#হলিডে
#পর্ব_৩_ও_৪
#পর্ব_৩
ডিনারে বসে তামিম বিরক্ত মুখে বললো,
—আমি শুধু স্যূপ বলেছি মা, তাও তুমি এতকিছু করলে? ডিসগাস্টিং।
সেলিনা ছেলের কথার জবাব দিলেন না।
—অপচয়ের একটা লিমিট থাকা দরকার!
টুয়েন্টি আইটেমস না হলে তোমার বুঝি চলে না?
সেলিনা ছেলেকে চোখ ইশারায় থামতে বললেন।
—বাড়ি ভর্তি চাকর বাকর, একদম বকবি না আমায়। চুপ!
—চাকর বাকর কথাটা বলতে তোমায় অন্তত আমি হাজারবার নিষেধ করেছি মা। তুমি কেন যে একি জিনিস বারবার রিপিট করো!
সেলিনা ছেলের ধমকাধমকিতে একটুও রাগলেন না।
তাঁর মন আজ অনেক ভালো। এই বাড়ির সবথেকে বড় আপদ বিদেয় হয়েছে। ছেলেকে যে তিনি কিভাবে আনন্দের খবরটা দিবেন বুঝতে পারছেন না।
তামিম একমনে মোবাইল স্ক্রল করে যাচ্ছে।
স্যূপ মুখে দিয়েই তামিম থু করে ফেলে দিলো।
—চিনি দিয়েছো কেন মা?
—কেন ভালো হয়নি? লাস্ট টাইম যখন সিংগাপুরে গেলি; তখন তো এই স্যূপ খেয়েই ওয়াও ওয়াও করলি। এখন নাক ছিটকাচ্ছিস কেন?
তামিম জানে মা ইচ্ছে করেই স্যূপে চিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর কারণ তামিম যাতে স্যূপ ফেলে ভাত খায়! তাঁর মায়ের বদ্ধমুল ধারণা ভাতের বিকল্প বলে কিছু নেই।
তামিম বিরস মুখ করে বললো,
—দেখি ভাত দাও। করলা জাতীয় তেতো কিছু কি আছে?
—করলা খাবি কেন? তোর কি মন খারাপ?
—মন এবং মেজাজও দুটোই খারাপ।
সেলিনা ছেলের পাতে করলা ভাজি দিতে দিতে বললেন,
—এক্ষুণি তোকে একটা মজার খবর দিবো, সাথে সাথে তোর মন ভালো হয়ে যাবে।
তামিম ফোন রেখে খাওয়ায় মনোযোগী হলো।
—কবুতরের ঝোল দিই একটু? কত রক্ত খুইয়ে এসেছিস! বাঁ-হাতটা নাড়ছিস কেন? দেখি, প্লেট এদিকে দে; আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
বিরক্তিতে তামিমের দম বেরিয়ে যাচ্ছে, মা সবসময়ই বেশি বেশি। তামিম তাও হাসিমুখে হা করলো।
—দাঁড়া, একটা ছবি তুলে রাখি। রাতে আপ্লোড করে দিবো। তোর বাবা দেখে হিংসেয় মরে যাবে।
—ওহ মা, আমার অফিসের কেউ যাতে না দেখে। বি কেয়ারফুল।
সেলিনা হাসিমুখে ছেলেকে ভাত খাওয়ানোর ছবি তুললেন।
তারপর একটু গলা নামিয়ে বললেন,
—তোর বাবা চলে গেছেন। ইতুও চলে গেছে। বাপ-বেটিতে মিলে বুঝুক এবার সংসার কাকে বলে?
আমার সাথে ঘাটাকুচা চলবে না। এ বাড়িতে বাস করতে হলে নো ঘাটাকুচা। সবসময় তোর জব নিয়ে কথা… হোয়াই?
তামিমের গলায় ভাত আটকে বিষম খেয়ে গেল।
—এই নে, পানি খা।
আমিও বলে দিয়েছি দেশের সবচাইতে বড় উইং এ আমার ছেলে চাকরি করে, তোমার মতো কাপড় ব্যবসায়ী হবে নাকি? দেশের জন্য রক্ত দিবে ফাইট করে, গুলি করে।
তামিম মা’কে থামিয়ে দিলো,
—আর রিতু? রিতু কোথায়?
—রিতু যায়নি। সে পড়ছে। কাল তাঁর বায়োলজি এক্সাম। মুখ হা করে থাকবি না। ভাত খা। তোর ঔষধ আমার ঘরে রেখে দিয়েছি। তুই আজ আমার সাথে ঘুমোবি। রাতে তোকে নিয়ে একটা মুভি দেখবো, সিলসিলা। অমিতাভের হিট! বুঝলি তামিম, তখন আমি তোর বাবার প্রেমে হাবুডুব খাচ্ছি, এরমাঝে মুভিটা রিলিজ করলো। আমি করলাম কি দুটো টিকিট কাটিয়ে…
—স্যরি মা! আজ মুভি দেখা হবে না। আমার কাজ আছে। পরশু জাপানের একটা টিম আসছে, ফুল সিকিউরিটি প্ল্যানে এখনো কিছু এডিটিং বাকী।
—অত কাজ দেখাবি না। এন এস আই’র তুই একলা অফিসার না। শোন্ না, টিকিট দুটো আমি করলাম কি তোর বাবার আন্ডারওয়ারের সাথে স্টেপলার দিয়ে আটকে দিলাম। তোর বাবা তো সকালে অফিস যাবে বলে আন্ডারওয়ার হাতে নিয়েই দিলো চিৎকার। চাচীমা মানে তোর দাদী সাথে সাথেই বললেন, এটা নির্ঘাত ভুতের কাজ।
এটুকু বলে সেলিনা খিলখিল করে হাসতে লাগলেন।
মায়ের এই অদ্ভূত ব্যাপারটা তামিম একদমই বুঝতে পারে না। যতক্ষণ কথা বলেন সব বাবাকে নিয়ে অথচ বাবার সাথেই তাঁর দুনিয়ার ঝগড়া! এর নাম দাম্পত্যজীবন? হুহ…
তামিম দ্রুত খাওয়া শেষ করলো। রিতুর সাথে কথা বলা দরকার। এ বাড়িতে রিতু হলো মন খারাপের একমাত্র ঔষধ।
রিতুর ঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে তামিম হালকা কাশলো,
—রিতু… আসবো?
রিতু পেন্সিলে কিছু একটা আঁকছে। না তাকিয়েই বললো,
—নো ভাইয়া।নো…
—তাহলে দরজায় দাঁড়িয়ে একটা কথা বলি?
—ওয়েট যাস্ট টু মিনিটস! দ্যান ইউ উইল স্টার্ট।
তামিম হাসলো। রিতু হচ্ছে এমন একটা মেয়ে, যে সবকিছু রুটিনের মধ্যে থেকে করে। কোনো বিষয়েই তাঁর কোনো ধরনের আদিখ্যেতা নেই; সব ধরনের খুঁতখুঁতে ব্যাপারে তাঁর রেসপন্স থাকে স্বাভাবিক ।এবং যেকোনো কথার শুরু সে খুব পজিটিভ ভাবে করে।
—ভাইয়া, তুই এই অরেঞ্জ কালারটা কেন পরেছিস আবার? তোকে দেখেই আমার বৈরাগীর মতো লাগছে। মন খারাপ হয়ে গেছে আমার। ধুততত।
তামিম হাসলো। কারণ সে জানে, রিতুর নিজের কখনোই মন খারাপ হয় না; একটুও না। কথাটা সে বলেছে কারণ হলো, সে বুঝে গেছে তামিমের মন খারাপ।
রিতু ড্রয়িং ছেড়ে চশমা খুলে টেবিলে রাখলো।
—ঘরে আয় ভাইয়া। তোকে পাঁচমিনিট দেয়া হলো এর মধ্যে কথা বলে বিদায় হবি।
তামিম ঘরে ঢুকলো না। দরজায় দাঁড়িয়েই বললো,
—তোর কাছে আমার বুদ্ধির লেভেল কেমন মনে হয়? মানে মানুষকে বুঝার ক্ষমতা কি আছে? থাকলে সেটা কত পার্সেন্ট? একটু ভেবে বল। তোকে দুমিনিট সময় দিলাম।
রিতু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললো,
—হাতে কয়টা স্টিচ লাগলোরে ভাইয়া?
—সাতটা। সারা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সব মিলিয়ে তেইশটা।
—মাই গড! তাও দিব্যি সুস্থ হাঁটছিস! গুড… গুড.. রিয়েল হিরো! তুই জব জয়েন করে দুবছরে এই নিয়ে চারবার এটাকে পড়লি। কোনদিন যে কে মেরে টেরে দেয়! ওরা ক’জন ছিল রে? পিস্তল ছিল না সাথে তোর? তুই কেন এটা সবসময় ক্যারি করিস না?
—আমার কথার জবাব দে রিতু। প্রসঙ্গ পাল্টাবি না।
রিতু চুলের ক্লিপটা খুলে চুলটা ঘেটে নিতে নিতে বললো,
—এনএসআইতে তুই যখন ট্রেনিং শেষ করিস, প্রাইম মিনিস্টার নিজে তোর পিঠ চাপড়ে কি বলছিলেন? দ্য মোস্ট ইন্টিলিজেন্ট বয়! এখন আবার নিজের বুদ্ধির লেভেল নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন? বুদ্ধির লেভেলেই তুই একজন এ.ডি। তোর বুদ্ধি অনেক ভালো, আগামী বছরই তুই একটা প্রমোশন পাবি আমি নিশ্চিত!
তামিম মাথা চুলকালো দরজা থেকে একটু সরে এসে ঘরের ভেতরে দাঁড়ালো।
—না মানে ধর, সাধারন দৈনন্দিন জীবনে আমি কেমন? আমার প্রফেশন বাদ দিয়ে জাজ কর।
রিতু তামিমের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো।
—ঘটনা কি বলতো ভাইয়া? এন এস আই’র এক তুখোড় ইয়ং অফিসার তুই; যে কিনা দুদিন পরপর বিভিন্ন সাকসেসফুল মিশন করছে, সে আজ এত নার্ভাস কেন?
—না মানে… একটা মেয়ে ধর তোর মতো পুঁচকে মেয়ে। এই এতটুকু ছোট… সে আজ আমায় ৮৫০টাকা ঠকিয়েছে। হাউ কুড শি মেইক মি এ ফুউল। তারপর আবার বললো, আমি নাকি তার ব্যবসার ক্ষতি করেছি, এর মানে কি?
রিতু ভ্রু কুঁচকে তামিমের দিকে তাকালো। চশমাটা চোখে পরতে পরতে বললো,
—ব্যবসার লস মানে? তুই তার ব্যবসার জায়গা ভেঙে দিয়েছিস নাকি?
—মানে হয়েছে কি যখন ওরা আমাকে এটাকটা করলো, তখন মেয়েটা কোথা থেকে জানি উদয় হলো। আমি তো সকালে ক্যাজুয়াল বেরিয়েছিলাম উইথাউট গান।
—শোন, মেয়ে বিষয়ক সব কথাতে কখনোই সিরিয়াস হয়ে পড়বি না। এরা ব্লেইম দিয়ে শুরু করে রবীন্দ্রনাথে চলে যেতে পারে! বি কেয়ারফুল ভাইয়া।তোকে দেয়া পাঁচমিনিট শেষ। বিদেয় হ। আমি ভীষণ কঠিন একটা চিত্র আঁকছি। লেভেলিংটা বাকি। প্লিজ ভাইয়া এখন যা।
—আমার ধারণা কি জানিস রিতু? মেয়েটা কোনো গ্রুপ ট্রুপে আছে, খুব সাহসী বুঝলি। মিথ্যা বলার সময় মুখটা সিরিয়াস ছিল।
রিতু দু-হাতে তামিমকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে বললো,
—মেয়েদের বুদ্ধির সাথে কখনো ছেলেদের তুলনা করবি না। কক্ষোনো না। মেয়েটার তোর কারণে তার ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে এবং তোকে সামান্য কটা টাকা ঠকিয়েছে মানে এই নয় যে, অপমানে তোকে মরে যেতে হবে। বাই দ্য ওয়ে ভাইয়া, বাবাকে গিয়ে তোর এই ব্যান্ডেজ ফ্যান্ডেজ দেখিয়ে আয়। তোর উপর এটাকের কথা শুনে টেনশানে পাগল হয়ে আছে। আমায় এই নিয়ে বিশবার কল করেছে। আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে!
তামিম হাসলো। ক্লাস টেনে পড়া একটা মেয়ে এই অল্পবয়সে কত ম্যাচিউর! সি হ্যাজ দ্য ফায়ার!
রিতু একদিন অনেক দূরে যাবে, আকাশ ছোঁয়া বড় হবে সে!
—তোর হেয়ার স্টাইলটার নাম কিরে রিতু, দারুণ লাগছে দেখতে তোকে।
—ডোন্ট মেইক মি ক্রেজি! গো ভাইয়া….
রিতুর ঘরে থেকে বেরিয়ে তামিম নিচে এলো। বাবার কাছে একবার যাওয়া দরকার। ইতুটা রান্না টান্না করতে গিয়ে হাত টাত আবার পুড়িয়ে ফেলেনি তো? খাবার পার্সেল করে নিয়ে যেতে হবে। বাবা কোন বাড়িতে গিয়েছে জানা দরকার। বনানীতে নাকি বসুন্ধরায়? মা’কে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে।
হারুন কা্চুমাচু গলায় বললো,
—স্যার, প্রোফাইল রেডী, আমি কি শুরু করবো?
হারুন তামিমের ব্যাক্তিগত সহকারী। তাঁর স্বভাব হলো, কথা বলার সময় ভয়ার্তভাবে কাচুমাচু ভঙ্গি করা। অথচ তামিম জানে, হারুন ভীষণ ব্রেভ একটা ছেলে। এই কাচুমাচু ভঙ্গিটা করে সে এক্সট্রা কনসার্ন পাবার জন্য।
—ইয়েস, নাউ স্টার্ট।
জায়ান্ট স্ক্রিনে প্রথম ছবিটা দেখে তামিম মোটামোটি একটা হাই ভোল্টেজ শক খেলো। শরবত ভ্যানের উপর পা তুলে মাঝিদের মতো মাথায় গামছা বেঁধে সেই মেয়েটা বসে আছে। চোখে আবার সানগ্লাসও। পরনে কটকটে লাল ফুল হাতা শার্ট, হাতা ভাঁজ করে কনুই পর্যন্ত তোলা এবং পরনের লুঙ্গি ভাঙ্গা দিয়ে ভাঁজ করে হাটু অবধি তোলা। পায়ে লাল কেড্স! ডান হাতে বিশাল ডায়ালের ঘড়ি। কড়া মেরুন লিপস্টিক ঠোঁটে একহাতে সনগ্লাস একটু তুলে ধরে বাঁ-চোখটা বন্ধ করে আছে। সবই আছে শুধু ডান হাতে সিগারেটটা বাকি। এর মাঝে শার্টের বুকের বোতামটা খুলে কলার পেছনে খাড়া করে টানা। এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে দেওয়ায়, লুঙ্গির নিচে দিয়ে ডান পায়ের গ্রিন শর্টস বেরিয়ে আছে।
হারুন এই ছবি কোথায় পেলো, কে জানে?
তামিম খুক খুক করে কেশে উঠলো।
হারুন বলতে শুরু করলো,
—-ওকে স্যার নাউ আই এম ডেসক্রাইবিং। ইনি নীরা আহমেদ। বয়স ১৮। পড়াশোনা ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষ পর্যন্ত। আপাতত বন্ধ। বর্তমানে একটি শরবতের ভ্যানের মালিক। নিজেই শরবত বিক্রি করেন। ব্যবসার বয়স নয় মাস। মডেলিং এর শখ। বিভিন্ন ধরনের ফটোশ্যূট করে রেখেছেন। ভালো নাচ জানেন। স্কুলের বিভিন্ন কনটেস্টে নাচের পুরষ্কারও আছে।
তামিমের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। ছবিটা স্ক্রিন থেকে সরানো দরকার। বুকের ভেতর কিছু একটা বিঁধে গিয়ে গা কাঁপুনি দিচ্ছে!
—নেক্সট।
—ইনি সোবহান আহমেদ। নীরার বাবা। ইনিও শরবত ব্যবসায়ী। তাঁর প্রথম স্ত্রী মারা যাবার সাত বছর পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ইনি সপ্তাহে দুদিন ভীষণ মদ্যপান করেন। মানুষ হিসেবে সহজ সরল।
—-নেক্সট…
—ইনি পারভীন আরা। সোবহান আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী। শারীরিক ভাবে অসুস্থ এবং এই পরিবারই তাঁর একমাত্র আশ্রয়স্থল।
—নেক্সট…
—এরা দুজন মিস নীরার দুই ভাই। ইনি বড় ভাই শাহীন আহমেদ, মারা গেছেন তিনবছর হলো। মৃত্যুর কারণ রোড অ্যাক্সিডেন্ট। মূলত ইনি মারা যাবার পরই পরিবারটিকে অর্থনৈতিক দুরবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। ছোটভাই শফিক আহমেদ, এমবিবিএসের স্টুডেন্ট ছিলেন, ২য় বর্ষে পড়া অবস্থায় এক জেলা প্রশাসকের মেয়ের সাথে প্রণয় ও বিয়ে হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসক বাবা তা মেনে নেন নি, মামলা করেন। শফিকের জেল হয় এবং জেল থেকে বেরিয়ে এখন মি. শফিক মানসিক ভারসাম্যহীন। মি. শফিকের অসুস্থতাই মিস নীরার পড়াশুনা বন্ধের কারণ। অসুস্থ ভাইকে দেখাশোনা করতে গিয়ে তিনি পড়াশোনা ড্রপ করেন। মিস নীরার ইনকামের বেশিরভাগটাই মি. শফিকের অসুস্থতাজনিত কারণে খরচ করা হয়।
ইনি লাবণী আহমেদ। নীরার বড় ভাবী, এ বাড়িতেই আছেন। পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রাইভেটে।
পড়াশোনার খরচও যোগান দেন মিস নীরা।
—নেক্সট…
—-রাজিয়া বানু। মিস নীরাদের বাসার একজন কাজে সাহায্যকারী। সকালে একবেলা কাজ করে যান। বেতন দু-হাজার টাকা। এন্ড দ্যা লাস্ট,
ইনি মাহবুব রনি। মি. শফিকের ক্লাসমেট। এ বাড়িতে যাতায়াত আছে। প্রায়ই মিস নীরা ও লাবণীর সাথে গভীর রাত পর্যন্ত গল্প করেন। পারিবারিক বিভিন্ন কাজেও সাহায্য করেন।
এই টোটাল ফ্যামিলি যে বিশাল দোতলা বাড়িটিতে থাকেন, সেটা তাদের নিজেদের নয়। মিসেস শরীফা নামের সোবহান সাহেবের এক দু-সম্পর্কের বোনের।তিনি বাইরে থাকেন, বাড়ির দখল বজায় রাখতে পরিবারটিকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন। এই পরিবারটির আয়ের উৎস তিনটি শরবত ভ্যান, মিসেস শরীফার পাঠানো টাকা, যা তিনি প্রতি মাসেই পাঠান এবং বাড়ির পেছনের বিরাট পুকুরের মাছ। এই মাছের ব্যাপারটা দেখাশোনা করতে ফিরোজ বলে একজন বয়স্ক লোক আছেন। তিনি মিস নীরার দূরসম্পর্কের চাচা। দিস ইস অল দ্য ডিটেল ফর নাউ স্যার!
—মি. হারুন। আপনি দুজন ওয়াচম্যান কনফার্ম করুন, মিস নীরার ভ্যানের আশেপাশে যাতে থাকে।
আগামী পরশুর পর তাঁর সাথে আমাকে মিট করানোর একটা ব্যবস্থা করুন। আর একটা ছোট্ট কাজ করুন, মিস নীরার ফটোটা আমার মোবাইলে সেন্ড করুন।
হারুন মৃদু হাসলো।
—ইয়েস স্যার।
এই তামিম স্যারের হারুন অন্ধ ভক্ত। ডিপার্টমেন্টের সবচাইতে সাহসী অফিসার তিনি। বিদেশে এ যাবত করা প্রতিটা ট্রেনিং ব্যাচে তিনি ফার্স্ট হয়েছেন। বিদেশী ভি-আই-পি ছাড়াও ইদানীং মিনিস্টার, প্রাইম মিনিস্টারের বিভিন্ন মিটিংয়ের সিকিউরিটি প্রোগ্রাম গুলোতে স্যারের ভূমিকা বেড়ে গেছে। সেই স্যার কিনা এক শরবতওয়ালীর সিকিউরিটি নিয়ে চিন্তিত! হারুনের কপাল ঘামছে, অন্য ব্যাপার নয়তো?
#পর্ব_৪
নীরার একদমই ভালো লাগছে না। লোকগুলো প্রায়ঘন্টাখানেক ধরে বসে আছে। এর আগেও তো এমন অনেক লোক তাকে বিরক্ত করেছে, এতক্ষণ তো বসে থাকেনি। কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে বিদেয় হয়েছে।
তিনমাস আগের কথা, এই তো সন্ধ্যার দিকে নীরা ভ্যান গুছাবে গুছাবে ঠিক করছিলো তখন কালো গাড়িতে এসে একটা আধবয়সী লোক বললো,
—যাবি? পুরো রাতে দশহাজার পাবি!
নীরা প্রথমে খুবই ভদ্রভাবে বললো,
—বিদেয় হোন।
কিন্তু লোকটা গেল না। ঘন্টাখানেক আশেপাশে ঘুরঘুর করলো। ভয়ে নীরার আত্মা শুকিয়ে আসছিলো। নীরা সেটা চেপে দাঁত কামড়ে ছিল।শেষমেশ কাস্টমার কমে একটু ফাঁকা হাতেই নীরা দা হাতে দৌড়ানি দিলো এরপর আশেপাশের লোকজন মিলে লোকটার গাড়ি ভাংচুড় করে একাকার করে দিলো। এদেরকে কি সেভাবে একটা দৌড়ানী দিবে? নীরা ভালো করে লক্ষ্য করলো মোট তিনজন লোক এবং সাথে গাড়ি আছে। ওয়ারলেসে কথা বলছে! পুলিশের লোক? হোক গিয়ে! এর মাঝে হলুদ শার্ট পরা লোকটি নীরাকে বেশি জালাচ্ছে। বারবার বলছে তাদের বস নীরাকে ডেকেছে। বসটা কে? এমপি, মন্ত্রী টাইপ? হলে হবে, যত বড় বসই ডাকুক নীরা একদম ঘাবড়াবে না। হলুদ শার্ট পরা ভদ্রলোকটি আবার এগিয়ে আসছে। নীরা ফিল্টারে ক্রাশ করা আইস দিতে মনোযোগী হলো।
—ম্যাম, আপনি আজ যেতে না পারলে কোনো সমস্যা নেই। একটা টাইম দিন। আমাদের স্যার জরুরি কিছু কথা বলবেন বলেই ডেকেছেন। আপনার ভয়ের কিচ্ছু নেই। আমরা গ্যারান্টি দিচ্ছি কিচ্ছু লিক হবে না।
নীরা লোকটিকে মনে মনে ভয়াবহ একটি গালি দিলো।
—আমরা অনেকক্ষণ ধরে আছি। আপনি কোনো কিছুই ক্লিয়ার বলছেন না। একটা জরুরি ব্যাপার বলেই নয়তো স্যার নিজেই আসতেন। কিন্তু স্যারের সাথে আপনার কানেকশনের কথাটা পাব্লিক হলে বরং আপনার বিপদ!
নীরা মনে মনে বললো, শালা, আমার বিপদ? তোর বড় স্যারের এমন জায়গায় আমি এসিড ঢালবো যে তোর বড় স্যারের সব পাব্লিক হয়ে যাবে। বিপদ কার তখন টের পাবি।
কিন্তু মুখে বললো,
—তোদের স্যারকে গিয়ে বল, জরুরি কথা এখানে এসে বলতে। এইসব জরুরি কথার মেয়ে আমি না। ক্লিয়ার? এখন বিদেয় হ…।
বলে নীরা মোটামোটি না দেখার ভান করে লোকটার উপর একজগ শরবত ঢেলে দিলো।
—তোকে কি বললাম, বিদেয় হতে বললাম না? উফ্ আমার কত শরবত লোকসান করলি। দেখি সর সর।
হারুন মোটামোটি নার্ভাস ফিল করতে লাগলো। মিস নীরা তুই-তুকারি শুরু করেছেন। লক্ষণ ভালো না। এর মধ্যে হারুনের শার্ট প্যান্ট শরবতে একাকার। এরকম শরবত গায়ে বসে থাকার মানে হয় না। কনস্টেবল হারিছ মিটিমিটি হাসছে। হারুন যে কেন এই দুটো গাধাকে সাথে আনতে গেল? কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। শরবত শুকিয়ে আঠা ধরে যাচ্ছে।
স্যারকে জানানো দরকার।
হারুন আবার জায়গায় গিয়ে বসলো।
—হ্যালো স্যার.. তিনি কিছুতেই দেখা করতে রাজি হচ্ছেন না।
—ভেরি স্ট্রেঞ্জ হারুন। একটা কাজ যদি তুমি প্রপার করতে পারো! একটা মানুষকে কনভিন্স করতে এত সমস্যা? দরকার হলে টাকা অফার করো। বলো যে, যে সময়টা উনার বেচাকেনার ক্ষতি হবে সেই টাকাটা তুমি পে করবে। গো এন্ড স্পিক।
—ওকে স্যার আমি দেখছি।
নীরা মনে মনে হালকা আনন্দ অনুভব করলো। লোকটার ভেতর ভয় ঢুকিয়ে দেয়া গেছে, এখন শুধু সেটা বাড়িয়ে দিতে হবে। এইসব লোককে ফেইস করার প্রধান ও প্রথম অস্ত্র হলো সাহস।
হারুন আবার এগিয়ে এলো,
—ম্যাম আমাদের সাথে গাড়ি আছে, আপনি সাথে গেলে আমরাই আবার ড্রপ করে দেবো। দেখুন, আমরা কিন্তু টাকা দিয়ে সবটা ক্ষতিপূরণ দিতে এগ্রি করছি।
এবার নীরার মেরুদন্ড দিয়ে ভয়ের হালকা একটা শীতল স্রোত বেয়ে গেল। এরা টাকা পর্যন্ত চলে এসেছে। সর্বনাশ! ভদ্রবেশি শয়তানের দল। পুলিশ হয়েও মেয়ে তুলতে চলে এসেছে। আবার বলছে ক্ষতিপূরণ! এই ব্যবসা করতে এসে যে নীরাকে কতকিছু জানতে হচ্ছে, শিখতে হচ্ছে, মানুষের কত রূপ যে দেখতে হচ্ছে! হুহ….
হারুন কাকুতির সুরে বললো,
—প্লিজ ম্যাম, একটা অপিনিয়ন তো দিন। আমরা ইয়েগারলি ওয়েট করছি। স্যারের সাথে আপনার মিটিংটা খুব জরুরি। আদারওয়াইজ আপনার কিন্তু বিপদ হতে পারে।
নীরা একটু ভাবলো, একশানে কি যাবে? সেই দুষ্টু লোকটাকে যেভাবে শায়েস্তা করেছিলো, এভাবে করবে নাকি? নীরা আশপাশটা ভালো করে দেখে নিলো, লোকজন ভালোই আছে। নীরা বিসমিল্লাহ বলে বড় ছুড়িটা বের করলো। বড় একটা চিৎকার দিয়ে দৌড়ানী দিতে হবে। আশেপাশের লোকদের মনোযোগ দরকার।
হারুন ফিরলো রাত আটটার পরে। বাঁ-হাতে ব্যান্ডেজ। কপালে ব্যান্ডেজ! তামিমের মাথায় রক্ত চড়ে আছে। কি ঘটেছে না ঘটেছে কিছুই তো ক্লিয়ার না। তামিম কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই হারুন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—আমি স্যার দাঁড়িয়ে কথা বলায় ছিলাম। কথা বলার সময় হুট করে নীরা ম্যাডাম ছুড়ি বের করলেন। তারপর দেখি পাব্লিক দৌড়াচ্ছে আমাদের। শুরু হলো এলোপাথাড়ি মার। স্যার, ঘটনা এখনো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ কি হলো, একটা গ্যাঞ্জাম তৈরি হয়ে গেল! ইউনিভার্সিটির পোলাপান স্যার, ধোলাই তো বুঝেনই! কনস্টেবল আতিক, দৌড়ে গিয়ে ড্রেনে পড়ে যায়। বেচারার হাত ভেঙ্গে গেছে স্যার।
হারুন চিন্তিত মুখে পকেট থেকে টিস্যূ বের করে কপাল মুছলো। সে ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত!
—অফিসের গাড়ি কোথায়?
—অবস্থা বেগতিক দেখে ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি নিয়ে সটকে চল এসেছে স্যার। এদেশের লোকের স্যার অন্যতম হবি গাড়ি ভাঙা। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে স্যার। পাব্লিক যে হারে জমায়েত হয়েছিলো, সব গুঁড়া করে দিতো!
তামিম বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে হারুনের দিকে। একটা মেয়ে যে কিনা তামিমের জন্য কোনো একটা ব্যাড এটাকে পড়তে পারে বলে তামিম ভয় পেয়েছিলো, সে কিনা এই অবস্থা তৈরি করে!
তামিম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
—বাসায় যাও হারুন। রেস্ট নেও। আই উইল হ্যান্ডেল দ্য ম্যাটার।
—-নীরা ম্যাডাম হুট করে কেন এমনটা করলেন, ব্যাপারটা যদি একটু ইন্টারোগেশন করে দেখা দরকার স্যার। আমরা কি উনার বাড়িতে একটা মিটিং ফিক্স করতে পারি?
তামিম কঠিন সুরে বললো,
—নো।
নীরা বাড়ি ফিরেই দেখলো, রনি ভাই এসেছেন। রনি ভাই আসা মাত্রই বাড়িতে উৎসব উৎসব ব্যাপার চলে আসে।
লাবণী ছুটে এসে বললো,
—দেখে যা নীরা, রনি এত বড় একটা মাছ নিয়ে এসেছে! আমি তো ভয়ে অস্থির, এই মাছ কাটবো কিভাবে? রনি বললো, নীরা ফিরুক; ও আগে মাছটা দেখুক তারপর কাটা হবে।
—মাছ দেখবো না ভাবী। তুমি বরং রনি ভাইকে মাছটা তাড়াতাড়ি কেটে ফেলতে বলো। তাড়াতাড়ি রান্না মানেই তাড়াতাড়ি খাওয়া। অতঃপর আড্ডা।
—মানুষটা এত শখ করে মাছটা নিয়ে এলো, দেখবি না? তোরা কেউ বেচারার মন বুঝিস না।
নীরা লাবণীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো।
—ভাবী, একটু পোলাও-ও রান্না করে ফেলো না। বড় মাছের পেটির ঝোল দিয়ে পোলাও কিন্তু দারুণ হবে!
লাবণী রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
—নীরা, তুই কি কোনোকালে আমার ‘মন’ ছিলি? মনের কথা সব বুঝে যাস!
নীরা জবাব দিলো না। দৌড়াতে গিয়ে সে ব্যথা পেয়েছে। ডানপায়ের পাতায় বেশ খানিকটা কেটে গেছে। বদের হাড্ডিদের সে পাক আরেকবার… সব শোধ নেবে।
নীরার পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে শফিক বিমর্ষ গলায় বললো,
—মানুষের সেবা করার মতো মহান পেশা বোধহয় আমার হবার কথা ছিল না। পাপী আমি বুঝলি, কোথাও হয়তো এমন পাপ করেছি যে ডাক্তারি পড়াটাই চলে গেল। কত ভালো লাগতো পড়াটা!
—তুমি কি আবার শুরু করবে পড়াশোনা?
—নারে, আমি পাগল মানুষ। কিইবা আর ডাক্তারি করবো? মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস, বর্ষাই আমার জীবনে অভিশাপ হয়ে এসেছিল! কত ভরসা করে ভালোবেসেছিলাম!
শফিক হু হু করে কেঁদে উঠলো।
—রনি ভাইয়া বিশাল মাছ এনেছে, চল নিচে যাবে। খাওয়া দাওয়া হবে, আড্ডা হবে।
—না। রনিকে দেখলে কলেজের কথা বেশি মনে পড়ে। বুক ব্যথা করে, চোখ ব্যথা করে… সহ্য করতে পারি না।
ফার্স্ট এইড বক্সটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে শফিক শার্টের হাতায় চোখ মোছে বিছানায় বসলো।
অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো,
—তোর পড়াশুনা করতে ইচ্ছে করে না নীরা?
নীরা শক্ত গলায় বললো,
—না।
—নাচ করতে?
—একদম না।
—আমি খুব আশা করে আছি নীরা, কোনো একটা মীরাকেল হবে। আমাদের সব ঠিক হয়ে যাবে, বর্ষা ফিরে আসবে, তুই পড়বি, নাচবি, লাবণী ভাবিকে আমরা আবার বিয়ে দিবো!
নীরা উঠে দাঁড়ালো,
—যাই, আমি খাবার নিয়ে আসি তোমার জন্য এঘরে। আজ গোসল করেছো তো?
শফিক হ্যাঁ সুচক মাথা নেড়ে আবার কাঁদতে লাগলো। কষ্ট আর কষ্ট!
নীরার ইচ্ছে করলো ভাইয়ের মাথায় সে একটু হাত বুলিয়ে বলে, ভাইয়া তুমি ঘুমের মাঝে একটা ভীষণ দুঃস্বপ্ন দেখেছো। এই দেখো, চোখ মেলে দেখো সকাল হয়ে গেছে… দুঃস্বপ্ন শেষ!
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা