#নিনীকা
#পর্ব_৭_ও_৮
#পর্ব_৭
ইলা সকাল থেকে মিনিমাম দশবার রওনককে ফোন করেছে কিন্তু প্রতিবারই ফোন ধরছে সোহেল। ধরেই বলছে, স্যার শট দিচ্ছেন। আপনি বিশমিনিট পরে করুন। বিশমিনিট করে করে দুপুর হয়ে গেল।
অবশেষে রওনককে পাওয়া গেল তিনটার দিকে।
—উফ! রওনক ভাই, তোমাকে তো পাওয়াই যাচ্ছে না। কত জরুরী কথা আছে জানো? মামী কিছু বলেছে?
—বলেছে সোহেলকে। জরুরী কথাটা বলতে তোর কেমন সময় লাগবে? দশমিনিটে হবে? এর বেশি লাগলে আমি রাতে ফোন দিই?
—না, না রওনক ভাই এখনি দরকার! আর পাঁচমিনিট বাড়িয়ে দাও, বলে ফেলছি।
—দিলাম। বলে ফ্যাল।
—আমি আর মামী মিলে একটা মেয়ে আপাতত ফাইনাল করেছি তোমার জন্য। মেয়েটা ডাক্তারি পড়া শেষ করেছে। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও চমৎকার। তাঁর বাবা ড. আশিকুল হক চৌধুরী, সমন্বয় ও সংস্কার বিভাগে সচিব। মা হাউজওয়াইফ। একমাত্র মেয়ে। নাম নিনীকা। আত্মীয়স্বজনরা বেশ ভালো ভালো পর্যায়ে আছেন। তোমার স্ট্যাটাসের সাথে একদম খাপে খাপ।
—আমাকে বলছিস কেন? মা’কে বল! তোরা হ্যান্ডেল কর।
—প্রাইমারি দেখা শেষ মোটামোটি। তোমার মা অসুস্থতার অজুহাতে দেখেও এসেছেন। তাঁরও পছন্দ হয়েছে। এই দেখতে যাওয়ায়ই তো পেপারে কি আজেবাজে নিউজ বের হলো।
—ওহ্ পাত্রী তোরা ক্লিনিকেই দেখলি?
—কি করবো বলো? তোমার বিয়ে বলে কথা! টের পেলে মিডিয়া তো ছাড়বে না। কত প্ল্যান ফ্ল্যান করে দেখতে হলো জানো? তুমি কি একবার মিট করবে তাঁর সাথে?
—তোর ভালো লেগেছে ইলা?
ইলা একটু চুপ করে থাকলো। কান্না চেপে নিয়ে বললো,
—একটা গল্প শুনবে রওনক ভাই?
—তুই কিন্তু আমার কথার জবাব দিসনি?
—গল্পটা শুনোই না রওনক ভাই!
—ইলা বিয়ের গল্প হলে তুই মা’কে শোনা।
—-গল্পটা আমার রওনক ভাই। অভিক যখন দেড় বছরের, ও’র পাপার বিজনেসটা হুট করে মার খেলো।ব্যালেন্স জিরোতে আর ধার ১০০তে। কোম্পানি টোটাল ফল করে গেল। অভাবে, কষ্টে অভিকের পাপা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। বাধ্য হয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমরা দেশে চলে এলাম। এক ছেলে আর মাথা পাগল স্বামী নিয়ে আমার জীবন যায় অবস্থা। সব গয়নাগাটি বিক্রি করে শেষ। প্রায় রাতেই আমি জেগে বসে থাকতাম আগামী দিন কিভাবে চালাবো সেই চিন্তায়। আমার এইরকম অবস্থায় আত্মীয়স্বজনরা দয়া মায়ায় উথলে উঠে দেখতে যেতেন। আসার আগে দু-চার-পাঁচশো টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে আসতেন। সেই টাকা আমি কাতর ভঙ্গিতে হাত পেতে নিতাম। সেই সুবাদে একদিন তোমার মা’ও গেলেন।
—আমার শট রেডী ইলা। রাখছি…
ইলা রওনকের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলে যেতে থাকলো।
—তোমার মা যখন গেলেন, তখন বিকেলবেলা।আগের রাতের বাসি শিম তরকারি দিয়ে আমি ভাত খেতে বসেছি। তাকে দেখে আমি ভাতের প্লেটটা লুকিয়ে ফেললাম। তিনি নির্বিকারভাবে সেটা দেখেও না দেখার ভান করলেন। আমায় কোনো স্বান্তনাও দিলেন না। আমার খুব রাগ হলো! সেসময় তোমার একেকটা ছবি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে।তোমাদের টাকার অভাব নেই। অথচ তিনি আসবার সময় ১০টা টাকাও আমায় সাধলেন না। এর এক সপ্তাহ পরেই একটা মজার ঘটনা ঘটলো জানো? অভিকের পাপার ওখানের এক কলিগ ফোন করে বললো, অভিকের পাপা নাকি ও’র কোম্পানির একটা পলিসি করেছিলো সেটা ম্যাচিউরড হয়েছে। সেখান থেকে অভিকের পাপাকে ফাইভ মিলিয়ন ডলার দেয়া হবে। আমি বা অভিকের পাপা কেউ কিন্তু এরকম কোনো পলিসির কথা মনে করতে পারলাম না। কিন্তু টাকাটা আমাদের তখন এতই দরকার ছিল যে, আমরা নিয়ে নিলাম। টাকা পেয়ে ও’র কোম্পানি দাঁড়িয়ে গেল, ও নিজেও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল। আমার স্বামী সন্তান ফিরে পেলো আগের জীবন।
—ইলা, তুই কিন্তু আজেবাজে বকে আমার সময় নষ্ট করছিস! আমার শট আছে।
—জানি রওনক ভাই, তোমার সময়ের অনেক দাম। তবু কথাটা তো শুনবে। তোমার মনে আছে রওনক ভাই, আমার পা থেকে একবার জুতো খুলে পড়ে যাওয়ায় তুমি আমায় বকেছিলে এই বলে যে আমি সামান্য একটা জুতো সামলাতে পারি না, তোমায় কিভাবে সামলাবো সারাজীবন? সেদিন তুমি আমায় নতুন জুতো কিনে দিয়েছিলে। আমার সংসার যখন ভেসে যাচ্ছিলো, আবার তুমিই হাল ধরলে। ইন্সুরেন্স কাম্পানির নাম করে তুমিই যে টাকাটা দিয়েছিলে তা আমি জানি।
—আমি কোনো টাকা ফাকা দেইনি ইলা। ঢপ ছুঁড়বি না।
—রওনক ভাই, তুমি সেদিন আমার সম্মান বাঁচিয়ে দিতে, সংসার বাঁচিয়ে দিতে, কি লুকিয়েই না কাজটা করেছিলে। তুমি বার বার আমার পাশে দাঁড়িয়েছো, আমায় শক্ত হাতে সামলেছো। আর সাহায্যটা এমনভাবে করেছো যাতে আমার আত্মসম্মানে একটুও আঘাত না লাগে।
একটু দম নিলো ইলা।
—রওনক ভাই, তোমার মতো অত বড় মানুষকে সামলানোর যোগ্যই ছিলাম না আমি কোনোকালে।তোমার যে বউ হবে সে হবে অসাধারণ।
—এত ব্যাখ্যা কেন করছিস ইলা? তোর কাছে কি কোনো ব্যাখ্যা চেয়েছি কখনো?
—ব্যাখ্যা না তো। নিনীকাকে ভালো লেগেছে কিনা জানতে চেয়েছিলে না, তার জবাব দিচ্ছি রওনক ভাই। লাস্ট থ্রি মান্থস ধরে লোক লাগিয়ে আমি খোঁজ নিয়েছি ও’র। একটা কথা এখন আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমি যাকে তোমার জন্য খুঁজে এনেছি সে ভীষণ যোগ্য তোমার। নিনীকা মেয়েটা খুব আলাদা রওনক ভাই। আর পাঁচটা মেয়ের মতো টিপিকাল টাইপ না। এই মেয়ে কাঁচের বয়ামে যত্ন করে রাখা আচারের মতো স্নিগ্ধ।
—তোর যখন এত পছন্দ, যা খুশি কর। এত ঘ্যানর ঘ্যানর করছিস কেন?
—তুমি কি একটু দেখবেও না ওকে? একটা ছবি পাঠাই?
—না।
—মোবাইল নাম্বার দিই? একটু কথা অন্তত বলো!
—না…
—আমাকে কথা দাও, খুব ভালোবাসবে ওকে…
রওনক ফোন কেটে দিলো। ইলা তাহলে এই মেয়ের খোঁজখবর করেই দেশে এসেছে। শুধু মা’কে পছন্দ করিয়ে দিতে এসেছিলো! মেয়েটার বাবা যেন কি?
সচিব! হাই প্রোফাইল ফ্যামিলি। আগেভাগেই মা’কে এলার্ট করতে হবে। মিডিয়া জানলেই উল্টো পাল্টা নিউজ করে ফেলবে। মা’কে বুঝিয়ে বলে দিতে হবে এখনি! একটা জেন্টল ফ্যামিলি এই লোড নিতে পারবে না। রওনক ব্যস্ত ভঙ্গিতে সাথে সাথেই মা’কে ফোন দিলো।
নিনীকার পাপা ফোন করলেন তিনদিন পর; ১১তারিখে, রাত দুটার দিকে। নিনীকা ক্লিনিকেই ছিল। পড়ছিলো তখন। ফোন স্ক্রিনে পাপার নাম্বার দেখে নিনীকা উদগ্রীব হয়ে ফোন ধরলো।
—হ্যালো পাপা! এতো রাতে? আর ইউ ওকে পাপা?
—হান্ড্রেড পার্সেন্ট ওকে মা! তুমি কেমন আছো? আমি কি তোমার ঘুম ভাঙ্গালাম?
—না না, ভালো আছি পাপা। ক্লিনিকেই আছি এখন। এই দু-সপ্তাহ আমার নাইট করতে হচ্ছে।পড়ছিলাম বসে।
—আমার মা টার এখন অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে তাহলে?
নিনীকা কিছু না বলে হাসলো।
—পাপা, তুমি কাল আসছো তো? কতদিন হয়ে গেল তুমি নেই বাসায়! আমি তোমাকে খুব মিস করছি পাপা।
নিনীকার গলায় অজস্র অভিমান।
—স্যরি মা, আরো দুদিন লাগবে। একটা জরুরি কথা ছিল তোমাকে নিয়ে।
—বলে ফেলো পাপা!
—তুমি কি এখন বিয়ে করতে চাও বা করবে? তুমি কি মেন্টালি রেডী আছো?
নিনীকা সশব্দে হেসে ফেললো।
—বিয়ে না করার কি আছে পাপা? অবশ্যই করবো। তুমি যখনি বলবে তখনি করবো! বিয়ের মতো চমৎকার একটা ব্যাপার জীবন থেকে বাদ দিবো কেন?
—ওহ মাই সুইট বেবী। তুমি আসলেই খুব বুদ্ধিমতি।
—আমি জানি বাবা। তবে বিসিএসের পরে করলে ভালো হয়। সবকিছুতে আমি প্রপার টাইম দিতে পারবো। এখন একটু ম্যানেজ করতে কষ্ট হবে, এই আর কি।
নিনীকার পাপা এইবার হেসে ফেললেন,
—বাহ্ নিজের বিয়ের ব্যাপারে বেশ কেয়ারফুল দেখছি তুমি! একটা ওয়ান্ডারফুল প্রপোজাল এসেছে আমার কাছে। আমি কি কথা বলবো তাদের সাথে?
নিনীকা ইতস্তত করে প্রসঙ্গ পাল্টালো,
—আমার কিন্তু এখন হেব্বী ইনকাম হচ্ছে পাপা। তিনটা ক্লিনিকে আলট্রাসনোগ্রাফি করাচ্ছি। ওটি অ্যাসিস্টেও পাচ্ছি। তোমার টাকা লাগলে চেয়ো কিন্তু। নাউ আই এম এ সলভেন্ট গার্ল পাপা।
নিনীকার পাপা হাসলেন খুব,
—আমি এসেই তোমায় একটা বিশাল সারপ্রাইজ দিবো। সারপ্রাইজ পেয়ে যদি তুমি খুশি হয়ে আমায় টাকা দাও, আমি অবশ্যই নিবো তখন।
—পাপা, মা’কে ফোন করেছো?
নিনীকার বাবা প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ পাল্টে বললেন,
—তোমার কি কাউকে পছন্দ আছে মা?
—আমার জীবনে আমায় একটা মশা কামড়ালেও সবার আগে তুমি জেনেছো! পছন্দ থাকলে তো জানতেই।
—থ্যাঙ্ক ইউ মাই সুইট বেবী।
নিনীকা ফোন রেখে একা একাই হাসলো। এট লিস্ট এতদিনে বিয়ের কথাটা এসেছে তাহলে!
আচ্ছা বিয়ের জন্য কিরকম ছেলে সে চায়? ইশ্ এই কথাটা তো এতোদিন সে একটুও ভাবেনি! নিনীকা বই বন্ধ করে বিয়ের কথা ভাবতে থাকলো।
আচ্ছা নিনীকার যে বর হবে সে কি নিনীকার সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাব খাবে কখনো? সন্ধ্যার পরে ঝুম বৃষ্টি নামলে, রিকশার হুড ফেলে দিয়ে ভিজবে কখনো? সে দেখতে কেমন হবে? শ্যামলা আর বড় বড় চোখের? খুব মিহিন মেজাজী না কাটখোট্টা?
বিছানায় বড় ফুল আঁকা চাদর কি সে ভালোবাসবে?নাকি তাঁর ধবধবে সাদা চাদর চাই? বিছানার ধারের জানালা কি হাট করে খোলা রেখে ঘুমানো তাঁর পছন্দ? আচ্ছা তাঁর কিসে আগ্রহ? রবীন্দ্রনাথ না বিভূতি? রাধালতার ফুল, না রজণীগন্ধা? ভরা জোছনার রাতে ময়ূরের পেখম খোলার দৃশ্য দেখে আনন্দ আর শিহরণে তাঁরও কি নিনীকার মতো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো কখনো? কুমোরের হাতের মাটির দলা চাকে ঘুরতে ঘুরতে কিভাবে একটি হাঁড়ি হয়ে গেল, এমন দৃশ্য দেখে কি নিনীকার মতো তাঁরও বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিলো কখনো?
আচ্ছা, সেও কি নিনীকার মতো ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খেযে হাঁচি দিবে? গরম ভাতের পাতে সে কি শুকনো মরিচ ভেঙ্গে ছড়িয়ে দিয়ে খেয়েছে কখনো? সরিষা পাতা কচলে…
নিনীকা নিজের মাথায়ই চাপড় মারলো।
বিয়ের কথা বলে দেখছি পাপা তাঁর পড়াশোনাটাই খেয়ে নিয়েছে!
সে আবার পাপাকে ফোন ব্যাক করলো,
—হ্যালো পাপা…
—মাই সুইট মম, কিছু বলবে?
—আই লাভ ইউ পাপা!
—তোমার কি মন খারাপ লাগছে মামণি? তুমি আমার কাছে এখানে আসতে চাও?
—না পাপা, আমার কাল অনেক কাজ! এমনি ফোন করলাম।
নিনীকা ফোন রেখে দিলো। তার কি বাবার কাছে লজ্জা লাগলো একটু?
#পর্ব_৮
নিনীকার বাবা ফিরেই একটা বিশাল গুড নিউজ দিলেন। চিত্রনায়ক রওনক রাজের মা নিনীকাকে পছন্দ করেছেন এবং নিনীকাকে তাঁর পুত্রবধু করতে আগ্রহী। রওনক এখন আউটডোর শ্যূটিং এ আছে। ফিরলেই এনগেজমেন্ট হবে। নিনীকাকে খবরটা সারপ্রাইজ দেয়া হবে। তবে সব করতে হবে মিডিয়া লুকিয়ে। এনগেজমেন্টের পর প্রেস ব্রিফিং করে জানানো হবে। বাড়ির সবাই এতে আকাশ পাতাল খুশি।
নিনীকার বাবা ড. আশিকুল হক চৌধূরী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার বিচক্ষণ মানুষ। পারিবারিক সকল কাজের সমন্বয় তিনি বেশ চমৎকার করেই করেন। তিনি নিনীকাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার বিশাল একটা পরিকল্পনাও ভেবে ফেললেন।
নিনীকা বাসায় ফিরলো রাতে। বাসা থমথমে নীরব। চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—বাসায় কিছু হয়েছে নাসিদা খালা? পাপা ফিরেছে?
আশিকুল হক চৌধুরীর সারপ্রাইজে পানি ঢেলে দিয়ে নাসিদা খালা বললেন,
—বিরাট কান্ড হইছেগো ছুডু মেডাম। আপনের বিয়া। বিয়া ঠিক হইছে নায়ক রওনক রাজের লগে! ওই যে “শেষ অধিকার” ছবির নায়কটা।
নিনীকা ক্লান্ত ভঙ্গিতে এপ্রনটা সোফায় রাখতে রাখতে বললো,
—তোমার মাথা ঠিক আছে তো খালা? নাকি আবার ভুত টুত দেখেছো?
—ভুত নাগো মেডাম, এই যে পানির গেলাসটা ছুঁইয়া কইতাছি। আপাগো, আপনের জনমের ভাগ্য! এতো বড়ো ফিলিমইস্টার আপনের স্বামী। তয় বেডার চুমা দেওনের একটু দোষ আছে। সব ফিলিমেই নায়িকারে চুমা দেয়। বেডাইতের এই দোষ কোনো দোষ না।
নিনীকা গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললো,
—কখন ঠিক হলো এসব?
—গেছে কাউলকা ঠিক হইছে। আপনেরে ছেড়াপেরাইজ দিবো স্যারে। এই দেহেন কেক আনছে। কালা কেক। মেডাম, কেক খাইবেন?
—তুমি কেক খাও খালা। পাপা কই?
—ছাদে।
নিনীকা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। একছুটে ছাদে চলে গেল। নিনীকাকে দেখেই পাপা বললেন,
—মাই সুইট পিক্সি, আই হ্যাভ এ গ্রেট সারপ্রাইজ ফর ইউ।
নিনীকা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—আমি জানি পাপা! আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছো!
নিনীকার বাবা একই সাথে অবাক ও আহত হয়ে বললেন,
—আগেই জেনে গেলে? ওহো…
—পাপা, আমি বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলতেই তুমি ফিল্মের হিরো ঠিক করে ফেললে?
আশিকুল সাহেব স্তম্ভিত হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন,
—তুমি জানলে কিভাবে? প্রবলেমটা কোথায়? নাইস বয়, নাইস ফ্যামিলি, নাইস পজিশন!
বাবার কফির মগে চুমুক দিতে দিতে নিনীকা বললো,
—ওসব হিরোটিরোদের ক্যারেক্টার নাকি ভালো হয় না পাপা। সংসার টিকে না ওদের। আরেকটু কি ভাববে পাপা?
—মামণি, আমি ওদের কথা দিয়ে দিয়েছি। তাছাড়া তাঁর মা তো আমাকে বলেই ক্লিনিকে তোমায় দেখতে গেলেন। তিনি তোমাকে ভীষণ পছন্দ করেছেন।
—তার মানে উনার ওই চেস্ট পেইনের ব্যাপারটা পুরো নাটক ছিল?
—আমিই তাদের বলেছিলাম মামণি। রওনক ইজ হার অনলি সান, কোনো ঝুট ঝামেলা নেই। আফটার ম্যারেজ ইউ’ল লিড এ লাইফ লাইক এ কুইন! হিজ মাদার ইজ রিয়েলি এ ওয়ান্ডারফুল উইমেন।
নিনীকা হাসলো,
—স্যরি টু সে পাপা, ফিল্মস্টারদের দাম্পত্য জীবন বলতে কিছু হয় নাকি? ১০০টা মেয়ের সাথে এরা বিছানা শেয়ার করে, এমন রিউমার কিন্তু আছেই।
—মামণি এটা কিন্তু একটা প্রচলিত ধারণা। সবার ক্ষেত্রে ঠিক নয়। ভালো বা খারাপ লোক কিন্তু প্রফেশন দেখে হয় না। আমাদের নর্ম হচ্ছে মিডিয়ার লোক বললেই আমরা খারাপ ভেবে নিই।
—তাও তো পাপা, ওই নায়ক কিন্তু আমায় পছন্দ করেনি; করেছে তাঁর মা! পরে দেখা গেল মিলছে না আমাদের।
—এতো ভাবছো কেন নিনী? তোমায় পছন্দ করবে না এমন কোনো ছেলে এই পৃথিবীতেই নেই! সারা পৃথিবীর সবথেকে চমৎকার মেয়েটা হলে তুমি!
—প্লিজ পাপা, গুল খাওয়াবে না। আমার তো মুভিতেই কোনো ইন্টারেস্ট নেই! আর লাইফ পার্টনার সোজা হিরো। ভেরি স্ট্রেঞ্জ!
—তুমি খুব লাকি, মামণি। রওনক ইজ দ্য অনলি হিরো যার কোনো স্ক্যান্ডাল নেই, রিউমার নেই।ক্যারিয়ার দেখেছো? টপে লিড করছে লাস্ট সেভেন ইয়ারস ধরে। আগামী দশ বছরেও কেউ তাঁর ধারে কাছে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে।
—সেদিক থেকে দেখলে তো আমারও কিন্তু একসময় ক্যারিয়ার হবে।
—লিসেন মাই সুইট মম, হবে আর এখনি আছে এর মধ্যে কিন্তু ডে নাইট ডিফারেন্স। এই পৃথিবীতে ভালোভাবে বাঁচতে গেলে তিনটা ‘প’ একসাথে দরকার। পয়সা, পজিশন আর পাওয়ার। রওনককে বিয়ে করা মাত্র এই তিনটা তুমি পেয়ে যাচ্ছো। তোমায় আর কষ্ট করতে হচ্ছে না। আর সাথে একটা মিষ্টি বরও পাচ্ছো।
নিনীকা আর কথা বাড়ালো না। তার বড় ক্লান্ত লাগছে। আজ সারদিন সে অনেক কাজ করেছে।
—-আই এম টোটালি কনভিন্সড পাপা! হিরোর বউ হওয়ার জন্য মন গলে গেছে।
বলতে বলতে নিনীকা ছাদের মেঝেতেই শুয়ে পড়লো।
—পাপা, আজ রাতে আমার সাথে ছাদে ঘুমোও না।আমরা রাতের আকাশ দেখবো! মধ্যরাতের তারা গড়িয়ে পড়া দেখলে আনন্দে তোমার বুক কেঁপে উঠবে।
নিনীকার পাপা মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন,
—মামণি, রওনকের সব মুভির ডিভিডি তোমার রুমে দেওয়া হয়েছে। এ যাবৎ ছাপানো সব ইন্টারভিউর কাটিং ও ক্লিপিংসও দিয়েছি। তুমি দেখে নিও। কথা বলবে তাঁর সাথে?
—পাপা, তাকে কি আমার জীবনের লুকানো সত্যিটা বলতে পারবো?
—অবশ্যই বলতে পারবে মামণি। হিরো মানুষ! হয়তো দেখা যাবে, তোমার সমস্যাটাই মিটিয়ে দেবে। যে ক্ষমতা আমার নেই, দেখা গেল সেটা তুমি তাঁর মাঝে পেয়ে গেলে।
নিনীকা পাপার গলা জড়িয়ে ধরলো।
—বড় ফুফু জানে? উনি কিছু বললো?
—সবাই জানে, তোমার জন্য সারপ্রাইজ ভেবে রাখা হলো অথচ তার আগেই দেখছি জেনে গেলে তুমি। হাউ স্ট্রেঞ্জ!
—আমার কিন্তু এখনও খটকা লাগছে। যদি আমায় পছন্দ না করে? আমার কি এখন খুশি হওয়া উচিত?
নিনীকার বাবা কফিমগে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
—বিয়ে তো আনন্দের ব্যাপার! অবশ্যই খুশি হবে।
—ঐ হিরোর ফোন নাম্বার কি আছে?
—আছে। তবে সেতো এখন দেশের বাইরে।
মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে নিনীকা বললো,
—ফোন নাম্বারটা দাওতো পাপা।
নিনীকার পাপা ফোনের ডায়ালপ্যাডে নাম্বার তুলতে তুলতে বললেন,
—তুমি দেখো মামণি, রওনক খুব ভালো বর হবে।
—আমি কি এখনি তাকে একটা ফোন করবো পাপা?
হ্যাংলা ভাবে যদি?
—ভাবলে ভাবুক! কেউ ভাবলেই তো তুমি আর হ্যাংলা হয়ে যাচ্ছো না মামণি। এই নাও কথা বলো।
নিনীকা মোবাইলটা হাতে নিলো, ফোন ধরলো সোহেল,
—হ্যালো, কে বলছেন?
নিনীকা বাবার দিকে তাকালো। গলায় জোর এনে বললো,
—আমি স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অতিরিক্ত সচিব নাসরিন সুলতানা বলছি। রওনক রাজ কি আছেন?
আপনি কে বলছেন?
সোহেলের বুক কেঁপে উঠলো,
—ম্যাম আমি উনার পার্সোনাল সেক্রেটারি সোহেল বলছি। আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম। স্যারকে দিচ্ছি দিচ্ছি।
বলেই সোহেল রওনকের শটের মাঝখানেই ঢুকে পড়লো।
—স্যার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফোন, সচিব ম্যাডাম চাচ্ছেন আপনাকে।
রওনক ফোন ধরতেই নিনীকা মিষ্টি গলা করে বললো,
—হ্যালো, রওনক রাজ সাহেব! আপনি নাকি সিগারেট খান খুব? দু-দিনের মধ্যেই সিগারেট ছাড়বেন। নাহলে তথ্য অধিকার আইনে আপনার নামে মামলা করা হবে। এক মামলায় ২২বছরের জেল।
বলেই নিনীকা চট করে ফোন কেটে দিলো।
—কেমন হলো পাপা?
আশিকুল হক মেয়ের কপালে চুমু খেলেন।
—তোমার যেন অনেক সম্মানের একটা দাম্পত্য জীবন হয় মামণি। গুড লাক।
রওনক বিড়বিড় করে বললো, সিগারেট খাওয়ার সাথে তথ্য অধিকার আইনে মামলার কি সম্পর্ক?সচিব ম্যাডাম হুট করে তার সিগারেট খাওয়া নিয়ে পড়লো কেন?
রওনকের ইলার কথা মনে পড়ে গেল।
মেয়েটার নাম যেন কি বলেছিলো? নিনীকা! সে নয়তো আবার? সচিব বলে কি ক্লু দিলো?
রওনক সোহেলকে আড়ালে ডাকলো,
—সোহেল এক্ষুণি বাসায় ফোন করো মা’কে। বলে দাও মেয়েসহ মেয়ের ফ্যামিলির যাবতীয় সকলের ফোন নাম্বার কালেক্ট করতে। কন্ট্যাক্টসে সেইভ করো। বি কেয়ারফুল!
সোহেল সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। রওনক কৌতুকী ভঙ্গিতে বললো,
—তোমার হয়েছেটা কি সোহেল? যে কেউ সচিব বললেই ভয় খাচ্ছো?
সোহেল কন্ঠ নামিয়ে বললো,
—নতুন আত্মীয়তা হচ্ছে তো স্যার। আপনার হবু শ্বশুর যদি খোঁজ নিতে ফোন করে… তাই আর কি।
রওনকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। মৃদু ঘামছে সে। নিনীকা তার জীবনে সত্যিই ঢুকে পড়ছে তাহলে!
(চলবে)
#তৃধা_আনিকা