়ে দিয়েছে। আমার দম ফেলবার সুযোগ নেই। এখনো সব ছবি বাছাই করা হয়নি।”
সুলতানা ধমকে উঠলেন।
-“কী কাজ? পোকামাকড়ের ছবি তোলার কাজ?”
-“মা প্লিজ! ওয়াইল্ড লাইফ ফটগ্রাফি বলো।”
-“লায়লাকে দেখ, তোর সাবজেক্টেই পড়েছে। কত ভালো চাকরি করছে। আগামী মাসে ব্যাংকক যাচ্ছে অফিস ট্যুরে। অফিস সব খরচ দিচ্ছে। তোর আপন ভাবী, তোর মতোই সাবজেক্ট, অথচ দু’দিন পরপর এব্রোড ট্যুরে যাচ্ছে। আর তুই? ক্যামেরা হাতে রাস্তার টং দোকানের চায়ের কাপের ছবি তুলছিস। মানুষের রাস্তায় বসে বিড়ি খাওয়ার ছবি তুলছিস। ইট ভাঙার ছবি তুলছিস!”
-“মা, ওটা স্ট্রিট ফটোগ্রাফি। ঠিক করে নাম বলবে তো!”
-“প্রিয় পুত্র, আমি তোর কাছে ফটোগ্রাফি শিখতে চাচ্ছি না। আগামী মাসের এক তারিখ থেকে তুই অফিসে বসবি, ব্যস। আমি তোর বাবার ব্যবসার কামলাগিরি আর করতে পারবো না।”
শাকিব দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। মা সব বুঝে, শুধু তার প্যাশনটাই বুঝে না। এই যে সে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে এশিয়ান ফটোগ্রাফি কনটেস্টে যাবার সুযোগ পেয়েছে, এটা কি মায়ের কাছে বিশেষ কিছু নয়?
-“মা বাবাকে বিয়ে করেছো তুমি। সুতরাং বাবার সবকিছু দেখবার দায়িত্বও তোমার। ব্যবসা যদি না-ই দেখতে পারবে তাহলে একটা ব্যবসায়ীকে কেন বিয়ে করছিলে? হুঁ?”
-“আমি কি জানতাম নাকি, তোর বাবা সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে হুট করে মরে যাবে।”
-“করেছো যখন এখন ভুগো। আই হ্যাভ মাই অওন ড্রিমস টু ফিল। আর ব্যবসায় সবসময় আমাকে ডাকো কেন? ভাইয়াকে ডাকো। ভাইয়া তো সব ফেলে বিদেশে গিয়ে নিজের পছন্দের চাকরিটাই করছে।”
সুলতানা আরো রেগে গেলেন। তবে এবার তার রাগ ঘুরে গেল তার বড় ছেলে হাসিবের দিকে।
-“তোরা দুই ভাইয়ে মিলে আমার কলিজা ভাজি ভাজি করে ফেল্। একজন বিদেশে গিয়ে সাদা সাদা ন্যাংটাদের পড়াচ্ছে। আরেকজন.. রাস্তায় মানুষের পিসু করার ফটো তুলছে।”
-“ভাইয়া ইউনিভার্সিটির টিচার, মা।”
-“ওই হলো! ইউনিভার্সিটি হোক, আর স্কুল হোক.. করছে তো মাস্টারি। অ তে অজগর খেয়ে এখন এ ফর এপেল পড়াতে গেছে। আরেকজন কী করছে? সেই পথেই হাঁটছে। পড়াশোনা শেষ করে এখন গরুর লেজের ছবি তুলছে। কদিন পর সেও বিদেশে গিয়ে পশুপাখির বিষ্ঠার ছবি তুলবে।”
-“মা প্লিজ! এরকম ভাবে বলবে না। আমি ছবিতে একটা ছোট্ট জিনিসের ডিটেইলিং করি। পৃথিবীতে এইরকম ফটোগ্রাফার হাতে গোনা অল্প কয়েকজন আছে। তোমার ছেলে এই অল্পকয়েকজনের মাঝে একদিন…”
শাকিবের কথা শেষ হবার আগেই সুলতানা চলে গেলেন। শাকিব নিশ্চিত মা এখন ভাইয়াকে ফোন করে বকবেন। বকুক। ভাইয়া যদি তার পছন্দমত প্রফেশনে যেতে পারে শাকিব কেন নয়?

শাকিব ঘরে এসে লম্বা একটা শাওয়ার নিলো। আজ সারারাত সে স্টুডিওতে কাজ করবে। কনটেস্টের জন্য ছবির একটা প্রাইমারি সিলেকশান লিস্ট তৈরি করবে। তারপর আরো ডিপলি বাছাই। উফ!
অনেক কাজ তার! শার্ট খুলতে গিয়ে শাকিবের আবার চোখ পড়লো বুক পকেটে থাকা নিশাতের চিঠিতে।চিঠিটা আরেকবার পড়া যাক। হুহ্!

~চলবে~

#তৃধাআনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here